তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:১৫

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#পার্ট_১৫
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

শ্রাবণের মেঘে ভেজা আকাশ। এত ভিজেও ক্লান্ত হয়নি সে, এখনো ভিজে চলেছে। সকাল হতে শুরু করে রাত অব্দি রিমঝিম বৃষ্টির খেলা চলতে থাকে অনবরত। মৃদু বাসাতে গাছের পাতা কাঁপে।
প্রকৃতির সাথে মানুষের সেই আদিম কাল হতেই সুনিপুণ সখ্যতা রয়েছে। প্রকৃতির মন কেমন করে উঠলে এই আজব মানবজাতির মনটাও যেন কেমন কেমন করে উঠে মাঝে-মধ্যে।
স্নিগ্ধা খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়ায় বৃষ্টি ছুঁতে। হাত বাড়াতেই টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে হাতে। অল্পতে সখ্যতা গড়ে ওঠে বৃষ্টির সাথে। ধীরে ধীরে বৃষ্টিরানী তার সীমারেখা অতিক্রম করে স্নিগ্ধ সুন্দর মেয়েটার মুখে এসে পড়ে, চোখে পড়ে, ঠোঁটে পড়ে। আবেশে চোখ বুজে ফেলে মেয়েটা। বৃষ্টির সান্নিধ্য ভালো লাগছে তার। মুখটা খানিক বাড়িয়ে দেয়। বিষন্ন বৃষ্টি, বিষন্ন পরিবেশ আর গুমট বাঁধা বিষন্ন একটা মন! সব যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো নিমিষেই। কি হয়ে হয়েছে ওর? কী কারনে এই বিষন্নতা? আগে তো এমন লাগেনি কখনো!

সাজেদা খানম ফোনে কারো সাথে হেসেহেসে নমনীয় কায়দায় কথা বলছে। নিজের রুম থেকে বের হতেই সেই দৃশ্য দেখতে পায় আদনান। অলস ভঙ্গিতে হেলেদুলে মায়ের কাছে এসে বসলো। সাজেদা খানম ফোন রেখে দিয়েছে ততক্ষণে। ছেলে তার মায়ের কোলে মাথা রাখতে রাখতে বলে,
“কার সাথে কথা বলছিলা? আমাদের ‘মিস ড্রামা কুইন’ কই মা? তার আলাপচারীতা পাচ্ছি না যে আজ!”
সাজেদা খানমের মুখ হাসি হাসি তখনও। ছেলের চুলে আলতো হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“আছে হয়তো ওর রুমেই। আজ দুদিন কেমন যেন মনমরা মনমরা। সেটা আমি সামলে নিবোনে খনে। এখন শোন? একটা ভালো খবর আছে, বাবা।”
আদনান উঠে বসে। নিরুউচ্ছাস স্বরে বলে,
“এই বলছো মেহুর মন ভালো নেই, আবার বলছো ভালো খবর! কী ভালো খবর?”
“মিসেস মাসুরা কে তো চিনিস না কি?”
“ছোট খালুর বিজনেস পার্টনার এর…!”
পুরো কথা শেষ করার আগেই সাজেদা খানম মাথা নারিয়ে বলে,
“হুম। ঠিক ধরেছিস।”
আদনানের কপাল কুঁচকে আসে। বলে,
“তো? কী হয়েছে?”
সাজেদা খানম আগ্রহ নিয়ে বলে,
“ওনার বড় ছেলের জন্য স্নিগ্ধাকে পছন্দ করেছে। কয়েকদিন আগে এসেছিলো না? তখনই নাকি বেশ ভালো লেগেছে তার। ভাবতে পারছিস কি ভালো খবর এটা!”
ভালো লাগার মতো তেমন কিছুই পেলো না আদনান। তার মায়ের এই অতি মাত্রায় আগ্রহের কারন ধরতে পারে না। তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে,
“এতে এতো আগ্রহের কি আছে?”
সাজেদা খানম আকাশ থেকে পরার ভঙ্গিতে বলে,
“কি বলিস তুই? খানদানী বংশ তাদের। তার উপর ছেলেটা ডাক্তার। দেখতে রাজপুত্রের মতো সুন্দর। কি সুন্দর মানাবে দুজনকে! তাছাড়া আমারও তো বয়স হয়েছে। মেয়েটাকে ভালো পাত্রে হস্তান্তর করতে পারলে ঝাড়া-হাত-পা হবো। ওকে তো নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসি আমি। এখন শুধু মেয়েটা মত দিলেই হলো।”
আদনান কেন যেন সহজ ভাবে নিতে পারলো না পুরো বিষয়টা। স্নিগ্ধার ও যে একদিন অন্য ঘরের ঘরনী হতে হবে সে কথা যেন মানতে অদ্ভুত লাগছে! ওর কাছে মনেহচ্ছে মেয়েটা এখনও সেই ছোটটি রয়ে গিয়েছে।
সাজেদা খানমের সাথে আর কথা না বাড়িয়ে স্নিগ্ধার রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। মন খারাপ কেন হবে মেয়েটার? ওর তো অজথা মন খারাপ হয় না! ও আবার কিছু করলো নাকি, তা ভেবে কিঞ্চিৎ আতংকগ্রস্থ হয়।
স্নিগ্ধা তখনও বারান্দাতেই দাঁড়ানো ছিলো। বিনা প্রতিক্রিয়ায় নিরলস ভিজে যাচ্ছে মেয়েটা।
“এই মেয়ে? ভিজছিস কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে না? ভেতরে আয়। শুনলাম মনমরা হয়ে ঘুরিস নাকি? কাহিনী কি, হু? প্রেমে-ট্রেমে পড়েছিস নাকি রে ড্রামা কুইন? কি সাংঘাতিক! ওই বেচারার কথা ভেবে খারাপ লাগছে। বেচারার জীবন তেনাতেনা।”
স্নিগ্ধা নিরুত্তাপ ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
“সেই চিন্তা তোর করার প্রয়জন নেই। আমারটা আমি বুঝে নিবো। যা তো এখন। ভালো লাগছে না।”
তুমুল অনিচ্ছা স্বত্বেও আদনান বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বৃষ্টির ছন্নছাড়া চলনে বিরক্ত হয়। স্বভাবসুলভ স্নিগ্ধার মাথায় চাটি মেরে বলে,
“এদিক তাকা! কি হয়েছে বল তো শুনি। ”
স্নিগ্ধার কঠর জবাব,
“কিছু হয় নাই। তোর মতো কথায় কথায় ‘কিছু হয়ে যাওয়ার’ রোগ নেই আমার। যা সর!”
আদনান বিরক্ত হয়ে বলে,
“আরে ঢং বাদ দিয়ে আমার দিকে তাকা তো! দেখি তোকে ওয়াইফ ম্যাটারিয়াল লাগে কি-না!”
আদনানের এহেন উক্তিতে হকচকিয়ে তাকায় স্নিগ্ধা। পুরো চোখমুখ জুড়ে বিন্দুবিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা। আদনান কিছুক্ষণ ভাবুক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলে,
“উমম, হুম! আসলেই তোকে এ বাড়ি থেকে তাড়ানো সময় হয়ে গিয়েছে। কবে যেতে চাস, বল?”
“আমি না থাকলে, তুই অনেক খুশি হবি, না?”
মেয়েটার কন্ঠে অভিমান উপচে পড়ে। ঠোঁট জোড়াও যেন উল্টে আসে। আদনানের চোখে পড়ে না এসব কিছুই। সে সানন্দে জবাব দেয়,
“খুবই খুশি হবো। প্লিজ বিদায় হ। আর হ্যাঁ, যাওয়ার আগে মাফ-টাফ চেয়ে যাস। ছোট থেকে তো আর কম জ্বালাসনি, তাই না? জ্বলেপুরে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছি, দেখ।”
স্নিগ্ধা তাকায়। চোখে তার কতশত প্রশ্ন! কতকত অনুরক্তি, মায়া, ভালোবাসা, কষ্ট! কিছুই কি টের পায় না ছেলেটা? কি অদ্ভুত!

.
বৃষ্টির সময় নয়নতারার সবচাইতে পছন্দের কাজ বই পড়া। চিরিচিরি বৃষ্টির তালেতালে বই পড়ার আনন্দই আলাদা।
যদিও এখন বৃষ্টি নেই। বৃষ্টি থেমেছে অনেকখন আগেই। এই থামে এই শুরু হয় টাইপ অবস্থা আর কি। বাহির থেকে পাখির কিচিরমিচির ডাকও ভেসে আসছে মৃদু স্বরে। অর্ধশোয়া অবস্থায় খাটের সাথে হেলান দিয়ে বই পড়ছে নয়নতারা। হঠাৎ বারান্দায় ঠক করে আওয়াজ হলো। আওয়াজটা বিশেষ কানে নিলো না। আবার এবং আবার! পরপর দুই তিনবার সেইম হওয়ার পর নয়নতারা কিছু একটা অনুমান করতে পেরে ঝটপট খাট থেকে নামে। বারান্দার দরজা খোলে, কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। বেশ কিছুক্ষণ এদিকসেদিক তাকিয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে চলে আসতে যাবে তখন পায়ের সাথে কিছু একটা লাগলো। তাকাতেই দেখলো ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা কাগজের দলা। নয়নতারার বুঝতে বাকি রইলো না কাজটা কার। এমন আজগুবি কাজকারবার পাগল-ছাগল ছাড়া সম্ভব নাকি? পূর্বেও বহুবার এমন হয়েছে। পুনরায় এদিক সেদিক তাকিয়েও কাউকেই যখন দেখতে পেলো না তখন ইটের টুকরো সহিত মোড়ানো কাগজটা খুললো নয়নতারা। একটু একটু ভেজা কাগজটাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“এই বৃষ্টির ফুল? তুমি একটু ছাদে আসবা?”
আরেকটা খুললো। সেখানে লেখা,
“ভেজা ফুল, মিষ্টি ফুল! আসবা কি? একটু দেখেই চলে যাবো, সত্যি!”
নয়নতারা অবাক হয়ে ভাবে,”ছাদে মানে! সে কি ছাদে এসেছে? কিন্তু কিভাবে? আশ্চর্য! স্পাইডার ম্যান নাকি?”
পরক্ষণেই খুশি খুশি লাগে। চোখমুখ জুড়ে হাসি ফুটে ওঠে। বুক ধুকপুক করে। খুব সাবধানে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে চিরকুটগুলো নিয়ে রুমে আসে। বইয়ের ভাজে চিরকুট দুটো রেখে এক ছুটে সিড়িতে আসে। নুপুর পড়া খালি পায়ে ঝুনঝুন শব্দে এগিয়ে চলে। বাসার কেউ যেন আলাপ না পায়, সেদিকে সাবধানী হয়।
একবার ভাবে, যাবে না। কিন্তু না যেয়ে সে পারেও না। এই একটা মানুষকে উপেক্ষা করার সাধ্য আপাতত নেই ওর। আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই সিড়ির দরজায় এসে থামে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দু হাতে স্কার্ট একটু উঁচু করে এক পা বাড়াতেই কেউ হেঁচকা টান মেরে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে ফেলে। নয়নতারা ঘাবড়ে যেয়ে চেঁচাতে লাগলে মুখ চেপে ধরে। ভয়ে বুজে ফেলা চোখ দুটো ধীরে ধীরে খুলতেই সামনে দাঁড়ানো অর্ধ ভেজা পাগল মানবটাকে দেখে। তাকে দেখে মনটা শান্ত হলেও অস্থিরতা কমে না। হাত আর মুখ চেপে রাখায় কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখাতে পারছে না মেয়েটা। শুধু তাকিয়ে রইলো অদ্ভুত এলোমেলো পাগলাটে মানবটার দিকে।
আরজুর চোখ ভেজা, মুখ ভেজা, শার্ট ভেজা। ভেজা চুল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে নয়নতারার চোখে, গালে। মেয়েটার চোখে শীতল ভয়, ছেলেটার চোখে মুগ্ধতা। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি আসার পূর্ব মূহুর্তের নীলচে কালো খোলা আকাশের নিচে দুটো মুগ্ধ প্রাণ! প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে তাদের আবেক, মায়া, মোহ!
নয়নতারা ঘন নিঃশ্বাস আরজুর হাতে পড়তেই মোহ কাটে আরজুর। হাত আগলা করে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে এক গুচ্ছ তৃপ্তির হাসি। দু’হাতে ঘন চুলগুলো এলোমেলো করে পানি ঝড়ায়। আড়চোখে তাকায় নয়নতারার দিকে। নয়তারা তখনও দেয়ালের সাথে হেলান দেয়া অবস্থায় দাঁড়ানো। এক পা দিয়ে আরেক পায়ের নখ খোঁচাচ্ছে। দৃষ্টি নিচের দিকে। খানিক বাদে চোখ তুলে তাকায় আরজুর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই হালকা কেশে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। পরক্ষণেই মেকি রাগ নিয়ে চাপা স্বরে বলে,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন? এই বৃষ্টির মধ্যে! কি অবস্থা করেছেন ভিজে নেয়ে! এমন কেন আপনি? বাচ্চামি স্বভাব কবে দূর হবে? আপনি কি জানেন? আপনি একটা অসহ্যকর লোক! আপনি থাকুন, আমি যাচ্ছি।”
এক দমে কথাগুলো বলে সত্যি সত্যি চলে আসতে লাগে মেয়েটা। আরজু হাত ধরে ফেলে। কাছে এনে বলে,
“আমাকে বাচ্চা বলো, তুমি কম কোথায়? বাচ্চাদের মতো এতো ছটফট করো কেন, হু? একটু স্থির হয়ে দাঁড়ানো যায় না? বাচ্চা ফুল একটা।”
নয়নতারার মিছে বিরক্তি ফুটিয়ে তোলা নয়ন! আরজুর হাসি আরো প্রশস্ত হয়। নয়নতারার কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দেয়। পেছন থেকে এক গুচ্ছ কদম এনে নয়নতারার চুলে গুঁজে দিতে দিতে বলে,
“ভালোবাসি ফুল! ভালোবাসি আমার ফুলটুসি! বৃষ্টির মতো ভালোবাসি, বৃষ্টিতে ভেজা কদম ফুলের মতো ভালোবাসি।”
নয়নতারা কিচ্ছু বলে না। কিন্তু তার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়,
“শুনছো আকাশ, বাতাস, শ্রাবনের বৃষ্টি? আমি পেয়েছি! আমি আমার মানুষটাকে পেয়েছি! অবশেষে পেয়েছি। আজীবন পেতে চাই। শুনছো সবাই?”
আরজু নয়নতারার গালে হাত রাখে। আকুতি ভরে সুধায়,
“তুমি কি আমার একান্ত এক ফুল হবে, ফুলটুসি? রোদে রাঙা ফুল, কুয়াশা মাখা ফুল, বৃষ্টিতে ভেজা ফুল! হবে কি আমার বারোমাসি ফুল?”
নয়নতারার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিছু সুখ সকল দুুঃখ দূর করার অসীম ক্ষমতা রাখে! অনেক অনেক দুঃখের পরেও সেই সুখের পরশ পুরোনো সকল দুুঃখ এক নিমিষে ম্লান করে দিতে পারে!…..(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here