#আলো_আঁধার_১৬
#জেরিন_আক্তার_নিপা
নিজেকে ধাতস্থ করতে আলোর কয়েকদিন সময় লাগল। বাস্তবতা কঠিন হলেও মেনে নিতেই হবে। কান্নাকাটি পাগলামি করে যে বাচ্চাটাকে ফিরে পাওয়া যাবে না। এটা এতদিনে আলোও বুঝে গেছে। জীবনে অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে সে। এতকিছু সহ্য করেও নিজেকে আবার তুলে দাঁড় করিয়েছে। এবারও পারবে। যা হয়েছে আল্লাহ ইচ্ছেতে হয়েছে। নিজের সন্তানের জন্য কষ্ট পেলেও ভেঙে পড়লে চলবে। তবুও যে মাঝে মাঝে মনকে মানাতে পারে না। জীবনের শেষ সম্বলটাকে হারিয়ে গন্তব্যহীন হয়ে পড়েছে আলো। কার জন্য বাঁচবে সে? বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরে ওর জন্য সামনে চলতে চেয়েছিল। ওকে মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে ছিল। এখন তো চোখের সামনে মরুভূমি ছাড়া কিছুই দেখে না সে।
মিসেস আমিনা ছেলের সঙ্গে আলোকে নিয়ে কথা বলেন। মেয়েটাকে এরকম মনমরা দেখতে তারও ভালো লাগে না। মা হয়ে তিনি সন্তান হারানোর ব্যথা বুঝেন। শুভ্রর বাবা যখন উনাকে ছেড়ে গিয়েছিল তখন শুভ্র উনার কাছে ছিল। উনার জীবনের লক্ষ্য। শুভ্রকে বড় করতে হবে৷ ওকে স্বাভাবিক একটা জীবন দিতে হবে৷ নিজের জন্য কিছুই করেননি তিনি। যা করেছেন ছেলের কথা ভেবেই। তখন যদি শুভ্র উনার কাছে না থাকত তাহলে উনারও হয়তো বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে যেত। আলো মেয়েটার তো সেই সম্বলটাও রইল না। বাচ্চাটা থাকলে ও যেভাবেই হোক জীবনে যুদ্ধ করত।
-“মেয়েটা এখন কী করবে কে জানে? স্বামীর কাছে ওই মেয়ে কখনো ফিরে যাবে না। যাওয়াটা উচিতও না। যে স্বামী বউয়ের খোঁজ খবর রাখে না, তার মত মেরুদণ্ডহীন পুরুষ মানুষের ছায়ায় কোন মেয়ে থাকতে পারে না। আলোর উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স নিয়ে নেওয়া। বাচ্চাটাও নেই। এখানেও আর থাকতে চাইবে না আলো।’
-“থাকতে চাইবে না! কেন? কোথায় যাবে ও?’
-“তুমি ওই মেয়েকে বোঝোনি শুভ্র। আমি ওকে যতটা চিনেছে ও কোন সম্পর্ক ছাড়া আমাদের উপর বোঝা হয়ে থাকতে চাইবে না।’
-“কিন্তু ও যাবে কোথায়? বাবা মা’র কাছে?’
-‘ওর বাবা নেই। মা যেহেতু এতদিনেও মেয়ের কোন খোঁজ নেয়নি, তাই আমার মনে হয় মায়ের কাছেও যাবে না সে।”
শুভ্রর কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তায় পড়ে গেল সে। আলো কি সত্যিই ওদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে! চলে যেতে চাইলেও আলোকে তো সে আটকাতে পারবে না। আলোর উপর কি তার কোন অধিকার খাটবে?
-“তুমি ওকে এই বাড়িতেই থাকতে বলো মা। কোথাও যাওয়ার জায়গা না থাকলে, ও একা কোথায় যাবে?
এখনও তো ও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। এই অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে গেলে ওর জন্য ভালো হবে না। আগে একটা থাকার জায়গা, একটা কাজ ঠিক করে নিক। তারপর নাহয় চলে যাবে।’
____________________________________________
দুই মাসে দীপ্ত আলোকে কোথায়, কোথায় খোঁজা বাকি রেখেছে? পুরো ঢাকা শহর তছনছ করে ফেলেছে সে। তবুও আলোর খোঁজ পায়নি। আলোর শ্বশুরবাড়ি, ওর মা’র উপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রেখেছে। আলো যদি তার মা’র সাথে দেখা করতে আসে। দীপ্ত জেনে ফেলেছিল, সেদিন লিজাই আলোকে দীপ্তর সম্পর্কে সব সত্য জানিয়ে দিয়েছে। আর তাইতো বেচারিকে নিজের জীবন থেকে হাত ধুতে হলো। দীপ্তর পথের কাটা হওয়ার আগে ওর অন্তত এক হাজার বার ভাবা উচিত ছিল। দীপ্তর দিন এখন বেশির ভাগই শহরের বাইরে কাটে। আলো যে এই শহরে নেই তা দীপ্ত বুঝে গেছে।
আজও সকাল সকাল বেরুচ্ছিল সে। মা পেছন থেকে ডাকলে দীপ্ত বিরক্ত হয়ে দাঁড়াল।
-“আজও বেরুচ্ছিস তুই? দুইটা মাস ধরে তোর ঠিকমত খাওয়া নেই। ঘুম নেই। গোসল, বিশ্রাম কিচ্ছু নেই। নিজের কী অবস্থা করেছিস তুই দেখ একবার। আয়নায় মুখটা একবার দেখ বাবা। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। গাল ভেঙে চাপার হাড্ডি দেখা যাচ্ছে। কী চাস তুই দীপ্ত? একটা মেয়ের জন্য নিজেকে শেষ করে দিতে চাস? ওই মেয়ে ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন মেয়ে নেই? ওকেই তোর বিয়ে করতে হবে! মেয়েটার আগেও বিয়ে হয়েছে। বাচ্চা হবে। এমন একটা মেয়ের জন্য তোর এমন পাগলামি শোভা পায় না। ওই মেয়ে তোর যোগ্য নাকি?’
-“মা আজ যা বলেছ, বলেছই। এই কথাগুলো নেক্সট টাইম তোমার মুখে শুনতে চাই না। প্রথম দিন বলে ক্ষমা করলাম। কিন্তু একই ভুল দু’বার করলে আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারব না।’
দীপ্তর গলায় এমন কিছু ছিল যে, ওর মা’র গা শিরশির করে উঠল। ছেলেটা পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি? দিনদিন কেমন মানসিক রোগীর মত আচরণ করছে। যাকে তাকে যা ইচ্ছা তা-ই বলে দিচ্ছে। কে গুরুজন, কে আপন? কিচ্ছু মানছে না। সেদিন ওর দাদার মুখে মুখেও তর্ক করল। যে ছেলে কখনো দাদার কথার অবাধ্য হয়নি, সে দাদাকে বুড়ো বলে সম্মোধন করেছে। উনি ছেলেকে বুঝতে পারেন না। তবে ছেলের এমন আচরণ দেখে এটা বোঝা যাচ্ছে, উনার ছেলে আগের সেই স্বাভাবিক দীপ্ত নেই। একটা মেয়ের জন্য ছেলেটা দুনিয়া তুচ্ছ মনে করবে! কী আছে ওই মেয়ের মধ্যে? দীপ্ত কেন আলোর জন্য এমন পাগলামি করছে?
-” দীপ্ত আমি তোর মা। কীভাবে কথা বলছিস তুই আমার সাথে? কোন ছেলে তার মা’র সাথে এরকম ব্যবহার করে!’
-“কোন মা তার ছেলের ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে এরকম মন্তব্য করে?’
-“যা সত্য তা-ই বলেছি আমি। ওই মেয়ের থেকেও হাজার গুণ ভালো মেয়েকে তুই বিয়ে করতে পারবি।”
-“তুমি আমার মা। মা হয়ে তুমি যদি ছেলের মনের অবস্থা না বুঝো তাহলে আমি কী করব বলো? কেউ না বুঝুক তুমি তো তোমার ছেলেকে বোঝার চেষ্টা করবে। তুমিও কেন বাকিদের সুর ধরবে? আমি আলোকে খুঁজে বের করব। ওকেই বিয়ে করব। এতে তুমি আমার সঙ্গ দিবে। আমাকে সাপোর্ট করবে। তা না তুমিও উল্টোপাল্টা বলে আমার মাথা গরম করে দিচ্ছ। তুমি চাও আমি রেগে যাই? চাও নাকি বলো।’
-“দীপ্ত, বাবা আমি কি মা হয়ে তোর খারাপ চাইব! তোকে সুখী দেখতে চাই আমি। আমরা সবাই চাই তুই যেন ভালো থাকিস। তোর কষ্ট তো আমাদেরও কষ্ট বাবা।’
-“না। আমার কষ্ট তোমাদের কষ্ট না। আমাকে কষ্ট পেতে দেখে যদি তোমরাও কষ্ট পেতে তাহলে আমাকে বাধা দিতে না। বরং আলোকে খুঁজতে আমাকে সাহায্য করতে। তোমরা আমার ভালো চাও না। চাইলে এটা বুঝতে আমার সব সুখ আলো। আলোকে ছাড়া আমি সুখী হব কীভাবে?’
তিনি হাল ছেড়ে দিলেন। এই ছেলের প্রতিটা কথা আলোকে নিয়ে শুরু হয়। আবার শেষও হয় আলোকে দিয়ে। আলো ছাড়া যেন আর কিছুই বুঝে না। মেয়েটা যে তার ছেলেকে কী জাদু করল! দেখতে সহজসরল মনে হলেও ওই মেয়ে আস্ত একটা নাগিন। নইলে কেউ কাউকে এভাবে বশ করতে পারে না। দীপ্ত চলে গেলে তিনি বিড়বিড় করে বললেন,
-” আল্লাহ দিক ওই মেয়ে যেন কখনও সুখে না থাকে। আমার ছেলে ওর জন্য যতটা কষ্ট পাচ্ছে, যতটা ভুগছে ওই মেয়েও যেন ততটাই ভুগে। ডাইনী মেয়ে। আমার ছেলেটাকে পাগল করে ছাড়ল। তোর কখনো ভালো হবে না মেয়ে। এই মায়ের অভিশাপে তুই শেষ হয়ে যাবি।’
________________________
শুভ্র আলোর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিল। আলোর সাথে কথা বলতে এসেছে সে। কী বলবে তা জানে না। শুধু জানে, আলো এখানে থাকুক এটাই সে চায়৷ ভেতর থেকে আলোর গলা পাওয়া গেল।
-“কে? ভেতরে আসুন।”
শুভ্র তবুও দরজার সামনে একটু দেরী করে ভেতরে পা দিল। আলো মনে হয় ঘর গোছাচ্ছিল। তাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
-“আসুন। কিছু বলবেন?’
শুভ্র এক মুহূর্ত ভাবল। যা বলতে এসেছে, বলবে? আলো কিছু মনে করবে না তো। কী মনে করবে? মেয়েটার কোন আশ্রয় নেই। শুধুমাত্র আত্মসম্মান দেখিয়ে এখান থেকে চলে গেলে থাকবে কোথায় সে? কোথায় উঠবে? কে ওকে জায়গা দিবে? একা একটা মেয়ে মানুষের সুযোগ সবাই নিতে চাইবে।
আলো কপাল কুঁচকে শুভ্রকে দেখছে। ছেলেটার স্বভাবে মেয়েলি ভাবই বেশি। নইলে ছেলেমানুষ কথা বলতে এত ভয় পাবে কেন? মনে মনে কী এত ভাবছে। আলো আবার বলল,
-“কিছু বলার জন্য এসেছিলেন?’
শুভ্র এবার নিজের কাজে মনে মনে নিজেকে ধমকালো। এত কিসের ভয় তার? যা বলতে এসেছে সোজা বলে ফেলবে। আসলে ভয়টা অন্য কোথাও। তার কথার উত্তরে আলো যদি বলে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আপনাদের বাড়িতে থাকব না আমি৷ সেটা ভেবেই শুভ্র ওদিক দিয়ে গেল না। আলোর ইচ্ছা জানতে না চেয়ে নিজের মনের কথা বলে দিল।
-“মা’র কাছে শুনলাম আপনি নাকি চলে যেতে চাচ্ছেন। এটা আপনার বাড়ি না। একদিন চলে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি চাচ্ছি আপনি এখন না গিয়ে আর কয়টা দিন পর যান। আপনার হাতে কোন কাজ নেই। থাকার জায়গাও নিশ্চিত নয়। এখানে কাউকে চিনেন বলেও মনে হয় না। আত্মীয় থাকলে যদি ওদের বাসায় উঠতে চান তাহলে সেখানে না গিয়ে আমাদের এখানেই থাকা ভালো। এভাবে থাকতে না চাইলে আপনি আমার মা’র শপে কাজ করতে পারেন। আপনার কাজের দক্ষতা দেখেই নাহয় স্যালারি নির্ধারণ করা হবে।’
এক দমে কথাগুলো বলে শুভ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আলোকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। সে মনেপ্রাণে চাইছে আলো এখানে থাকুক।
আলো শুভ্রর কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করল। হ্যাঁ উনি যা বলছিলেন তা ভুল না। আলোর জায়গার কোন জায়গা নেই। হাতে কোন কাজ নেই। সামান্য ইন্টারমিডিয়েট পাস দিয়ে তাকে কে কাজ দিবে? আলো নিজেও কয়টা দিন ধরে এসব নিয়েই ভাবছিল। ওদের উপর বোঝা হয়ে থাকতে নিজের আত্মসম্মানে লাগছিল। এখন যেহেতু শুভ্র নিজেই এই প্রস্তাব দিয়েছে। তাহলে সে ভেবে দেখবে। তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের বিপদ ডেকে আনবে না। একটা কাজ পেলে ঘর ভাড়া করেও থাকতে পারবে।
চলবে___
(