তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:১৭

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#পার্ট_১৭
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

সূয্যি মামা ডুববে ডুববে ভাব, এমতাবস্থায় রিকশা এসে থামলো নয়নতারাদের বাসার সামনে।
নয়নতারা ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আপনি যে বললেন, আপনি বিশেষ কোথায় যাবেন আমাকে নিয়ে!”
আরজু ঠোঁট চেপে হাসে। রহস্যের হাসি। রিকশা থেকে নামতে নামতে বলে,
“বিশেষ মানুষ যেখানে থাকে সেটাই তো বিশেষ জায়গা। তাই নয় কি?”
নয়নতারা রিকশা থেকে নামে। কাঁধে ব্যাগ নেয়। মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
“সব সময় ফাইজলামি, না? আপনি আসলেই একটা অসহ্য!”
আরজু হাসে। সুন্দর ও সতেজ হাসি। চাপা স্বরে বলে,
“কিন্তু এই অসহ্য ছেলেটা যে তোমায় পাকাপাকি ভাবে তার কাছে রেখে দেয়ার বন্দবস্ত করতে যাচ্ছে ফুলটুসি!”
নয়নতারা মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“ইশশ! বললেই হলো? আমি কারো কাছে যাচ্ছি না। এসব ফুলটুসি-টুলটুসি বললেই পটে যাবো নাকি? কখনোই না।”
“তাই?”
“হু।”
“তাহলে আদনানকে বিয়ে করলে না ক্যান? কত ভালো ছেলে, সুদর্শন দেখতে। আমার মত অস্থিরতাও ওর মাঝে নেই। নম্রভদ্র ঠান্ডা মেজাজ। তবে কেন ফিরিয়ে দিলে তাকে?”
এই আকস্মিক প্রশ্নে যতটা না রাগ হয়েছে তার চাইতেও বেশি অভিমানী হয়েছে। মুখ ফুলিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আমার ইচ্ছে, আপনার তাতে কি? আমার যাকে ইচ্ছে কাছে টেনে নিবো, যাকে ইচ্ছে দূরে ঠেলে দিবো।”
বলেই গেইটের ভেতর ঢুকে যায়।
আরজু রিকশাওয়ালাকে বিদেয় করে চটজলদি নয়নতারার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথা চুলকে বলে,
“এই, রাগ করেছো? স্যরি ফুলটুসি।”
নয়নতারা তার রাগ-অভিমান সাময়িক ভাবে চেপে রেখে উৎকন্ঠা নিয়ে বলে,
“আশ্চর্য! আপনি ভেতরে আসছেন কেন? কেউ দেখে ফেলবে না? যান প্লিজ।”
আরজু ঠোট উল্টে বলে,
“তো? দেখলে কি হবে? আমার ফুল আমার অধিকার। কেউ দেখলে কি হবে?”
নয়নতারা বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এই ছেলে বলে কি? নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“দেখুন, সবসময় বাচ্চামি ভালো লাগে না। যান তো।” বলতে বলতে এক হাতে ঠেলে আরজুকে গেইটের বাহিরে সরায়।
আরজু হাসি চেপে রেখে বলে,
“ছিঃ এত বড় অপমান! এই প্রথম বোধহয় কোনো প্রেয়সী এই কাজ করলো। খুবই অপমান্স বোধ করছি। আই থিংক এই গেইটের সাথে ঝুলে পড়েই আমার ফাঁস খাওয়া উচিত। বিদায় পৃথীবি!”
নয়নতারার প্রচুর হাসি পেলো। কিন্তু হাসি পেলেও হাসা বারণ। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“দুই মিনিটের মধ্যে এখান থেকে না গেলে খারাপ হবে।”
বলে গেইট আটকে দিলো। তারপর হনহনিয়ে হেঁটে উপরে চলে এলো। চুপিচুপি হাসলোও। এই ছেলেটার মতো করে কেউ ভালোবাসতে পারবে না ওকে। কেউ না।

নয়নতারা রুমে এসে ব্যাগটা রাখলো। নিহা আর নয়না ফোনে গেইম খেলছিল খুব মনযোগে। তাদের বাবা-মা কোনো একটা বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা করছে তাদের রুমে। নয়নতারা সবার কর্মকান্ড দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের আলগা করা খোঁপাটা খুলতে না খুলতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। নয়না ডেকে বলল,
“দেখতো কে এসেছে।”
নয়না ফোনেই চোখ ডুবিয়ে রেখে বলল,
“তুমি একটু দেখো না আপু, প্লিজ।”
তার সঙ্গে নিহাও সুর মিলালো,
“হ্যাঁ, প্লিজ আপু প্লিজ! আউট হয়ে যাবো নাহয়।”
“ফোন পেয়ে বেয়াদপ হচ্ছো দিন দিন। গেইম খেলা বন্ধ করছি তোমাদের, ওয়েট।” গজ গজ করে বলতে বলতে নিজেই গেলো নয়নতারা। চুল গুলো এক পাশে এনে দরজা খুলতেই চমকে উঠলো। ছানাবড়া চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো দুই হাত ভাজ করে বুকের উপর রেখে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধ উন্মাদ মানবটার দিকে। তার মুখ হাসিহাসি। চোখেমুখে রহস্য। নয়নতারাকে চমকাতে দেখে তার মুখের হাসি চওড়া হয়, রহস্যের মাত্রা বেড়ে যায়।
ভেতর থেকে ভেসে আসে,”কে এলো রে?”
নয়নতারা জ্বিহ্ব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজায়। ভয়ে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,
“ক-কেউ না। কেউ না।”
আরজু ঠোঁটের কোনা দিয়ে গেঁজ দাঁত বেড়িয়ে আসে। নিচু স্বরে বলে,
“মিথ্যে বলো কেন, ভীতু ফুল! বলো যে নয়নতারা ফুলের মালি এসেছে, তার আমানত ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।”
নয়নতারা সত্যিই ভয় পায়। তার পরিবার সবটা যদি সহজে এক্সেপ্ট না করে? যদি বাজে রিয়েক্ট করে? যদি সব ঠিকঠাক বুঝতে না চায়? আরো কত কত প্রশ্ন! হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গাল, ঠোঁট মুছতে মুছতে বলে,
“এই ছেলে? কি সমস্যা? প্লিজ চলে যান। কেউ এসে পড়বে। সমস্যা হয়ে যাবে। প্লিজ চলে যান। বাচ্চামো করে না প্লিজ!”
নয়নতারার কথাটুকু শেষ হতে না হতেই নিরুপমা এসে হাজির হয়। জিজ্ঞেস করে, “কার সাথে কথা ব..” কথাটুকু পুরোপুরি শেষ করতে পারেনা সে। তার পেছন পেছন আসে মোফাজ্জেল করিম নয়নতারার বাবা। তিনিও চুপ। এক এক করে নিহা নয়না সবাই আসে। সবাইকে দেখে নয়নতারা হতবিহম্বল হয়ে পরে। একবার আরজু একবার পরিবারের বাকি সদস্যদের দিকে তাকায়। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে অবাস্তব লাগছে। হুট করে এমন হবে ও নিজে কল্পনাও করেনি। ওর পরিকল্পনা তো ছিলো অন্যরকম। কিন্তু এখন কি করবে?
.
সন্ধ্যা নেমে এসেছে ততক্ষণে। চারদিক থেকে মাগরিবের সুমধুর আজান ভেসে আসছে। চারদিক আবছা অন্ধকার।
সাজেদা খানমের বিশেষ অতিথি দের উপর ক্রমশ অসন্তুষ্টির মাত্রা বেড়ে আকাশ সমান হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ডাক্তারের উপর। ছেলেটার নাম সে জানতে পেরেছে তার নাম সাইম। কিন্তু আদনান সাইমকে মনে মনে নাম দিয়েছে ফালতু ডাক্তার! যদিও এই নাম দেয়ার পিছনে যথেষ্ট অসন্তুষ্টি লুকিয়ে আছে। আদনানের মতে প্রথম কারন হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত অধিকারত্ব ফলানো। স্নিগ্ধা সকালে কি খেয়েছে, দুপুরে কি খেয়েছে, বিকেলে কিছু খেয়েছে কিনা, খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করেছে কিনা, বৃষ্টিতে কেন ভিজেছে, নিজের প্রপার যত্ন নিচ্ছে কিনা তা নিয়ে যেন এই ফালতু ডাক্তারের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ!
আদনান সরাসরি কিছু বলতে না পারলেও মনেমনে অনেক কিছু বলেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলেছে, “এহহ! মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি যেন! মেয়েটা হচ্ছে আমাদের আর অতিরিক্ত দরদ দেখাচ্ছে সে। বেশি প্রেম ভালো না রে ফালতু ডাক্তার, মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু!”
মনের কথা শুনতে পাওয়ার ক্ষমতা যদি মানুষের থাকতো তবে বোধহয় এই শান্ত পরিবেশ এতক্ষণ অব্দি শান্ত থাকতো না।
তবে একটা বিষয় আদনানকে খুব ভাবাচ্ছে।
আদনান বুঝতে পারছে না স্নিগ্ধার প্রতি ছেলেটার কেয়ারনেসে সে খুশি না হয়ে, কেন রাগ অনুভব করছে। যার সাথে মেয়েটার বিয়ে হতে যাচ্ছে তার যদি মেয়েটার উপর কেয়ারনেস তৈরি হয়ে থাকে সেটা তো ভালো দিক। ওর রাগ রাগ লাগছে কেন? ঠান্ডা মেজাজের মানুষ হওয়া স্বত্বেও কেন সাইমকে মেরে নাকশা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে? ও কি জেলাস, বাই এনি চান্স? বাট হোয়াই? স্ট্রেঞ্জ!
এসব ভাবতে ভাবতেই বাসা থেকে বের হয় মসজিদের উদ্দেশ্যে। নামাজ পড়ার আগ অব্দি মনটা, মাথাটা ঠান্ডা হবে না কিছুতেই।

নামাজ শেষে বাসায় ফিরলো না। টং দোকানে বসে ছিলো কিছুক্ষণ। দোকানের মামার সাথে আড্ডা দিয়েও মনে তৃপ্তি মিললো না। উসখুস লাগছিলো স্নিগ্ধার জন্য। মিনিটে মিনিটে ঝগড়া করা মেয়েটা এক বিকেল এক সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলো চোখ বুজে থেকে। আদনান অস্থিরতা অনুভব করছে। ইচ্ছে হচ্ছে স্নিগ্ধার কাছে বসে থাকতে। কিন্তু ইচ্ছে হলেও গেলো না। বাসায় ফিরলো এশার নামাজ শেষ করে।

বাসায় ফিরে বিরক্তিভাব অর্ধেকটা দূর হয়ে গেলো তখন, যখন শুনলো সাইমরা চলে গিয়েছে। ছেলেটার কেয়ারনেসে সাজেদা খানম মুগ্ধ। প্রশংশা করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আহা, এমন ছেলে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। এই ছেলের সাথেই স্নিগ্ধার বিয়ে দিবে বলে এক প্রকার মনস্থির করে ফেলেছে তিনি।
আদনান মাকে এবং মায়ের অপ্রাসঙ্গিক কথাগুলোকে কোনোরূপ পাত্তা না দিয়ে স্নিগ্ধা রুমে গেলো।
মেয়েটা তখনও চোখ বুজে শুয়ে ছিলো। আদনান পাশে বসলো। স্নিগ্ধার কপালে হাত রাখালো। ধীরে ধীরে চোখ মেললো স্নিগ্ধা। আদনানের দিকে তাকালো দূর্বল চোখে। আদনান মৃদু হাসলো। চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“এখন কেমন লাগছে মেহুরানী?”
স্নিগ্ধা কিছু বললো না। ওর মন জুড়ে কিসের যেন অভিমান, কিসের যেন কষ্ট!
আদনান পুনরায় দরদ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“খুব বেশি খারাপ লাগছে কি? মাথা টিপে দেই?”
একটু থেমে বলে,
“যদিও তোর মতো ওতো ভালো পারি না, তবে একটু একটু পারি নিশ্চই।”
স্নিগ্ধা তখনও চুপ।
আদনান নিজে নিজেই সব বলছে। হঠাৎ কি মনে হতেই ব্যস্ত হয়ে বলে,
“এই? তুই তো আমার অস্থিরতায় কতকিছু তৈরি করে খাওয়াস। আজ আমি তোকে ইন্সট্যান্ট বানিয়ে খাওয়াবো। বল কি খেতে ইচ্ছে করছে তোর?”
স্নিগ্ধা কপাল কুঁচকে তাকায়। সারা মুখ জুড়ে একরাশ বিরক্তি। মনে মনে ভাবছে হয়তো, ‘ছেলেটা জালাচ্ছে কেন এতো?’ বিশেষ পাত্তাই দিলো না ও। চোখেমুখে কাঁথা টেনে উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়লো।
আদনান আর জ্বালালো না মেয়েটাকে। স্নিগ্ধার রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। যাওয়ার সময় সাজেদা খানমকে পাঠিয়ে দিলো ওর রুমে। কখন কি লাগে, বলা যায়?
আদনান পুনরায় ফেরত এলো প্রায় দের ঘন্টা পর। এর মাঝে অবশ্য কয়েকবার এসে রুমের দরজায় দাড়িয়ে দেখে গেছে স্নিগ্ধা আর মাকে।
হাতের ট্রেতে করে প্রথমবারের মতো নিজের তৈরি খাবার নিয়ে আসলো হন্তদন্ত হয়ে। স্নিগ্ধার মাথার পাশে বসতে বসতে মাকে বলল,
“মা? তোমার জন্য আলাদা করে রেখে এসেছি। গরম গরম খেয়ে দেখো তো জলদি।”
সাজেদা খানম অবাক চোখে কিছুক্ষণ ছেলের দিকে চেয়ে রইলো। ছেলে তার ব্যাপক পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। আদনান মা’কে দু’হাতে আগলে বের করতে করতে তাড়া দিলো জটজলদি খেয়ে কেমন হয়েছে জানাতে। সাজেদা খানম অবিশ্বাস নিয়ে বেড়িয়ে গেলো। আসলেই ছেলে তার নিজে রান্না করেছে?
স্নিগ্ধা ঘুমাচ্ছে তখন। জ্বর অনেকটা কমে গিয়েছে তার। আদনান আস্তে করে ডাকলো,
“এই মেহু? মেহুরানী? একটু ওঠ।”
স্নিগ্ধা ঘুম ঘুম চোখ মেলে দেখলো কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। আদনান আলতো করে ধরে সোয়া থেকে বসালো। স্নিগ্ধা কপাল কুঁচকে বাচ্চাদের মতো তাকিয়ে রইলো। আদনান চমৎকার করে হেসে খাবারটা মুখের সামনে নিয়ে বলে,
“হা কর, মেয়ে। দেখ তো কেমন হয়েছে। অতোটা ভালো না হলেও খারাপ হয়নি আই থিংক। নে হা কর..!”
স্নিগ্ধা হা করে বাধ্য বালিকার মতো। তাকায় আদনানের দিকে। তাকায় ছেলেটার চোখে, মুখে। যে ছেলে নিজের প্লেটে ভার বেড়ে খেতে পারব না, সে করেছে রান্না?
আদনানের মুখে তৃপ্তির হাসি, সন্তুষ্টির হাসি।

কার জন্য কার মনে ঠিক কতটুকু অনুভূতি জমে আছে, তা অনেক সময় সে নিজেও জানে না। জানতে চায় না কিংবা চেষ্টা করে না। হুট করে টের পায় না। এই অনুভূতি গুলো খানিক অদ্ভুত হয় বটে তবে সেই সাথে খুব মূল্যবানও হয়।……(চলবে)

(এখন থেকে রেগুলার দেয়ার চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here