তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:১৩+১৪

0
630

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#পার্ট_১৩
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

পাখির কিচিরমিচির ডাকে ঘুম ভাঙে নয়নতারার। বিছানার পাশেই জানালা। জানালার পাতলা পর্দা ভেদ করে তীক্ষ্ণ আলো এসে পড়ছে চোখেমুখে। সুন্দর পাতলা মুখটা সকাল বেলার ফুটন্ত ফুলের মতো চকচক করছে। মেয়েটা চোখ কচলে উঠে বসে। বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কি যেনো ভাবে!
খানিক বাদে নয়নতারার মা নিরুপমা আসে নয়নতারার রুমে। এবং তার ডাকেই মৌনতা কাটলো নয়নতারার। তবে আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকেই আকস্মিক প্রশ্ন করলো,
“আম্মু? আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই, তুমি কষ্ট পাবা?”
মেয়ের এহেন অযৌক্তিক প্রশ্নে বেশ হকচকিয়ে গেলেন নিরুপমা। মৃদু ধমকের স্বরে বললেন,
“এটা কেমন প্রশ্ন নয়ন?”
নয়নতারা এক প্রকার তাড়া দিয়ে বলল,
“বলো না আম্মু? ভুলে যাবা?”
“এটা খুব অযৌক্তিক একটা প্রশ্ন। তুই হারাবি ক্যান? আর তুই আমার মেয়ে, হারালে কষ্ট পাবো না? যদিও হারানোর প্রশ্ন কেন আসছে বুঝতে পারছি না।”
নয়নতারা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“সত্যিই কষ্ট পাবা?”
নিরুপমা কপাল কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকায়। মেয়ে দিনকে-দিন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে!
নয়নতারা শান্ত কিন্তু কঠিন কন্ঠে বলল,
“আরজুকে তো তুমি খুব পছন্দ করতা আম্মু। নিজের ছেলের মতো নাকি ভালো বাসতা! কই, তাকে তো মনে নেই তোমার! আমাকেও এমন ভুলে যাবা, তাই না? কোনো ব্যাপার না আম্মু। আমি বুঝে গিয়েছি, এটাই জাগতিক নিয়ম। এই জাগতে কেউ কারো না! কারো জন্য কারো চলার পথ থেমে থাকে না।”
কথাটুকু বলে রহস্যময় হাসলো। তারপর রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
নিরুপমা হতভম্ব দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সেদিকে। বিস্ময় নিয়ে ভাবে, কি বলে গেলো মেয়েটা? এখনো ওর আরজুকে মনে আছে? এতগুলো বছর পরও? অজানা একটা আশংকা ভর করে মন জুড়ে! অস্থিরতা নিয়ে রুম থেকে বের হতে হতে ডাকে,”এ-এই নয়নের বাপ? এই শুনছেন?”
.
স্নিগ্ধা নিঃশব্দে টেবিলে নাস্তা দিচ্ছে। আদনান আড়চোখে সবটা দেখছে আর চুপচাপ খাচ্ছে। ভেতর থেকে ডাক আসলো,”স্নিগ্ধা? মা? একটু পানি দিয়ে যা তো।”
স্নিগ্ধা সাথে সাথেই গ্লাসে পানি ঢেলে তা নিয়ে সাজেদা খানমের রুমে চলে গেলো। ফিরে এলো পরপরই। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই নিজের প্লেটে নাস্তা নিয়ে খেতে লাগলো। আদনান জিজ্ঞেস করলো,
“কাল একা একা চলে এলি ক্যান?”
স্নিগ্ধা জবাব দিলো না। আদনান নিজের দোষ সম্পর্কে অবগত। রাত দশটায় সে বাড়ি ফিরেছিলো। এই এতোটা সময় তার একবারের জন্যেও মনে পড়েনি, স্নিগ্ধাকে সে একা দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছে! বাড়ি ফিরে স্নিগ্ধাকে দেখে মনে পড়েছে! কি সাংঘাতিক কেয়ারলেস হলে মানুষ এমন করে? আদনান তার ভুলে অনুতপ্ত। তাই নরম স্বরে বলল,
“অভিমান করেছিস, মেহু?”
“আমি বাচ্চা না, আদনান! তোর সাথে কথায় কথায় অভিমান করার বয়স আমার নাই।”
“রাগ করিস না প্লিজ। আমি একটা কাজ করেছি, মেহু।”
স্নিগ্ধার নির্জীব জবাব,
“ভালো।”
“মেয়েটা কতটা খুশি হবে তা ভেবেই ভালো লাগছে।”
স্নিগ্ধা আদনানের দিকে চাইলো। কি মায়া লাগে এই শান্ত শান্ত মুখটার দিকে চাইলে!
স্নিগ্ধা মৃদু হেসে বলল,
“মেয়েটার খুশি নিয়ে তুই খুব ভাবিস, তাই না?”
আদনান ঠোঁট উল্টে বলল,
“আরেহ না, তেমন কিছু না। তোকে তো আগেই বলেছি, ওকে আমার অন্যরকম লাগে। একটু একটু ভালো লাগে, দ্যাট’স ইট। প্রেম-ট্রেম ভাবিস না যেন!”
স্নিগ্ধা হেসে ফেললো। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
“তুই একটা বোকা। সেই ছোট বেলার মতো বোকাই রয়ে গেলি আদনান।”
আদনান জিজ্ঞেস করে,
“আসলেই?”
স্নিগ্ধা উত্তর না দিয়েই নিজের রুমে চলে যায়। অকারণেই খারাপ লাগে আজকাল। নয়নতারাকে হিংসে লাগে খুব। কারনটা তার অজানা। কিংবা জেনেও না জানতে চাওয়া প্রবল প্রচেষ্টা!
.
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই যখন ভাত ঘুম দিলো। নয়নতারার তখন বাহিরে বের হতে ইচ্ছে হলো। প্রায় সময় এই টাইমটাতেই আরজু ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরত। রুম থেকে বের হলেই দেখতো আরজু সিড়ি বেয়ে উঠছে। ওকে দেখলেই একটা হাসি দিতো। কাছে ঝুকে চোখেমুখে ফু দিয়ে বলতো,
“কি ব্যাপার ফুলটুসি? রোজ রোজ আমি আসার টাইমে দাঁড়িয়ে থাকো যে? মিস-টিস করো নাকি, হু?”
নয়নতারা বিরক্তি ভরে তাকাতো। আজ অনেক বাদে তার মন চাইলো, ‘যদি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটত!’
নয়নতারার মনের ইচ্ছের পুরোপুরি পুনরাবৃত্তি না ঘটলেও কিছুটা মিল ঘটলো। সিড়ি দিয়ে নামার সময় আদনানের সাথে মুখোমুখি হলো। আদনান হেসে বলল,
“হ্যালো নয়নতারা! ভালোই হয়েছে। চলুন।”
নয়নতারা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“চলুন মানে!”
“চলুন মানে চলুন। আমি যেখানে নিয়ে যাবো সেখানে চলুন।”
নয়নতারা খিট ধরে বলল,
“পারবো না। আমি কোথাও যাবো না।”
আদনান ওর চাইতে বেশি খিট ধরে বলল,
“পারতে হবে, যেতে হবে।”
নয়নতারা কপাল কুঁচকে তাকাতেই আদনান হেসে ফেললো। অনুনয় করে বলল,
“আরেহ ‘মিস এংরি বার্ড’, চলুন। ফর দ্যা লাস্ট টাইম। প্লিজ?”
নয়নতারা মুখে কিছু না বলেই আদনানের সাথে গেলো। ওরা নামলো একটা পার্কের সামনে। আদনান বলল,
“আপনি একটু পার্কের ভেতরে যান। আমি দুই মিনিটে আসছি।”
নয়নতারা অবাক হয়ে বলল,
“মানে কি? আমি একা কই যাবো? আপনার কাজ থাকলে, কাজ করে আসুন। আমি ওয়েট করছি।”
“এখানে দাঁড়ানো টা সেইফ না। আরেকটু এগিয়ে দাঁড়ান।”
নয়নতারা আর কথা না বাড়িয়ে সামনে আগালো। বিকেল বেলার তেজী সূর্যের রশ্মি তখন উঁকিঝুঁকি মারছে গাছের ফাঁকেঝোঁকে। আগাতে আগাতে অনেকখানি এগিয়ে গেলো মেয়েটা।
গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো একটা ছেলের দিকে নজর যেতেই চমকে উঠলো মেয়েটা। যত সামনে আগাচ্ছিল ততই ওর হার্ট দ্রুত বিট করছিলো। পেছন ফিরে ছিলো বিধায় মুখটা দেখতে পাচ্ছিল না। কিন্তু সেই ঘ্রান, সেই চুল, সেই গড়ন! অনেক চেনা মনে হলো। এড়িয়ে যাবে ভেবেও এড়াতে পারলো না। খুব কাছে গিয়ে ডাকলো,
“এক্সকিউজ মি!”
ছেলেটা সাথে সাথেই পেছন ফিরলো। নয়নতারা ওর ওড়নার কোণা দিয়ে কপাল, গলা মুখ মুছলো। মেয়েটার মনে হলো সে এক্ষুনি পরে যাবে। জিহ্ব দিয়ে নিজের পাতলা ঠোঁট জোড়া ভিজালো। অতিরিক্ত ভাবনায় ফলে হ্যালোসিলেশন হচ্ছে কি? নাকি সত্যি সে?
ছেলেটা তখনও চেয়েছিলো কেবল।

বহুদিন পর নিজের মানুষটাকে দেখে অসহ্যকর অনুভূতি হলো নয়নতারার। কিছু না বলেই চলে যেতে লাগলে ছেলেটা হাত টেনে নিজের দিকে ফিরায়।
এক হাত দিয়ে ধরে রেখে, গভীর মমতা ভরে আরেক হাত নয়নতারার ডান গালে রাখে। নয়নতারার গাল বেয়ে অভিমানী অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ততক্ষণে। এতগুলো দিন ধরে জমানো অভিমান, অভিযোগ সব যেনো অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়তে চাইলো অনবরত। টলমল চোখে চেয়ে রইলো অতিপরিচিত সেই মুখটার দিকে! সেই চোখ, সেই মুখ, সেই মানুষ!
আরজু আরো একটু আহ্লাদ নিয়ে গাল ছুঁলো! নিজের চোখ জোড়া অভিযোগে ভর্তি মেয়েটার চোখে রাখলো। বহুদিন বাদে সেই অনুভূতি মিশ্রিত বুলি ছুড়লো,
“কেমন আছো ফুলটুসি? কেমন আছো ফুল, আমার সুন্দর ফুল?”
নয়নতারার অভিমানের ঘট যেন এবার পরিপূর্ণ হলো। এই ছেলেটার সাথে একটা কথাও না বলার তুমুল ইচ্ছে জাগ্রত হয় মন-প্রাণ জুড়ে। নিজের গাল থেকে আরজুর হাত সরাতে চায়, নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায় প্রাণপণ! ও যতই ছাড়িয়ে নিতে চায়, ছেলেটা ততই শক্ত করে ধরে।
নয়নতারার ভেজাভেজা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,
“সেই তেজ! ঠিক আগের মতই রাগে টইটুম্বুর রাগী ফুল আমার! আই ওয়াজ মিস ইউ। আই ওয়াজ মিস ইউ এভ্রি মোমেন্ট, এভ্রি মিনিট’স, এভ্রি সেকেন্ড। আই মিস ইউ ইনফিনিটি, ফুলটুসি!”
নয়নতারা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। থেমে থেমে বলে,
“বাট আই ওয়াজেন্ট মিস ইউ স্টুপিড! আই জাস্ট হেইট ইউ। আই হেইট ইউ আ লট, আই হেইট ইউ ইনফিনিটি!”………..(চলবে)

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#পার্ট_১৪
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

আরজু স্মিত হেসে নিজের বাহুর বাঁধন আগলা করলো। সাথে লাগোয়া গাছটার সাথে হেলান দিয়ে নিরুত্তাপ স্বরে বলল,
“এইটুকু একটা মেয়ের এতো তেজ আসে কই থেকে, ভেবে পাই না!”
নয়নতারা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায়।
আরজু কাছে এসে বলে,
“ভালোবাসি এই তেজী মেয়েটাকে। ভীষণ ভালোবাসি। যাবে আমার সাথে?”
নয়নতারার কাটখোট্টা জবাব,
“কখনোই না। কোনো স্টুপিডের সাথে কোথাও যাবো না। এই মানুষটার সাথে একটা কথাও বলবো না।”
“আমি যদি বলি, যেতেই হবে!”
নয়নতারার উত্তাপ প্রতিবাদ,
“এখন খুব না? এখন খুব প্রেম উতলে পড়ছে! এতদিন কই ছিলো এই প্রেম?”
“এতদিন গোপনে ছিলো। ছোট ফুলকে বড় হতে দিয়েছি। একজন বলল, আমার ছোট্ট ফুল, মিষ্টি ফুল বড় হয়ে গিয়েছে। আমার ফুলকে আমার করে নেয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তাই চলে এসেছি, ভালো করেছি না, ফুল?”
নয়নতারা কিছু বলল না। চোখ মুছলো, মুখ মুছলো, আশেপাশে তাকালো সাবধানী দৃষ্টিতে।
“আকাশ কেমন মেঘ করেছে দেখেছো? বৃষ্টি নামবে বোধহয়। বাসায় যাবে না? নাকি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদবে আর জেদ ধরবে?”
মুখে তার বাচ্চাসুলভ হাসি। কথাটা বলে সাবধানী চোখে নয়নতারার দিকে তাকায়।

নয়নতারা কটমটিয়ে তাককিয়ে উল্টো ঘুরে হাঁটা ধরলো। মেয়েটা বড় হয়েছে, একটু বদলেছে, আবেগ প্রকাশ করতে শিখেছে। কিন্তু ছেলেটা বদলায়নি। সেই আগের মতোই ছন্নছাড়া রয়ে গিয়েছে। পাগলামি যার স্বভাবে সে কি এত অল্পে বদলায়? বদলাতে পারে কি? না বোধহয়!
নয়নতারা যেই রিকশাটায় উঠলো প্রায় সাথে সাথেই আরজুও সেই রিকশাটায় লাফিয়ে উঠলো।
এই যে তিন-চার বছর পর ছেলেটাকে দেখছে, একটাবারের জন্যেও তা মনে হচ্ছে না নয়নতারার। আগে যেমন পাগলাটে কর্মকান্ড করতো, এই এতবছর পরও সেই সেইম পাগলাটে বিহেভ করছে! পরিবর্তন হয়নি কথাবার্তাও! কি আশ্চর্য!
চিরিচিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে ততক্ষণে। নয়নতারা তাকাবেনা তাকাবে না করেও আড়চোখে তাকালো। তাকাতেই দেখলো ছেলেটা তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাসিটা সেই আগের মতোই! বৃষ্টির রেশ বাড়ছে ক্রমশ। নয়নতারার বোধ হলো এই জঞ্জালে ভরা শহরটা এখন পুরোপুরি ফাঁকা। আরজু আর ও ছাড়া কেউ নেই, কেউ না! আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝেই একটা বৃষ্টিময় কন্ঠ ভেসে আসলো….
“বৃষ্টির ফোঁটায় কল্প ঝড়ে
অহেতুক মন খারাপে!
চুপচাপ চারিপাশ একলা শহর
তোমার হাসির আলাপে!
মেঘের হাহাকার কষ্ট বোঝেনা,
বৃষ্টির গল্প জানেনা শোনেনা,
ভাবনারা কোনো বাড়ন মানে না
তোমায় ভেবে যাই!
আকাশ সমান অভিমান বুকে
থমথমে মেঘ হৃদয়ের ট্রাফিকে,
ভিজুক ভালোবাসা স্মৃতির অসুখে
মায়া-আদর বাড়ায়।
আমি তোমায় ভালোবাসি বৃষ্টির মতো!
আমি তোমায় ভালোবাসি বৃষ্টির মতো!”

চোখ তার মেয়েটাতে আবদ্ধ। গান গাইতে পারেনা বলে যেই ছেলে চিরকুটে গান লিখে দেয়, তার কন্ঠে এই সুন্দর গান শুনে চমকিত হয়!
চোখেমুখে বৃষ্টির পানি। চোখ পিটপিট করে তাকায় দুজন দুজনের দিকে। অবাক শহরের অবাক দুটি প্রাণ!
নয়নতারার মনে কত কত প্রশ্ন! কিন্তু অবাক করার বিষয় কোনো প্রশ্নই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে না। ফিরে আসা ভালোবাসায় জটিলতা সৃষ্ট করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
আরজু বলে,
“আমি জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন।”
নয়নতারা অন্যদিকে মুখ ফিরায়। অভিমানি কন্ঠে বলে,
“কোনো প্রশ্ন নেই! আমি সেদিন বার বার করে বলেছিলাম, শুধু একবার বলেন, অমন জঘন্য কাজ আপনি করেন নি। কিন্তু না, আপনি আপনার কথার নড়চড় সেদিন করেন নি। সবাই যখন আপনাকে খারাপ বলছিলো, তখন আমার কেমন লেগেছিল, ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? কি ভাবছেন, এতোটা সময় পর এসে মুখে ফুলঝুরি ছাড়বেন আর আমি গলে পানি হয়ে যাবো? কখনই না।”
আরজুর নির্জিব জবাব,
“পরিস্থিতি ছিলো না বোকা। আমি কমিটেড ছিলাম। যখন সময় হয়েছে তখন তুমি হারিয়ে গেলা! আমি তোমায় কত খুঁজেছি জানো? একেতো এভাবে হারিয়ে গিয়েছিলা, তার উপর এখন আবার অভিমান করছো? তোমরা সব মেয়েরাই কি এমন? কষ্টও দিবা নিজেরা আবার অভিমানও করবা তোমরাই!”
“কিসের কমিটমেন্ট?”
“পুলিশের সাথে কমিটমেন্ট। আমি ওদের একটা প্রজেক্টে হেল্প করেছি জাস্ট। নিজের এবং দেশের স্বার্থে।”
নয়নতারা কিছুই বুঝতে পারছিলো না। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আরজু আশ্বাস দেয়ার ভঙ্গিতে হাসলো। পুরো ঘটনা খুলে বলল একটু একটু করে। যার পুরো বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায় এই যে,
“যেই ছেলেটা মারা যায় সেই ছেলেটা ছিলো একটা টেরোরিস্ট গ্যাং এর ছেলে। । পুলিশ অনেক আগে থেকেই এই গ্যাংটা ধরার জন্য নানান ফন্দি আটে। অবশেষে এই ছেলেটাকে শনাক্ত করে ওর পিছনে লাগে। কিন্তু ছেলেটা টের পেয়ে পালাতে গেলে পুলিশ গুলি করে। এবং ছেলেটা আনফরচুনেটলি মারা যায়। কিন্তু এই গ্যাং যদি বুঝতে পারতো যে পুলিশ ওদের পেছনে লেগেছে তবে, পালিয়ে যেতে চেষ্টা করতো। তাই তারা পুরো কেইসটা এমন ভাবে সাজায় যেন ওরা বুঝতেই না পারে পুলিশ টের পেয়েছে। তাই আমাকে খুনি বানিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে যেন সন্দেহ না হয় ওদের। ডিভি হেড ছিলো আমার দুলাভাই। আর সে-ই আমাকে এই মিশনে যুক্ত হতে হেল্প চায়। আমি এই মিশনে হেল্প করেছি মাত্র। আর যেহেতু আমার এই লাইনে আসার ইচ্ছে আগে থেকেই তাই এটাকে এক্সপেরিয়েন্স হিসেবে নিয়েছি। পুরো মিশন কমপ্লিট হওয়ার আগেই তোমরা উধাও হয়ে গেলা। আমার কি দোষ বলো?”
নয়নতারা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এমন কিছু যে হতে পারে এটা ওর ধারনাতেও ছিলো না। বিস্ময়ে রেশ সাথে নিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
“কিন্তু এটা নিয়ে নিউজ হয়েছিলো। অনেক হাইলাইট করা হয়েছিলো। প্রি-প্ল্যানড হওয়া স্বত্বেও এত হাইলাইট কেন করা হয়েছিলো।”
“প্রি-প্ল্যানড বলেই তো এতো হাইলাইট করা হয়েছে বোকা মেয়ে। যাতে করে ওদের সন্দেহ না হয়। তবুও ওরা কিভাবে যেন বুঝে ফেলেছিল যার কারনে ওদের ধরতে লেইট হয়। আর আমাকে ছয় মাস বন্দি থাকতে হয়। জোশ না? অপরাধ না করেও অপরাধীর সাজা! হা হা হা! আর রত নিউজ দেখছো কিন্তু গ্যাং টাকে ধরার পর যেই নিউজ গুলো হয়েছিলো তা দেখনি?”
নয়নতারা ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ দাঁড়ায়, না! ওর কখনই নিউজ টিউজ এর প্রতি ইন্টারেস্ট কাজ করেনি। মুখ ফুলিয়ে বলে,
“আচ্ছা ওটা বাদ দিলাম। কিন্তু এরপর আমায় খুঁজেন নি কেন? আমি তো রাগ করে খোঁজ নেই নি। আপনি কেন খুঁজেন নি?”
আরজুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই উত্তর দেয়,
“খুঁজবেন-ই-বা কেন? আপনি তো আমায় সত্যি সত্যি ভালোবাসেননি। সব তো মিথ্যে মিথ্যে ভালোবাসা। আমি তো জানি সব।”

আরজু হো হো করে হাসে। হাসি থামিয়ে বলে,
“খুঁজেছি বোকা। অনেক খুঁজেছি। তানিশাকে জিজ্ঞেস করবো সেই উপায় ও ছিলো না। তোমরা চলে আসার পর পরই তানিশারাও কোথায় যেন চলে গিয়েছিলো। কত জায়গায় খুঁজেছি, কত জনকে জিজ্ঞেস করেছি! কিন্তু পাই নি। এক পর্যায়ে খোঁজা বন্ধ করে দিলায়। গ্রাজুয়েশন এর জন্য জাপান চলে গেলাম। ভাবলাম আমি গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করি আর আমার ফুলটাও ততদিনে বড় হোক।”
বলেই আবার হাসলো।
মেয়েটার খুশি লাগছে খুব। এত খুশি ও রাখবে কই! সবটা স্বপ্ন মনে হতে লাগলো। সেই সাথে নিজের মিথ্যে অভিমানের জন্য রাগ ও হতে লাগলো। শুধু শুধুই এত অভিমান!
এক জোড়া সুখি প্রাণ ছুটে চলল সকল দুঃখ-কষ্ট পেছনে ফেলে। বারংবার মনে হতে লাগলো,”ইশশ, প্রাপ্তিতে বুঝি এতোই সুখ!”
.
সন্ধ্যে হওয়ার একটু আগে বাড়ি ফিরে আদনান। পুরো শরীর ভিজে একাকার। কাকভেজা যাকে বলে!
স্নিগ্ধা কিছু জিজ্ঞেস করে না। আদনান নিশ্চুপ ভাবেই নিজের রুমে যায়। ঘন্টাখানিক পর নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে। স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করে,
“এক কাপ চা দিবো? আদা চা?”
আদনান মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ালো। যার অর্থ ‘না’।
ধীর পায়ে হেঁটে সোফায় বসলো। ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলে,
“একটু পানি দে।”
স্নিগ্ধা পানি এনে দেয়। আদনান কাঁপাকাঁপা হাতে পানির গ্লাস নেয়। পান করতে পারে না ঠিক ভাবে।
স্নিগ্ধা কপাল কুঁচকে সবটা দেখে। আদনান গ্লাস রেখে বুকে হাত রাখে। শ্বাস নেয়ার মাত্রা ক্রমশ বেড়ে যায়। স্নিগ্ধাকে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারে না। নিজের বুকে শক্ত করে হাত চেপে রাখে।

স্নিগ্ধার মনে হঠাৎ ভয় ঢুকে। আদনানের হাতে হাত রেখে উৎকন্ঠা নিয়ে জানতে চায়,
“এ-এই আদনান? এমন করছিস কেন? এই তোর কি কষ্ট হচ্ছে? এই?”
আদনান আর কিছু বলে না। চোখ বুজে ফেলে। অনবরত ঘামছে ছেলেটা।
স্নিগ্ধা যা বোঝার বুঝে যায়। ছুটে যায় আদনানের রুমে নেভুলাইজার আনতে। সাজেদা খানমকে ডাকে না। ছেলের চিন্তায় সে না অস্থির হয়ে যায়! তখন হবে আরেক বিপদ! মেয়েটা একাই সব সামলে নেয়ার চেষ্টা করে।
এই সমস্যাটা আদনানের ছোট থেকে। কোনো কিছুতে খুব বেশি কষ্ট পেলে কিংবা চিন্তা করলেই শ্বাসকষ্ট হয়। কি ভীষণ কষ্ট পায় ছেলেটা তা কাছ থেকে না দেখলে বুঝতে পারবে না কেউ।
স্নিগ্ধা আদনানের এই সমস্যাটাকে খুব ভয় পায়। সবসময় হাসিখুশি থাকা ছেলেটার এমন অবস্থায় কষ্ট হয় খুব।

আদনান যখন স্বাভাবিক হয় তখন বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। স্নিগ্ধা আদনানের মাথা টিপে দিচ্ছে। বুকে হাত বুলাচ্ছে। চোখেমুখে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুছে দিচ্ছে।
আদনান স্নিগ্ধার হাত ধরে থামায়। ঠান্ডা কন্ঠে বলে,
“একটু উঠিয়ে বসা তো।”
স্নিগ্ধা আলতো হাতে উঠিয়ে বসায়।
আদনান স্মিত হেসে বলে,
“তোকে খুব ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি আবার? এখানে বস তো একটু।”
স্নিগ্ধা ওর পাশেই বসে। চিন্তিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন লাগছে এখন? কষ্ট হচ্ছে আদনান? শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে কি?”
আদনান চমৎকার করে হাসে। কিছুক্ষণ স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে থেকে সুধায়,
“কাঁদছিস কেন, মেয়ে?”
স্নিগ্ধা হকচকিয়ে যায়। চোখ মুছে বলে,
“আজব! কাঁদবো কেন! কাঁদার মতো কি হয়েছে?”
“কিছু হয় নি। তুই যে আবার ফ্যাঁচ কাঁদুনে তা ভুলে গিয়েছিলাম। হা হা হা!”
স্নিগ্ধা কিছু বলে না। ওর শুধু কান্না পাচ্ছে। কি জ্বালা!
আদনানের শান্ত আবদার,
“তোর কোলে একটু মাথা রাখি মেহু?”
স্নিগ্ধা আস্তে করে বলে,
“হু, রাখ। মানা করিনি তো!”
আদনান মত পাল্টে ফেলে নিমিষেই। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
“না থাক, রুমে গিয়ে একটু ঘুমাই। এমনিতেই খুব জ্বালিয়ে ফেলেছি তোকে। আর না জ্বালাই।”
স্নিগ্ধা কিছু বলে না। আগের ন্যায় বসে থাকে। আদনান চলে যেতেই ও কেঁদে ফেলে। কেন কাঁদে তার কারণ অজানা। মুখ ঢেকে কাঁদে সে। কেমন যেন কষ্ট কষ্ট লাগছে ওর!
.
রাত তখন দুটো কি তিনটে হবে। নয়নতারার ঘুম ভাঙে ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে। নয়নতারা ফোন রিসিভ করে কানে নেয়। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে,
“হ্যালো!”
“ঘুমাচ্ছ ফুলটুসি? ইশশ, ঘুম ভেঙে দিলাম আমার ফুলের!”
নয়নতারা ধপ করে উঠে বসে। মৃদু কন্ঠে বলে,
“এতো রাতে ইমম্যাচিউর মানুষদের মতো করার জন্য কল করেছেন? আপনি একটুও পাল্টাননি, স্টুপিড!”
ওপাশ থেকে হাসির স্বর ভেসে আসে। নয়নতারা মুগ্ধ হয়ে শোনে। কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি হয় মেয়েটার। কি আশ্চর্য মানুষের অনুভূতি! এই অনুভূতিগুলো বাক্সবন্দি করে রাখা গেলে কেমন হতো?…..(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here