#মায়াবিনী_মানবী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১০
বুজলা, ভালোবাসা জিনিসটা ভাইগ্যে থাকলে চাইরদিকে সুখ আর সুখ দেহা যায়। আর না থাকলে চাইরদিকে সুখের মইধ্যেও দুঃখ ছাড়া আর কিছু খুইজা পাওয়া যায় না।
লিপির কথা জুইঁর কাছে কিছু টা বোধগম্য হলো আবার কিছু টা হলো না।কথাটার মর্ম সে বুঝতে পেরেছে।কিন্তু হঠাৎ করেই এমন কথা কেন বলল সেটা জুইঁর জানা নেই।
আসলে তখন জুইঁ লিপির রুমে একটা কথা জানার জন্য আসে।লিপি মানুষ টা খুব ভালো। তার বহু গুণের মধ্যে একটা গুণ হলো একটু বেশি কথা বলা।কারো সঙ্গে কথার মজলিসে বসলে পেটের সব
কথা উগলে দিবে।এমন মানুষ জীবনে থাকলে একশো ভাগের মধ্যে পঞ্চাশ ভাগ সময় তারা কাজে আসে আর পঞ্চাশ ভাগ অকাজে আসে।মূলত জুইঁ আলআবির সম্পর্কে ই জানতে এসেছে তার কাছে।
লিপির রুমে এসে দেখে লিপি কেবলই পান মুখে তুলছে।জুইঁ কে দেখে পান ভর্তি মুখ নিয়েই একটা হাসি দিলেন।জুইঁও হাসির বদলে তাকে হাসি ফেরত দিল।
জুইঁ ধীর পায়ে এসে লিপির বিছানায় বসে পরল।জুইঁর জানা মতে লিপির সঙ্গে এখন একটু কথা বললেই লিপি গল্পে মশগুল হয়ে যাবে।জুইঁ খুব বুদ্ধি খাঁটিয়ে লিপির সঙ্গে কথা বলতে লাগলো। একপর্যায়ে দুজনই গল্পের জ্বালে আটকা পরতেই জুইঁ লিপিকে জিজ্ঞেস করল…
–আচ্ছা আলআবি ভাইয়া কে কেমন লাগে আপনার? মানে মানুষ হিসেবে?
লিপি পানের শেষ পিকটা ফেলে বলল…
–আমার জীবনে দেহা ভালা মানুষ গুলানির মইদ্যে আলআবি একজন। পোলাডা ভালা আছে। তয় কয়লার মইদ্যে থাকা হিরা মানিক সবাই তো আর দেকবার পারে না।আলআবি হইলো কয়লার মইদ্যে হাইন্দা থাকা হিরা।
জুইঁ মনে মনে শান্তির হাসি হেসে তারপর মুখ টাকে একটু বিকৃত করে নাক ছিটকে বলল…
–নিজের বাবার সঙ্গে ই যে ভালো করে কথা বলে না সে আবার কেমন হিরা?
তখনি লিপি বলে…
বুজলা, ভালোবাসা জিনিসটা ভাইগ্যে থাকলে চাইরদিকে সুখ আর সুখ দেহা যায়। আর না থাকলে চাইরদিকে সুখের মইধ্যেও দুঃখ ছাড়া আর কিছু খুইজা পাওয়া যায় না।
জুইঁ এই কথা টা শোনার পরে বলল…
–আপনার কথার অর্থ তো বুঝতে পারলাম। কিন্তু একথা কেন বললেন?
লিপি একটা দীঘর্শ্বাস ছাড়ল।এই দীর্ঘশ্বাস জুইঁ কে বলে দিচ্ছে -“আমরা চোখে যা দেখি সর্বদা সেটাই সত্যি হয় না।বরং অগোচরে ই হয় সবচেয়ে তিক্ত সত্যির আদান-প্রদান।”
লিপি আনমনে বলে উঠলো…
–আলআবি কি আর এইরম আছিলো?আছিলো না।
জুইঁ লিপির কথা বুঝতে পারল না।তবে এটুকুন ঠাহর করতে পারল যে তার সামনে বসে থাকা তার লিপি আন্টি তাকে আজ হয়তো কোন এক তিক্ত স্বাদ ভরা অধ্যায় পড়ে শুনাবে। জুইঁ লিপিকে উদ্দেশ্য করে বলল…
–তাহলে কেমন ছিল উনি?
লিপি হঠাৎ করেই বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজা ভালো মতো লক করে দিল।তারপর আবার জুইঁর কাছে এসে বসে পরল।জুইঁ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে লিপির দিকে তাকাতেই লিপি বলতে লাগলো…
–আলআবির বাবা মানে সিরাজ খালুরা হইলো তিন ভাই।সিরাজ খালু সবার থেইকা বড়।যশোর এর ওই বাড়িতে তিন ভাই থাকতো এক লগেই।তিন ভাইর আদরের বইন আছিল দিলরুবা। দিলরুবা থাকত ঢাকাতেই।সজল হইলো মাইজ্জা খালুর পোলা।মানে মাসুদ খালুর পোলা।আর ছোড খালু হইল মুর্তজা খালু।হেয় বিয়া শাদির ধারে কাছেও ঘেঁষে নাই।এক্কেবারে ভবঘুরে আছিলো।দিলরুবার মাইয়া হইলো আলো।এগো সক্কলেরই একখান কইরা মাইয়া পোলা।খালি মুর্তজা খালু বাদে।ভালাই চলতাছিল সংসার। সিরাজ খালু যা কইতো তাই হইতো বাড়ির শেষ কথা।
পোলা মাইয়া গুলি বড় হইলো।আলোরা ছুটি পাইলেই বেড়াইতে আইসা পড়ত।শেষবার আলো গেরামে যহন আইছিল তহন আলো পড়ত কেবল ইন্টারে।আলোর বাপ ওবায়দুর ছিলেন পরহেজগার মানুষ। হের পুরা ডা পরিবার আছিল পরহেজগার। আর আলোর দাদিতো দুবার হজ কইরা আসা মহিলা ছিলেন।ইন্টারে উটতে না উটতেই আলোরে বিয়া দেওনের লেইগা আলোর দাদি উইঠা পইরা লাগে।আলোর বাপ তার মায়ের কথায় দিনে চোইদ্দ বার উঠতো আর বইতো।আর তাছাড়া আলোর বাপেও চায় মাইয়া তাড়াতাড়ি বিয়া দিতে।
এদিকে আলআবি, আলো আর সজল আছিলো এক বয়সের পোলাপান। সবগুলিই তহন ইন্টারে উটছে।বুজো না মাইয়া পোলা তো!সজল আর আলো একজন আরাক জনরে পছন্দ কইরা ফেলায়।তয় দুইজনের পেরেম নাকি বাইল্যকালের থেই চলতে আছিলো।আলোর বিয়ার কথা হুইন্না সজল আলআবিরে কয় কোনমতে বিয়া যেন ঠিক না হয়। আলআবি কোন কালেই কাউরে ডরাইতো না।তয় বড়গো ভিষণ সম্মান করতো। এহন যেমন দেহ বাপের লগে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কয় এমন করতো না।আর সক্কলে সিরাজ খালু রে ভয় পাইলেও আলআবি ভয় পাইতো না।
আলো গেরামে যহন আইলো তহন আলোর বাপে সবাইরে ডাইকা কইলো মাইয়ার বিয়া ঠিক করছে।আর তার আম্মা মানে আলোর দাদি নিজে বিয়া ঠিক করছে।এই কথা শোনার পরে আর কেউ কিছু কইলো না।হেইদিন রাইতে আলআবি যাইয়া সিরাজ খালু রে সজল আর আলোর ব্যাপারে সব কিছু ভাইঙ্গা কয়।অনেক কওনের পর সিরাজ সাহেব কইছিল যদি কোন ভাবে পারে তাইলে হে বিয়া ডা আটকাইব।এর মাঝে ই আলোর দাদি বিয়ার দিন তারিখ ঠিক কইরা ফেলায়।আলআবির তহনও বিশ্বাস আছিলো যে সিরাজ খালু কিছু একটা করবো।বিয়ার উপলক্ষে সবাই ঢাকা যায়।
বিয়ার দিন আলো আলআবির কাছে অনেক কাইন্দা কাইন্দা কয় এই বিয়া আলো করতে চায় না।ওইদিন ছাঁদে কিছু একটার লেইগা যাইয়া আমি তিন ভাই বোনরে দেইখা ফেলি আর সব কথাও শুইনা ফালাই।সজল আর আলো একজন আরেক জনের হাত ধইরা কানতাছিল।আলআবি দুইজনের সামনে মূর্তির মতো খাড়াইয়া ছিল।পোলা মাইয়া দুইডার কান্দন দেইখা আমিও হেইদিন কাইন্দা ফালাইছিলাম।
তহন দেহি আলআবি সজল আর আলো রে রাইখাই হনহন কইরা নিচে নাইমা যাইতাছে।আমিও ওর পিছু পিছু গেলাম। যাইয়া দেহি আলআবি সিরাজ খালুর লগে কথা কইতাছে…
–বাবা আমি তো তোমাকে আলো আর সজলের কথা বলেছি।তুমি তাও চুপ আছো কিভাবে? (আলআবি)
–যা হচ্ছে এখানে হতে দাও বাঁধা দিও না।(সিরাজ সাহেব)
–বাবা প্লিজ এমন ভাবে বলো না।সজল এর কষ্ট তুমি দেখতে পাও না?আলোর কষ্ট তুমি দেখতে পাও না?আর বয়সই বা কতো ওর।মাত্রই তো ১৮ তে পা দিল।(আলআবি)
–আলোর দাদি সজলের ব্যাপারে জেনে গিয়েছেন আর আমাকে ওয়াদা করিয়েছেন আমি যেন বিয়ে কোন ভাবে বন্ধ না করি।সেই সাথে তোমার মাসুদ চাচাকেও ওয়াদা করিয়েছেন সে যেন কোন ভাবেই আলোকে তার ছেলো বউ হিসেবে ঘরে না তোলে।(সিরাজ সাহেব)
–ওহ।তার মানে চাচ্চুও জানে ওদের সম্পর্কে? (আলআবি)
–এবাড়ির প্রত্যেকে জানে।আর দয়া করে তুমি বা তোমরা কোন সিনক্রিয়েট করো না।আর তুমি খুব ভালো মতো জানো মাশরুখ পরিবার কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করে না।(সিরাজ সাহেব)
সেইদিন আলআবি আর সিরাজ খালু আরো তর্ক করে।একসময় খালু আলআবির গালে একখান চড় মাইরা দেয়।বিয়া ডা কোন ভাবেই আটকানো যায় নাই। জোড় কইরাই আলোরে বিয়া দেয়া হয়।আলো বিদায়ের সময় কইছিল একটু ওর রুমটা শেষ বারের জন্য দেখব। জীবন্ত মাইয়াডা সেই যে ঢুকলো আর জীবন্ত ফিরতে পারল না।লালশাড়ি পইরা মাইয়াডার লাশ বাইর হইলো।বিয়া বাড়ি চোখের পলকে হইলো মরা বাড়ি।সবাইর সামনে আলআবি হেইদিন কইছিল…
–প্রেম ভালোবাসা অন্যায় বলে মনে হয় কেন আপনাদের কাছে। একটা মেয়ে একটা ছেলে কে কেন ভালোবাসতে পারবে না?আরে যেখানে সামান্য খাবার খেতে গেলে খাবারটা ভালো না লাগলে তা না খেয়ে অন্য খাবার প্লেটে তুলে নেই খাওয়ার জন্য সেখানে একটা মেয়ে যাকে ভালোবাসে না তার সাথে কি করে সারাজীবন থাকবে?খাবারের মতো সে তো আর তার স্বামী কে পাল্টাতে পারবে না।মেয়ের জন্য এতোই যখন চিন্তা তখন মেয়ের সুখ নিয়ে একফোঁটা চিন্তা কারো নেই কেন?আলো চলে গেছে এখন আর চিন্তা করতে হবে না। চিরতরের জন্য আপনাদের চিন্তা ঘুচিয়ে দিয়ে গেছে। আর চিন্তা করতে হবে না।আর করতে হবে না।
সেই দিন ই আলআবি যশোর আইসা পরে।বাপ পোলার দূরত্ব বাড়তে বাড়তে আইজকা এইখানে আইসা থামছে।ইন্টার এর পড়ালেহা শেষ করোনের পর আলআবি হুট কইরাই ফেরানসে চইলা যায়।আলআবি যাওনের পর সজলর আর মুর্তজা খালু হুট কইরা কই যানি উধাও হইয়া গেছে। কোন খোঁজ খবর নাই।আলআবি দেশে ফিরনের পর একবারের লেইগাও যশোর যায় নাই।সজলের বাপ মাও এহন চট্টগেরাম থাহে।
কথা গুলো বলে লিপি তার ওড়নার আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিলেন।জুইঁ এতক্ষণ একদৃষ্টিতে লিপির দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছিল।লিপির কথা বন্ধ হতে ই জুইঁ তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিল।জুইঁর মনে এখন জমেছে অনেক গুলো প্রশ্ন।জুইঁর মনে হচ্ছে সে এখন প্রশ্নের স্তুপে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে জুইঁ লিপিকে কিছু বলতে উদ্যত হলো আর তখনই দরজায় কেউ কড়া নাড়লো।
চলবে………….
[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক।গল্পের সকল প্রকার চরিত্র, উক্তি কাল্পনিক।অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]
(আসসালামু আলাইকুম,
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা।গল্পটা এখন থেকে রাতে দিব।)