প্রণয়িনী,পর্ব:৮

প্রণয়িনী
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ৮

তুর্জর দিকে তাকিয়ে তুলিকে অন্যঘরে নিয়ে যেতে বললো ছায়ানিকা, রিদানকে চোখের ইশারায় ফ্যান সরাতে হাত লাগাতে বললো। কাজটা যতোটা সহজ মনে হয়েছিলো ততোটা সহজ নয়, ফ্যানটা যথেষ্ট ভারী। তুলিকে অন্যঘরে শুয়িয়ে দিয়ে তুর্জ ফিরে এসে ওদের সঙ্গে হাত লাগালো। রাকিব মুর্তির মতো তার পেটের কাটা জায়গাটার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। ফ্যানটা সরানো হয়ে গেলে রাকিবকে টেনে বসানোর চেষ্টা করলো রিদান। রায়ানের পালস চেক করতে করতে ছায়ানিকা বললো,

-“পালস ড্রপ করেছে, হি ইজ ডেথ।”

মুহূর্তেই ঘরের মাঝে পিন পতন নিরবতায় ছেয়ে গেলো, ছায়ানিকাই আবার বললো,

-“রাকিবকে তুলিস না। ফাস্ট এইড বক্স আন, আগে কাটা জায়গাটা ব্যান্ডেজ করে দে, তারপর ওকে অন্যঘরে নিয়ে যা।”

এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা কারো ধারনাতে ছিলো না, তুর্জ ফাস্ট এইড বক্স আনতে গেলে রিদান বললো,

-“রায়ানটা আর নেই, ব্যাপারটা বিশ্বাস হচ্ছে না। কি নির্মম মৃত্যু হলো ছেলেটার!”

ছায়ানিকা কাঁপাকাঁপা গলায় বললো,

-“সব আমার জন্য হয়েছে, আমি এখানে থাকার জেদ না করে ফিরে গেলে হয়তো রায়ান আজ অক্ষত থাকতো।”

তুর্জ এতোক্ষণে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে ফিরে এসেছে, রাকিবের ক্ষতটা ড্রেসিং করার সময় তুর্জ রাকিবকে বললো,

-“ভয় পাস না, সকাল হলেই কাছের হাসপাতালে নিয়ে যাবো তোকে। এখন অন্তত রক্তটা কোনোভাবে আটকাই…”

রাকিব তুর্জকে ইশারায় কাছে ডাকলো, তুর্জ রাকিবের মুখের কাছে কান নিলে রাকিব মুচকি হেসে বললো,

-“আমি ব্যাথা পেয়েছি তাতে কষ্ট নেই, রায়ান নেই এবার আমি তুলিকে দেখাতে পারবো আমি ওকে কতোটা ভালোবাসি। আমার গতরাতের করা ক্ষণিকের অপরাধ ও ঠিকঠিক ক্ষমা করে দিবে বল?”

তুর্জ কিছুই বলে না, ও এক প্রকার দোটানায় ভুগছে। একদিকে ওর মন বলছে রাকিবকে সমর্থন করা মানে তুলির সঙ্গে অন্যায় করা, অন্যদিকে রায়ানের মৃত্যু আর নিজের এ অবস্থায়ও রাকিবকে তুলির কথা ভাবতে দেখে, ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখে সত্যিই ওর জন্য খারাপ লাগছে তুর্জর। তুর্জকে চুপ থাকতে দেখে রাকিব বললো,

-“কি রে, তুলি আমাকে ক্ষমা করে দেবে না?”
-“তুই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য কি না তা সময়ই বলে দেবে।”

কথাটা বলে মুচকি হাসে তুর্জ তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে তুলির ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

সকাল আটটার দিকে মায়াজাল এ পুলিশ এসে পৌঁছালো, রায়ানের লাশ পোস্ট মর্টেমের জন্য নেয়া হবে। এম্বুলেন্সে রায়ানের লাশ তোলার সময় রিদান রাকিবকে বললো,

-“আমার মনে হয় তোর সঙ্গে যাওয়া উচিত। তোরও তো বেশ খানিকটা কেটেছে, কোনোমতে রক্ত বন্ধ হয়েছে তবে মেডিসিন তো কিছু নিস নি। তাছাড়া রায়ানের লাশ দেখে তোর বাবা-মায়ের কি প্রতিক্রিা হবে তা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছিস।”
-“রায়ানের সঙ্গে এমনটা হবার কথা ছিলো না, তবুও হয়েছে। আমি ফিরে গেলে এসবের পেছনে কে আছে তা বের করবো কি করে?”

ছায়ানিকা পাশে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছিলো, রাকিবের একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে ছায়ানিকা বললো,

-” কাল রায়ানের লাশ দেখে আমার মনে হয়েছিলো, আমাদের এখনই এখান থেকে পালানো উচিত। কিন্তু যতোই সময় অতিবাহিত হয়েছে ততোই মনে হয়েছে, আমরা চলে গেলে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি অন্য কারো সঙ্গেও হবে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি এর শেষ না দেখে যাবো না, তুর্জ, তুলি, রিদান ওরাও আমাকে সাপোর্ট করেছে। অন্যসময় হলে আমি নিজে তোকে থেকে যেতে বলতাম কিন্তু এ মুহূর্তে তোর পরিবারের তোকে বড্ড বেশি প্রয়োজন। আমদের ভরসা করিস তো? আমরা সব সামলে নেবো দেখিস…”

রাকিব ছায়ানিকার হাতটা শক্তকরে চেপে ধরলো। এক মুহূর্তের জন্য কিছুটা স্বার্থপর হয়ে গেলেও রায়ানের মৃত্যুটা ভেতর থেকে পোড়াচ্ছে রাকিবকে। রায়ানের অধপতনের পেছনে প্রত্যক্ষভাবে নিজের দোষ থাকায় কখনোই জোর গলায় বারন করতে পারে নি রাকিব। তবুও প্রতিবার তাকে শোধরানোর চেষ্টা করেছে, কখনো পেরেছে আবার কখনোবা নিজেই রায়ানের স্রোতে ভেসেছে। দুজন মানুষ যাদের জন্মক্ষণ এক অথচ আজ একজন মৃত আর অন্যজন জীবিত। এটাই হয়তো জীবন মৃত্যুর অদ্ভুত খেলা!

রাকিবকে এম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে ভেতরে এলো ওরা চার বন্ধু। রিদান আগেই ওর মামাকে ফোন করে দিয়েছিলো, এর মামাই পুলিশ এর ব্যবস্থা করেছে। পুলিশ ইন্সপেক্টর রাকিবের ঘর থেকে বের হয়ে বললেন,

-“বাড়িটা বেশ পুরোনো মনে হচ্ছে, আপনাদের এখানে থাকাটা নিরাপদ নয়। যতো দ্রুত সম্ভব এ বাড়িটা ছেড়ে দিন।”

ছায়ানিকা জিজ্ঞেস করলো,

-“ফ্যানটা কি করে পড়লো?”
-“যতোদূর বুঝলাম অনেক পুরোনো ফ্যান তো, তাই স্ক্রু প্যাচ কেটে খুলে গেছে। ফ্যান পড়ে যাওয়াটা একটা দুর্ঘটনা, এটা নিয়ে বেশি ভাববেন না। যে কোনো প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।”

যেতে যেতে ইন্সপেক্টর একবার রিদানকে ডেকে বললো,

-“তোমার মামা ভালো মানুষ, তাই তার কথায় নিরবে এই ব্যাপারটাকে চেপে যাচ্ছি। এমন বদ্ধ বাড়িতে থাকাটা খুব একটা সুবিধার ব্যাপার না, লোক জানাজানি হলে সন্দেহের তীর তোমাদের দিকেই আসবে। যতো দ্রুত সম্ভব এ জায়গা থেকে সরে পড়ো। সবসময় ভাগ্য সহায় হয় না, পরবর্তীতে আর কোনো দুর্ঘনটা ঘটলে আমার দ্বারা তা হ্যান্ডেল না’ও হতে পারে। এখনও সময় আছে রিদান…”
-“আমি বুঝতে পেরেছি স্যার, আমি ব্যাপারটা মাথায় রাখবো।”
-“ভালো থেকো রিদান।”

১৭
তুলি জ্ঞান ফেরার পর কারো সঙ্গে কোনো কথা বলে নি, নাস্তা করে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। তুর্জ বারবার তুলির ঘরে উঁকি দিচ্ছে…

বিকালের দিকে তুলিকে জানলার কাছে বিমর্ষমুখে বসে থাকতে দেখে তুর্জ দরজায় নক করে বললো,

-“আসতে পারি?”
-“আয়…”

ভেতরে এসে তুর্জ ইতস্তত করে বললো,

-“তুই কি কিছু ভাবছিস? সকালের ঘটনাটাকে একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যা না…”
-“ওরা দুই ভাই আমার সঙ্গে যা করেছে তা আমি কখনোই ভুলবো না তুর্জ, কিন্তু বিশ্বাস কর ওদের সঙ্গে যা ঘটেছে তা আমি চাই নি। আচ্ছা, সবটা কি আমার জন্য হলো?”

তুর্জ তুলির পায়ের কাছে বসে শান্তভাবে বললো,

-“এসব কি কথা তুলি? ওটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা ছিলো। তুই একদম এসব নিয়ে ভাববি না।”
-“কেউ জানলে আমাকেই দোষারোপ করবে, বলবে আমার জন্যই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।”

তুর্জ তুলির চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,

-“আমি তোকে বিশ্বাস করি তুলি!”

তুর্জর চোখের দিকে তাকিয়ে তুলি এক মুহূর্তের জন্য আশেপাশের সব ঘটনা ভুলে গেলো, মন্ত্রমুগ্ধের মতো তুর্জের দৃষ্টিতে নিজের দৃষ্টি স্থাপন করে পাথর হয়ে বসে রইলো দীর্ঘক্ষণ। একসময় তুর্জ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো, নিজেকে সংযত করলো তুলি নিজেও। তবে ওই বিকেলের মৃদু আলোয় ক্ষণিকের অনুভূতির রেশ যেনো মনের মাঝে খুটি গেড়ে বসে রইলো আজীবনের জন্য!

নিজের দিকে ছায়ানিকাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রিদান প্রশ্ন করলো,

-“তুই কি আমাকে সন্দেহ করছিস? বিশ্বাস কর, রাতে ওই স্ক্রুগুলো আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।”
-“আমি ওসব ভাবছি না, ওটা নেহাতই একটা দুর্ঘটনা। আমি ভাবছি গায়েব হয়ে যাওয়া মেয়েটার কথা, কোথায় গেছে কে জানে। ওর সঙ্গে কে কে আছে তা’ও বা কে বলতে পারে।”
-“আচ্ছা চিকা, আমরা এতোদিন এ বাড়িতে আছি, রায়ান বা রাকিব কেউ ফ্যানের স্ক্রু এর ব্যাপারটা খেয়াল করেনি কি করে?”
-“ওসব ভেবে কাজ নেই, মেয়েটার কথা ভাব। এ বাড়ির ব্যাপারটা জলদি মেটানো দরকার।”

হঠাৎ ছায়ানিকার ফোন বেজে উঠলো, ফোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ছায়ানিকা। ফোনের স্ক্রিনে বিজয়ের নাম দেখে রিদানের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো, কল রিসিভ করে ছায়ানিকা চলে যেতেই দেয়ালে জোরে ঘুষি মারলো রিদান। তার বড্ড বেশি কষ্ট হচ্ছে, ছায়ানিকা কেনো নিজের সমস্যাকে রিদানকে না ডেকে বিজয়কে ডাকছে? কে বিজয়, ক’দিনের পরিচয়ে এতো কিসের ঘনিষ্ঠতা? রিদানের নিজেকে শূণ্য মনে হচ্ছে, কাকে সে চিকা বলে রাগাবে, কার সঙ্গে সে নিজের সুখ-দুঃখের কথা ভাগ করে নেবে, কে তার সব সমস্যার সমাধান করে দেবে! নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় মনে হতে লাগে রিদানের, তবে কি তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা ধীরে ধীরে তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে? আচ্ছা, রিদান কি ছায়ানিকাকে ভালোবাসে? এই যে এতোদিন ছায়ানিকা পাশে পাশে ছিলো, কই তখন তো এমন কোনো অনুভূতি হয় নি। তবে আজ দূরে যেতে দেখে মনটা এতো ব্যাকুল হয়ে পড়ছে কেনো? এ ব্যাকুলতাকে কি সম্বোধন করবে রিদান! মাথা ঝিমঝিম করছে রিদানের, নিজেকে এতোটা দিশেহারা তার কখনোই মনে হয় নি…

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here