#মেঘের_পরে_মেঘ
পর্ব:০২
জাহান আরা
শাহেদ রুমে এলো রাত ১২টার দিকে।কেমন বিধ্বস্ত,ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো ওকে।শাহেদের মুখে যেনো আষাঢ়ের মেঘ জমে আছে।
নিলুর মন কু ডাক ডাকতে শুরু করলো। মনে মনে দোয়া ইউনুস জপে যাচ্ছে নিলু।
শাহেদ রুমের দরজা লাগিয়ে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো।নিলু বিছানা থেকে নেমে ছুটে গেলো শাহেদের কাছে।শাহেদের পুরো শরীর অনবরত কাঁপতে লাগলো।
নিলু কিছু বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে এসব।শাহেদ এরকম করছে কেনো?
শাহেদকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কী হয়েছে,শাহেদ নির্বাক হয়ে রইলো।
নিলুর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো নিলুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো।নিলু টের পাচ্ছে শাহেদের চোখের জলে নিলুর ব্লাউজের পিঠের দিক ভিজে যাচ্ছে।আর নিলুর চোখের জলে শাহেদের শার্টের পিছনের দিক।
দুজনেই কাঁদছে।
শাহেদের কান্না থামার পর নিলু শাহেদকে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে তোমার? ”
শাহেদ বললো,”মা রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছে।”
নিলু হতভম্ব হয়ে গেলো শুনে।কি বলছে শাহেদ এটা?
সত্যি সত্যি উনি বের হয়ে গেছে বাড়ি থেকে?
নিলুর কি অপরাধ এতে?
নিলুর চাকরি করতে চাওয়া?
নিলুর সন্তান না হওয়া?
নিলুর বাবার বাড়ি থেকে কিছু দিতে না পারা?
এই দোষ ছিলো নিলুর?
এই দোষের শাস্তি রেহানা বেগমের শাশুড়ির গৃহ ত্যাগ?
শোকের তীব্রতায় নিলু স্তব্ধ হয়ে গেলো।
শাহেদ নিলুর বিবর্ণ মুখ দেখে বুঝতে পারলো নিলুর উপর দিয়ে কী যাচ্ছে। নিজের মায়ের এরকম ব্যবহার দেখে শাহেদ ও হতভম্ব। কিন্তু কি করবে শাহেদ?
মা তো,যা-ই বলুক,মায়ের জন্য সাত খুন মাফ।মা’কে তো আর দোষী বলা যায় না।
শাহেদ মনে মনে ঠিক করলো,আগামীকাল দুজনে গিয়ে মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বাসায় নিয়ে আসবে।
নিলুকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসালো শাহেদ,নিজেও বসলো নিলুর পাশে,তারপর কোমল স্বরে বললো,”বাদ দাও নিলু,মা যখন চায় না তোমার চাকরির জন্য চেষ্টা করতে হবে না।তুমি চাকরির চিন্তা বাদ দাও।”
শাহেদের এই নির্দয়তা নিলুকে হতভম্ব করে দিলো,কাঁপা কাঁপা গলায় নিলু বললো,”কী বলছো তুমি এসব?
তুমি জানো না একটা চাকরি আমার কতো দরকার,বাড়তি ১হাজার টাকা পেলেও সেটা আমার মায়ের জন্য এখন ১ লক্ষ টাকার মতো। আমার তিনটা বোন আছে,ওদের লেখাপড়া,ওদের খরচ,সংসারের খরচ,মা একা একজন রোগা মানুষ, তুমি জানো মা বারোমাস অসুস্থ থাকে,এই শরীর নিয়ে ওনার একার পক্ষে সম্ভব না সংসার চালানো।মায়ের রোজগারের উৎস তো একটাই,বাবার রেখে যাওয়া এক টুকরো জমি।
আমাদের সংসারের এই দুরবস্থা তুমি আগে থেকেই জানো,সেখানে তুমি আমাকে বলছো আমি চাকরি না করতে?”
শাহেদ বিরক্ত হলো নিলুর এরকম কথা শুনে।নিলু এতো নির্বোধ কেনো?
নিলুকে বুঝানোর জন্য বললো শাহেদ,”দেখো নিলু,তোমার আগে নিজের সংসার বাঁচাতে হবে,তুমি এখন ওনাদের পরিবারের কেউ না,এখন তুমি এই পরিবারের বউ,তোমার চিন্তা থাকবে আমাদের সংসার নিয়ে।মা যখন চায় না তখন তোমার চাকরির চিন্তা মাথায় আনার ও দরকার নাই।চাকরি করা মেয়েরা স্বামীদের দাম দেয় না,নিজেকে নিজে অনেক বড় মনে করে,সংসারে মন থাকে না তাদের।মেয়েদের চাকরি হচ্ছে নিজের রান্নাঘর,নিজের সংসার। শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করা,সন্তানের সেবা করা,স্বামীর সেবা করা,এর চাইতে বড় চাকরি আর কি?”
শুকনো হেসে নিলু বললো,”এসব কথা কবে থেকে শিখলে শাহেদ?
আমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে আমার মা,বোনদের প্রতি আমার কোনো দায়িত্ব নেই?
বিয়ের আগে কি আমি তোমাকে বলি নি এসব কথা,না-কি তুমি তখন জানতে না আমার চাকরি করতে চাওয়ার কথা?
তুমি নিজে তখন বলেছিলে আমি চাইলে চাকরি করতে পারবো,কোনো আপত্তি থাকবে না তোমার পরিবার থেকে।এমনকি যেখানে তোমার বড় দুই ভাবী দুজনেই কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করে।”
নিলুর কথা শুনে শাহেদ খুব বিরক্ত হলো।নিলু কবে থেকে এসব ভাগ করতে শুরু করেছে বড় ভাবীদের সাথে শাহেদ ভেবে পেলো না।শাহেদ রেগে গিয়ে বললো,”ভাবীরা দুজন থাকেন স্কুলে,বাসায় মা একা,রাহাতের বউ থাকে বাপের বাড়ি,তাহলে সারাদিন মায়ের সাথে থাকবে কে?
বাসায় কাজকর্ম করবে কে তুমিও যদি চাকরিতে যাও?
রান্নাবান্না,ঘরের কাজ এসব কি মা করবে?
তোমার মায়ের সংসারের জন্য এখন আমার মা’কে দিয়ে কাজ করাতে চাও না-কি তুমি নিলু?”
নিলুর ভীষণ হাসি পেলো শাহেদের কথা শুনে।কষ্টের হাসি।হেসে উঠলো নিলু।
শাহেদ জিজ্ঞেস করলো,”হাসছো কেনো এরকম?”
“তোমার লজিক শুনে হাসছি শাহেদ।”
“কী?”
“তোমার কথার মানে হচ্ছে তোমার ভাবীরা সবাই বড়লোকের মেয়ে,তারা কোনো কাজ করতে পারবে না।তারা চাকরি করবে,বাপের বাড়ি থাকবে।
কেনো?
কারণ তাদের বাবার বাড়ি থেকে খাট,ফার্নিচার,টিভি,ফ্রিজ আনতে পেরেছে।
আমি এতিম মেয়ে,আমার মায়ের সামর্থ্য নেই কিছু দেয়ার,আমি বাঁজা মেয়েও,তাই আমাকে থাকতে হবে দাসীর মতো। শাহেদ একটা কথা বলো তো,তুমি কি আমাকে বউ করে এনেছো,না-কি কাজের মেয়ে এনেছো?”
শাহেদ খুঁজে পেলো না নিলুর কথার কি জবাব দিবে সে?
সে তো এসব ভেবে বলে নি কথাটা।মায়ের কথা ভেবেই বলেছে এই কথা।এসব কথার এই অর্থ বের করবে নিলু,শাহেদ তা বুঝে নি।নিলু এরকম গুছিয়ে জবাব দিবে তাও শাহেদ ভাবে নি।
নিলুর বলা প্রতিটি কথা শাহেদকে তীরের মতো বিঁধলো।বিশেষ করে নিলুর নিজেকে বাঁজা মেয়ে বলা।
শাহেদ কখনোই সন্তান না হওয়াকে নিলুর দোষ দেয় নি।নিলু কেনো তবে এসব কথার মধ্যে সন্তানের কথা টেনে আনলো?
কেনো নিলু নিজেকে বাঁজা বললো?
নিলু কি জানে না শাহেদ এই কথা সহ্য করতে পারে না?
শাহেদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”নিলু,তোমাকে আমি আগেও বলেছি,কখনো সন্তান না হওয়ার জন্য নিজেকে দোষারোপ করবে না,নিজেকে বাঁজা মেয়েছেলে বলবে না,আমার এসব পছন্দ না।আমি সারাজীবন সন্তান ছাড়া থাকতে পারবো তুমি থাকলে,তবে কেনো আমাকে কষ্ট দিতে এই কথাটা বললে নিলু?”
নিলু বললো,”এটুকুতেই এতো কষ্ট হলো শাহেদ?
আর আমি যে উঠতে বসতে এই কথাটা শুনি তখন আমার কেমন লাগে?”
শাহেদ আর কথা বাড়ালো না।প্রসঙ্গ বাদ দিতে বললো,”কাল আমরা মা’কে আনতে যাবো,তুমি গিয়ে মায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বলবে,চাকরি করবে না।দেখবে মায়ের রাগ কমে যাবে।”
নিলু সোজাসুজি জবাব দিলো,”অনেক হয়েছে শাহেদ,আর না।
আমি যাবো না কাল আম্মা কে আনতে,আর আমি এমন কোনো অপরাধ করি নি যে ওনার পা ধরতে হবে আমার।অপরাধ তোমার মা করেছে,বিনা অপরাধে আমাকে থাপ্পড় মেরেছে।
আর আসল কথা হচ্ছে,পরশু আমি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবো।মৃত্যু ছাড়া কেউ আমাকে ঠেকাতে পারবে না।”
নিলুর এরকম চ্যাটাংচ্যাটাং কথা শাহেদের সহ্য হলো না,রেগে গেলো শাহেদ নিলু যখন বললো,সে কোনো দোষ করে নি,দোষ শাহেদের মা করেছে।
নিলুর গালে সজোরে চড় মেরে বললো,”এতো বড় সাহস তোর,আমার সামনে বসে বলছিস আমার মা অপরাধ করেছে,এখনই তোর এতো বাড় বেড়েছে,চাকরি করলে তো তুই ধরা কে সরা জ্ঞান করবি না।”
চড় খেয়ে নিলু চুপ হয়ে গেলো।আর একটা কথাও বললো না।বিছানার এক পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। শাহেদের দেওয়া চড়ে নিলু যে ব্যথা পেয়েছে তারচেয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছে শাহেদের ব্যবহারে। শাহেদ নিলুর গায়ে কখনো হাত তুলতে পারে নিলু কখনো কল্পনা ও করে নি,এরকম রেগে গিয়ে তুইতোকারি করতে পারে তাও নিলু জানতো না।
এজন্য অন্য এক শাহেদ,নিলুর চেনা সেই শাহেদ না।যে শাহেদ গভীর রাতে ঘুমের ঘোরে হাতড়ে দেখে নিলু কোথায়,অন্য বালিশ থেকে তুলে এনে নিজের বুকের উপর শুইয়ে দেয় নিলুকে,তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়,এই সেই শাহেদ না। কিছুতেই না।
চলবে….?