অজানা তুমি পর্ব ৩৩+৩৪

#অজানা_তুমি
#রুবাইতা_রুহি (ছদ্ননাম)
#পর্ব -৩৩

আয়রান চলে গেলো ঔষুধ কিনতে।আমি বেন্ঞের উপর বসে রইলাম।বিভিন্ন ধরণের রোগিদের আনাগোনা।কারো কারো পা কেটে গেছে,কারো হাত ভেঙে গেছে,কারো জ্বর,কারো মাথা ফেটে গেছে,কেউ কেউ প্রেগন্যান্ট এখনই ডেলিভারি করাতে হবে।চিৎকার করতে করতে যাচ্ছে।তখনই কোথা থেকে দাদি এসে আমাকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো।আমি হুটহাট আক্রমনে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।দাদি এখানে কি করে আসলো?ওনাকে খবর কে দিলো?আমি দাদির হাত ধরে নরম গলায় বললাম

-“দাদি তুমি এখানে?কাঁদছো কেন?”

নুরানিও চলে এসেছে পিছন পিছন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে আমাকে জিগ্যেস করলো -“ভাবি!ছোট কোথায় মানে রিদ্রিশ?ওকে নাকি পাওয়া গেছে?কোথাও ও?বলো?কি হলো বলছো না কেন?ছোট কোথায়?”

নুরানির এতো উত্তেজনা থেকে অবাক হয়ে গেলাম।দাদিতো তার মতো কান্না করেই চলেছে।সবার অবস্থা করুণ।এতোবছর পর নিজেদের পরিবারের সবথেকে আদরের ছোট ছেলেকে পাওয়া গেছে।তাও এই অবস্থায়।কি করে তার ওই অবস্থার কথা বলি ওনাদের?থাক যা বলার আয়রান এসেই বলুক।আমি ওদের আশ্বস্ত করে বসতে দিয়ে বললাম

-“আছে আছে।এখন ভালো।ভর্তি করানো হয়েছে।এখন বেডে শুয়ে আছে ভিতরে।জানালার গ্লাস দিয়ে দেখতে পারো।”

দাদি মুখে আচল গুঁজে ফোঁপাতে ফোঁপাতে জানালার সামনে দাঁড়ালো।নুরানি আমার পাশে বসে জোরে জোরে নিংশ্বাস নিচ্ছে।ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম

-“কি হয়েছে তোমাদের বলো তো?এরকম হুরমুর করতে করতে এলে?আর তোমাদের খবরই বা কে দিলো?”

নুরানি আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বললো -“ভাবি কে খবর দিয়েছে সেটা বড় কথা না।বড় কথা হচ্ছে ছোটকে পেয়ে গেছি আমরা।আমার ছোট ভাই।জানো ও আর আয়রান ভাইয়া আমার থেকে বড় তারপরও ওকে ছোটবেলা থেকে ছোট বলে ডাকতাম।কতো খেলেছি আমরা জানো।বদের হাড্ডি ছিলো একটা।জানি না এখন কেমন আছে?কিরকম হয়েছে!কিরকম দেখতে হয়েছে?আমাদের চিনতে পারবে নাকি?জানো দাদিকে সবার থেকে সবথেকে বেশি ভালোবাসতো।”

তারমধ্যে আয়রান ঔষুধের ব্যাগ নিয়ে হাজির।

আয়রান -“তোমরা এখানে?”

নুরানি -“হ্যা চলে এসেছি।ছোটকে নাকি পাওয়া গেছে?”

আয়রান গম্ভীর মুখে “হুম” বলে দাদির কাছে চলে গেলো।দাদির কাধে হাত রেখে ডাক দিলো।

আয়রান -“দাদু!”

দাদি-“হুম?”

আয়রান -“চলো গিয়ে ওখানে বসি।তোমার ছোটদাদু আছে।ডাক্টার পারমিশন দিলে ভিতরে দেখতে যেও!এখন বসো ওইখানে।তোমার না হাটু ব্যাথা?”

দাদি গিয়ে বসলো।ডাক্টার একটুপর ভিতরে যাওয়ার পারমিশন দিলো।কারণ রিদ্রিশের জ্ঞান ফিরেছে।এতে যেনো আয়রানের প্রাণ ফিরে এলো।কিন্তু আপাতত আয়রান যাবে না রিদ্রিশের সামনে কারণ রিদ্রিশ তো ওকে ঘৃণা করে।তাই ভিতরে দাদিই গেলো।আমি আয়রানের কাধ হাত রেখে শান্তনা দিয়ে বললাম -“চিন্তা করো না।সব ঠিক হয়ে যাবে।তোমার সেই ছোট ভাইটাও আবার আগের মতো হবে।তোমাকে ভালোবাসবে।বিশ্বাস রাখো।হুম?”

আয়রান মাথা নিচু করেই হঠাৎ করে আমাকে জরিয়ে ধরলো বুকের ভিতরে।পারলে নিজের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে।কাশতে কাশতে আয়রানের পিঠে হাত বুলাতে লাগলাম।শুধু একটু ভুল বোঝাবোঝির দুই ভাই কতোটা কষ্ট পাচ্ছে তা ভালোই বুঝতে পারছি।একজন এদিকে বসে ছটফট করছে আরেকজন অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে।আয়রানের তো কোনো দোষ ছিলো না।ও তো ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করায় নি।ভুলে হয়ে গেছে।রিদ্রিশকে যদি কেউ এটা বোঝাতে পারতো তাহলে খুব ভালো হতো।যাই হোক এখন আয়রানের মুড চেইন্জ করতে হবে।আয়রানের কাছ থেকে নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে বললাম

-“সবই তো হলো।কিন্তু আমার জামাই তো দুইটা মানে দুইজন একইরকম দেখতে।যদি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় তোমার রুমে না এসে তোমাকে রিদ্রিশ ভেবে ওর রুমে চলে যাই তাহলে কি হবে?আমি নিজেই তো কনফিউজড!”

আয়রান ভ্রু কুঁচকে আমার কোমড় চেপে ধরে বললো -“ভুলেও না।একদম না।শোনো রিদ্রিশের হাতে ট্যাটু আছে নিশ্চই দেখেছো।ওর চুলগুলো উঁচু উঁচু।ওহ আরেকটা উপায় আছে চেনার ওর চোখের মণিগুলো কালো আমার গুলো দেখেছো?ধূসর?চোখ দেখে চিনবে।ভুলেও ওকে আয়রান ভাববে না।তাহলে তোমার খবর আছে বলে দিলাম দুষ্টু মেয়ে!”

আমি হেসে কুটি কুটি হচ্ছি।ভাবতেই অবাক লাগে।ভুল হওয়ার সম্ভাবনা আছে।কারণ দুইজন তো জমজ।

ওদিকে দাদি দরজা ভেদ করে রিদ্রিশের কেবিনে ঢুকলো।আদরের নাতিটার এই অবস্থা দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।রিদ্রিশ বেডের উপরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।হাতে ক্যানোলা লাগানো।সবথেকে পরিচিত কারো উপস্থিতি আর ঘ্রাণ পাওয়ার সত্তেও চোখ বন্ধ করে রইলো।কারণ এই চেহারা নিয়ে দাদির সামনে দাঁড়ানোর কোনো মুখ নেই।বলতে গেলে নিজের কর্মের জন্য একপ্রকার লজ্জা পাচ্ছে সে।উনি রিদ্রিশ ঘুমাচ্ছে ভেবে তার পাশে বসলো আস্তে করে।রিদ্রিশের চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললো -“দাদাভাই আমার!কতো বড় হয়ে গেছে।কি সুন্দর মুখখানা দেখতে হয়েছে।কি সুন্দর নাক,কান,চোখ,মুখ দাদাভাই আমার কোনো হিরোর থেকে কম নয়।দাদাভাই আমাকে মনে আছে তোমার?এইযে তোমার এলিজাবেথ আমি!আমাকে নাকি এলিজাবেথের মতো দেখতে?ও দাদুভাই!একটু চোখ খোলো।দাদু তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো।আর কোনো কষ্ট হবে না তোমার।তুমি আবার আগের মতো ভালো হয়ে যাবে।দাদাভাই আমার!”

রিদ্রিশের সারা মুখমণ্ডলে হাত বুলিয়ে একা একাই বকবক করতে লাগলেন আর চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।কিন্তু উনি তো জানেন না তার স্পর্শে রিদ্রিশের ভিতরে ঝড় উঠে গেছে।রিদ্রিশ পারলে এখনই উঠে তার দাদুকে জরিয়ে ধরে। রিদ্রিশেরও যে খুব কষ্ট হচ্ছে।আজকে প্রায় ৩বছর পর নিজের দাদুকে কাছে পেয়েছে।এমনে প্রতিদিন তাদের বাড়ির সামনে গিয়ে বাগানে যখন তিনি পানি দিতেন তখন দেখতে যেতো।দূর থেকে দেখেই চলে যেতো।আর এখন দাদি কতোটা কাছে।দাদুর আড়ালেই রিদ্রিশের চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।সবার থেকে দাদুই বেশি ভালোবাসে তাকে।মনে মনে বাচ্চাদের মতো নিজেকে শান্তনা দিলো রিদ্রিশ।আচ্ছা আয়রান কি বাইরে তাই জন্য অপেক্ষা করছে?সে কি ওকে একবারো দেখে গেছে?ভাইয়া কি এখনো তাকে আগের মতোই ভালোবাসে?আরে ধুর ভাইয়া তো তাকে ভাই মানেই না।নাহলে এভাবে নিজের মা-বাবাকে, প্রিমাকে মারতে পারতো না।দাদি ওখানেই বসে রইলো রিদ্রিশের হাত ধরে।নাতিকে একা ফেলে যেতে ইচ্ছে করছে না।মনে মনে ভেবে রাখলেন যত তারাতারি সম্ভব রিদ্রিশকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।নাহলে রিদ্রিশ যদি আবার অন্যকোথাও চলে যায়?তাহলে উনি আর বেচে থাকতে পারবেন না।

ওদিকে আয়রান জানালা দিয়ে দাদু-নাতির ভালোবাসা দেখে চলেছে।নিজেকে প্রচন্ড অপরাধী লাগছে তার।

এদিকে আমি বসে বসে ঝিমাচ্ছি।রাত তো কম হলো না।সবাই মনে হয় আজকে এখানেই থাকবে যা দেখছি।আয়রান থাকলে আমিও থাকবো।অবশ্যই থাকবো।এই অবস্থায় আয়রানকে একা থাকতে দেওয়া যাবে না।আয়রানকে পাশে না পেয়ে দেখি মহাষয় জানালার কাছে দুই হাত দাড়িঁয়ে ভিতরে দেখার চেষ্টা করছে।মিটিমিটি হাসতে লাগলাম।ভিতরে একটু যাওয়ার জন্য প্রায় পাগলই হয়ে গেছে।কতোবার যে ঘুরে এসেছে জানালার গ্লাসের কাছে গিয়ে তার কোনো হিসেব নাই।ওর অবস্থা থেকে দূর থেকে ডাক্টার,নার্সরাও হাসছেন।যখনই টের পেলো দাদি বের হচ্ছে তখনই আয়রান দৌড়ে আবার আমার পাশে বসে অন্যদিকে মুখ করে রইলো।দাদি আয়রানকে ইশারা করে ওনার দিকে ডাকলেন।আমি কান পেতে শুনতে পেলাম দাদি আয়রানকে বলছে -“ওই ওকে কবে নিয়ে যেতে পারবো বাসায়?”

আয়রান -“ডাক্টারকে জিগ্যেস করতে হবে।”

দাদি -“তো জা না!এখনই জিগ্যেস কর।”

আয়রান “আচ্ছা” বলে ডাক্টারদের কেবিনের দিকে চলে গেলো।দাদি আবার ভিতরে ঢুকলো।হায় রে!কি করছে এরা?রিদ্রিশকে একটু শান্তিতে ঘুমাতেও দেবে না।মুচকি হাসলাস এদের এতো ভালোবাসা আর যত্ন দেখে।
#অজানা_তুমি
#রুবাইতা_রুহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব -৩৪

আয়রান ফিরে এসে আমাকে বললো -” কালকে সকালেই ওকে নিয়ে যেতে পারবো।

-“ওহ ভলোই হলো।”

-“হুম।কয়টা বাজে?”

-“রাত ৯টা।”

-“এর মধ্যেই এতো বেজে গেছে?”

-“হুম।”

-“তোমরা তো খাও নি কিচ্ছু। দাদিও তো কতসময় হলো এসেছে। আচ্ছা দাড়াও আমি রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসি।”

-“আচ্ছা।”

আয়রান চলে গেলো। রাত তো অনেক হলো আসলেই। দাদি তো এখনো বসে আছে ভিতরে। নুরানি তো এখনও আমার পাশেই বসে আছে। মাথা নিচু করে মুখ গোমড়া করে আর হাত কচলাচ্ছে। বারবার আমি বলেছি এভাবে কষ্ট করে বসে না থেকে বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে। আমরা তো আছি এখানেই। কিন্তু সে তো সেই! যাবে না মানে যাবেই না। আমিও আর জোর করি নি। একটু হাটা দরকার তাই উঠে দাড়িঁয়ে রিদ্রিশের কেবিনের কাছে দরজার ধারে দাড়িঁয়ে দাদিকে তার পাশেই বসে থাকতে দেখলাম। ওই এক ভাবেই মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রিদ্রিশের তো জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্টারই তো বললো। ঘুমিয়ে গেছে মনে হয়। চোখের পাতা তো ঘনঘন নড়ছে। জেগেই আছে হয়তো। দাদির সাথে কথা বলতে খারাপ লাগছে তাই হয়তো ঘুমানোর ভান ধরে বসে আছে। আর ওদিকে আয়রান পাগলের মতো শুধু দৌড়াচ্ছে। একটু পর হাতে দশ প্যাকেট খাবারের বক্স নিয়ে হাজির হলো। আমি জিগ্যেস করলাম

-“এতোগুলো কে খাবে?”

-“কেন?আমরা সবাই খাবো!”

-“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি বেশি এনে ফেলেছো।”

-“রিদ্রিশও তো খাবে। ওতো অসুস্থ। এখন ওকে বেশি বেশি খাইয়ে আবার আগের মতো তরতাজা বানাতে হবে না?”

আয়রানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। বেচারার চেহারার কি হাল হয়েছে এই একদিনেই। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে,চোখের নিচে হালকা কালো কালো দাগ পড়েছে,চুলগুলো উষ্কখুষ্ক,শার্টের বুকের উপরের বোতাম কয়েকটা খোলা।
এতেই বুকের পশমগুলো দেখা যাচ্ছে। আমি আয়রানের সামনে দাড়িঁয়ে বোতামগুলো যত্ন সহকারে লাগিয়ে দিলাম। নুরানি অন্যদিকে তাকিয়েই গলা ঝাড়লো। আমি লজ্জায় সরে গিয়ে খাবার গুলো রাখলাম টেবিলের উপরে। ওহ আয়রানকে জিগ্যেস করতে হবে একটা কথা ভুলেই যাই।

-“আচ্ছা আমরা কি আজকে এখানে থাকবো?”

-“হ্যা আমি থাকবো। তোমাদের রাতে এখানে থাকার দরকার নেই। কষ্ট হবে। আরো এখানে কতো অসুস্থ রোগি আছে। তোমরাও অসুস্থ হয়ে পড়বে। এর থেকে ভালো তুমি নুরানি আর দাদির সাথে বাসায় চলে যাও। রাতটা আমি থাকি। সকালে আবার তোমরা এসো ওকে নিয়ে যাবো।”

কথার মাঝখানেই নুরানি টগবগ করতে করতে করতে বললো -“কে যাবে বাসায়?আমি যাবো না। দাদি আর ভাবি যাক। আমি থাকবো এখানে।”

আয়রান নুরানি মাথায় হাত রেখে বললো

-“বোন তোর ছোট এখানেই নিরাপদে আছে। কোথাও যাবে না আর। দেখ তুই দাদিকে নিয়ে চলে যাবি। দাদিও তো অসুস্থ তাই না বল? এই দুর্গন্ধ, ময়লা জায়গায় থাকলে তো দাদিও অসুস্থ হয়ে যাবে। হুম?বোঝার চেষ্টা কর।”

অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে নুরানিকে রাজি করানো গেলো। নার্সরা রিদ্রিশকে একটি রুমে নিয়ে গেলো। এখানেই থাকবো আমরা। ভিতরে বিশাল বড় একটা রুম। দুইটা বিছানা,বারান্দা,সোফা,এসি,ড্রয়ার,ফ্রিজ সবই আছে। রিদ্রিশকে শোয়ানোর সময় সে চোখ খুলে একবার দাদির দিকে তাকিয়ে ছিলো। পরক্ষনেই আবার শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। এহ!সবার সামনে কিভাবে ভেজা বিড়াল সাজছে দেখো!যেনো এখানের কেউকে চেনে না। ঢং ধরে বসে আছে। আমি আর আয়রান বেরিয়ে গেলাম। নুরানি আর দাদি বসে রইলো রুমে। আয়রানই বারণ করেছে আমাকে যেতে কারণ আমাকে দেখলে রিদ্রিশ উত্তেজিত হয়ে যাবে তাই। দাদি রিদ্রিশকে খাওয়াতে লাগলো। নুরানি বিছানার উপর বসে বসে নিজে ছোট ভাইকে দেখছে। দাদি রিদ্রিশের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো

-“দাদুভাই!হা করো আরো বেশি করে।”

রিদ্রিশ মাথা নামিয়েই হা করলো। আর একটিবারও তাকায় নি কারো দিকে। ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড গিল্টি ফিল হচ্ছে। ওদিকে আমি আর আয়রান হসপিটালের বারান্দায় দাড়িঁয়ে আছি। গ্রিল হাত দুই হাত দিয়ে ধরে বাইরে এক মনে তাকিয়ে আছে। পাশে আমি দাড়িঁয়ে আয়রানের ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছি। আকাশে মিটিমিটি তারা দেখা যাচ্ছে। তখনই দুইটা ছোট লাল গোলাকার আলোকে স্থান পরিবর্তন করতে দেখে বিষ্ময়ে মুখ হা হয়ে গেলো। কি এইটা? লাফিয়ে উঠে হাত গ্রিলের বাইরে বের করে উত্তেজিত হয়ে বললাম -“ওইযে দেখো দেখো লাল লাল কি যেনো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাচ্ছে। কি ওইটা?আগুনের গোলা নয়তো? ওগুলো কি পৃথিবীতে আসছে?”

আয়রান রুহির এতো লাফালাফি দেখে তাকিয়ে দেখলো। তারপর নিজের অজান্তেই রুহির হাত দুইটা আকড়ে ধরে বললো -“হেই হেই!থামো! ওইটা প্লেণের লাইট। রাতে প্লেণ আকাশে উড়ার সময় এভাবে বিভিন্ন কালারের লাইট জ্বলতে থাকে।”

শান্ত হয়ে দাড়িঁয়ে রইলাম। আসলেই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

আয়রান -“শোনো একটু পরে নুরানি দাদিকে নিয়ে চলে যাবে। তুমি যাবে ওদের সাথে?”

আয়রানের দিকে তাকিয়ে দেখি তার কথাগুলো অন্যকিছু ইঙ্গিত করছে।

-“না না!আমি থাকবো তোমার সাথে। তুমি তো থাকবে তাই না?”

আয়রান -“হ্যা আবার জিগ্যেস করতে হয়। তুমি থাকবে আমার সাথে?সিরিয়াসলি? ঘুমাতে পারবে না কিন্তু!”

-“আমি ভেবে চিন্তা করেই বলছি। ওই একদিন না ঘুমালে কিছুই হবে না।”

আয়রান মুচকি হেসে গাল টেনে দিলো। যেনো এতে সে খুব খুশিই হয়েছে। বারান্দার এদিকটা একদম অন্ধকার। এখানে মানুষ নেই একজনও। কয়েকটা লক করা রুম রয়েছে। সেগুলো বন্ধই রয়েছে। তাই এদিকটা একদম পরিষ্কার। বারান্দা দিয়ে সামনে অনেকগুলো বিল্ডিং দেখা যায়। সেগুলো প্রায় বিশ,ত্রিশ তলা হবে।

-“আচ্ছা আমরা কয় তলায়?বলতে পারবেন?”

আয়রান -“হ্যা আমরা চৌদ্দ তলাতে আছি।”

-“ওহ। অনেক উপরে। কিন্তু সামনের এতো বড় বড় বিল্ডিয়ের জন্য বোঝা যাচ্ছে না।”

আয়রান -“হুম।”

-“আচ্ছা আপনি একবারো রিদ্রিশের কাছে যান নি কেনো?”

আয়রান -“কারণ ওতো আমাকে ঘৃণা করে। আর ডাক্টার রিদ্রিশ যাদের ঘৃণা করে তাকে সামনে যেতে নিষেধ করেছে। এতে ও উত্তেজিত হয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই!”

-“ওহ। আপনি রিদ্রিশকে অনেক ভালোবাসেন তাই না?”

আয়রান মাথা নিচু করে হাত পিছনে নিয়ে বারান্দার রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলো। আমার এক কথা শুনে আয়রান সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ভ্রু কুঁচকে বললো -“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

-“নাহ এমনি। বলতে না চাইলে দরকার নেই।”

-“হ্যা ভালোবাসি অনেক ভালোবাসি। আমার ছোট ভাই ও। মা-বাবার পরে ও,নুরানি আর দাদিই তো আমার সবকিছু। আর কেউ নেই আমার। নানাভাই,নানুভাই সেই পাঁচ বছর আছে মারা গেছেন। রিদ্রিশও আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। সারাদিন ব্রো ব্রো করে গলার সাথে ঝুলে থাকতো। আমি যেখানে যাবো সেখানেই যেতো। অফিস ছাড়া। কিন্তু আমি একটু পেটচাপা। এইসব ভালোবাসা,অনুভূতি,আবেগ আমি সহজে প্রকাশ করতে পারি না। সব নিজের ভিতরেই চেপে রাখি। তাই রিদ্রিশ বুঝতো না যে আমিও ওকে ভালোবাসি। তাই মাঝে মাঝেই জিগ্যেস করতো ‘ব্রো তুমি কি বেশি আমাকে ভালোবাসো নাকি নুরানিকে?তুমি একদিনও একটু আমাকে ভালোবাসি ভাই বলো না। তোমার মুখ থেকে অনেক শুনতে ইচ্ছা করে।’। কিন্তু আমি কোনোদিন এই শব্দগুলো ওকে বলতে পারি নি। তাই কোনোদিন বুঝতেও পারে নি। জানো একটা মজার ঘটনা ঘটেছিলো। রিদ্রিশকে যেহেতু আমার মতো দেখতে। তাই একদিন বাবার সাথে অফিসে যাওয়ার জন্য নিজে আমার মতো সেইম কোট,পেন্ট পড়ে বাবার সাথে বেরিয়ে গেছিলো। ওইদিন আমি রাত জেগে কাজ করছিলাম বলে মরার মতো ঘুমাচ্ছিলাম। তো অফিসে গিয়ে রিদ্রিশ কোনো কাজ পারছিলো না। বাবা বুঝে গিয়েছিলো। সেদিন বাসায় এসে সবার বাথরুম পরিষ্কার করিয়েছিলো। বেচারা কয়বার যে বমি করেছে এর জন্য তার কোনো হিসাব নেই।”

বলে আয়রান হাসতে হাসতেই আবার শান্ত হয়ে গেলো। ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আর কোনোকিছু জিগ্যেস করলাম না।

একটুপরে দাদি আর নুরানি চলে গেলো। বলতে গেলে দাদি তো যেতেই চাইছলো না। নুরানি জোরজবরদস্তি করে নিয়ে গেছে। আমি আর আয়রানই রইলাম। রিদ্রিশকে ঘুমের ঔষুধ খাওয়ানো হয়েছে তাই ঘুমাচ্ছে। হসপিটালের সব জায়গার লাইট অফ করে দিয়েছে। রাত হয়েছে এর জন্য। এখন তো ঘুমানোর সময়। রিদ্রিশ ঘুমাচ্ছে বিদেয় আয়রান গিয়ে রিদ্রিশের পাশে বসলো। মন ভরে দেখতে লাগলো নিজের ছোট ভাইকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আয়রান নিজের মনে অজান্তেই বলা শুরু করলো -“কি অবস্থা করেছিস নিজের?এরকমটা কেউ করে?আমাদের কথা একবার চিন্তা করবি না?আমার কথা না একটাবার দাদু আর নুরানির কথা তো চিন্তা করবি। আমি নাহয় তোর শত্রু। কিন্তু নুরানি আর দাদি তো কিছুই করে নি। কেনো এরকম করলি? বল? কেনো?”

বলতে বলতে আয়রানের চোখে পানি চলে এলো। বিছানার উপর বসে আয়রানের কাজকর্ম দেখছি। খুব আফসোস হচ্ছে রিদ্রিশ যদি একটু শুনতে পেতো আয়রানের পাগলামিগুলো তাহলে একটু হলেও রিদ্রিশের মনটা আয়রানের জন্য নরম হতো। ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। রিদ্রিশ নিথরভাবে চিত হয়ে শুয়ে আছে। মুখটা কালো হয়ে গেছে। আয়রান রিদ্রিশের চুলে একমনে হাত বুলিয়েই যাচ্ছে আর নিজে নিজেই বকবক করে যাচ্ছে। আমি নিরব দর্শক হয়ে দৃশ্যটা উপভোগ করছি।

___চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here