টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ১১

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||১১তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িম বাসন্তীর অচৈতন্য মুখ খানার দিকে তাকিয়ে আছে। একদিনেই যেন রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে হৃদয় লুভানো এই বসন্ত কুমারী। নায়িম চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রথমদিনের সেই কিশোর বয়সী চেহারা।

“বসন্ত কুমারীর চেহারায় বুঝি হৃদয় আটকে ছিল আমার?” প্রশ্নটা মনে আসতেই পুরনো দিনের সোনালী স্মৃতিতে হারিয়ে যায় নায়িম।

অতীত,
নায়িম সবে মাত্র একটা রেডিওতে আর.জে মাত্র। হুট করেই কিছু নিস্তব্ধকর তথ্য সহিত নিজের সবকিছু ফিরে পায় সে। জানতে পারে তার জীবন কতটা তাণ্ডবী। খান বাড়িতে থাকা খান বংশের ছেলে হিসেবে, এ তার কাম্য নয়। এমন কী বিয়েও তার জন্য নয়, না সন্তান-সন্ততি। যদিও নারীকে ঘৃণা করে সে, কিন্তু তাই বলে সে যে একদম জৈবিক চাহিদা শূণ্য এমন তো নয়।

প্রতিটি পুরুষের একজন নারী দরকার, প্রতিটি নারীর একজন পুরুষ; কারণ মানুষের অনেক ভালো-মন্দ, দুষ্টু-মিষ্টি মানসিক, শারীরিক, সাময়িক, স্থায়ী চাহিদা থাকে যা একমাত্র বিপরীত লিঙ্গের কেউই পূরণ করতে পারে। এই জন্যই তো বিয় নামক পবিত্র সম্পর্ক এত আবশ্যক মানবজীবনে।

নিজের শো শেষ করে অনিমেষের বাসায় হাজির হয় সে। অনিমেষের মামনি সুস্মিতা ঘোষ তাকে দেখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না।

“আন্টি, অনিমেষ কী ঘরে?”

“হুম, তুমি যাও। বাবু ঘরেই।”

নায়িম গম্ভীর মুখ নিয়ে অনিমেষের জন্য নির্ধারিত থাকার ঘরে চলে গেল। সুস্মিতা ঘোষের নিকট ছেলেটাকে বড্ড অদ্ভুৎ লাগে। কেমন এক গম্ভীর চেহারা সর্বক্ষণ, কোনোদিন হায়-হ্যালো পর্যন্ত বলে না।

“ব্রো আই নিড আ গার্ল, হু আই ওন।”

“হোয়াট!” বিস্মিত হয় অনিমেষ। হবে নাই বা কেন? যে ছেলেটা নারীদের ঘৃণ্য চোখে দেখে তার মুখে এমন কথা নিতান্তই অবিশ্বাস্য।

“হোয়াট হোয়াট? আই নিড আ ক্যাম্পেনিয়ন। আই ওলসো নিড আ ফ্যামিলি লাইক ইউ।”

“তাহলে আর কী বিয়ে করে নে। তোর তো হাজার ভক্ত আছে তার থেকে একটাকে… অর ইলজ্ আমি খুঁজব? দ্য হ্যান্ডসাম আর.জে নায়িমের জন্য তো যে কেউ-ই রাজি হয়ে যাবে।”

“উহু, বিয়ে করব বাট করব না। এমন কোনো মেয়ে লাগবে যে টাকা-পয়সা, আরাম-আয়েশ সহ সব মোহ-মায়া মুক্ত। যাকে এসব এখনো ছুঁতেই পারেনি। যে অমলিন, পবিত্র, নিঃস্ব, অজ্ঞাত দিন-দুনিয়া সম্পর্কে। যার পৃথিবী অত্যন্ত ক্ষুদ্র, সেই পৃথিবী হব আমি। যে চল-চাতুরী ভাবনা, দুনিয়াবি সুখের মায়া, নিজের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞাতই নয় এমন মেয়ে লাগবে।”

“তুই তাহলে মঙ্গলে যা মেয়ে খুঁজতে। কারণ এই দুনিয়ায় না পাগলেও নিজের অধিকার ধরতে জানে। আর বিয়ে করবি, আবার করবি না, কেমন আজগুবি কথা?”

“মানে খুব সহজ। সে আমার স্ত্রী হবে পৃথিবীর আড়ালে শুধু আমার ঘরে, সবার সামনে সে কেউ না আমার। বিয়ে করব, তবে ধর্মীয় ভাবে, আইনত নয়। তাই তো এমন মেয়ে লাগবে যে কোনো দিন-দুনিয়ার জ্ঞানই জানে না। নিজ অধিকার দিতে জানে কিন্তু নিতে না। যে এখনো অবুঝ।”

“তবে তো তোর পিচ্চি বিয়ে করা লাগবে। কারব একমাত্র তারাই কিছু বুঝে না। কাল তো এক গ্রামের স্কুলে যাচ্ছিস একটা অনুষ্ঠানের জন্য, তো সেখানেই দেখিদ অমলিন নিষ্পাপ পিচ্চি খুঁজে পাস কি না?” কথাটা নিছক ঠাট্টা করে বলল অনিমেষ। কিন্তু কে জানত এ সত্যি হতে চলেছে?

অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সকাল নয়টাতেই স্কুলে পৌঁছে যায় তারা। মিষ্টি রোদ, শীতল বায়ু, পুকুরপাড় ঘেষেই বিদ্যালয়। গার্লস্ স্কুল ছাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। নায়িম ভেবেছিল গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় খুব বেশি মেয়েরা শহরের মতো উন্মাদনা দেখাবে না তাকে নিয়ে, রেডিও কয়জন গ্রামের মেয়েই বা শুনে? কিন্তু তাকে অবাক করে প্রায় সকল মেয়ে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য, কথা বলার জন্য পাগল ঘেরাও করে তাকে।

বিরক্ত হয় যুবক। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয় প্রতিটি মেয়ের মুখের আজগুবি মেকআপ দেখে। মানে এত জমকালো সাজ, হিল? জোরজবরদস্তির স্মার্ট হওয়ার প্রচেষ্টা। বিয়ে বাড়ি না কি বুঝতে পারছে না নায়িম।

“কোনো শিষ্টাচার নেই না কী! স্কুলে এসব এলাও করে কী করে!” কথাগুলো আপন মনেই বিড়বিড়ায় সে। তখনই চোখ যেয়ে পড়ে দূর থেকে এগিয়ে আসতে থাকা এক মেয়ের দিকে।

মেয়েটার মাথা নত মাথার দুই পাশে দুই বেনি দুলিয়ে দুলিয়ে এগুচ্ছে সে। পরনে সাধারণ স্কুল ড্রেস। মেয়েটি যতই সামনে এগুচ্ছে ততই তার অস্পষ্ট ছবিটি স্পষ্ট হচ্ছে নায়িমের চোখের সামনে। এই মেয়েটি আর কেউ নয় বাসন্তী।

উজ্জ্বল শ্যাম গড়ন, ক্লান্ত ও কোমল ভঙ্গিমা, শীতল চাহনি। ললাট বেয়ে ঘাম ঝরছে দীর্ঘ সময় হাঁটায় হয়তো, ঘর্মাক্ত হাড্ডিসার গোলগাল ভাসা ভাসা চোখ সমেত মুখশ্রীতে অন্যরকম এক প্রশান্তিকর কিছু আছে।

“এই মেয়ে এদিকে আসো?” নায়িম উচ্চ স্বরে বলে।

ভয়ে কেঁপে উঠে বাসন্তী। সে জানে না কে এই লোক। জানবে কীভাবে? রেডিওই শুনার ক্ষমতা আছে তার? তার ভয় হচ্ছে যে সে ভুল কিছু করেছে কি না কিংবা শাস্তি দিবে না তো লোকটি?

“জ-জী, বলেন?”

তার ভীতিগ্রস্ত গলায় কিছু একটা ছিল যা স্পর্শ করে নায়িমকে। হয়তো তার ভীতিই কিংবা অন্যকিছু।
“আমাকে চিনো তুমি?”

মাথা দুবার ডানে-বামে ঘুরায় বাসন্তী। অর্থাৎ, সে জানে না। আর কোনো কথা হয় না তাদের মাঝে সেদিন। তবে নায়িমের জানত এই মেয়েটিই তার কাঙ্ক্ষিত। লোক লাগিয়ে খোঁজ নেয় সে, জানতে পারে তার অসহায়ত্ব৷ একদম নিশ্চিত হয় সে যে এই মেয়েটিকেই তার চাই।

বলতে গেলে বাসন্তী প্রেমে পড়েনি নায়িম কিংবা ভালোও বাসেনি সে, কারণ এ দুটোই হৃদয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু সে বাসন্তীর বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করেছিল অত্যন্ত বুঝে-চিন্তে এবং ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে। নায়িমের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সুর পায় সে বাসন্তীর মাঝে, তার চাওয়াগুলোর পূর্ণতা বাসন্তী। পছন্দ এবং প্রিয় করেছিল সে বাসন্তীকে সেদিন, ভালোবাসেনি।

বর্তমানে,

“এই যে শুনছেন? ভিজিটিং আওয়ার শেষ। আপনি এখন যেতে পারেন।”

নার্সের ডাকে ঘোর ভাঙে নায়িমের। পা নাড়ায় না সে। ধূর্ত চাহনি তার নার্সের দিকে। কাউকে কল করার সাথে সাথেই একজন ওয়ার্ড বয় তাড়ার সাথে কক্ষে ঢুকে।

“সরি স্যার৷ উনি জানত না আসলে।” বলে নার্সটিকে টেনে নিয়ে চলে যায়।

___

“মি.তাহজিব একটা খবর জানানোর ছিল। গায়ক নায়িমের নিজস্ব গাড়িকে একটা হসপিটালের সামনে দেখা গিয়েছে৷ আর সেই গাড়ি থেকে তার অফিশিয়াল উকিল সহ একজন উঠতি যৌবনা নারী এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীকে নামতে দেখা গেছে। তারপর আরেকজন পুরুষও নেমেছে, কিন্তু সে কে চোখ-মুখ ঢাকা থাকায় বুঝা যায়নি। মেয়েটির হয়তো ডেলিভারি ছিল।”
মিনমিন করে বলে তাহজিবের ভাড়া করা লোক।

“হোয়াট! খোঁজ নেওনি কে ঐ দুটো মেয়ে? আর রেকোর্ড করেছে বিষয়টা?”

“জী, স্যার রেকোর্ড করেছি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও খোঁজ নিতে পারিনি। এমন কী রিসিপশনে যেয়ে অনিমেষ ঘোষ আর গায়ক নায়িমের নাম নিতেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে আমায়। টাকা অফার করেছিলাম বলে আরেকবার দেখলে জানে মেরে ফেলবে।”

“ধুর! তোমাদের দিয়ে না কিচ্ছু হবে না! আমাকে ফুটেজটা পাঠাও এখন।”

কল কাট করে দেয় তাহজিব। এত সময়ে বহু বার খুঁজেও ছেলেটার সম্পর্কে একটা আড়ালে থাকা তথ্যও বের করতে পারেনি। যদিও লোকসমাজে ছেলেটা এতিম এবং এতিমখানায় বড় হয়েছে বলে প্রচার। তবে তাহজিবের এ কথা বিশ্বাস হয় না।

ছেলেটাকে অনেক বেশিই ক্ষমতাধারী মনে হয় তাহজিবের। নাহলে এতবার চেষ্টা করেও ছেলেটার সম্পর্কে একটাও খারাপ দিক কী করে না পেতে পারে সে! কোন মানুষ এতটা তুলসি পাতা হয়! আবার তার নিয়োগ করা চারের অধিক মানুষ লাপাত্তা খোঁজ নিতে যেয়ে।

তাহজিব হলো নায়িমের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের দুজনের ক্যারিয়ার একসাথেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু নায়িমের যেখানে অনেক সংঘর্ষ করতে হয়েছে এবং বিভিন্ন পর্যায় হয়ে আজকের এই জায়িগায় পৌঁছিয়েছে। সে সেখানে একজন মিডিয়ার লোককে ঘুষ দিয়ে এক চান্সেই বড়সড় প্রজেক্ট পেয়ে গিয়েছিল।

সাপ-লুডুর খেলায় নিরাব্বইতে যেয়ে সাপের মুখে পড়ে তাহজিব, একদম নিচে নেমে আসে। একের পর এক ফ্লপ দেয়, অপরদিকে নায়িমের প্রতিটি গান এবং শো হিট। নায়িমের বাহ্যিক ব্যক্তিত্বের জন্য জনপ্রিয়তা বাড়ছিল তিনগুণ হারে। সেখান থেকেই হিংসার সূচনা এবং নিচে নামানোর প্রচেষ্টা।

টুং-টুং শব্দে ফোনের দিকে ধ্যান দেয় তাহজিব। ফুটেজটা বেশ খেয়াল করে দেখে সে।

“হোক না হোক এই মাস্ক, ক্যাপ, গ্লাসেস পরা লোকটাই নায়িম।” সন্দেহ মাখা কণ্ঠ নায়িমের৷
নিজের নিয়োগ করা লোকটাকে কল করে তাহজিব।

“হ্যালো।”

“জী, স্যার। ভিডিও পেয়েছেন?”

“হুম, পেয়েছি আর দেখেছিও। শোনো এই ফুটেজটা বিভিন্ন সুনামধন্য নিউস চ্যানেলে পাঠাবে বুঝলে। আর আমি রাখছি এখন।”

কলটা কেটে আপন ভাবনাতেই হাসে তাহজিব।

“মেবি তোর ধ্বংসের কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে দ্য গ্রেট নায়িম!”ক্রোধান্বিত চোখে ব্যঙ্গ করে বলে সে। তবে কি সত্যিই খারাপ সময় আসতে চলেছে নায়িমের?

__

নায়িম খেয়াল করে বাসন্তীর হাত নড়ছে। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরছে তার। নায়িম ছুটে যেয়ে ডাক্তার ডাকে। ডাক্তার এসে চেক-আপ করে বলে,

” শি ইজ ফাইন নাউ।”

ডাক্তার ও নার্স বেড়িয়ে যেতেই বাসন্তী উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু সেলাইয়ের জায়গায় চিনচিনে ব্যথা সহ জন্মদানের দুর্বলতায় তা পারে না, বরং কোঁকিয়ে উঠে ব্যথায়৷

“আরে করছোটা কী?” ধমকিয়ে উঠে নায়িম।

ঔষধের মতো কাজ করে এই ধমক। শান্ত হয়ে যায় বাসন্তী।

“আ-আমার বাবু?”

বাসন্তীর দুর্বল গলায় নায়িমের কণ্ঠও নরম হয়।

“ও সুস্থ আছে৷ অবজারভেশনে রেখেছে এখন। সকাল হলেই আমাদের দিয়ে দিবে।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here