মেঘের_পরে_মেঘ পর্ব ১

ইন্টারভিউতে যাবার দুদিন আগে রাতে নিলুফারের শাশুড়ি বললেন,”আমার বাড়ির বউ হয়ে থাকতে হলে কোনো চাকরি করা যাবে না,আর চাকরি যদি করতে হয় সংসার ছাড়তে হবে তোমার।”

শাশুড়ির কথা শুনে নিলুর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো।মাথা ঝিমঝিম করছে যেনো।
জবাবে কী বলবে সে?
সে কী বলবে যে আপনার তো স্বামী আছে, চার ছেলে আছে রোজগার করার মতো ,তাই আপনি জানেন না সংসারে অভাব কাকে বলে,আমার মায়ের মতো যদি ঘরে ৪টা মেয়ে থাকতো,বিধবা হতেন তবে বুঝতেন সংসারে অভাব কাকে বলে?

গলায় কাঁটার মতো বিঁধে থাকা কান্নার জন্য নিলু বলতে পারে নি কিছু।

শাহেদ বাসায় ফিরলো রাত ৯টায়।বাজারে ওর একটা কনফেকশনারি আছে।বাসায় এসেই চড়া গলায় নিলুকে ডাকতে শুরু করলো।শাহেদের গলার আওয়াজ পেয়ে নিলুর অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো।নিলু জানে এখনই ওর শাশুড়ি ফুঁসতে থাকবেন রাগে।

শাহেদ ঘরে ঢুকেই নিলুকে বললো,”তাড়াতাড়ি এক কাপ চা দাও নিলু,আমি চেঞ্জ করে নিচ্ছি এই ফাঁকে। ”

নিলু মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরের দিকে গেলো।চা বানিয়ে কাপে নিবে সেই মুহুর্তেই ঘরে বিস্ফোরণ ঘটলো যেনো।
শাশুড়ির চিৎকারে নিলুর হাত থেকে চা’য়ের পাতিল পড়ে গেলো।
নিলু জানে উনি এখন কি বলবেন। ভয়ে,লজ্জায় নিজের দু’কান চেপে ধরলো নিলু যাতে ওনার কথাগুলো শুনতে না পায়।

কিন্তু নিস্তার পেলো না,রান্নাঘর থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলো শাশুড়ি বলছেন,”একে তো বাঁজা মেয়ে,তার উপর এখন আধিখ্যেতা দেখাচ্ছে চাকরি করবার,আরে তোর বউয়ের এসব রংঢং কি আমি বুঝি না ভাবস তুই?”

শাহেদ কাতর স্বরে আবেদন করে বললো,”আল্লাহর দোহাই লাগে মা,আস্তে কথা বলো।নিলু শুনতে পেলে কষ্ট পাবে খুব।ওকে বাঁজা বলো না তুমি,তোমার পায়ে পরি।ডাক্তার বলেছে ওর কোনো সমস্যা নেই,বাচ্চা হতে এমনিতেই দেরি হচ্ছে।আর চাকরি করতে আমি ওকে নিষেধ করে দিব মা,তবুও ওকে নিয়ে এসব কথা বলো না।ওর চরিত্র নিয়ে আঙুল তুলো না।আমার নিলু এরকম মেয়ে না।”

“হ,তোর নিলু তো দুধে ধোঁয়া তুলসীপাতা,এখন কি আমার তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালানো লাগবো?
এই বাঁজা মাইয়ারে আমার শুরু থাইকাই পছন্দ না,তুই কি দেইখা দেওয়ানা হইলি আমি বুঝি না।বিয়ার ৩ বছর হইছে এখনো বাচ্চা দিতে পারে নাই।তারে আবার আমার সম্মান দিয়া কথা কইতে হইবো এখন?তার ভয়ে আমারে বিলাইয়ের মতন মিউমিউ কইরা কথা কইতে হইবো?
তোর বউ কি প্রিন্সেস ডায়না নাকি?
এই রেহানা বেগম কাউরে ভয় খায় না,কাউরে কর দিয়া চলে না।”

শাশুড়ির উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দ নিলুর হৃৎপিণ্ড কে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে যেনো।
নিলুর মনে হচ্ছে ও যেনো কোনো পশু,যে বাচ্চা দিতে পারে না বলে এভাবে কথা শোনানো হচ্ছে। নিজেকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে না নিলুর এরকম কথা শুনে।

শাহেদ যেনো কান্না করে দিবে,শাহেদের এরকম অসহায় কণ্ঠ নিলু আগে কখনো শোনে নি।শাহেদ মিনতি করে বলছে,”মা,আমি যদি সন্তান ছাড়াই নিলুকে নিয়ে খুশি থাকতে পারি তবে কেনো তুমি এরকম করছো?
আমার তো কোনো সমস্যা নেই এটা নিয়ে।”

রেহানা বেগম ক্রুদ্ধস্বরে বললো,”তুই তো আর পুরুষ মানুষ নাই রে শাহেদ,তুই তো তোর বউয়ের চাকর হইয়া গেছস,এজন্যই বুঝস না বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া জীবনের কোনো দাম নাই।তাইলে তুই কি করতে দোকান চালাস আমারে ক তো,তুই শাড়ি পইরা বাড়িত থাক,তোর বউয়ের যখন রাস্তায় উঠার শখ,তোর বউ দোকান চালাক।আমার চাইর পোলার মইধ্যে তোর মতো বউয়ের গোলামী কোনো জন করে না।
কতোবার কইরা কইছি আমার ছোট ভাইয়ের মাইয়া সুরমারে বিয়া করনের লাইগা,শুনলি না।মাইয়াডার কপাল পোড়া দেইখাই অল্প বয়সে বিধবা হইছে।তোরে কতো পছন্দ করতো।আমার ভাইয়ের হইলো গিয়া হাত খোলা,পুরা বাড়ি সাজাইয়া দিতো আমার ভাই।বিয়া করতে গেলি এতিম মাইয়া,কি দিতে পারছে ওই মাইয়া এখন তোরে?
বাপের বাড়ি থাইকা একটা সুতাও আনতে পারে না যেই মাইয়া,বাচ্চা দিতে পারে না যেই মাইয়া,তার কতো আধিখ্যেতা আবার।”

শাহেদের এসব অপমান নিলুর সহ্য হচ্ছে না।
মনে মনে আল্লাহ কে বললো,”দুনিয়ায় এতো মানুষের মরণ হয় খোদা,আমার কেনো হয় না?
আমাকে কেনো আজরাইল চোখে দেখে না।আমাকে নিয়ে এই রকম আর খেলো না,আমাকে নিয়ে যাও এই দুনিয়া থেকে।আমার জন্য আমার স্বামীর এতো অপমান হয়,তাকে আর অপমানিত করো না।”

ভিতরে কাঁচের কিছু একটা ভাঙার ঝমঝম আওয়াজ ভেসে এলো।নিলু দৌড়ে নিজের রুমের দিকে গেলো।রুমে গিয়ে দেখে শাহেদ রাগের মাথায় টেবিলের উপর থেকে জগ নিয়ে আছাড় মেরে ফেলে দিয়েছে।রাগে,জিদে শাহেদের মুখ রক্তাক্ত হয়ে আছে।
ভয়ে নিলুর চেহারা পাংশুটে হয়ে গেলো।

নিলুকে দেখার সাথেসাথে রেহানা বেগমের কাঁটা গায়ে যেনো কেউ লবণের ছিঁটা দিলো,ছুটে এসে নিলুর গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে চিৎকার করে বললেন,”বহুত সহ্য করছি তোগো এসব,আর সহ্য করমু না।হয় তুই বান্দীর মাইয়া এই বাড়ি থাকবি,না হয় আমি এই বাড়ি থাকমু।এরকম বাঁজা মেয়েছেলের লগে এক ছাদের নিচে আমি থাকমু না।”

পুরো পৃথিবী যেনো নিলুর চোখের সামনে ঘুরতে লাগলো। কখন যেনো মাথা ঘুরে নিলু পড়ে গেলো বুঝতেই পারে নি।

জ্ঞান ফিরতেই দেখে শাহেদ পায়ের কাছে বসে আছে। নিলুকে উঠে বসতে দেখে শাহেদ মাথার কাছে এসে বসলো।নিলু কিছু বুঝে উঠার আগেই শাহেদ নিলুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
নিলু কিছু না বলে চুপ করে থাকলো।

ভাগ্যে যদি সন্তান না থাকে তবে কে পারে সন্তান দিতে?
আল্লাহ যদি সন্তান না দেয় কার ক্ষমতা আছে সন্তান দেয়ার?
কেনো আম্মা বুঝে না এটা?
নিলু জবাব খুঁজে পায় না এসব প্রশ্নের।

দরজায় কারো টোকা পড়তেই শাহেদ নিলুকে ছেড়ে উঠে গেলো। নিলু বিছানায় হেলান দিয়ে বসে রইলো।

কিছুক্ষণ পর নিলুর ফোনটা বেজে উঠতেই নিলু বিছানা থেকে উঠে গিয়ে ফোন ধরলো।
দেখে মা ফোন দিয়েছে।
নিজেকে সামলে ফোন রিসিভ করলো।

ওপাশ থেকে নিলুর মেজো বোন শিলু বললো,”আপা,কেমন আছিস?”

“ভালো আছি রে,তুই কেমন আছিস শিলু?”

“আপা,আমাকে শিলু বলবি না প্লিজ,শিলু বললে কেমন নিজেকে শেয়াল শেয়াল মনে হয় আমার।”

শিলুর কথা শুনে নিলু হেসে উঠলো।শিলুটা সবসময় কেমন মজা করে কথা বলে।
শিলু বললো,”আপা,আমার টেস্ট পরীক্ষা ও তো শেষ,এইচএসসি ঘনিয়ে এলো,বলছিলাম কি,আমার না ফিজিক্সে একটু সমস্যা আছে,ফাইনালের আগে যদি দুটো মাস প্রাইভেট পড়তে পারতাম আমি।”

শেষের কথাগুলো বলার সময় শিলুর গলা ধরে এলো,নিলু স্পষ্ট বুঝতে পারছে শিলুর চোখ ভিজে উঠেছে।
ওকে অভয় দেয়ার জন্য বললো,”ভাবিস না,পড়িস তুই।আমি ম্যানেজ করে নিবো সব।”

আমতাআমতা করে শিলু বললো,”তোর শাশুড়ি যদি এবারও জানতে পারে তবে….”

শিলু আর কথা শেষ করলো না।নিলুর বুকের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুন আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
মনে পড়ে গেলো দুবছর আগের কথা।শিলুর মেট্রিক পরীক্ষার আগে ও ঠিক এরকম হয়েছিলো,শিলুর হায়ার ম্যাথে প্রব্লেম ছিলো।
শাহেদ কে নিলু বলার সময় ওর শাশুড়ি শুনে ফেলে,আর তারপর উনি যা বলেছেন সেসব কথা মনে পড়লে এখনো নিলুর শরীর শিউরে উঠে।

একটা চাকরি ভীষণ দরকার নিলুর।

শিলুর কথার মাঝেই নিলুর মা সাবিনা বেগম ফোনটা টান দিয়ে নিয়ে নিলো।তারপর নিলুকে বললো,”নিলু,মা আমার,তুই শিলুর কথা পাত্তা দিস না।আমি ওর প্রাইভেটের ব্যবস্থা করবো।তুই ভাবিস না মা।জামাইকে আবার বলতে যাস না।তোর সংসারে আমাদের নিয়ে যেনো অশান্তি না হয়।”

নিলু মনে মনে বললো,”মা তুমি তো জানো না,কি সুখের সংসার আমার,কি সুখে আমি আছি।কিচ্ছু জানো না মা তুমি,কিচ্ছু না।”

#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব: ০১
জাহান আরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here