#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১০ম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
সারাটা রাত্রি নির্ঘুম কেটেছে বাসন্তীর। ভেবেই পাচ্ছে না নায়িমের মতোন ছেলের জীবন এতটা জঘন্য কেটেছে! ছেলেটার মাঝে এত কষ্ট লুকানো এক বিছানায় শুয়েও বুঝতে পারেনি সে।
নিজের পেটে হাত দিয়ে মনে মনে বলে,
“তুই চিন্তা করিস না বাবু। আমি তোর দাদীর মতোন আমি হব না। নিজে শহীদ হয়েও তোকে রক্ষা করব।”
আরও চিন্তা বাসন্তীর। সে তো সাধাসিধে জীবন চেয়েছিল, এত জটিল জীবন নয়। আর সে বিপ্লবীই বা কী করে হবে? এর দ্বারা কী বুঝিয়েছে অনিমেষ? সে যত দূর জানে বিপ্লবীদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে স্পষ্ট, দৃঢ়তা থাকে তাদের মতমতে। বাসন্তীর স্বভাব-আচারণেই এসব নেই। সে কী করে…?
আলোয় ঝলমল করছে চারিধার। রাত্রি ভর নিদ্রাহীন কাটানোর জন্য তন্দ্রাবিষ্ট বাসন্তীর চোখ-মুখ। অস্থির চিত্তে আর শুয়ে থাকতে না পেরে বিছানা থেকে উঠে পড়ে। বিশাল ঘরটা ত্যাগ করে করিডরে হাঁটাহাঁটি করছে সে।
“গুড মর্নিং, ভাবী।”
অনিমেষ চোখ ডলতে ডলতে ঘুম মাখা কণ্ঠে বলে উঠে। বাসন্তী কিছু না বলে মাথা ঝাঁকায়।
“ভালো হয়েছে দেখা হলো। কাল রাতে সব শুনার পর কিছু ভেবেছেন…?”
“কী ভাবব আমি? ভাইয়া, আমি তো এত জটিলতা বুঝি না। মানুষটার কষ্ট লাঘব করতে চাই, একটু ভালো থাকতে চাই স্বামী-সন্তান নিয়ে। কিন্তু কী করে? কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। যার স্বামী তারই সন্তানকে জন্মের সাথে সাথে অন্য জায়গায় ফেলে দেওয়ার পরিকল্পণা করেছে সেই হতভাগা আমি! কীভাবে করব নিজের কপালের লিখন পরিবর্তন!”
বলতে বলতেই সশব্দে কেঁদে দেয় বাসন্তী। মুহূর্ত না পেড়ুতেই সূক্ষ্ম এক ব্যথার সূচনা হয় তার মাঝে। ধীরেধীরে তা যেন মহৎ আকার ধারণ করছে। পেটে হাত রেখেই আর্তনাদ করে উঠে রমণী।
বাসন্তী আর্তনাদ শুনে ঘুম ছুটে যায় বাকি সকলের। অনিমেষ বাসন্তীর শেষ কথা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল, হুট করে চিৎকার শুনে হচকচিয়ে যায় সেও। চৈতালির দরজার সম্মুখেই দাঁড়িয়ে তারা, তাই সে-ই সবার আগে ছুটে এসে ধরে বাসন্তীকে ধরে। নায়িমও এসে পড়ে।
“বসন্ত, কী হয়েছে তোমার? অনিমেষ, চৈতালি কী হয়েছে ওর?”
কাজের মেয়েগুলোও ছুটে এসেছে। তাদের মাঝেই একজন অল্প বয়স্ক মেয়ে উদ্বিগ্ন গলায় উত্তর দেয়,
“ছোটো মালকিনের তো মনে হয় ডেলিভারি সময় এসে পড়েছে। উনাকে হাসপাতালে নিয়ে যান তাড়াতাড়ি।”
নায়িম তাড়াতাড়ি বাসন্তী কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করে। চৈতালি ও অনিমেষও পিছন পিছন নামছে। গাড়ির পিছনের সিটে চড়ে বসে সে বাসন্তীকে নিয়ে চৈতালিও, অনিমেষ গাড়ি ড্রাইভ করছে। কাছের এক হাসপাতালে এসে গাড়ি থামে।
নায়িম গাড়ি থেকে নামতে নিবে তখনই অনিমেষ হাত ধরে নিষেধ সাধে।
“হুতাশে তুই ভুলে যাচ্ছিস তুই কে। তুই ঠিক হয়ে পরে আসি। আমি আর চৈতালি ভাবীকে নিয়ে যাচ্ছি।”
অনিমেষের কথা শেষ হতেই দুজন হাসপাতালের স্টাফ স্ট্রেচার সমেত এসেছে। চৈতালি কোনোরকম বাসন্তীকে ধরে গাড়ি থেকে নামায়৷ অত্যন্ত ব্যথায় বাসন্তীর অবস্থা খারাপ। অনিমেষ ও চৈতালি তাকে ধরে স্ট্রেচারে বসায়৷ স্টাফ সহ তারা দুজন বাসন্তীকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়।
নায়িম নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাদের হাসপাতালে ঢোকা দেখছে। আজ কেন যেন অনুভূতি শূণ্য নায়িমের চোখে বহু বছর পর অশ্রু জমেছে।অসহায়ত্বে জর্জরিত লাগছে। তবুও কেমন শক্ত ভাব চেহারায়, যেন কিছুই হয়নি। নিজের অভিমতকে নিজেই অস্বীকার করছে সে।
“অর্থ, প্রাচুর্য, যশ শুধু আনন্দ, সুবিধা ও সুখ বয়ে আনে না; সাথে আসে সূক্ষ্ম অসহায়ত্ব, অসুবিধা, হারানোর ভীতি, সবকিছু লোকালয়ের আড়ালে রাখার দুশ্চিন্তা।”
____
অনিমেষ, নায়িম ও চৈতালি ওটি এর সামনে দাঁড়িয়ে। সবেমাত্রই ভিতরে ঢুকানো হয়েছে বাসন্তীকে। ভিতর থেকে একজন ডাক্তার ও নার্স বেড়িয়ে এলো চিন্তিত ভঙ্গিমায়।
“পেশেন্টের পরিবারের লোকজন কারা?”
রুক্ষ কণ্ঠ নার্সের।
“আমি। মানে আমি ওর হাজবেন্ড। কী হয়েছে বলুন!” নায়িম এগিয়ে আসে।
“আচ্ছা অসতর্ক লোক তো আপনি! চেকআপ করাননি সময়ে সময়ে? এত কমপ্লিকেশন প্রেগন্যান্সিতে… দেখেন, আপনার উচিত ছিল আরও আগে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে রাখা বা বাসায় রাখলেও এক্সট্রা যত্নে রাখা। যাকগে সময়ের আগেই ডেলিভারি করতে হবে এখনই। তবে এতে বাচ্চার আর পেশেন্টের দুজনেরই রিস্ক থাকবে।”
নায়িম জমে গেছে সব শুনে। কী বলবে বা করবে সে? এমন কী সে দুঃখিত, শোকাহত না কি স্তব্ধ নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না। সে স্বাভাবিক, তবুও কী যেন একটা বিধছে বুকের মাঝে।
অনিমেষ জানে না নায়িমের আড়ালে রাখা চোখ-মুখের প্রতিক্রিয়া শুধু ধারণা থেকেই তাকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু কীসের জন্য সান্ত্বনা পাচ্ছে নায়িম এও নায়িম নিজেই জানে না।
প্রায় ঘণ্টা খাণেক পর সাদা তোয়ালে জড়ানো ফুটফুটে এক বাচ্চা কান্নার সুর তুলে নার্সের কোলে চড়ে বেড়িয়ে এল। নার্স এসে নায়িমের দিকে এগিয়ে ধরল বাচ্চাটিকে।
“এই দেখেন, জান্নাত এসেছে আপনার বাড়িতে। মেয়ে হয়েছে আপনার।”
নায়িম গোল গোল চোখে বাচ্চাটিকে দেখছে। তার আঁখি যুগলে আজ অন্যরকম অনুভূতি প্রবাহিত হচ্ছে। এমন আগে কখনো হয়নি। এ বুঝি পিতৃত্বের সুখ?
“কী নির্মল ও নিষ্পাপ দেখতে! যেন পৃথিবীর কোন মোহ-মায়ার কলুষতা কিংবা ধূলিকণার ছোঁয়া পায়নি ও। আমার পাপিষ্ঠ, মলিন হাত কী ওর যোগ্য! আমি ওর যোগ্য তো? জানি না, জানতে চাইও না। শুধু জানি সর্বক্ষণ, সব পরিস্থিতিতে তোকে আগলে রাখব এই বুকে। রাজকন্যা নয়, সম্রাজ্ঞী হবি তুই খান আর মোস্তফা সম্রাজ্যের।”
কথাগুলো ভাবতেই নার্সের কোল থেকে শিশুটিকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয় সে। মনে পড়ে যায় বাসন্তীর কথা। স্বাভাবিক কণ্ঠেই প্রশ্ন করে,
“বাসন্তী কোথায়? ও ঠিক আছে তো?”
“ওনার অবস্থা তো খুবই গম্ভীর। যদি কাল সকালের মাঝে হুশ না আসে তাহলে ধরে নিতে হবে কোমায় ফল করতে পারে এমন কী মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকবে। আর বাবুকেও আজ অবজারভেশনে রাখতে হবে। প্রিম্যাচ্যুর্ড বেবি, বুঝতেই পারছেন।”
বলে নার্সটি বাচ্চাকে নিয়ে চলে যায়।
নার্সের কথা শুনে নায়িমের মস্তিষ্ক, দৃষ্টিভঙ্গি যেন এবার একবারেই শূণ্য হয়ে পড়ে। যেই মানুষটার মস্তিষ্কে সারাদিন নিত্যনতুন বুদ্ধি, পরিকল্পণা খেলা করত , আল্লাহ আজ এমনই খেল খেলেছে তার চিন্তাশক্তি ও মস্তিষ্ক উভয়ই ফাঁকা হয়ে গেছে।
___
করিডোরে দাঁড়িয়ে জানালার বাহিরে বিশাল আকাশ দেখতে ব্যস্ত নায়িম। লক্ষাধিক তারা কী ঝলমল করছে! তার আচার-আচরণ দেখে কারো বোঝার উপায় হবে না আড়ালে রাখা বেদনা। অনিমেষ এক কাপ কফি এগিয়ে দেয়।
“তোর পছন্দের লাটে নাহলেও খেতে খারাপ না। টেস্ট করে দেখ।”
নায়িম বিনা কথাতেই ওয়ান টাইম কাপটি হাতে নেয়। এক চুমুক পান করে।
“একটা কথা বলি রাগ করিস না। তুই কি এখনো বলবি তুই বাসন্তী ভাবিকে ভালোবাসিস না?”
“ভালোবাসা তো মিস্টার এন্ড মিসেস খানেও কম ছিল না তবুও সময়ের সাথে… ভালোবাসা কী বা কেমন আমি জানি না। বুঝতেও চাই না, বসন্তকে ভালোবাসতেও চাই না। সেটা ফিঁকে হয়, মরিচীকা পড়ে তাতে সময়ের সাথে, ভালোবাসা সঙ্গ ছাড়ে। আমি শুধু জানি আমার জীবনে বসন্ত মানে সুখ, আনন্দ, ভালো থাকা, সকল চাওয়ার পূর্ণতা, আজীবন না পূরণ হওয়া প্রয়োজন।”
“তুই অনেক চিন্তিত ভাবীর জন্য, তাই না? তবে যত যাই হোক তুই নিজেকে সামলে নিবি মাসুম বাচ্চাটার জন্য, ওকে?”
স্মিত হাসে নায়িম।
“কথায় আছে ‘ঘর পুড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ডরায়’। কিন্তু সেই একই গরুর যদি আরেকবার ঘর পুড়ে, তাহলে আর ভয়-ডর থাকে না। সেলিনা হোসেনের ‘কাকতাড়ুয়া’ উপন্যাসের বুধাকে মনে আছে? ধরে নে সেই বুধার চেয়েও পাকানো পুরুষ আমি, যার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ হারিয়েছে, তাও তাদের নিজের ইচ্ছেতে।
ছোটো বেলায় ধাক্কা সামলেছি এখন আর কী! এসব কিছু আমার ক্ষমতার বাইরে না। খালি একটা জিনিসই চাওয়া এখন আমার সন্তান যাতে আমার ভাগ্য না পায়। অথচ, সে সুস্থভাবে জন্ম নেওয়া মানেই নিশ্চিত সে পেতে চলেছে, হয়তো আমার চেয়েও জঘন্য জীবন। যেখানে তার বেঁচে থাকাই বড়ো কষ্টকর হবে।”
তার ধাঁধাময় কথার কিছুই বুঝে উঠতে পারে না অনিমেষ৷ শুধু চিন্তিতই সে। অথচ, এই ছেলের প্রতিটি কথা বলার ভঙ্গিমা ও কণ্ঠ একদম শীতল ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। তবে মানে এগুলোও নায়িমের পরিবার সম্পর্কিত ঝামেলা। কিন্তু কী ঝামেলা তা এখনো ধোয়াশা অনিমেষের কাছে। মানুষটা যে হাজারবার জানতে চাইলেও বলবে না। কিন্তু এখন বড় প্রশ্ন বাসন্তী কি বাঁচবে না কি আত্মগ্লানি আর নিষ্ঠুরতার জীবনে ভাসিয়ে দিয়ে যাবে নায়িমকে?
চলবে…
প্র্যাক্টিকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত গল্প দিতে লেট হলেও ধৈর্য্য রাখবেন আশা করছি। শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া লেট হলেও যতদূর সম্ভব পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।