#শ্রাবণ_তোমার_আকাশে
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব___২৬
সকাল দশটার দিকে হঠাৎ সীমা বেগম এসে হাজির শাম্মীর বাসায়। আরাফাত তখন ব্রেকফাস্ট সেরে ডিউটিতে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো। বেলা মন খারাপ নিয়ে ঘরে বসেছিলো। সীমা বেগমকে বাসায় আসতে দেখে শাম্মী খুব খুশি হলো। কত বছর পর দেখা!
‘ভাবি কেমন আছেন?’
সীমা বেগম নিরুত্তাপ গলায় বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ আছি কোনোরকমে। তোমরা কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ!’
সীমা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বেলা নাকি তোমাদের বাসায়?’
আরাফাত হসপিটালের ডিউটিতে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো। কথাটা শুনে সে এগিয়ে এসে পরিচিত হলো সীমা বেগমের সাথে। তারপর বলল, ‘বেলা। মানে আপনার মেয়ে আমাদেরই বাসায় আছে মামানি। ওনি অসুস্থ ছিলেন, এখন ঠিক আছেন।’
সীমা বেগম উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, ‘অসুস্থ ছিল? আমাকে জানাওনি কেন তোমরা?’
শাম্মী উত্তর দিল, ‘ভাই না করেছিলো। আপনি না-কি অসুস্থ। চিন্তা করবেন তাই আর জানাইনি।’
সীমা বেগম অপ্রসন্ন গলায় বললেন, ‘লোকটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। তাঁর অদ্ভুত কান্ডকীর্তিতে দেখবে একদিন হার্ট অ্যাটাক করে মরে যাবো।’
আরাফাত অপ্রশস্ত হাসলো। অতঃপর বলল, ‘মামানি আপনি থাকবেন আমাদের বাসায়। মামার সাথে যোগাযোগ হলে বলে দিব। তাছাড়া আপনারা মা-মেয়ে দুজনেই তো অসুস্থ। এত কেন টেনশন করেন আপনারা, বুঝিনা। জীবনে যা,ঘটার ঘটবেই, দুশ্চিন্তা না করে বিষয়টাকে কীভাবে সামলানো যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করা উচিৎ আমাদের।’
সীমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘টেনশন কি আর বলে কয়ে আসে? এমনিতেই হয়ে যায়। আর দেখো, তোমার মামা যেসব কান্ড করছে এতে কি টেনশন না করে থাকা যায়? এই লোক পাগল করে দিবে আমাদের। কোনো খবর না দিয়ে সে দেশের বাইরে গেছে, আর এই খবর আজকে সকালে আমাকে জানালো। ভাবো, এই লোকের কাজটা কি ঠিক? অনন্ত জানিয়ে তো যাবে!’
আরাফাত বলল, ‘তাও ঠিক।’
শাম্মী বলল, ‘ভাই হলো জেদি লোক।’
‘আমার ডিউটির দেরি হয়ে যাচ্ছে মামানি। আপনি কিন্তু এখানেই থাকবেন। আম্মু আসছি আমি।’ আরাফাত বলল।
আরাফাত যাওয়ার পরে সীমা বেগম শাম্মীকে অনুরোধের স্বরে বলল, ‘বেলা কোথায়? একটু ডেকে দাও না। কতদিন দেখি না মেয়েটাকে!’
‘হ্যাঁ অবশ্যই!’
বেলা একা ঘরে বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি। শাম্মীর মিহি কন্ঠের ডাকে ওর ঘুম ভাঙে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে ড্রইংরুমে আসতেই সোফায় বসে থাকা সীমা বেগমকে দেখে খুব অবাক হলো। সীমা বেগমের চোখের কোন ভরে উঠলো জলকণায়। আলতো হাতে তিনি তা মুছে নেন। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা একে মেয়ের দিকে তাকান। আর নাইমুদ্দীন সাহেব কবে থেকে এতো লুকোচুরি শিখে গেল? ওনি যে বেলার মা তা কি ভুলে গেলো লোকটা, যে অন্যের বাসায় ওকে রেখে গেলো? মেয়ের সাথে সীমা বেগমের দেখা হলো অনেকগুলো মাস পড়ে। সামনাসামনি দেখে সীমা বেগম দমে গেলেন। একী হাল হয়েছে তাঁর মেয়েটার? মলিন চেহারা, চোখের নিচে কালি, শরীর ভেঙে গেছে। হাসি নেই ঠোঁটের কোণে। অসুস্থ চেহারাটা অবলোকন করে সীমা বেগম বেলাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন। বেলা মাকে শান্ত করে সপ্রতিভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘আম্মু তুমি এখানে? ফোন কোথায় তোমার? কাল রাতে কতগুলো ফোন দিলাম, ধরলে না যে!’
সীমা বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ফোন বন্ধ ছিলো। সকালে উঠেই দেখেছি এতগুলো ফোন। নাম্বার চিনি না তাই আর ফিরতি কল করিনি।’
‘ওহ!’
‘তোর আব্বু যে দেশের বাইরে গিয়েছে জানিস?’
‘হুম। শুনলামই তো কাল।’
সীমা বেগম বললেন, ‘তোর আব্বু এটা কোনো কাজ করেছে? এতকিছু ঘটে গেলো আর আমাকে একটা কথা পর্যন্ত বলে নাই। এখন হুট করে বলে সে নাকি দেশের বাইরে। তাও আবার শাইনির চিকিৎসার জন্য!’
বেলা অবাক হয়ে বলল, ‘মানে? আব্বু তোমাকেও বলে যায়নি? তুমি কোথায় ছিলে?’
সীমা বেগম হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি তোর মামার বাড়ি গিয়েছিলাম।’
‘মামার বাড়ি? কেন?’
‘তোর আব্বুর সাথে ঝগড়া হয়েছিল না সেদিন? এরপর প্রেসার ফল করলো রাতেরবেলা। পরদিন রাগ করে বাড়ি চলে যাই৷ তোর আব্বু আমাকে একটা ফোন অবধি করেনি। কিছু জানায়নি!’
‘আমি যে এখানে জানলে কীভাবে?’
‘তোর আব্বু আজ সকালে বড়ভাইয়ের ফোনে ফোন করে সব বলে আমাকে। আমি তো অবাক! শাইনিকে সে মেনে নিয়েছে। প্রতি লাইনে তিনবার করে ওর সুস্থতা কামনা করেছে। হঠাৎ করে তাঁর এতটা পরিবর্তন হলো বুঝলাম না!’
বেলা বিস্মিত হয়ে বলল, ‘সত্যিই?’
‘তা নয়তো কি! আমার তো প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। পরে ভিডিয়ো কলে দেখলাম। আলম ভাইও সাথে ছিলেন। ওনার সঙ্গেও কথাবার্তা হলো দীর্ঘক্ষণ।’
বেলা ঢোক গিলে অসহায় কন্ঠে মা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আর ওনি? ওনার খোঁজ নাওনি? কেমন আছেন ওনি আম্মু?’
সীমা বেগম মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে মুচকি হাসলেন। তারপর ধীর গলায় বললেন, ‘ শাইনি তখন বেডে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো। কথা হয়নি ওর সাথে!’
বেলা কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ভালো আছে তো?’
‘বলেনি আমায়। তৃতীয় থেরাপি দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে শুনলাম।’
বেলা ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল, ‘আমাকে নিয়ে গেলে কি হতো!’
মা-মেয়ের কথা এতক্ষণ মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছিলেন শাম্মী। এবার ওদের কথার মাঝখানে শাম্মী বলে উঠলো, ‘নিজের যা হাল করেছো তারপরে ভাই তোমাকে আর নিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। স্বামীর কষ্ট নিজের চোখের সামনে দেখে সহ্য করতে পারতে না! প্রথম থেরাপির এফেক্টেই নাওয়াখাওয়া ভুলে অজ্ঞান। বাকিগুলোর সময় কি হবে তা চিন্তা করেই ওরা আর সঙ্গে নেয়নি তোমাকে। আমিই বারণ করলাম। আরাফাতের আব্বুও এটাই বললো। একা মেয়েমানুষ, সেখানে অসুস্থ হলে খেয়াল রাখবে কে! তোমাকে সামলাবে না তোমার হাজব্যান্ডকে!’
সীমা বেগম মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন, ‘হুম। সবদিক বিবেচনা করেই তোর আব্বু আর নিয়ে যায়নি তোকে।’
কথাগুলো শুনে বেলার মন থেকে বড় একটা পাথর নেমে গেলো বলে মনে হলো। যাক, শাইনির বিষয়ে কিছু তো তথ্য,জানতে পেরেছে, এটাই বা কম কীসের! এবার অপেক্ষা করার পালা। কিন্তু এখনো মনের ভেতর দুটো প্রশ্ন উঁকি মারছে। এক.নাজনীন বেগম কোথায়? কী অবস্থা তার? বেলা যে এত অসুস্থ ওনি তো একবারও খোঁজটোজ নিলেন না, নাকি নিয়েছেন? দুই.নাইমুদ্দীন সাহেব হঠাৎই শাইনিকে মেনে নিলেন কেন? চিকিৎসার জন্য বাইরে অবধি নিয়ে গেছেন, কিন্তু কেন? যে লোকটাকে ওনি পছন্দই করেন না…
মনের ভেতর প্রশ্নগুলো চেপে রেখে মায়ের সঙ্গে আরও কথাবার্তা বললো বেলা। শাম্মী দুপুরের রান্নার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। সীমা বেগম বেলাকে নিয়ে এখানেই থাকবেন ক’টা দিন। দুজনের শরীর-মনের অবস্থা ভালো নয়। তাছাড়া এখানে থাকলে আরাফাতের কাছ থেকে শাইনির বিষয়ে আপডেট জানা যাবে৷ এজন্যই থাকা। এভাবেই বেশকিছু দিন কেটে গেলো। মা-মেয়ে দুজনেই শাম্মীর বাসায় থাকে। শাম্মীর বর কয়েকদিনের জন্য কানাডা গেছে বলে, বেলাদেরকে বাসায় ফিরতে দিলেন না তিনি। বেলার মনটা সারাক্ষণ শাইনির চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকলেও কেউ ওকে ফোন করে শাইনির খবর দেয় না।আরাফাতের কাছে ফোন দিয়ে সবকিছু বলে, বেলাকে ওর কাছ থেকেই জেনে নিতে হয়৷ যার ফলে
আরাফাতের সঙ্গে বেলার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। অবশ্য বেলা আজকাল বেশ চুপ হয়ে গেছে। শাইনির বিরহে প্রতিটি ক্ষণ বিষের চেয়েও বিষাক্ত মনে হয়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে হৃদযন্ত্রে অদ্ভুত তোলপাড় শুরু হলেও দেখার কেউ নেই। দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে যেদিন শাইনি ফিরবে, সেদিন আচ্ছামত ওর বুক জাপটে পড়ে থাকবে বেলা। কোনোদিন আর ছাড়বে না। চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই ওর৷ বাবা নামক ব্যক্তিটাও ওকে বুঝলো না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের গভীর থেকে।
মাস তিনেক পেরিয়ে গেছে৷ সেদিন এক বৃষ্টিস্নাত সতেজ গোধূলি বিকেল। মন মাতানো রিমঝিম বৃষ্টি নেমেছে বিকেলের প্রথম প্রহরে। তিনতলা বারান্দার ওপর রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি শেষে প্রকৃতির অদ্ভুত সতেজতা মুগ্ধ চোখে দর্শন করছে বেলা। সদ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া পিচঢালা কালো রাস্তাটা চকচক করছে অবিরাম। কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতার গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে শিশিরকণার ন্যায় টুপটাপ ঝরছে বর্ষণের একছাঁট শীতল বৃষ্টি। মন জুড়িয়ে যায় প্রতি মুহূর্তে। বেলার হাতে থাকা সীমা বেগমের ফোনটা করুণ এক সুরে বেজে ওঠলো। বেলা বাইরে থেকে দৃষ্টি নামিয়ে ফোনের দিকে তাকালো। ফোনটা সারাক্ষণই ওর কাছেই থাকে। বড্ড আশা তাঁর, যদি কোনোদিন বেলার বাবা ফোন করে, তাহলে শাইনির খোঁজটা ওনার কাছ থেকে নিয়েই ছাড়বে! কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষিত ফোন কলটি আর আসে না। বাবা ফোন দেয় না। সেজন্য পাহাড়সম একরাশ অভিমান জমেছে বেলার কোমল মনে। কিন্তু এতদিন পর হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে ফোন দেখে বেলা খানিকটা অবাকই হলো বটে। কম্পিত হাত বাড়িয়ে ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকালো, ‘আসসালামু আলাইকুম.. ক কে বলছেন?’
‘ক কেমন আছো ব বেলা ববউউউউ..?’
বেলা কথাটুকু শ্রবণ করেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। ওপাশের ব্যক্তিটির অসুস্থ কন্ঠ ওর বুকে তীরবিদ্ধের মতো আঘাত হানছে৷ বেলা ফুঁপিয়ে ওঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘আ আপনি ক কেমন আছেন?’
ওপাশ থেকে উত্তর এলো, ‘ভ ভালো নেই আমি। তোমাকে ছাড়া এখা…’
তারপর আর কথা এলো না৷ কেউ যেন ফোন নিয়ে নিয়েছে জোর করে। অতঃপর লাইনটি কেটে গেলো। পরবর্তীতে বেলা ট্রাই করলেও কল বারবার কেটে গেলো। সেদিন পুরোদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদলো বেলা। রাতে খেলোও না৷ শাইনি ভালো নেই একথা শোনার পর ওর গলা দিয়ে কী আর খাবার নামবে? কখন শাইনিকে পুরোপুরি সুস্থভাবে নিজের চোখের সামনে দেখতে পারবে? আর কতদিন অপেক্ষা করবে বেলা?
চলবে…ইনশাআল্লাহ! আপনারা মন্তব্য জানান না কেন? খুব বেশি গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে? আপনাদের পছন্দসই বোধহয় হচ্ছেনা তাইনা? ভুলভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।