এক প্রহরের খেলা, পর্ব:১৮+১৯

0
358

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

১৮||

বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর অবশেষে লাইন মিললো। রাজন নিজেই ফোন ধরেছে। আজাদের কণ্ঠ পেয়েই সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ” আমার কোন দোষ নেই বস। লিটনের লোকজন যে আমাকে ফলো করে এ পর্যন্ত এসেছিল তা আমি পরে টের পেয়েছি। কিন্তু আপনাকে সতর্ক করার কোন সুযোগই পাইনি। তার আগেই ওরা আপনার পাশে অদিতিকে দেখতে পেয়ে এলোপাতাড়ী গুলি ছুঁড়ছিলো। হয়ত মেয়েটাকে মারতে চাচ্ছিলো ওরা। বস আপনার কোন ক্ষতি হয়নি তো।”
-” নাহ্, স্রেফ একটা গুলি লেগেছে। ”
-” কী বলেন বস? এখন কী অবস্থা আপনার।? ”
-” ভালো। আচ্ছা, এসব কথা বাদ থাক। এবার আমার দুটো কাজ করে দে।”
-” জি, বলেন বস।”
-” বস না, আজাদ ভাই বল।”
-” জি, বস্ মানে আজাদ ভাই।”
-” তোর কাছে অদিতির মোবাইল আছে না ? ”
-” জি বস…? ইয়ে মানে ভাই। ”
-” সেখানে ভি বাটন প্রেস করে ভেলিয়া আন্টি বের কর। তারপর সেই ভেলিয়া আন্টির নম্বরটা আমাকে…!”
-” বস্…ইয়ে আজাদ ভাই। লিটনের লোকজন আমার পকেট সার্চ করে অদিতিরটা সহ আমার মোবাইলও নিয়ে গেছে। বলে তোর বস টাকা দিলে ফেরত পাবি। বস, আমার ষাট হাজার টাকা দামের মোবাইল। শালারা ভাইগিরির ইজ্জত মারসে। শালা ছিঁচকে পকেটমার। ”
-” কী বলিস, অদিতির মোবাইল ওদের কাছে ? ”
-” জি, ভাই।”
-” ওহো..!” আজাদ এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। চিন্তিত ভঙ্গিতে অদিতির দিকে তাকাতে দেখলো অদিতি নির্নিমেষে ওকেই দেখছে। আজাদকে তাকাতে দেখে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো অদিতি।
-” ভাই, আপনি এখন কোথায় ? এদিকে সবাই টেনশন করতিসে ? ”
-” এক মিনিট…!” বলে ফোন কান থেকে সরিয়ে অদিতির দিকে অসহায়ের মত তাকালো আজাদ, ” অদিতি, আপনার মোবাইল নেই। লিটনের লোকজন নিয়ে গেছে। কী করবেন এখন ? ”
অদিতি হতাশ চোখে তাকাল। কিছু না বলে হাত ওল্টালো সে। আজাদ ফোনটা ফের কানে ঠেকিয়ে বলল, ” আচ্ছা, রাজন, রুমকির কোন খোঁজ পাওয়া গেছে জানিস ? ”
-” জি ভাই। আপনার কাজিন সকালেই ফিরে এসেছে। সে হয়ত আজই তার স্বামীর সাথে ঢাকার বাড়ীতে ফিরে যাবে। তাগের বাড়ীতে বিরাট ধুম পড়েছে।”
-” অহ্, তাই নাকি ? যাক, খুব ভালো। ওর স্বামীর নাম্বারটা যোগাড় করতে পারলে আমার নাম্বারে সেভ করিস তো। লোকটার সাথে কিছু কথা বলা দরকার। ”
-” আচ্ছা, দেখি। যোগাড় করা যায় কিনা।” বলে কল কেটে দিলো রাজন। আজাদ ফোন বন্ধ করতে গিয়ে সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস চাপতেই শুনল অদিতি বলছে,
-” মন খারাপ মনে হচ্ছে ?”
-” কেন? ” আজাদ চমকে তাকালো। অদিতির কণ্ঠটা যেন বিদ্রুপাত্মক শোনালো ওর কানে।
-” না মানে রুমকি বরের সাথে ফিরে যাচ্ছে আর আপনি আমার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন।”
-” শোধ নিচ্ছেন তাই না ? ” আজাদ কোনো কিছু না ভেবেই হেসে ফেলল কিন্তু অদিতি রেগে গিয়ে বলল, ” কিসের শোধ ? ”
-” তখন আমি ঐসব বলেছি বলেই তো এসব বলছেন।”
-” জি, না। সেসব কিছু না। আপনি নিজেই বলেছেন রুমকি আপনার মায়ের ইচ্ছা। এখন আবার ওর স্বামীর নম্বর চাইছেন। অদ্ভুত না ? ”
-” না অদ্ভুত না। কারণ ওর স্বামীকে ফোন করব স্যরি বলার জন্য আর আমার অংশের না-দাবী নামা তাকে কুরিয়ার করব এবং ঐ জায়গার দখল ছেড়ে দেব আমি। এগুলো তো রুমকির সাথে আলোচনা করা যাবে না। সে হয়তো আমার ফোনই ধরবেনা। তারচে বড় কথা আমি নিজেই ওকে ফোন করবো না।”

অদিতি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। এরপর মৃদুস্বরে বলল, ” হঠাৎ এতোটা বদলে গেলেন কী করে।”
-” জানি না। ভালোলাগাগুলো হঠাৎ করে আপনা হতেই মন্দলাগায় রূপ নিয়েছে। আমি নিজে থেকে কিছু করিনি। আপনা থেকেই যা হবার হচ্ছে।” বলেই আজাদ ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘড়ি দেখে বলল, ” প্রায় ছ সাত ঘন্টা যাবৎ আমরা দুজনেই না খেয়ে আছি। সামনে দীর্ঘ একটা রাত আর লম্বা সফর। একটা হোটেলে থামা উচিত আমাদের। কী বলেন ? ”

অদিতি ঘোর কাটিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঝাঁকালো, ” জি, তা তো উচিত কিন্তু এখানে হোটেল কোথায়?”
-” এখানে নেই। তবে মাইল খানেক গেলে একটা বাজার পাবো আমরা। ওখানে হোটেল সহ অনেক কিছুই পাওয়া যাবে। আমার মোবাইলের চার্জও শেষের দিকে। একটা পাওয়ার ব্যাঙ্ক দরকার। আরো কিছু টুকিটাকি।” বলেই নিজের হিপ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল আজাদ। লিটনের কাটা চেকটা ভাঁজ করে রাখা। কিন্তু এটা খরচ করার ইচ্ছে নেই ওর। ওর টাকাটা ওকেই ফেরত দেবে আজাদ। কিন্তু কিভাবে সেটা এখনও ঠিক করেনি।”

মাইল দেড়েক আসার পরই একটা বাজারমত জায়গা পড়ল। আজাদ ওকে বসিয়ে রেখে বাইরে বেরুল। ওর ইচ্ছে সে নিজে আগে দেখে এসে পছন্দ হলে তারপরেই অদিতিকে নিয়ে যাবে। এটা বলেই বেরুলো সে।
অদিতি ড্রাইভিং সিটে বসে মন দিয়ে বাইরের দোকান পাট দেখতে লাগলো। জায়গাটা ওর জন্য নতুন। এর আগে এদিকটায় কখনো আসেনি। সারি সারি দোকানপাট। সব্জির দোকান থেকে শুরু করে সেলুন, মাংসের দোকান, ফোন ফ্যাক্স ফটোকপি সহ সবরকমের দোকানই আছে এখানে। দেখতে দেখতেই অদূরে একটা ভাঙাচোরা সাইনবোর্ডের ওপর হঠাৎ চোখ আটকে গেল অদিতির। সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে কয়েক সেকেন্ডকে কয়েক যুগ মনে হলো যেন। স্টিয়ারিং এ হাত রেখে ঠোঁট মুড়ে ভাবতে লাগল এবার। দুচোখ বন্ধ করে মাথাটা স্টিয়ারিং এ ঠেকাল। যোগবিয়োগ কষে সিদ্ধান্ত নিতে মাত্র তিন মিনিট সময় নিলো অদিতি। আর তারপরই ছোঁ মেরে ড্যাশবোর্ডের উপর রাখা রিভলবারটা চট করে নিজের পার্সে পুরে নিলো। ঠিক একই সময়ে আজাদ উঁকি দিল গাড়ীর জানালায়। রীতিমত চমকে গিয়েছিলো অদিতি। ধরা পড়া ভঙ্গিতে হাসলেও আজাদ ওর ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটুকু ধরতে পারলো না। হয়ত বাইরের উত্তেজনায় এদিকে মন দেবার সময় পায়নি। সে বাম হাতের ইশারায় অদিতিকে ডাকলো, ” অদিতি, আসুন। এখানে ভালো একটা হোটেল পাওয়া গেছে। আর বোরকাটা দিয়ে নিজেকে কভার করে নিন। প্রচুর আজেবাজে লোকজন এখানে। বাজার তো…!”
অদিতি নিকাবের আড়াল থেকেই দ্বিতীয়বার তাকালো আজাদের দিকে। ওর মুখের উপর এখন পাতলা ফিনফিনে কালো পর্দা দেয়া। পার্সটা আঁকড়ে ধরে গাড়ী থেকে নামলো সে। আজাদের পেছন পেছন হোটেলের ভেতর গিয়ে ঢুকলে আজাদ ওকে পর্দা ঘেরা একটা ছোট্ট কেবিন দেখিয়ে দিলে অদিতি নিঃশব্দে সেখানে প্রবেশ করল। ছোট্ট একটা টেবিলে মুখোমুখি দুটো চেয়ার। অদিতি বসতে গিয়েও থেমে গেল।
-” আমি একটু ফ্রেশ হতে চাচ্ছি। এখানে মেয়েদের বাথরুম নেই ? ”
-” আছে তো মনে হয়। চলুন, দেখিয়ে দিচ্ছি।”
-” না না। আপনাকে আসতে হবেনা। আপনি এখানেই বসুন। আমি একাই পারবো। তাছাড়া বাইরে তো কত মেয়ে দেখলাম।” বলে অদিতি পার্স সাথে নিয়েই বেরুল।
আজাদ ততক্ষণে মোবাইলে মনোযোগী হয়ে পড়েছে। মা ফোন করেছে। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ছে যেন,” তুই এসব কী শুরু করেছিস বলবি ? ”
-” কেনো, কী করেছি আমি ? তাছাড়া কিছু করলে তো রুমকি বাড়ী ফিরতো না। শুনেছো তো সে যে বাড়ী ফিরেছে ? ”
-” রুমকির কথা কে বলছে। তুই নাকি রুমকির স্বামীর সাথে কথা বলে ওকে তোর অংশ দিয়ে দিবি? ”
-” কে বললো এসব ? রাজন? ” আজাদ বিস্মিত। রাজনকে তো সে এটা খুলে বলেনি। রাজন বুঝলো কিভাবে !
-” সে ছাড়া আর কে ? এসবের মানে কী বলবি ? ”
” মানে কিছুই না। কিন্তু এইমুহূর্তে তোমাকে এতকথা ফোনে বোঝাতে পারবো না মা। ঐ জায়গা নিয়ে আমার এমনিতেও কোন আগ্রহ নেই। তাছাড়া আমি সবকিছু অন্যরকম করে ভাবতে শুরু করেছি। আমার অংশটা আমি আবদুল্লাহ মামার জন্য ছেড়ে দিতে চাই।”
-” কিন্তু কেন ? এই বাজারে ঐ জায়গার দাম কত তুই জানিস ? ”
-” জানি। এও জানি জায়গাটা নানু আমাকে আর রুমকিকে দিয়েছিলো এক ঘাটে ভেড়াবার জন্য। ভাগ্য আমাদের দুই ঘাটে বেঁধেছে কাজেই ঐ জায়গা আমি এমনিতেও ছেড়ে দিতাম। মনে করো রুমকির বিয়েতে এটা গিফট করলাম।”
-” তোর কী হয়েছে বলতো। এরকম ছন্নছাড়াদের মত কথা বলছিস কেন ? ”
-” কারণ আমি ছন্নছাড়া। রাখি মা, তোমার সাথে এ নিয়ে পরে কথা বলবো।” বলে ফোনটা কেটে দিতেই বুকটা হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল আজাদের। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হলো। গোলাকার ধাতব একটা নল ওর পেছন দিয়ে পিঠে ঠেকিয়েছে কেউ। আর সেটা যে পিস্তলের তা আজাদের চেয়ে ভালো কেউ জানবে না। নলটার চাপে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নামলো। একচুল না নড়ে স্থির বসে রইল আজাদ।
ঘাড় না ফিরিয়েই রূঢ় স্বরে বলল, ” কে তুমি ? ” বলে দ্বিতীয় দফায় চমকে উঠল অদিতির অন্যরকম কণ্ঠ শুনে।
একটা কণ্ঠ ফিসফিসিয়ে বলছে, ” আমি অদিতি। একচুল নড়লে পিঠ ঝাঁঝরা করে দেব আজাদ মুনতাসির। তোমার পুরো নাম আমি আগেই জেনেছি। য়্যু আ’ আন্ডার আরেস্ট। ”
আজাদের বিস্ময় এবার মাত্রা ছাড়ালো। বোধকরি বাজ পড়লেও এতোটা ঘাবড়াতো না। তবু সে ঐ ভাবেই সহজ সুরে বলতে চেষ্টা করলো, ” অদিতি কী হচ্ছে এসব ? ফান করার জায়গা এটা নয়।”

-” শাট আপ। ফান না কী তা শ্বশুরবাড়ী ঢুকলেই টের পাবে। স্ট্যান্ড আপ। খবরদার চালাকির চেষ্টা না।” বলে ধাতব নলটা আধা ইঞ্চি প্রায় দাবিয়ে দিলো মেরুদন্ডের পাশ দিয়ে। আজাদ দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করছে। কিন্তু মাথা কাজ করছে না। শ্বশুরবাড়ী মানে কী ! হাজত ? তারমানে অদিতি পুলিশের ইনফরমার ? নাকি সে লিটনের চর ? কোনটা? নাহ্, মাথাটা হ্যাং হয়ে গেছে। অদিতির নির্দেশ মেনে রোবটের মত বাইরে চলে এলো আজাদ।

রাত এখনও পুরোপুরি নামেনি। চারিদিক আঁধার করে এলেও এদিকটায় বাজার বলে দোকানপাটের আলোয় চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। অদিতি আসলে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে ! আজাদ কোন প্রশ্ন না করে শান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলল। অদিতি বোরকার ভেতর দিয়ে পিস্তল ঠেকিয়েছে ওর পিঠে। তাই বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। দেখলে মনে হবে দুজন মানুষ একসাথে হেঁটে যাচ্ছে।

মুখ তুলে ছাদের নিচে আটকানো সাইনবোর্ডটা আরেকবার দেখে নিশ্চিত হলো অদিতি। তারপর কাঠের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়বার আগে আজাদকে নলের গুঁতা দিতেই সে আগে প্রবেশ করলো। পেছনে অদিতি। রুমটায় একটা বড় টেবিল। তাতে বেশ কিছু কাগজপত্র। চেয়ারের পেছনে যে লোকটা বসে আছে তার বয়স পঞ্চাশের কিছু ওপরে হবে। কাঁচাপাকা দাড়ী। পান খাওয়া লাল মুখ। সাদা পাঞ্জাবী পরে বসে কী যেন লিখছেন। অদিতিদের দেখে তাকালেন। ইশারায় চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললে অদিতি সন্তর্পনে পিস্তল সরিয়ে ব্যাগে রেখে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। আজাদ বিস্ময় তখনো কাটেনি উল্টো বেড়েছে। সে একবার মুখ ঢাকা অদিতিকে আরেকবার সাদা পাঞ্জাবী পরা লোকটাকে দেখলো। লোকটা ঘরের এককোণে পানের রস ফেলে বললেন, ” সাক্ষী কই ? ”
আজাদ বিভ্রান্তের মত তাকিয়ে রইলো অদিতির দিকে। পুরো ব্যপারটা বুঝতে তার মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মত লাগলেও বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আর তখনই প্রশ্নটা শুনলো, ” আপনার হাত তো বন্ধ। সই করবেন কিভাবে ? ”

আজাদ অদিতির দিকে তাকিয়ে এবার মৃদু স্বরে বলল, ” যেভাবে পারব সেভাবেই করব। না পারলে বাম হাত দিয়ে। তাতেও কাজ না হলে আঙ্গুলে কালির ছাপ দিয়ে করবো । চলবে?” সাদা পাঞ্জাবির দিকে তাকালো আজাদ। মাথার ভেতরটা হালকা লাছে ওর। স্বপ্ন দেখছে না তো। এক্ষুণি গাড়ীর ঝাঁকুনি তে ঘুমটা ভেঙ্গে যাবেনা তো !

-” আচ্ছা, ঠিকআছে। বসেন।”
নতুন ফর্ম বের করে তাতে লিখতে শুরু করলেন সাদা পাঞ্জাবী পরা লোকটা। আজাদ সেসব দেখছেনা। সে দেখছে অদিতিকে। যদিও তার আপাদমস্তক কালো কাপড়ে ঢাকা। দেখাই যাচ্ছেনা মেয়েটাকে। ঐ ছাইচাপা আগুনের খবর কেবল আজাদই জানে। যার আঁচ একটু আগেও টের পেয়েছে আজাদ। আর অদিতি ! সেই যে মুখ নামিয়েছে তার আর মুখ তোলার নাম নেই।

সাক্ষী যোগাড় হলো কাজী অফিস থেকেই। একজন কাজী সাহেবের ছেলে আরেকজন সেই অফিসেরই স্টাফ। সইসাবুদ শেষে স্থানীয় মওলানা দোয়া কালাম পড়ে বিয়ে পড়ালেন। তারপর নাতিদীর্ঘ মুনাজাত শেষে বরবধূকে দোয়া করে বিদায় নিলেন তিনি। আজাদ নিজেই পকেট থেকে টাকা বের করে পিয়ন ছেলেটাকে দিয়ে বাজারের সবচে ভালো মিষ্টিটা আনিয়ে সবাইকে দিতে বলল। এই সময়টুকুর মধ্যে অদিতি একটা কথাও বলেনি কবুল আলহামদুলিল্লাহ বলা ছাড়া। এমনকি তাকায়নি পর্যন্ত। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে আজাদ নিজেই বললো, ” অনেক খিদে পেয়েছে।”
অদিতি চমকে তাকালে আজাদ বললো, ” একটু আগে যেখানে খেতে গিয়েছিলাম সেখানেই চলো যাই ? ”

অদিতি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়ল। দুজনে কাজী অফিস থেকে বেরিয়ে ফের আগের হোটেলটাতে ঢুকল তবে আগের কেবিনটা খালি পেলো না। অন্য এক দম্পতি ওটা দখল করে বসেছে। আজাদ বলল, ” এক কাজ করলে কেমন হয়। খাবার প্যাকেট করে নিয়ে গাড়ীতে বসে খাই চলো। এখানে খোলা টেবিলে তুমি মুখ তুলে খাবে কিভাবে? ”

আজাদের অনায়াসের তুমি ডাক অদিতিকে ক্ষণে ক্ষণে বিহ্বল করে দিচ্ছিলো। সে এবারও মাথা নাড়লে আজাদ দুজনের জন্য খাবার আর পানি কিনে গাড়ীতে চলে এলো। অদিতি ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলে আজাদ অপর পাশ দিয়ে উঠে বসল। গাড়ীর দরজা বন্ধ করার সাথে সাথেই চারপাশের কোলাহলমুখর পরিবেশটা হঠাৎ করই নিরব হয়ে গেল। আজাত খাবারের প্যাকেটটা ড্যাশবোর্ডের উপর রেখে এবার অদিতির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। অদিতি এখনও মুখের ওপর থেকে পর্দা সরায়নি। এত লজ্জা সে কাকে পাচ্ছে ! আজাদকে ? একটু আগেই তো আজাদের আত্মা উড়িয়ে দিয়েছিলো আর এখন ভয় পাওয়া দেখানো হচ্ছে !

আজাদ কপট গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ” রিভলবারটা কোথায় ? ”
-” জি….? ব্যাগে।” শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো অদিতি।
-” ব্যাগে তো বুঝলাম। ওটা তোমাকে কেন দিয়েছিলাম, নিজেকে সেইফ করার জন্য।”
-” আপনাকে মারার কথাও তো বলেছিলেন। বলেছিলেন বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে গেছে।”

আজাদ খানিক চুপ থেকে এবার হা হা করে হেসে উঠতে গিয়েই হাতের ব্যথায় কুঁকড়ে গেলে অদিতি দ্রুত নিকাব তুলে বললো, ” কী হলো। এতো জোরে হাসে কেউ? ”
-” আমার যে পাগলের মত হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে…!”

অদিতি একহাতের টানে নিকাব খুলে ফেলে বলল, ” সব ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে নেই।”
-” তুমি দিলে যে? ”
-” এটা আমার ইচ্ছের চে বেশী প্রয়োজন। অস্বীকার করব না।”
-” তারমানে আমাকেও শাহানের মতো বেছে নিয়েছো শুধু নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে? ” আজাদের কণ্ঠে ওটা অভিমান না অস্বস্তি বোঝা গেলো না।

অদিতি মাথা নাড়ল, ” জি না, ঠিক এমনটা না। তবে আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি এমনটাও বলোবো না কারণ এতো অল্প সময়ে কাউকে বোঝা যায় না। আসলে আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।”
-” কৃতজ্ঞতা প্রকাশের নমুনা কী এই? ”
-” কেন, আমাকে পছন্দ নয় আপনার ? ” চিরল চিরল চোখের পাপড়ী মেলে দিয়ে জানতে চাইল অদিতি।
আজাদ সেদিকে তাকিয়ে ঘোরলাগা কণ্ঠে জবাব দিলো, ” এখন না বললেই বা কী। গলায় তো ঘন্টা বাঁধা পড়েই গেলো।”
-” ওহ্, তাহলে আমি ঘন্টা ? ” অভিমানে গাল ফোলালো অদিতি। বলল,” আমার তো মনে হয়েছিলো আমাকে আপনি পছন্দ করেন।”
-” এটা আসলে তোমার একার না। এটা সব মেয়েদের একটা কমন সমস্যা। কেউ একবারের জায়গায় দুবার তাকালো কী দুটো নরম কথা বললো, ব্যস্ তারা ধরেই নেবে ঐ ছেলে ওর জন্য পাগল।”

অদিতি আহত চোখে তাকালো। আজাদ সেটাকে পাত্তা না দিয়ে বললো, ” নাও কী আর করা। পিস্তল ঠেকিয়ে বিয়ে করিয়েছ। এখন মুখে তুলে খাইয়ে দাও।”

অদিতি ম্লান মুখে ড্যাশবোর্ডের ওপর থেকে খাবারের ব্যাগটা টেনে নিয়ে প্যাকেটগুলো খুলতে আরম্ভ করে দিলো। আজাদকে ফোনে ব্যস্ত দেখে আলগোছে চোখের কোণটা বাম হাতের তর্জনী দিয়ে মুছে নিতেই আজাদ চট করে তাকালে অদিতি মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আজাদ কিছু না বলে ফোনে মন দিলো।
-” হ্যালো মা ? ইয়ে, একটা কথা বলার জন্য ফোন দিলাম। আমি আসলে ইয়ে, মানে বিয়ে করে ফেলেছি।” বলে অদিতির দিকে তাকালো। অদিতি প্রতিক্রিয়াহীন। সে একমনে খাবারের প্যাকেট থেকে স্ট্যাপলারগুলো আলগা করায় ব্যস্ত।
-“বউ আমার পাশেই। কথা বলবে..?” বলতেই অদিতি দ্রুত মাথা নাড়লে আজাদ চোখ পাকিয়ে নিঃশব্দ ধমক দিলে অদিতিকে ফোনটা হাতে নিতে হলো। মৃদু স্বরে সালাম দিলে ওপাশ থেকে আজাদের মা বললেন, ” নাম কী তোমার? ”
-” জি, অদিতি।”
-” হিন্দু নাকি? ”
-” জি না। মুসলমান।”
-” অ…! তা তোমার বাবা কী করে ? ”
-” আমার বাবা মা নেই? ”
-” বলো কী ? এতিমখানা থেকে তুলেছে নাকি তোমাকে? ”
-” জি না। আমার মামা আছে। তার কাছেই আমি মানুষ। নাম বললে হয়ত চিনবেন। উনি একজন এমপি। ”
-” তাই নাকি? তা মা তোমার লেখাপড়া কদ্দুর ?”
-” জি, অনার্স পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিয়েছি।”
-” তোমার মামা-মামীককে জানিয়েছো ? ”
-” জি, জানাবো।”
-” দেখো, আমার ছেলের উপর যেনো দোষ না আসে বাবা। তা তোমার নানা বাড়ি কোথায়? বাবা-মা’র অংশ কিছু পাওনি ? ”
এ পর্যায়ে আজাদ ফোন টেনে নিয়ে নিল, ” মা আমি রাখি। আমরা এখন কুয়াকাটার দিকে যাচ্ছি। ওখানে রুম বুক করে তোমাকে ফোন দেব। আর হ্যাঁ, কাউকে আমার অবস্থান জানিয়োনা আবার। আমি এই ক’দিন ঝামেলামুক্ত থাকতে চাই। রাখি মা, দোয়া করো আমাদের জন্য।” বলে ফোন কেটে দিলো আজাদ।

অদিতি ততক্ষণে ওর প্যাকেট খুলে ড্যাশবোর্ডের ওপর সাজিয়ে দিয়েছে। আজাদ থমথমে মুখে বলল, ” এসব কী? ”
-” আপনার খাবার।”
-” বাম হাতে খাবো ? ”
– ” ওহ্…!” অদিতি ব্যস্ত হলে আজাদ গেট খুলে নেমে পড়ল। অদিতি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। পরক্ষণেই পেছনের গেট খুলে রেখে সামনে এসে খাবারের প্যাকেটগুলো একে একে পেছনে নিয়ে সিটের ওপর রাখলো আজাদ। তারপর সামনের ডোর লক করে অদিতির পাশের দরজায় এসে ওর জানালায় টোকা দিলে অদিতি ডোর আনলক করল। আজাদ ডাকলো, ” এসো।”
অদিতি কোন প্রশ্ন না করে চুপচাপ নেমে এলো। আজাদ ওর পেছন দিয়ে দরজা বন্ধ করে দ্রুত হাতে পেছনের দরজা সসম্মানে মেলে ধরলে অদিতি বিনা বাক্য ব্যয়ে তাতে উঠে বসল। দুম করে দরজা আটকে ওপাশ দিয়ে ঘুরে নিজে উঠে বসল আজাদ। স্বস্তির একটা শব্দ করে বলল, ” ডার্ক গ্লাসের গাড়ী বানানোর আইডিয়াটা কার জানিনা। আজ তাকে আমার অন্তর থেকে দু’আ দিতে ইচ্ছে করছে ।”

অদিতি খাবারের প্যাকেট খুলতে গিয়েই টের পেল আজাদ ওর পাশে এসে গা ঘেঁষে বসেছে। অদিতির হঠাৎ বুক ঠেলে কান্না পেলো। খাবারটা একপাশে সরিয়ে রেখে একরকম ঝাঁপিয়েই পড়ল আজাদের বুকে। ওর কাঁধে মুখ গুঁজতেই ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল আজাদ। তারপরেও নবপরিণীতাকে ছাড়ল না। এক হাতেই টেনে নিলো নিজের কাছে। অদিতির ঝরঝরে মসৃন চুলে নাক ডুবিয়ে বলল,” পিস্তলটা এতোবড় উপকার করবে জানলে তোমাকে আরো আগে কিডন্যাপ করতাম।”

======

গাড়ী ছুটে চলেছে কুয়াকাটার দিকে। আজাদ ইচ্ছে করেই সমুদ্রপথে বঙ্গোপসাগর দিয়ে চট্টগ্রাম যাবার পরিকল্পনা করেছে। সেখান থেকে রাঙামাটি। তার মতে এভাবে যাত্রা যেমন সংক্ষিপ্ত হবে তেমনি কষ্টও কম হবে। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে যাবার ঝক্কির সামনে এই ক্ষুদে টয়োটা যথেষ্টই অপ্রতুল। সে তুলনায় ট্রলারে বা ফেরী করে গেলে অন্তত জার্ণির ধকল অনেকখানিই লাঘব হবে। তাছাড়া অদিতির চেহারা এই একদিনেই শুকিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে আজাদের। চোখের নিচে কালি পড়ে সুন্দর মুখটা মলিন দেখাচ্ছে। ওর কষ্ট আরো বাড়িয়ে দেবার কোনো মানে হয়না। সে নিজে ড্রাইভ করলে ব্যপারটা ভিন্ন ছিলো। একটা মেয়ের পক্ষে অতগুলো পথ গাড়ী চালিয়ে যাওয়া রীতিমত শাস্তিই বটে। সেকারণেই পরিকল্পনা বদলেছে আজাদ।

পথে একজায়গায় থামতে হলো ওদের। অদিতির বিরতি প্রয়োজন। ইতোমধ্যেই আজাদ তার ক্ষতস্থানের জন্য একটা গ্রহনযোগ্য ব্যখ্যা তৈরী করে নিয়েছে। পথে কেউ অনাবশ্যক কৌতুহল প্রকাশ করলে তাকে বলা হবে রোড এক্সিডেন্টে আহত হয়েছে। অদিতির যদিও আপত্তি ছিলো এই কৈফিয়তে কিন্তু আজাদ যুক্তি দেখিয়েছে, ঘটনাটা তো পথ চলতেই ঘটেছে তাহলে রোড এক্সিডেন্ট বলতে সমস্যা কোথায় ? অবশেষে অদিতিকে আজাদের যুক্তি মেনে নিতে হয়েছে।
বিরতির পথ হোটেলগুলোতে ওরা বসেনি। আজাদ একাই গিয়ে খাবার কিনে এনে গাড়ীতে পেছনের সিটে বসে খেয়ে নিয়েছে।
একপর্যায়ে ওরা কুয়াকাটা পৌঁছুলে যাত্রাবিরতি নিলো। হোটেলের রেজিস্টার বুকে আজাদ গর্বের সাথে বাঁ হাতে লিখলো মি এন্ড মিসেস মুনতাসির।

চলবে….

এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

১৯||
রাজন প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও বেলালকে দেখে নিজেকে সামলে নিলো। পরক্ষনেই খিস্তি আউড়ে বলল, ” শালা বাটপার, তুইই তাহলে এগের এখানে নিয়ে এসেছিস?”
-” অই শালা। বাটপার কী আমি ? না তোর আজাদ ভাই বাটপার ? ” বেলাল রেগে গেলো। “পাঁচ লাখ টাকা আর ছেমড়ি নিয়া ভাগলো সে। তারপরেও সে তোর কাছে খুব সাধু, তাই না? ”

বেলালের জবাবে রাজন তেড়ে উঠতেই তার কাঁধে থাবড়া মেরে থামিয়ে দিয়ে আরেকজন বললো, ” এ্যাই, কথা কম। তোদের ঝগড়া তোদের। এখানে ওসব কেওয়াজ বাধায়ে লাভ নেই। তোদের বস কোথায় আছে সেটা শুধু বল।”

-” বস্, কোথায় আছে তা আমি কিভাবে জানবো ? ” বিভ্রান্ত চোখে তাকালো রাজন। সামনের লোকটাকে সে এর আগেও দেখেছে। পেট্রল পাম্পে যেদিন আজাদ ভাই লিটনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো সেদিন এই লোকটা তার ডান দিকে দাঁড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ টেবিলের ওপর চাপড়ের শব্দে সেদিকে তাকাতেই দেখলো সেখানে একটা চেক রাখা হয়েছে। চেকের মধ্যে টাকার অঙ্ক দেখে রাজনের আক্কেল গুড়ুম হবার যোগাড় হলো। সে ভুল দেখছে না তো। কিন্তু এতো টাকা কিসের জন্য ! সে তো আসলেই জানেনা আজাদ ভাই কোথায়। আজাদ ভাইকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পরও সে তার অবস্থান জানায়নি। এই প্রফেশনে ঐটাই নিয়ম। তাছাড়া আজাদ ভাইকে মোবাইলেও ট্র্যাক করা যাবেনা। কারণ সে সম্পূর্ণ নতুন একটা নাম্বার থেকে ওকে ফোন করেছে এবং সম্ভবত কথা বলার পর ফোনটা সে বন্ধ করে রেখেছে। সামনে দাঁড়ানো লোকটা কেশে উঠতেই রাজন তার দিকে তাকালো।
– ” লিসেন, আজাদের খবর দিলে এরকম চেক আরো পাবে।”
রাজন চেকের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বললো, ” যদি জানতাম তাহলে কী আর চুপ থাকতাম ? ঠিকানা বলে চেক নিয়ে চলে যেতাম। আমি আসলেই জানিনা।” রাজনকে অসহায় দেখাচ্ছে।

” তাহলে কে জানে ? ” লোকটার ঠান্ডা দৃষ্টির সামনে রাজনের চোখের তারা হঠাৎ চঞ্চল হলো। রুদ্ধশ্বাসে উত্তর দিলো।
-” যে জানে তার নাম জানতে চাইলে এই চেকটা আমাকে দিতে হবে।”
-” একটা শূণ্য কাটা যাবে। ”
-” চলবে না। আমার ষাট হাজার টাকা দামের মোবাইল নিয়ে গেছে তোমাদের লোকজন। ঐটাই তো পোষাবে না। আরো কম ? ”
লোকটা রাজনের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চেকটা ঠেলে দিলো রাজনের দিকে।

দরজায় শব্দ হবার প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুললেন আজাদের মা। দরজা খুলে অমন দশাসই দুজন ছেলে দেখে যারপরনাই চমকে গেলেন তিনি। তবে ঘাবড়ালেন না। কারণ ব্যক্তিগত ভাবে তিনি ভীরু নন। পুরুষ ঠেঙিয়ে ছেলে বড় করেছেন। একহাতে সবদিক সামলেছেন। তাছাড়া তিনি ভালো করেই জানেন, আজাদের একটা নামডাক আছে এলাকায়। আর ওর মা বলে তার নিজেরও একটা আলাদা দাপট আছে। তার সাথে বেয়াদবি করার কথা কেউ ভাববে না। কিছুটা কড়া কণ্ঠেই তিনি বলে উঠলেন, ” কে তোমরা ? কী চাও এখানে ? ”

-” আস্সালামুআলাইকুম আন্টি। আমরা আজাদ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম আন্টি।” হাসিমুখে প্রবেশ করেই একজন পা ছুঁলো আজাদের মায়ের। আরেকজন হাত তুলে সালাম দিয়ে এককোণে দাঁড়ালো। ছেলে দুটোর অমন অনুগত ব্যবহারে অনেকটাই গলে গেলেন জাহানারা। আর সেটা তার কণ্ঠস্বরেই প্রকাশ পেলো। তিনি মোটামুটি নরম সুরেই বললেন, “ও তো বাড়ীতে নেই বাবা।”
-” জি, তা আমরা জানি আম্মা। কিন্তু আজাদ ভাইকে তো জরুরী দরকার। সে টাকা পাবে আমার কাছে। সেটাই দিতে এসেছি। আচ্ছা, আজাদ ভাই এর নতুন ফোন নম্বরটা একটু দেন তো আম্মা। আমি সরাসরি কথা বলে নেই।”

-” আজাদের নতুন নাম্বার ? ও তো বললো ওর….!” বলতে গিয়েই ছেলের অনুরোধ মনে পড়লো জাহানারার। আজাদ বলেছিলো কাউকে ওর অবস্থান না জানাতে এবং নম্বর না দিতে।
জাহানারা দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন , ” ও বলেছিলো ঢাকার বাইরে যাবে। কোথায় যাবে তা তো বলেনি বাবা। আর নাম্বারও নেই। ”
-” ওহ্ হো, তাহলে তো মুশকিল হলো। আচ্ছা, কী আর করা। চলি তাহলে আম্মা।” বলে ছেলে দুটো সালাম দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোতে গিয়েও থেমে গেলো।
প্রথমজন ফিরে এসে বলল, ” আম্মা। আজাদ ভাই যদি আপনার কাছে ফোন করে তাহলে ভাইকে বলবেন, তার পাওনা পঞ্চাশ হাজার টাকার চেকটা আমি দিতে এসেছিলাম। না পেয়ে ফিরে গেছি। এটা শুনে যদি আজাদ ভাই অনুমতি দেন তবে আমি আপনার হাতে চেকটা দেবো নয়তো না। ঠিকআছে ? যাই আম্মা।”

-“এ…একটু শোনো, বাবা। আমি তো আজাদের মা। আমার ছেলের টাকা তোমরা আমাকেও দিতে পারো। আজাদ ফোন করলে ওকে নাহয় আমিই বলে দেব । কিন্তু পাওনা তো ফেলে রাখা ঠিক না। দাও, চেক আমাকে দাও। আজাদকে যা বলার আমি বলবো।”
-” কিন্তু আন্টি, আজাদ ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া তো কাউকে দেয়া যাবেনা এটা। তার এক কথা, আমার থেকে নিছোস, আমাকে ফেরত দিবি। কাজেই আপনাকে দিসি শুনলে আজাদ ভাই যদি রাগ করে। তারচে ভাই ফিরুক ।” বলে ছেলেটা চলে যেতে ধরলে জাহানারা প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
-” আরে ওর ফিরতে অনেক দেরি হবে। তাছাড়া আমি ওর মা। কথাটা বোঝ না কেন। আমাকে দিতে তোমাদের সমস্যা কী।”
-” সমস্যা আছে তা তো বলিনি আম্মা। মানে আজাদ ভাই যদি রাগ করে ! ভাইয়ের যা রাগ। ”
-” করবে না। আমি নিজেই ওকে ফোন করে সব বলে দেবো।”
-” ওহ্, তাই নাকি। তাহলে এখনি ফোন করে জেনে আমাকে জানান না আম্মা। নিশ্চিন্ত হই। কিছু মনে করবেন না। ভাইকে না বলে এতোগুলো টাকা…!”
-” তাকে তো এখন পাবে না রে বাবা। সে এখন বিয়ে করে কুয়াকাটা হানিমুনে । ওর এদিকের সবকিছু আমার ঘাড়ে ফেলে গেছে। তুমি বরং ওর টাকা নিশ্চিন্তে আমাকেই দিয়ে যাও। আমি হলাম ওর মা। ওর টাকাপয়সার উপর আমার চেয়ে বেশী কার হক আছে বলো তো ?”
-” জি, তা তো একশ ভাগ সত্যি। তাছাড়া ভাই যে বিয়ে করে হানিমুনে এটা তো দারুণ খবর। ” বলে পাশের জনের দিকে তাকিয়ে হেসে চোখ টিপে বলল ,” চেকটা তাহলে আন্টির হাতেই দিয়ে দেই। কী বলিস ? ”
-” কিন্তু চেকটা তো ভাইয়ের নামে। আন্টি তো এটা ক্যাশ করতে পারবে না। তখন আরেক ঝামেলা হবে। তারচে চেকটা ভাঙ্গিয়ে ক্যাশ টাকাটাই আন্টির হাতে তুলে দেন।” পাশের দ্বিতীয় লোকটা এতক্ষণে মুখ খুললো। প্রথমজনের মনঃপুত হলো প্রস্তাবটা।
খুশিমনে মাথা নাড়ল,” তাই তো। তুই তো মন্দ বলিস নি। সেটাই করি। ” বলে হাসলো ছেলেটা।
জাহানারা চকচকে চোখে তাকালেন, ” এটা তো আরো ভালো। তোমরা চেক ভাঙ্গিয়ে আনতে আনতে আমি তোমাদের জন্য চা করি।”
-” জি, আম্মা। আমি টাকা ক্যাশ করিয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ফিরছি। ” বলে ছেলেটা বেরিয়ে গেলে অপর ছেলেটাও তার পিছু নিলো। ছেলেগুলো বেরোতেই জাহানারা কী ভেবে চট করে আজাদকে ফোন দিলেন। কিন্তু আজাদের মোবাইল বন্ধ পেয়ে খানিকটা হতাশ হলেন। তার নতুন নাম্বারে কল দিলেন, সেটাও বন্ধ। হালকা একটা অস্বস্তি হতে লাগলো তার। ছেলেটা অবস্থান জানাতে মানা করলো। বলে কী ভুল করলেন তিনি। কিন্তু না বললেও তো টাকাটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো। তাছাড়া তখন মনে মনে ভেবে রেখেছিলেন যে কথাটা আজাদকে জানিয়ে দেবেন। ওকে যে ফোনে পাবেন না এটা তো আর ভাবেন নি। চা বানাতে গিয়েও খচখচে অনুভূতিটা লেগে রইলো মনে।

=====

রাতের গাড়ীতেই ঢাকা রওনা দিলাম আমরা। আসলে মন মানছিলো না। সত্যি বলতে গতরাতের ঘটনাটায় বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম আমি। ভাবতেই পারিনি এতোবড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবো। সে কারণেই হয়তো সাহস জাগেনি থাকার। তাছাড়া রুমকির ঐ কাজিনটাকে ভালো লাগেনি আমার। শালার হিরোচিত মুখশ্রী আমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিলো। ঐ মাসুম চেহারা আর পাকনা বুদ্ধি দিয়ে আবার আমার বউটাকে কোন পাঁকে ফেলে দেয় কে জানে। ফুটানি দেখে তো মনে হয় শালা টম ক্রুজ। ইচ্ছে হচ্ছিলো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই। রুমকিকে ফিরে না পেলে ওকে যে কী করতাম তা আমি নিজেই বলতে পারবো না তবে একহাত দেখে নিতাম এতে কোনো সন্দেহ নেই। নাহ্, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আর কোনোদিন ঝিনাইদহে আসবো না। রুমকির খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। ওর বাবা- মা’কে বলবো ঢাকায় আসার জন্য। মেয়ের সাথে যতদিন খুশি থেকে যাবে সমস্যা নেই। কিন্তু আমার মন ময়ূরীকে আমি আর ছাড়ছি না। বহুকষ্টে ওকে ফিরে পেয়েছি। আর হারাতে চাই না। শব্দ করেই দীর্ঘশ্বাসটা পড়লো আমার।

-” কী ব্যপার, এতো চুপচাপ ? ”
রুমকির ডাকে ঘাড় ফিরালাম। সিটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছি আমি। রুমকি আমার বাহুতে থুতনী রেখে তাকিয়ে আছে। নিকাবের উপর দিয়ে ওর ডাগর চোখগুলো যেন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ঝুঁকে চুমু খাবার ইচ্ছেটা প্রবল কষ্টে হজম করলাম। বাসভর্তি যাত্রী। কার না কার চোখে পড়ে যাবে। যদিও অধিকাংশই ঘুমে ঢুলছে। রাত তো আর কম হলো না।
রুমকি আমার বাহুতে মাথা রেখে বলতে লাগলো, ” আপনি কী এখনও আমার উপর রাগ করে আছেন ? ”
-” হম। অনেক। ”
-” রাগ করার মতো কী করেছি আমি? ”
-” সরাসরি কিছু করোনি তবে তোমার নায়ক মার্কা ফুপাত ভাইকে দেখে মেজাজটা বিগড়ে গেছে। শালা ফুটানির বাদশা।”
” ওহ্, ওর কথা ছাড়ুন তো। ওর নামও আমার শুনতে ইচ্ছে করছে না। আমি তো ভেবে রেখেছি কষ্ট করে হলেও একটা না-দাবী নামা দলিল করে আমার অংশের দাবী ছেড়ে দেবো। দলিলটা ওর মুখে মারতে পারলে খুশি হতাম বেশী কিন্তু সেটা তো আর পারবো না। আব্বাকে বলেছি সব রেডি করে কুরিয়ার করে দিতে। আমি সই করে বড়আপার মাধ্যমে আব্বাকে পাঠিয়ে দেবো। কী বলেন ? ”
-” খুবই ভালো হবে। একেবারে ভেজাল শেষ।” বলতে বলতেই আমার সেলফোন বেজে উঠলো । দুজনেই চমকে উঠলাম আমরা। একটু অবাকই হলাম আননোওন নাম্বার দেখে৷ এইসময় আবার কে ফোন করতে যাবে। নায়লার সাথে তো সব চুকিয়ে দিয়েই এসেছি। তাহলে ? কিছুটা দ্বিধা নিয়েই রিসিভ করলাম।
-” হ্যালো !”
-” রূপম রিজভি বলছেন ? ”
-” কে বলছেন প্লিজ ? ” কণ্ঠটা পরিচিত মনে হওয়ায় সচকিত হলাম। ধরি ধরি করেও ধরতে পারছি না। আর তারপরেই হঠাৎ পরিচয় জানতে পেরে রাগে গা শক্ত হয়ে উঠলো আমার। কড়া সুরে বললাম, ” আমার নাম্বার কোথায় পেলেন? ”
-” এটা কী খুব কঠিন কিছু ? এটা ওসি সাহেবের কাছ থেকে পেয়েছি। আসলে আপনাকে আমার খুবই দরকার।”
-” কিন্তু আপনাকে তো আমার কোনো দরকার নেই।” বিদ্রুপের সাথে বলে ফোন রাখতেই যাচ্ছি তখনই শুনলাম তার কণ্ঠে ভিন্ন সুর।
-” ভাই, আমি জানি আপনি ভীষণ রেগে আছেন আমার উপর। রুমকিও নিশ্চয়ই তাই । অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। আসলে কী জানেন, মানুষ সহজে তার স্বভাব থেকে বেরোতে পারেনা। বুঝতে পারলেও না। বরং কখনও কখনও এটা আমাদের চরম ক্ষতি করে বসলেও আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা। একমাত্র সৌভাগ্যবানেরই পারে নিজেকে বদলে ফেলে যথাসময়ে একটা সঠিক পথে আনতে । আমার সে সুযোগ বা পরিস্থিতি কোনোটাই জোটেনি।”

-” এসব তত্ত্বকথা বলার জন্যেই কী ফোন করেছেন? মতলব কী পরিস্কার করে বলুন। কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই ফোন করেন নি ? আর এটাও আশাকরি বুঝতে পারছেন যে আপনার কোনো কিছুই আর গোপন নেই?”

-” রূপম ভাই। আমি সব জানি আর জেনেই আপনাকে ফোন করেছি। বলতে পারেন ক্ষমা চাইতেই ফোন করেছি। হয়তো রেগে আছেন বলে আমার কথাগুলো বুঝতে পারছেন না। মজার ব্যপার হলো, আমার জীবনের এই অভাবনীয় পরিবর্তনও রুমকির কারণেই। সত্যি বলতে কী জানেন,
কাঁচা বয়সের আবেগ সহজে ভোলা যায় না। আমার মনে রুমকির প্রতি যাবতীয় ফ্যান্টাসীর জন্য আমার মা দায়ী। ”

-” আমি এসব কথা শুনতে আগ্রহী নই । ”

-” যাই হোক্, কাজের কথা বলি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি রুমকির সাথে আমার সহ অংশীদারীত্বের অংশটা ছেড়ে দেবো। কিছুদিনের মধ্যেই আমি আব্দুল্লাহ মামার কাছে কাগজ বুঝিয়ে দেবো। আর আমার অনুরোধ থাকবে, আপনি প্লিজ এটা মেনে নেবেন । ফিরিয়ে দেবেন না যেন। ধরে নিন, এটা আমার পক্ষ থেকে আপনাদের দুজনকে বিয়ের গিফট ।”

-” আপনি ভাবলেন কী করে আপনার গিফট আমার ওয়াইফ বা আমি নেবো ? বরং আপনি শুনে খুশি হবেন যে রুমকি নিজেই ওর অংশ ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

বলে খানিক অপেক্ষা করলাম আমি। ওপাশে আজাদ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, ” রূপম ভাই, আমি মাত্র চার ঘন্টা আগে বিয়ে করেছি । আর আমি চাইনা, আমার নব দাম্পত্যে কোন কুটিলতাকে প্রশ্রয় পাক । আপনি হয়তো ভাবছেন, এটা কিভাবে সম্ভব বা কিভাবে কী হলো। আসলে রুমকি ভেবে আমার লোকজন যাকে তুলে নিয়ে আসে সেই মেয়েটি একটা এতিম আর উপযুক্ত অভিভাবকহীন অসহায় একটা মেয়ে। তবে অত্যন্ত শার্প আর ইন্টেলিজেন্ট সে। যাই হোক, আমি নিজেও ভাবতে পারিনি এতো সামান্য সময়ের পরিচয়ে আমরা বাধা পড়ে যাবো। অদিতির মত মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে যাবো। আমার মনের অনুভূতি আমি আসলে আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না । এটা খুব সত্যি যে , প্রতিটা মানুষের জীবনে এমন একজন থাকা দরকার যে তাকে প্রয়োজনে বদলাতে সাহায্য করে। সবার জীবনে সেই টার্ণিং পয়েন্ট আর পার্ফেক্ট পারসন সময়মতো মেলেনা। সৌভাগ্যক্রমে আমার মিলে গেছে। জানিনা, ভাগ্য আমাকে এতোবড় উপহার কেন দিলো। আমি তো কখনো ভালো কিছু করেছি বলে মনে পড়েনা। তবে আজ আমি সত্যিই বদলে যেতে চাই। একেবারে মন থেকে। আর শুরুটা রুমকিকে দিয়েই করলাম। কারণ আমি সবচে বড় অপরাধ আপনার রুমকির সাথেই করেছি। ওকে বিভ্রান্ত করতে চেয়ে।”

নিরবে কথাগুলো শুনলাম। তবে এবার আর জবাবে কিছু বললাম না।
আজাদ বললো, ” দোয়া করবেন। সব ছেড়েছুড়ে কিছুদিনের জন্য সব ভুলে যেতে চাই। ইচ্ছে আছে ঝিনাইদহ ফিরে গিয়ে জায়গাটার একটা গতি করবো। তবে সেটা এখনও সময়ের ব্যপার। রুমকি আর আপনার কাছে ক্ষমাটুকু না চাওয়া পর্যন্ত আমি ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। রুমকিকে বলবেন, সে যেন আমাকে মন থেকে ক্ষমা করে দেয়। রাখি।”

-” একমিনিট। আজাদ সাহেব। ” দ্রুত থামালাম ওকে। ” একটা কথা। আপনি কী সত্যিই বিয়ে করেছেন ? ”

-” মিথ্যে বলছি বলে কেন মনে হলো আপনার ? বললামই তো ওর নাম অদিতি। আপনি চাইলে কথা বলিয়ে দিতে পারি।”

-” আমার সাথে ? ”

-” রুমকির সাথে। ”

-” নো নিড। বিশ্বাস করলাম। বেস্ট অফ লাক। দু’আ রইলো। ”

-” ধন্যবাদ। রাখছি।”

ফোন কেটে দিয়ে রুমকির দিকে তাকালাম। আলো আঁধারীর মাঝেই ওর কৌতুহলি চোখ দেখে নড়েচড়ে আরো গ্যাঁট হয়ে বসলাম আমি। রুমকি হতভম্ব সুরে বললো, কে ছিলো ? অদিতি কে ? ”

ওর কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বললাম, ” হিংসুটি। এক নম্বরের হিংসুটি তুমি। অদিতি তোমার সতীন না। আজাদ মিয়ার বউ। তোমার হিরো মার্কা ভাই ছিলো ওটা।”

-” আজাদ ভাই বিয়ে করেছে ? বলো কী? ”
-” হম..!”
-” আপনার কাছে কী চায় সে ? ” রুমকির চোখ বড় হলো।
-” এবার আর নিতে চায় না, এবার দিতে চায়। তোমার সহ অংশীদারের জায়গাটা।”

-” ইস্, কী আমার ভালোমানুষটা। বদমাশ একটা। নিশ্চয়ই কোন নতুন মতলব এঁটেছে।”

-” উঁহুঁ, প্রেমে পড়েছে।”

-” মানে ? ” রুমকির চোখ জোড়া অন্ধকারেই জ্বলে উঠলো যেন। হেসে ফেলে বললাম , ” আজাদের কণ্ঠ আর বাচনভঙ্গি তাই বলছে। ওর বউ এর নামই অদিতি। আরো মজার কথা শোনো, তুমি মনে করে ওর লোকেরা যাকে কিডন্যাপ করেছে তাকেই বিয়ে করেছে সে।।”
-” বলো কী ? ” বিস্ময়ের আতিশায্যে সোজা হয়ে বসলো রুমকী। চোখ পিটপিট করলো বারকয়েক । “ইন্টারেস্টিং! ”

-” আসলেই ইন্টারেস্টিং। ”

-” বেচারী অদিতির কপাল পুড়লো। ” বলেই হেসে ফেলল রুমকি। আমিও সামান্য হেসে মৃদু ধমকে দিলাম।

-” থাক্, এসব বলেনা। ওরা সুখী হোক। জগতের সকল দম্পতি আনন্দে থাকুক এই দোয়াই করি । আর যার যার ভাগ্য তার তার। কাউকে বদদু’আ করা ঠিক না। আমার নিজের কপালের খবরই তো এখনও জানিনা।”

-” একদম মাইর দেবো। আপনার এতো কাছ ঘেঁষে বসে আছি তারপরেও বলছেন একথা ?”

-” মনের দাবী যে আরো বেশী। আর শরীর….!”

-” আহ্, চুপ। কী শুরু করেছেন ! সামনের সিটের মহিলাটা কান পেতে শুনছে আমাদের কথা। ” গলার স্বর আরো খাদে নামিয়ে ফেললো রুমকি।
আদুরে বিড়ালের মতো আমার বাহুতে মুখ ঘষে নাক গুঁজে দিলো ও। আমি আলতো করে ওর মাথাটা নিজের সাথে চেপে ধরলাম। এক অন্যরকম ভালোলাগা ছড়িয়ে পড়লো আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে। বাসের প্রায় সব যাত্রীই আধোঘুমে আধোজাগরণে নিমগ্ন। রুমকিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আবেশে আমারও ঘুম আসতে শুরু করেছে। কিন্তু দুজন একসাথে ঘুমিয়ে পড়া যাবেনা। কোনদিক দিয়ে কোনটা চুরি হয়ে যাবে তারচে একবারে বাড়ী গিয়েই ঘুমাব ভেবে জেগেই রইলাম। কয়েক ঘন্টার পথ। তাছাড়া যাত্রাটা আজ আনন্দের। প্রিয়জনকে ছুঁয়ে এমন অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়া যায়। এখন শুধু অপেক্ষা একটি অসমাপ্ত অধ্যায়ের। সেদিনের এক প্রহরের খেলা আজ সাঙ্গ করার পালা। আহা, ঢাকা তুমি কতদূর।

চোখটা লেগে এসেছিলো কী না বলতে পারবো না। আচমকা প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়ে লাফিয়ে উঠলো পুরো বাসটা। আমি তো বটেই রুমকি সহ ঘুম ঘোরে চমকে উঠলো সবাই আর তারপরেই টের পেলাম বাসটা ভয়ংকরভাবে কাত হয়ে একদিকে হেলে পড়েছে। আতঙ্কে রুমকিকে জাপটে ধরলাম নিজের সাথে। কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিনা। কোনোমতে রুমকির মুখটা দেখলাম। বেচারী আমাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আমি নিজেও পুরোপুরি বেসামাল অবস্থায় আছি । সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিনা। এদিকে পুরো বাসজুড়ে কালিমা ধ্বণিতে মুখরিত। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম এক বিধর্মীও আল্লাহ আল্লাহ বলে খুব কাঁদছে। প্রানপণে রুমকিকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলাম। রুমকির দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে খুব, আবার সে বসতেও পারছে না। ওকে কিছু বলতে যাবো তখনই টের পেলাম বাসটা ক্রমাগত কাত হতে হতে একসময় সবেগে নিচের দিকে উল্টে গেলো। চিৎকার দিয়ে রুমকিকে হাতড়াতে হাতড়াতেই টের পেলাম রুমকি আমার বুকে নেই। সে আগেই কোথায় যেন ছিটকে পড়েছে। এরপরই আমি মাথায় প্রচন্ড আঘাত পেলাম তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই।

===

অদিতিকে নিয়ে লবিতে বসেই ডিনার সারলো আজাদ। তাকে বেশ শান্ত আর স্থির দেখাচ্ছে। সে তুলনায় অদিতি যথেষ্ট চঞ্চল আর প্রানোচ্ছল। কথার ফাঁকে ফাঁকে এটা সেটা বলে দুষ্টুমী করছে মেয়েটা আজাদের সাথে। আজাদ যদিও পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছেনা অদিতির প্রতি। একটা অস্বস্তিমত লেগে আছে মনে। একটু আগেই একটা খটকা জেগেছে মনে। যদিও পাত্তা দেয়নি কিন্তু এখন মনে হলো ব্যপারটা আমলে নেয়া উচিত। কারণ এন্ট্রান্স দিয়ে যে লোকটাকে ঢুকতে দেখেছে আজাদ তাকে আর দশজন আগন্তকের মতো সহজ মনে হয়নি ওর। যদিও লোকটাকে আগে দেখেনি সে। তবু মনে হলো ঘাপলা আছে ওর মাঝে। লোকটাকে স্থানীয় বলে মনে হলো। বারকয়েক মোবাইল দেখার ফাঁকে ফাঁকে ওকে দেখার চেষ্টা করছে বলে ক্ষীণ একটা সন্দেহ হলো আজাদের। চট জলতি সিদ্ধান্ত নিলো আজাদ। চেকআউট করবে সে। রিস্ক নেবে না । অন্তত অদিতিকে সাথে নিয়ে তো একদম না। সাপার অসমাপ্ত রেখেই রিসেপশনের দিকে রওনা দিলো আজাদ। অদিতির বাহু ধরে টেনে তুললো ওকে। অদিতি অবাক হলেও কিছু বললো না। সে নিজে লিফটের দিকে এগোতে যাচ্ছিলো। আজাদই থামালো ওকে। অদিতি অবাক হলো, ” রুমে যাবো না আমরা ? রাত কত হলো সে খেয়াল আছে ? ”
-” এই হোটেলে উঠছি না আমরা।” বলেই বিলবুকে ঝটপট বিল গুঁজে দিয়েই রিসেপশানে এসে কিছুক্ষণ কথা বললো ওদের সাথর আর তারপরই অদিতিকে নিয়ে বের হয়ে এলো আজাদ।
অদিতি ভীষণ অবাক এবং একই সাথে দুঃখিত হলো। এতো সুন্দর হোটেলটা অথচ আজাদের পছন্দ নয়। কিন্তু কথা বলার কোনো সুযোগই পাচ্ছেনা সে। লোকটা হাঁটছে তো না যেন দৌড়োচ্ছে। কিছু বললেও জবাব দেবে বলে মনে হচ্ছে না। অদিতি তাকিয়ে আজাদকে দেখলো।
হোটেলের লবি ধরে হাঁটতে হাঁটতেই চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে আজাদ। এক পর্যায়ে অদিতি না বলে পারলো না।।
-” আপনার হঠাৎ কী হলো ? আমি বুঝলাম না, এরকম হুট করে হোটেল ছাড়ার মানে কী ? আজ রাতে যদি কোন রুম না পাই আমরা তো ?”
-” না পেলে বিচে থাকবো নয়তো ঝাউবনে। তবু এখানে না। ফেউ লেগেছে।”
-” ফেউ ? ” অদিতি চারপাশে তাকালো কিন্তু কাউকে দেখতে পেলো না। আজাদ রীতিমত টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে পড়ে যাবার দশা হলো অদিতির।
হোটেল থেকে বেরিয়েই বিচের দিকে হাঁটতে শুরু করলো আজাদ। কোনোদিকে মন নেই। মুখেও কিছু বলছে না। কেবল মোবাইল টিপছে আর কানে লাগাচ্ছে। যেন অদিতির কাজই হচ্ছে শুধু ওকে ফলো করা। এবার রেগে গিয়ে অদিতি চাপা স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, ” আশ্চর্য, ভুতে তাড়া করেছে নাকি আপনাকে। কোথায় ছুটছেন আপনি? ”
আজাদ এক সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়ালো। এমনভাবে তাকালো যেন অদিতিকে হঠাৎ দেখছে। তারপরই হেসে ফেলে বললো,
-” আজ আমরা কটেজে থাকব । কটেজ পছন্দ নয় তোমার ? ” বলতে বলতেই হালকা চালে বলে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো লোকটা। অদিতির রাগ উঠে যাচ্ছে। পা’টা রীতিমত ব্যথা করছে। কোনে জবাব দিলো না সে। আজাদের লম্বা লম্বা পদক্ষেপের সাথে তাল মেলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও বেঁচে গেছে দুবার। এখন সে যেভাবে এটাকে হাঁটা বলেনা। আজাদ হঠাৎই ওকে টেনে নিজের গায়ের সাথে জড়িয়ে নিলো। অদিতি এবার ঝুলে চললো আজাদের সাথে। ওকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে অন্ধের মত ছুটছে আজাদ। একপর্যায়ে থামলো ওরা। অদিতি হাঁপাতে হাঁপাতে চারিদিকে তাকালো।

ওরা এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে একটা কটেজের সামনের লনে। সামনে কাঠের বারান্দা। তার উপর দুটো চেয়ার পাতা। তবে দরজাটা লক করা। অদিতি টান মেরে হিজাবটা খুলে হাতে নিয়ে চেয়ারের উপরে বসে পড়লো। লম্বা বেনীটা একপাশে এনে দু’পা তুলে বসে রইলো অদিতি। কথা বলবে না সে আজাদের সাথে। যা ইচ্ছা করুক।
আজাদ খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। কথা শেষ করে ফিরে এলো সে। এবার অদিতির দিকে তাকিয়ে সুন্দর করে হেসে বললো, ” আহ্, আমার ভাঙ্গা ঘরে চান্দের আলো।”
অদিতি ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আজাদ ফের হাসলো ওর রাগ দেখে। মাথায় টোকা মেরে বললো, ” অপেক্ষা করো। লোক আসছে চাবি নিয়ে। রাগ যত আছে সব জমুক। পুরোটা একসাথে নামিয়ে দেবো। আচ্ছা, অদিতি। তোমার কাছে কী সুন্দর লাগছে না কটেজটা ? ”

-” মোটেও না। এটা কোনো সুন্দর হলো ? আমার তো ভুতের বাড়ী মনে হচ্ছে।” অদিতি চারপাশ দেখে বললো।

-” অন্ধকার বলে এমন মনে হচ্ছে। সকালে দেখবে কত সুন্দর লাগে। ” বলে অদিতির পাশে বসে পড়লো আজাদ।

অদিতি ওর দিকে তাকিয়ে কপট রাগের সুরে বলল, ” মানে কী এসবের ? একটু বলবেন ? অমন ঝকমকে হোটেল ছেড়ে এই জঙ্গলে আসার মানে কী বুঝলাম না। মশার আড্ডা।”

-” আমাদের মত নবদম্পতির জন্য জায়গাটা আদর্শ। একদম নির্জন। কেউ দেখবে না। আচ্ছা, তুমি কী জানো, এখান থেকে ট্রলারে সুন্দরবন যাওয়া যায় ? ”
-” যাহ্।”
-” যাহ্ কী। সত্যিই। যাবে তুমি ? ”
-” আমার দরকার নেই।”
-” তাহলে কী দরকার তোমার বলে ? ”
-” এখন বলবো না।”
-” কখন বলবে ?” আজাদ নিজের মাথা দিয়ে অদিতির মাথায় ঠুকে দিলো।
অদিতি ‘ উফ’ বলে কপালে হাত বুলিয়ে জবাব দেবার আগেই দেখলো টর্চ হাতে দুজন লোক আসছে। অদিতি দ্রুত হিজাব মাথায় দিয়ে ভদ্রস্থ হলো। আজাদ এগিয়ে গিয়ে ওদের সাথে কথা বলে হাত মেলালো। একজন এসে দরজা খুলে দিলো। অপরজন ভেতরে ঢুকে মিনিট দশেকের মধ্যেই ঝাড়মোছ করে কটেজের চাবি বুঝিয়ে দিলো আজাদের হাতে। লোকদুটো চলে গেলে আজাদ চাবিটা পকেটে রেখে পেছনে তাকাতেই দেখলো অদিতি নেই। সে দরজা খোলা পেয়েই ভেতরে ঢুকে গেছে। আজাদ নিজেও কাঠের বারান্দা পেরিয়ে ঘরে উঁকি দিতেই দেখলো অদিতি মুগ্ধ হয়ে কটেজটা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করেছে। আজাদ হাতের ব্যাগ ট্যাগ এককোণে রেখে অদিতির পিছু নিলো। এতোক্ষণ মেয়েটা ওকে রাগ দেখিয়ে ওকে অনেক জ্বালিয়েছে। এবার আজাদের জ্বালানোর পালা।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here