ভ্রম_নাকি_তুমি পর্ব শেষ

#ভ্রম_নাকি_তুমি!(৭ম এবং শেষ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

আয়ান চোখ খুলে দেখলো অবনীকা দুই হাত দিয়ে ওর গলা টিপে ধরে আছে। তাহলে কি অবনীকা ওকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে? অবনীকা কিছু একটা বলছে কিন্তু আয়ান শুনতে পাচ্ছে না। আয়ান নড়ার শক্তি ও হারিয়ে ফেলেছে। কিছু মুহূর্ত পরে অবনীকার গলা শুনতে পাচ্ছে ,

“কি হয়েছে আপনার? আয়ান, আয়ান? আপনি ঠিক আছেন তো? এরকম করছেন কেন?
আপনার কি শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? গলায় কি হয়েছে? এভাবে গলা ধরে আছেন কেন?
আয়ান কিছু তো বলুন। আয়ান”

অবনীকা এসব বলেই যাচ্ছে আর আয়ান এর গলায় আলতো ভাবে হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে ওর। আয়ান লাফ দিয়ে উঠে বসলো। তারপর বিস্ফোরিত চোখে এদিক ওদিক তাকালো। এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলো। অবনীকা ভয়ার্ত চোখে আয়ান এর দিকে তাকিয়ে আছে।

– কি হয়েছিলো আপনার? ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ওরকম করছিলেন কেন?

– কি রকম করেছি?

– কেমন অদ্ভুত! গলায় হাত দিয়ে মোড়ামুড়ি করছিলেন আর জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিলো গলা থেকে কিছু একটা ছাড়ানোর চেস্টা করছেন। আর ঘেমেও তো গেছেন অনেক।

– ও। খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম।

– আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।

বলেই অবনীকা আয়ান এর দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। আয়ান ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি একবারেই শেষ করে দিলো। অবনীকা শাড়ির আচল দিয়ে আয়ান এর কপালে জমে থাকা ঘাম গুলো মুছে দিলো। আয়ান কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। তবে অবনীকা কে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।

পরদিন সকালে আয়ান অফিসে যাওয়ার পরেই গতদিনের মতো অবনীকা ও বাসা থেকে বের হয়ে গেল। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে আবার বাসায় ফিরে এলো। আশ্চর্যের ব্যাপার আজ ও কেউ ওকে ফলো করছে। কিন্তু পেছন দিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেল। দ্রুত পায়ে হেটে বাসার মধ্যে ঢুকলো।
বাসায় ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই দেখলো দরজার সামনে আয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান কে দেখে চমকে উঠলো। আয়ান এখন বাসায়??

– কি ব্যাপার, আপনি এখন বাসায় এলেন যে? শরীর ঠিক আছে তো আপনার?

আয়ান একটা মুচকি হাসি দিয়ে অবনীকা কে পাশ কাটিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। ভেতরে ঢুকে ওপরে সোজা নিজের ঘরে চলে গেছে। অবনীকা বুঝতে পারছে না কিছুই। এই সময়ে বাসায় এসেছে কেন? না বাসায় তো যে কোন সময়েই আসতে পারে। হয়তো কোন কাজ ছিলো, কিংবা কোন জরুরী পেপার রেখে গেছে বাসায়। কিন্তু অবনীকার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রহস্যময় হাসিটা দেয়ায় অবনীকার কপালে চিন্তার ভাজ দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা ও কি দেখতে পেয়েছে নাকি অবনীকা বাইরে গেছিলো? আয়ান আবার বুঝে যায় নি তো ও কোথায় গিয়েছিলো? না না ও তো অফিসে ছিলো।

অবনীকা এসব ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে গেল। কিন্তু ঘরে তো আয়ান নেই। গেল কোথায়? বাথরুমে দেখলো কিন্তু সেখানে নেই। বারান্দায় গিয়ে দেখে আয়ান একমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। অবনীকা একটু ইতস্তত করে আয়ান এর কাঁধের ওপর হাত রাখলো। কিন্তু আয়ান ভাবলেশহীন ভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে অবনীকা কে আয়ান দেখতেই পায় নি। কি হয়েছে আয়ান এর? এরকম আচরণ কেন করছে? আয়ান কি রেগে আছে তাহলে?

– আপনি কি কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত?

– হু।

– আমাকে বলা যাবে?

আয়ান অবনীকার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল। অবনীকা ও পেছন পেছন গেল।

– কি হয়েছে আপনার? কিছু তো বলুন। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। বলুন না কি হয়েছে?

আয়ান খুব জোরে অবনীকার একটা হাত ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।

– কি, কি করছেন আপনি? এভাবে হাত ধরেছেন কেন? আমার লাগছে।

– কোথায় গিয়েছিলে একটু আগে?

অবনীকা ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,

– বা বা বন্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম।

– লুকিয়ে? কেন আমাকে বলে যাওয়া যেত না? কাল ও তো গিয়েছিলে।

– ওই আসলে আমার মনে ছিলো না৷ বাসায় এতকিছু ঘটে গেছে যার জন্য আমার মাথায় প্রেশার পড়েছে তাই ভুলে গিয়েছিলাম, স্যরি।

আয়ান এবার আরো জোরে অবনীকার হাত চেপে ধরলো। অবনীকা ব্যথা পেয়ে অস্ফুট স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো।

– আর কতো নাটক করবে তুমি?

– মানে?

– বুঝতে পারছ না? সত্যিই বুঝতে পারছো না? নাকি না বোঝার অভিনয় করছো?

– না আমি বুঝতে পারছি না।

আয়ান নিজের পকেট থেকে কতগুলো মাইক্রো স্পিকার বের করলো।

– এগুলো কি?

অবনীকার চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। আয়ান এগুলো কোথা থেকে পেলো? ঢোক গিলে বললো,

– কি এগুলো?

– জাস্ট শাট আপ। এখনো নাটক করে যাচ্ছো?

আয়ান এবার জোরে চিৎকার করে উঠলো। আয়ান এর এতটা রাগ দেখে অবনীকা হতভম্ব হয়ে গেছে। ভয় ও পাচ্ছে। কারণ আয়ান কে এতটা রাগতে কখনোই দেখে নি অবনীকা।

– বলো এসব কেন করেছো? কি ক্ষতি করেছে আমার পরিবার? বলো কি জন্য আমার পরিবারের সাথে একটার পর একটা অন্যায় করে যাচ্ছো? কেন এত অভিনয়? কেন?

– জানতে চাও কেন?

– হ্যাঁ চাই। বলো আমাকে।

– এটা জানতে চাও না আমি কে?

– মানে?

– মানে তুমি তো জানোই না আমি কে। তোমার তো এটা জানা উচিত যে আমি কোন অবনীকা নই। আমি তোমার প্রথমা স্ত্রী, অবনী। আর আমি একটু আগে আমার মাকে দেখতে গিয়েছিলাম হস্পিটালে।

আয়ান এবার অবনীকার হাত ছেড়ে দিলো। এটা কি বললো অবনীকা! আয়ান এর হাত পা কাঁপছে। এটা কি করে হতে পারে??

– ভাবছো আমি মরার পরে কি করে ফিরে এলাম, তাই তো? আসলে কি জানো? আমার ভাগ্যটা খুব ভালো। তাই সেদিন মৃত্যুর মুখ থেকে ও ফিরে এসেছি। তোমার মা আর ভাইয়ের এতটা চেস্টা সত্বেও আমি বেঁচে যাই।

– মানে?

– তুমি কি জানো সেদিন আমার সাথে কি হয়েছিলো?

– হ্যাঁ তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো।

– মিথ্যে! মিথ্যে বলা হয়েছে তোমাকে। আমার এক্সিডেন্ট হয়নি। আমাকে খুন করার চেস্টা করা হয়েছিলো।

আয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অবনীকার দিকে। ও কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। কি বলছে ও এসব? অবনীকা একটু থেমে বলতে শুরু করলো,

– রিয়ান আমার বাথরুম এর ভেন্টিলেটর আলগা করে রেখে দিয়েছিলো। আমি যখন গোসল করতাম ও আমাদের পাশের রুমটাতে গিয়ে ভেন্টিলেটর থেকে সেটা দেখতো। কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারিনি। সেদিন যখন তোমার আসার কথা ছিলো, তখন আমি রাতের জন্য খাবার বানিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে গোসল করতে ঢুকি বাথরুমে। হঠাৎ ভেন্টিলেটর এর দিকে চোখ যায়। আমি ওখানে হাত দিতে একজোড়া চোখ দ্রুত সরে যায়। আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি করে বাইরে বেড়িয়ে আসি। কিন্তু ততক্ষণে রিয়ান আমার ঘরে চলে আসে। আমি তখন পোশাক পুরোপুরি পরতেও পারিনি। রিয়ান এসে আমাকে এই অবস্থায় দেখে ওর মধ্যে পশুত্ব জেগে ওঠে। বিছানার পাশে থাকা তোয়ালে দিয়ে আমার মুখ আর আমার শাড়ির আচল দিয়ে দুইহাত বেঁধে দিলো। আমি চিৎকার করতে পারলাম না। ও জোর করে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। আমি কিছুই করতে পারছিলাম না শুধু চোখ থেকে পানি পড়ছিলো।

অবনীকা একটু থামলো। ওর চোখ দুটো চিকচিক করছে পানিতে। আয়ান এক দৃষ্টিতে অবনীকার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। অবনীকা চোখ মুছে আবার বললো,

– রিয়ান চলে যাওয়ার পরে আমি কোনমতে উঠে গিয়ে মাকে সব কথা জানাই। কিন্তু উনি বলেন যে এসব কথা যেন কাউকে না বলি, রিয়ান ছোট তাই একটা ভুল করে ফেলেছে। আমি রেগে গিয়ে বলি যে আমি সবকিছু তোমাকে বলে দিব। প্রয়োজন হলে পুলিশের কাছে যাবো। রিয়ান যে জঘন্য কাজ টা করেছে তারজন্য ওকে শাস্তি পেতেই হবে। এটা বলে ঘর থেকে বের হয়ে আসি। কিন্তু দরজার কাছে আসতেই কেউ আমার মাথায় খুব জোরে আঘাত করে। পেছনে ঘুরে দেখলাম মা। তারপর তারা দুজন মিলে আমাকে ইট দিয়ে থেতলে দেয় পুরো মুখ। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।

– তাহলে তুমি বেঁচে গেলে কি করে?

– যখন জ্ঞান ফিরলো তখন জানতে পারি সেদিন রাতে আমাকে একটা দম্পতি বাঁচায়। ওরা আমাকে ওভাবেই রাস্তার ওপরে ফেলে দেয় যাতে এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দেয়া যায়। পরে তারা আমাকে উদ্ধার করে হস্পিটালে নিয়ে যায়। মুখটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়াতে প্লাস্টিক সার্জারি করাতে হয়। ওনাদের কাছে আমার কোন ছবি ছিলো না। তাই ডক্টর আমার মুখটা আগেরমতো করতে পারেনি।

– তাহলে আমরা যে লাশ দেখেছিলাম সেটা কার?

– আমাকে যিনি পান উনি একজন ডক্টর ছিলেন। সেই রাতেই একটা বেওয়ারিশ লাশ আনিয়ে তাকে আমার পোশাক পরিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখেন। কারণ তিনি তোমার মা আর ভাইকে দেখেছিলেন আমাকে রাস্তায় ওভাবে ফেলে রাখতে। তাই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার সাথে কোন অন্যায় হয়েছে। পরে উনি আমাকে নিজের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দেন। আমি সুস্থ্য হওয়ার তিন মাস পরেই জানতে পারি আমার মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে যার চিকিৎসা তুমি করাচ্ছো। তারপর থেকে প্রতিদিন মায়ের সাথে দেখা করি।

– তাহলে তুমি প্রতিশোধ নিতে এসেছো?

– অর্ধসত্যি এটা। আমার ঘর, আমার সংসারে আমি ফিরে এসেছি। কিন্তু তোমার মা আর ভাই যা করেছে তাতে তাদের শাস্তি প্রাপ্যই ছিলো। আমি চাইলে তাদের মেরে ফেলতে পারতাম, কিন্তু সেটা কম হয়ে যেত। একজনকে অন্ধ আরেক জনকে মানসিক রোগী বানিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছি। এইজন্যই অবনীকা সেজে এসেছি। কখনো এটা বুঝিয়েছি আমি অবনী, আবার কখনো এটা বুঝাতে চেয়েছি আমার ভেতরে অবনীর আত্মা আছে।

– আয়ান, সেদিন যদি আমি সেই ভালো মানুষ টার হাতে না পড়তাম তাহলে হয়তো ওখানেই মরে যেতাম। আর এতবড় সত্যিটা তুমি কখনো জানতেই পারতে নাম গল্পটা অন্য রকম হতো।

অবনী কাঁদছে। আয়ান নিচে বসে পড়লো। এমন কিছু ঘটে গেছে যে তাতে ও কাউকে কিছু বলতে পারছে নাহ। অবনীকে কি বলবে ওর সাথে তো অন্যায় হয়েছে। আর মা আর ভাইকেই বা কি বলবে? ওরা তো নিজের মা আর ভাই!

আয়ান চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। অবনী আয়ান এর পাশে বসে পড়লো। ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,

– তুমি নিজেকে অপরাধী মনে করো না। আমি জানি এতে তোমার কোন দোষ নেই। বরং তুমি এখনো সেই আমাকে ভালোবাসো। তুমি আমাকে ঠকাও নি।

আয়ান অবনীকা কে জড়িয়ে ধরলো।

রাতে খাবার টেবিলে বসে অবনী সবাইকে সত্যিটা জানিয়ে দিলো। আয়ান এর মা তার কাজের জন্য খুব লজ্জিত হলো। তবে এ কদিনে যে শাস্তি পেয়েছেন তাতে তার পাপের বোঝা কিছুটা হালকা মনে হচ্ছে। আর রিয়ান ও তার কাজের জন্য অনেক বড় শাস্তি পেয়েছে। পরদিন সকালে আয়ান এর বাবা পুলিশকে খবর দিলেন। রিয়ান এর মায়ের ৭ বছরের জেল হলো আর রিয়ান এর ১৪ বছরের। যদিও আয়ান এর খুব কষ্ট হিয়েছে। কিন্তু অপরাধী যে-ই হোক না কেন তাকে তো শাস্তি পেতেই হবে।

একদিন খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে আয়ান বললো,

– আচ্ছা অবনী তুমি ভূতের মতো সাজলে কিভাবে??

– আয়ান আমি দুই বছর ধরে তোমার থেকে দূরে ছিলাম। অনেকটা সময় পেয়ে গেছি ভয় দেখানো শ্রখার জন্য। শব্দগুলো তো মাইক্রো স্পিকার দিয়ে করতাম, যেটা আমার ফোনের সাথে কানেক্টেড ছিলোম প্রত্যেকের বাথরুমে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। যখন খুশি চালাতাম। আর চোখে সাদা লেন্স লাগাতাম।

– তুমি কবে যেন আমাকেও ভয় পাইয়ে মেরে ফেলবে।

আয়ান আর ওর বাবা হা হা করে হেসে ফেললো। আয়ান এর চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। কিছু পাওয়ার, কিছু হারানোর।

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here