তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:১৬

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#পার্ট_১৬
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

পৃথীবির সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে,
পৃথীবির সব রূপ লেগে আছে ঘাসে,
পৃথীবির সব প্রেম আমাদের দুজনার মনে,
আকাশ ছড়ায়ে আছে শান্তি হয়ে আকাশে আকাশে!….
বারান্দায় পায়চারী করতে করতেই জীবনানন্দ দাশের কবিতাটি আবৃত্তি করছিলো আদনান। পরন্ত বিকেলের শান্ত পরিবেশ। ক্ষণে ক্ষণে বিকেলের তেজহীন সূর্যের রশ্মি উকি মারছে তার খোলা বারান্দায়। লাল, হলুদ, কমলা রঙের হয়ে চমকাচ্ছে চোখে পাতলা ফ্রেমে একটা চশমায়। আদনান খানিক বিরক্ত হয়ে এপাশ থেকে ওপাশে যায়। চশমা খুলে হাতে নেয়। কিন্তু চশমা ছাড়া সে বই পড়তে পারে না। চশমাটাকে তার কেবল বই পড়ার সমটাতেই প্রয়োজন পড়ে। অফিস শেষে বাড়ি ফিরে শেষ বিকেলে বই পড়া তার নিত্যদিনকার অভ্যাস।
টিশার্টটা টেনে সামলে নিয়ে পেছন ঘুরতেই দেখতে পেলো এক কাপ রং চা হাতে স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে সে ছেলেটার আবৃত্তি শুনছিলো। বারান্দার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ান। দূর্বল চাহনি। চোখেমুখে তার রাজ্যের ক্লান্তি। এক্ষুনি পড়ে যাবে টাইপ ভাব।
আদনান সুন্দর হাসলো। বইটা বন্ধ করে চায়ের কাপটা নিলো। আদনান বই পড়ার সময় চা নিয়ে আসা স্নিগ্ধার ডেইলি রুটিন। সে সানন্দে তার রুটিন মেনটেইন করে। মুখের হাসি বজায় রেখেই আদনান বলে,
“তুই কখন আসলি? এদিকে আয়, এক সঙ্গে বিকেল দেখি।”
স্নিগ্ধা ধীর পায়ে এগিয়ে আসে। অর্ধ গ্রীলের বারান্দায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। স্মিত হেসে বলে,
“কবিতাটা আরেকবার বলবি?”
আদনান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,
“কোনটা? কেবল পড়লাম যে?”
“হুম।”
আদনান চশমাটা খুলে টিশার্ট এর কোণায় মুছে নেয়। পুনরায় পরে নিয়ে হালকা কেশে বইটা সামনে মেলে ধরে। মৃদু বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে পুনরায় বলে,
“পৃথীবির সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে,
পৃথীবির সব রূপ লেগে আছে ঘাসে,….!
পরের লাইন বলার আগেই স্নিগ্ধা আদনানকে থামায়। বইটা ছিনিয়ে নেয়। তারপর অদ্ভুত ভাবে থেমে থেমে বলে,
“উঁহু, ভুল। জীবনানন্দ জানত না, পৃথীবির সব রূপ লেগে আছে তোর চোখে, মুখে, গায়ে, তোর এই বিরক্তিকর চশমাটায়, টিশার্টে, গলায়। জীবনানন্দ জানে না, আকাশে, বাতাসে, পাহারে, সমুদ্রে কোথাও শান্তি নেই। একটু শান্তি নেই! কারো মনে, কোথাও প্রেম নেই, আছে কেবল অপ্রেম!”
আদনান ভীষণ রকম চমকায়। কি বলে এই মেয়ে? খানিক বিরক্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করে বলে,
“ফাইজলামি করছিস? চড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো ফাজিল। যাহ ভাগ।”
স্নিগ্ধা অনুভব করলো ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। আদনান কি বলছে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে আর এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকলেই ও পরে যাবে।
আদনান লক্ষ্য করলো স্নিগ্ধা টলছে। ছেলেটা চট করে বুঝে ফেললো স্নিগ্ধা ঠিক নেই। উল্টা-পাল্টা কথা বলার কারনও বেশ ভালো মতোই বুঝে গেলো। চশমা আর বইটা টুলে রেখে এক হাতে স্নিগ্ধাকে ধরলো। গালে, কপালে হাত রাখলো। উৎকন্ঠা নিয়ে ডাকলো,
“মা? এই মা? কই তুমি? মা!”
ছেলের এমন উৎকন্ঠা মিশ্রিত ডাক শুনে ছুটে আসলেন সাজেদা খানম। স্নিগ্ধা আর আদনানকে এমন বেকায়দায় দেখে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে? স্নিগ্ধার এই অবস্থা কেন?”
ছেলেকে প্রশ্ন করেই স্নিগ্ধাকে ডাকলেন,
“স্নিগ্ধা? এই, কিরে?”
আদনান মায়ের উপর ভীষণ রাগ হলো। খটখট করে বলল,
“মেয়েটার এতো জ্বর, আর তোমার খবরই নেই! শরীর পুড়ে যাচ্ছে। আর তুমি জানোই না, কি হয়েছে? আশ্চর্য!”
সাজেদা খানম সঙ্গে সঙ্গে স্নিগ্ধার কপালে হাত রাখলেন, এবং ভয়ানক চমকালেন। এত জ্বর তো আর হুট করেই আসেনি। ধীরে ধীরে বেড়েছে। আর সে নিজে কিনা জানেই না! যে মেয়ে সব দায়িত্ব নিয়ে কি সুন্দর সামলে নেয়, কেউ অসুস্থ হলে সঙ্গে সঙ্গে টের পায় তার বেলায় এহেন অবহেলায় অনুতপ্ত হলেন। অনুতাপের স্বরে বললেন,
“ও তো দুদিন যাবত ঠিক মতো রুম থেকেই বের হয় না, এনজিও তেও যাচ্ছে না। ভেবেছিলাম মন-মেজাজ খারাপ তাই আর বিরক্ত ও করিনি। আমি আসলে খেয়াল করিনি বাবা।”
আদনান মায়ের সাথে আর কথা বাড়ায় না। স্নিগ্ধাকে সাবধানে ধরে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। জ্বর মাপে। জ্বরের মাত্রা অস্বাবিক বেশি হওয়ায় অস্থির হয়ে উঠে আদনান। মায়ের দিকে ভীতস্থ চোখে তাকিয়ে বলে,
“মা? জ্বর তো প্রচন্ড বেশি। অফিস যাওয়ার সময়েই দেখেছিলাম কেমন যেন চুপচাপ। বোধহয় তখন থেকে জ্বর জ্বর ভাব ছিলো। ইশ সারাদিন এভাবে…!”
মায়ের দিকে তাকিয়ে অসন্তুষ্ট ভাবে বলে,
“তুমি একটু খেয়াল করবা না? এত পর করে ফেলেছো? নাকি মেয়েটাকে বিদায় করতে পারলেই বাঁচো?”
ছেলের কথায় তার মন খারাপ হয়। পরে আবার কি যেন মনে পড়ে তার। ছেলের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।
.

তিন চাকার ‘রিকশা’ নামক এই যানবাহন নয়নতারা বরাবর-ই বেশ পছন্দের। নিজেকে মুক্ত পাখির মতো মতো মনে হয়। যাত্রাটা আরো বেশি মধুর হয় যদি পাশে একজন অনবরত বকবক করতে পারা পাগল প্রেমিক থাকে। আরজু একটু পর পর নয়নতারার দিকে তাকায়। চোখে চোখাচোখি হতেই বোকা বোকা হাসে। নয়নতারা বিড়বিড় করে বলে,”পাগল একটা!”
নয়নতারা হুড তুলে দেয়। আরজু হুড নামিয়ে ফেলে। নয়নতারা বিরক্তি নিয়ে আবার উঠায় আরজু ফেলে দেয়। এই অদ্ভুত খেলা চলতে থাকে অনেকবার। নয়নতারা অতিষ্ঠ হয়ে বলে,
“ধ্যাত, রোদ পড়ছে।”
আরজু হেয়ালি করে বলে,
“একটু নাও রোদের আদর, ক্ষতি কি? নিজেকে সবার থেকে, সব কিছু থেকে এতো আড়াল করে রাখতে চাও কেন, হু?”
নয়নতারা অবাক চোখে চায়। এ ছেলে বলে কি! রোদের কথা ভেবে রোদে পুড়ে মরতে হবে? ঠোঁট উল্টে বলে,
“দেখুন? রাগ হচ্ছে কিন্তু। আমি কিন্তু এখন নেমে যাবো।”
যদিও সে মিছেমিছি রাগ দেখাচ্ছে তবুও সেটা মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই। আরজু নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,
“পারলে নামো।”
“সত্যি নেমে যাবো কিন্তু।”
“আচ্ছা!”
নয়নতারার খুব ইগোতে লাগে। এতক্ষণ মিছেমিছি রাগ দেখালেও এবার সত্যি সত্যি রেগে গেলো। রেগেমেগে বলল,
“এই মামা? রিকশা থামান। থামান বলছি।”
আরজু আরো বেশি জোর দিয়ে বলল,
“এই মামা? নো রিকশা থামাথামি। থামাইলে খবর আছে।”
নয়নতারা কটমটিয়ে তাকায় আরজুর দিকে। আরজু তার স্বভাবসুলভ হাসি দেয়। শ্যামল দীঘির মতো সুন্দর সেই হাসি। রিকশার হুড তুলে দিয়ে বলে,
“বাচ্চা একটা রাগি ফুল। রাগে নাক লাল হয়ে গিয়েছে, ইশশ!”
বলেই মুখ চেপে হাসে। এদিক তাকায় সেদিক তাকায়। মেয়েটার দিকে তাকিয়েও তাকায় না।
নয়নতারা হুড ফেলে দেয়। নাক ছুঁয়ে বলে,
“একদম বাজে কথা বলবেন না। আমার নাক মোটেও লাল হয় না।”

আরজু নয়নতারার একটু কাছে ঝুঁকে মৃদু স্বরে বলে,
“তাই নাকি? তাহলে কি হয়? হলুদ, সবুজ নাকি নীল হয়েছে?”
নয়নতারা কপাল কুঁচকে তাকায়।
আরজু চাপা স্বরে বলে,
“তোমাকে আজ একটা সারপ্রাইজ দিবো। না, একটা না। দুটো সারপ্রাইজ দিবো।”
নয়নতারা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।
আরজু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ফেলে। মুখে তার রহস্যের হাসি। রিকশা ওয়ালা ঘার ঘুরিয়ে দুটো প্রেমময় প্রাণের খুনশুটি দেখে।
.

সন্ধ্যে নেমে এসেছে ততক্ষণে। স্নিগ্ধার মাথার পাশে বসে জলপট্টি দিচ্ছে সাজেদা খানম। ছেলে তাকে কিছুই করতে দিচ্ছিল না প্রথমে। এক প্রকার জোর করেই জলপট্টি নিয়েছে ছেলের কাছ থেকে। আদনান খাটের সাথে লাগোয়া দেয়ালটাতে হেলান দিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে। কি নিদারুণ মায়া অনুভব হচ্ছে মেয়েটার জন্য। আদনান তখন বলা স্নিগ্ধার কথাগুলো ভাবে। কি বলেছে মেয়েটা? জ্বরের ঘোরে আবোল-তাবোল বলেছে? নাকি মনে যা ছিল তাই বলেছে?
নিজের এমন উদ্ভট অবিশ্বাস্য ভাবনায় নিজেই চমকে উঠে আদনান। স্নিগ্ধা তো ওর বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড। বোন ব্যাতিত এটাই তো ওদের সম্পর্ক। এসব উদ্ভট ভাবনা তো এখানে বেমানান।
আদনানের এসব ভাবনার মাঝেই দরজায় কলিংবেল বাজে। সাজেদা খানম তড়িতগতিতে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। বলে, বাবা তুই একটু দেখ ওকে আমি দেখে আসছি কে এসেছে। মায়ের অতি উৎসাহের কারন খুঁজে পায় না। সাজেদা খানম চলে গিয়েছে ততক্ষণে।
আদনান স্নিগ্ধার কপালে হাত রাখে। স্নিগ্ধা চোখ পিটপিট করে। ঠোঁট নাড়ানো চেষ্টা করে। কিছু যেন বলতে চায় মেয়েটা কিন্তু বলতে পারে না। আদনান জিজ্ঞেস করে,
“কিছু বলবি মেহু?”
মেয়েটা নিরুত্তর, নিস্তেজ।
আদনান চাপা ক্ষোভ ঝেড়ে বলে,
“নিষেধ করেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে, শুনিস নি আমার কথা। এখন কেমন লাগছে? বেয়াদপ, ফাজিল।”
কথাগুলো বলতে বলতেই স্নিগ্ধার মাথায় হাত বুলায়। মিনিট পাঁচেক এর মাঝেই রুমে দুজন মানুষ আসে। একজন মধ্যবয়সী নারী। আরেকজন বেশ সুদর্শন ছেলে। দুজনের চেহারায় অসম্ভব মিল। আদনান মধ্যবয়সী নারীটাকে চিনে। মিসেস মাসুরা। ছেলেটাকে না চিনতে পারলেও অনুমান করতে পারে এটা তার ডাক্তার ছেলে।

আদনান সালাম দেয়। সকল ফর্মালিটি সারে। তার মেজাজ চরম খারাপ হয়ে যাচ্ছে এই মূহুর্তে। মায়ের উপর রাগ হচ্ছে প্রচুর।
ছেলেটা স্নিগ্ধার পাশে বসলো। পালস চেইক করছে, জ্বর মাপছে।
আদনান কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। হু হু করে রাগ বেড়ে আগুন হয়ে যাচ্ছে।
আদনানের মনে হলো, দুনিয়াতে কি ডক্টরের অভাব পড়েছে? এই ছেলেকে ডেকে আনা লাগবে কেন? মায়ের দিকে একবার বিরক্তির চোখে তাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।……(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here