অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ৮

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_৮
#সুলতানা_পারভীন

-আজই এভাবে পাগলামি করার কি ছিল বলো তো নিহার? আমি কি পালিয়ে যাচ্ছিলাম কোথাও? নাকি ম্যাডাম ভেবেছেন আবেগের বশে যেভাবে ধরা দিতে এসেছি রাত পোহালে সব ভুলে আগের মতো হাওয়া হয়ে যাবো? হুম? পাগলি মেয়ে একটা!

আবরার বরফ শীতল হাত ছুঁইয়ে চাদর ভেদ করে নিহারের কোমড় জড়িয়ে কথাগুলো বললো। কথাগুলো শেষ হতেই নিহার একটা টু শব্দও করলো না। চুপচাপ চাদরটা গায়ে জড়িয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শোয়ার চেষ্টা করলো। আবরার নিহারের হঠাৎ এমন কাজে একটু অবাক হলো। নিহার উল্টো দিকে ঘুরার আগেই নিহারের কোমড় জড়িয়ে নিজের বুকের উপরে টেন নিল। নিহার আবার একবার ঠোঁট বাঁকিয়ে আবরারের বুকে মাথা রেখে চুপ করে রইলো। আবরার এক হাতে নিহারকে জড়িয়ে রেখে অন্য হাতটা নিহারের চুলের মধ্যে ডুবিয়ে দিয়ে নিহারের চুলগুলো এলোমেলো হাতে যতটুকু মুঠোতে পুরতে পারলো সেটা ধরেই টেনে নিহারের মুখটা নিজের মুখের বরাবর আনলো। নিহার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছে দেখে আবরার এবারে নিহারের নাকে হালকা করে নাক ঘঁষে ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে সরে এলো।

-কি হলো ম্যাডাম? বলো না কেন কিছু? উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছো, ব্যাপার কি? এতেদিন আমাকে চাই বলে পাগল হয়ে গেছ, এখন কাছে পেয়ে আর ভাল্লাগছে না তাই না?

-মারছো কেন? লাগছে তো চুলে?

-আরো মারা উচিত তোমাকে মেয়ে। আমাকে পাগল করে এখন দূরে সরে যাওয়া হচ্ছে না? মানবো না বুঝলেন ম্যাডাম? এভাবে নিজে থেকে কাছে টেনে আবার নিজেই দূরে ঠেলে দেয়া একদম মানবো না।

-কি আর করবো? আমি আপনাকে পাগল বানাচ্ছি, পাগলামি করছি। কিন্তু আপনি তো সেই ফ্রেন্ড হয়েই থাকতে চাচ্ছেন। সেটা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই সরে যাচ্ছি। ছাড়ুন।

-কেন? হাজবেন্ড ওয়াইফ কি ফ্রেন্ড হতে পারে না?

-না পারে না। আর বিয়ের পরে পরপুরুষের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করার মতো রঙ আমার মনে লাগে নি।

-আরে! মানে কি! আমাকে পরপুরুষ মনে হয় তোমার?

-নইলে নিজের বউয়ের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাও কোন লজিকে?

-আচ্ছা বাবা। ভুল হয়েছে। মনে হচ্ছে তুমি আবার সালমান ভাইয়ের ফ্যান। এক লাড়কা অর এক লাড়কি কাভি ভি দোস্ত নেহি হো সাকতে, টাইপের আর কি। থাক বাবা। বন্ধু হতে হবে না। তবু গাল ফুলিয়ে সরে যেও না। বুকেই থাকো।

-দরকার নেই। ছাড়ো। আমি তো পাগলামি করে আপনাকে নিজের করে আটকে রাখতে চাইছি। আর করবো না। প্রবলেম নেই। এতোগুলো দিন অপেক্ষা করেছি দরকার হলে আরো করবো। তবু জোর করে আপনার কাছে আসবো না আর। সরি।

-আরে?! নিহার?

নিহার এবারে নিজেকে আবরারের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। আবরারও আর মূহুর্ত দেরি না করে নিহারকে শক্ত করে পিছন থেকেই জড়িয়ে নিয়ে নিহারের ঘাড়ে নাক মুখ ডুবিয়ে আদুরে একটা কামড় বসালো। নিহার একবার কেঁপে উঠে সরার চেষ্টা করতেই আবরার এবারে নিহারের কানের লতিতে কামড় বসালো।

-আমাকে জেদ দেখানো হচ্ছে ম্যাডাম? পাগলামি করা কাকে বলে এবার আমিই দেখাচ্ছি আপনাকে। তোমার পাগলামি দেখে যা মনে হয়েছিল তাই বলেছিলাম। তাই বলে সামান্য একটা ব্যাপারে এভাবে এতো রাগ করবা? তা তো হবে না ম্যাডাম। তুমি যদি রাগ করতে জানো, তবে তোমার হাজবেন্ডও রাগ ভাঙানোর ওস্তাদ।

-কে কার হাজবেন্ড? আপনি তো আমার ফ্রেন্ড হন। তা কোথায় শুনেছেন যে ফ্রেন্ডকে এভাবে জাপটে ধরে তার রাগ ভাঙায়?

-ফ্রেন্ডস হওয়ার রুলস তো তুমি নিজেই ব্রেক করলে। মানোও না আমাদের নতুন ফ্রেন্ডশিপটা। তাই তুমি যা চাও তাই মাথা পেতে গ্রহণ করলাম ম্যাডাম।

-দরকার নেই আপনার এতো মাথা পেতে নেয়ার। ছাড়ুন। আমি নীলার কাছে থাকবো আজকে। আপনি আরাম করেই ঘুমান।

-তাই? আমার নেশা ধরিয়ে এখন পালানোর ফন্দি আটছ মেয়ে? তা তো হবে না। ছ’সাত বছরের জমা সমস্ত আদর একসাথে চাইছিলে না তুমি? এতো জলদি পালাতে চাইলেই বা দিচ্ছে কে পালাতে? আর এই যে এবার তুমি পালাতে চাইছ তার শাস্তিও তো পেতে হবে। তার সাহস হয় কি করে উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার?

-আবরার? আরে? ছাড়ো না?

-নোওওওও। নো মিন্স নো ম্যাডাম। যতক্ষণ উল্টোদিকে ঘুরে থাকবে ততক্ষণ জ্বালাতন চলবে, চলবেই।

-আরে?

আবরার কথাগুলো বলতে বলতে আবার নিহারের ঘাড়ে ছোট্ট কামড় এঁকে দেয়া শুরু করেছে। নিহারের রীতিমতো অতিষ্ঠ দশা। কোনোমতো ঘুরে আবরারের দিকে ফিরে কটমট করে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আবরারের শক্ত বাঁধনে বন্দি হলো নিহার। নিহারকে কোনো কিছু বলার সুযোগটাও দিল না এবারে আবরার। তার আগেই হারিয়ে গেল ভালোবাসার রঙিন কোনো এক দুনিয়ায়। নিহারও এতোক্ষণে অভিমান ভুলে আবরারের রঙিন ভালোবাসার সাগরে গা এলিয়ে দিয়েছে। এতোগুলো বছর পর নাহয় নতুন করে স্বপ্নগুলো ডানা মেলুক ভালোবাসার আকাশে।

অন্যদিকে, আবছা ছায়ামূর্তিটা বাস্তব নাকি স্বপ্ন সেটা ভাবতে ভাবতেই আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া এঁকে দিলো মানুষটা নীলার ঠোঁট জোড়ায়। নীলা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ঘুম কাটিয়ে চোখ মেলে তাকালো। জিহান! জিহানের মুখটা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নীলা। ছেলেটা নীলার মুখের দিকে আরো কিছুটা ঝুঁকে নীলার ঠোঁটজোড়া নিজের উষ্ণ ঠোঁটের বাঁধনে আটকে নিল। আর সেই স্পর্শে নীলা যেন স্ট্যাচু হয়ে গেছে। এক বিন্দুও নড়ার ক্ষমতাই যেন নেই মেয়েটার এই মূহুর্তে। বাস্তব, স্বপ্ন, ঘুম, ওষুধের ঘোর সব মিলিয়ে কেমন অস্থির লাগছিল এতোক্ষণ। অথচ জিহানের আলতো স্পর্শটা যেন নীলার শরীর থেকে সমস্ত কষ্টগুলোকে শুষে নিতে শুরু করেছে নিমিষেই। এ কেমন অদ্ভুত রকমের অনুভূতি!

-কাল সকালে কি এই স্পর্শটাকে স্বপ্ন ভেবে ভুল হবে মাই ডিয়ার ওয়াইফি? উমমমম। একটা কাজ করা যায় এটা যে স্বপ্ন না সেটার প্রমাণ রাখতে তোমার গলার কাছে একটা লাভ বাইট এঁকে দেয়া যায়। শাওয়ার নেয়ার সময় যখন দেখবে তখন স্বপ্ন না সত্যি সেটা বুঝতে সুবিধা হবে তোমার। কি বলো বউ? ভালো হবে না কাজটা?

-একদম না। তুমি কেন এসেছ? চলে যাও এখান থেকে।

-কি ভাবো বলো তো? তুমি বললেই আমি চলে যাবো? চলে যাওয়ার জন্যেই কি তোমাকে বিয়ে করেছি? এমন একটা বাধা আসবেই জানতাম। তাই তো কাউকে না জানিয়েই কোর্ট ম্যারেজটা করে নিয়েছি।

-এবং আপনার ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপারটাও আমি ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। যেমন আপনি নিজের জীবন থেকে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন।

-তাই। এতো বোকা কেন মেয়ে তুমি বলো তো? কারো সাথে ইন্টিমেট হওয়ার হলে আমি গাধার মতো মেইন ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে দেয়ালে চেপে ধরে—।

-জাস্ট শাট আপ। একটা কথাও শুনতে চাই না আমি আপনার। চলে যান এখান থেকে। নইলে আমি এক্ষুণি সবাইকে ডাকবো। বাবা আর ভাইয়া এসে যদি দেখে আপনাকে এই রুমে——।

-কি আর করা! ডাকো? তোমার হাজবেন্ডকে তুমি যদি মাইর খাইয়ে শান্তি পাও, তাইলে ডাকো? আমি হেল্প করবো সোনাবউ? ওয়েট? শ্বশুরমশাই? আবরার ভাইয়া——।

-যাও এখান থেকে। বের হও।

-নীল? আরে? চলে যাবো তো। তোমাকে এক নজর না দেখে শান্তি পাচ্ছিলাম না। তাই তো ছুটে এসেছি এভাবে বউটার কাছে। সেই কখন খেয়েছি, রাতে খাওয়াও হয়নি। তবু এভাবে তাড়িয়ে দিবে বউটা?

-একদম নাটক করবেন না মিস্টার জিহান। আপনার মুখোশটা না খুলে গেছে।

-কার যে মুখোশ কখন খুলবে টেরই পাবে না। শুধু চমকে উঠবে সত্যিটা জানার পর। একটু শান্ত হয়ে শোনো তো আমার কথাগুলো?

-আপনার আর কোনো নাটকে আমি ভুলবো না জিহান। আরেরকবার বোকাদের দলে নাম লেখাতে পারবো না।

-মানে এখনও আমাকে বিশ্বাস করবে না? ওদেরকেই এতোটা বিশ্বাস? আর আমি? আমি কেউ না তোমার?

————————————————–

-ঠিক আছে। করো না বিশ্বাস। যেদিন সবটা চোখের সামনে দেখবে, সেদিন নিজের ভুলের জন্য পস্তাবে। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।

কথাগুলো বলে আর এক মূহুর্তও অপেক্ষা করলো না জিহান। নীলার বিছানা থেকে উঠে এসে দরজার দিকে পা বাড়ালো। ছেলেটা যে রাগে রীতিমতো ফুঁসছে সেটা আবছা আঁধারিতেও বুঝতে পারছে নীলা। দরজা পর্যন্ত গিয়ে জিহান আবার ফিরে এলো। নীলার দিকে খানিকটা ঝুঁকে নীলার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে ছোট্ট দুটো শব্দ উচ্চারণ করে হন হন করে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। নীলার ঘুম জড়ানো চোখে জিহানের চলে যাওয়ার দৃশ্যটা ধীরে ধীরে আরো আবছা হয়ে আসছে। আর কানে বাজছে শব্দদুটো।

-ভালোবাসি, নীল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here