অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ৭

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_৭
#সুলতানা_পারভীন

-নিহার? জানি আর কারো কাছে জীবনে অপরাধী হই বা না হই, তোমার কাছে আমি আজীবনের অপরাধী। গত ছয়টা বছরে কত শত অভিমান, অভিযোগ জমিয়ে রেখেছ সেটাও জানি। আজ হুট করে সবটা মিটিয়ে নিতে চাইলে কি তুমি হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এক পা এগিয়ে আসবে না নিহার? অতীতের সমস্ত তিক্ত ইতিহাস ভুলে তোমার কোলে মুখ ডুবিয়ে যদি একটু শান্তির আশ্রয় খুঁজে নিতে চাই, তাহলে কি তুমিও আমাকে ফিরিয়ে দিবে? নাকি আমার সমস্ত অন্যায়গুলো, তোমার প্রতি করা অবিচারগুলো পথ আগলে দাঁড়াবে তোমারও? কাউকে ভালোবেসে ঠকেছি তো, ভালোবাসতে হয়তো আর পারবো না কখনো। বন্ধু হয়ে, সহযাত্রী হয়ে পাশে থাকতে দিবে প্লিজ? নাকি অভিমান করে তুমিও দূরে সরে যাবে আমার থেকে? যেমনটা বাকিরা করে সবসময়?

বেশ অনেক রাত পর্যন্ত নীলার রুমে থেকে মেয়েটাকে খাইয়ে দাইয়ে ওষুধ খাইয়ে নিজের রুমে এসে বিছানাটা ঝাড়ায় মন দিয়েছে নিহার। সারাদিনই বলতে গেলে নীলার রুমেই ছিল। সকালের অগোছালো বিছানাটা তাই আবরার যাওয়ার পর থেকেই একইভাবে পড়ে আছে। লোকটা কত রাতে আবার এসে বিছানার এই অবস্থার মধ্যে ঘুমাবে কি করে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই একমনে বিছানা ঝেড়ে বালিশগুলো ঠিক করায় মন দিতেই পিছন থেকে কথাগুলো শুনে চমকে তাকিয়েই আবরারকে দেখে অবাক হলো। অবাক না শুধু, বলা চলে স্তব্ধ বিস্ময়েই তাকিয়ে রইলো নিহার আবরারের মুখের দিকে। ঘড়ির কাঁটায় এগারোটা বাজতে চললো প্রায়। এই সময়ে আবরার কখনোই আসে না। বাড়িতে থাক বা না থাক ভোর হওয়ার আগে রুমের ধারেকাছেও আবরারকে গত ছয় বছরে ঘেঁষতে দেখে নি নিহার। সেটা ওদের বিয়ের প্রথম রাতের কথাই বলুক, বা গতকাল রাতের। তাহলে আজ এই মূহুর্তে লোকটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে কি করে? আর কিসব বলছে? নিহার যা শুনছে সত্যিই শুনছে তো? নাকি লোকটাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছে নিহার! চাওয়া পাওয়ার বিশাল ব্যবধানে কি নতুন কোনো কল্প কাহিনী গড়ছে ওর উত্তপ্ত বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক?! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আবরারকে ওর পাশে বিছানায় বসতে দেখে নিহার প্রায় লাফিয়ে সরে এলো। স্বপ্ন দেখলেও এমন সাংঘাতিক স্বপ্ন সহ্য করার মতো ক্ষমতা নিহারের নেই। কল্পনার ফাঁকে ভুল করেও যদি আবরার চলে আসে তাহলে এর পরিণাম কি হবে সেটা ভাবার দুঃসাহসও নিহারের নেই। অবশ্য নিহার চমকে সরে আসার চেষ্টা করেও বেশিদূরে যেতে পারলো না। আবরার হাত বাড়িয়ে নিহারের একটা হাত চেপে ধরতেই নিহার থমকে দাঁড়িয়ে আবরারের দিকেই তাকিয়ে রইলো। কল্পনা আর বাস্তবতা সব মিলে মিশে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গেছে বেচারির মাথার মধ্যে। তবু যেন আবরারের স্পর্শগুলো অন্য কথা বলে যাচ্ছে নিহারের কানে ফিসফিস করে। কারো হৃদয় চেড়া শব্দগুলো বড্ড বেশিই ভালো লাগছে নিহারের। সাথে একটু ভয়ও হচ্ছে। ঘোরটা কেটে যেতেই যদি স্বপ্নগুলোও হারিয়ে যায়?

-বড্ড বেশিই দেরি হয়ে গেছে না নিহার? ঠিকই তো! আর কতদিনই বা তুমি অপেক্ষার প্রহর গুনবে? কেনইবা গুনবে? কেনই বা অপেক্ষা করবে? তুমি তো চেষ্টা করেছিলে নিজের মতো করে। আমিই তখন তোমাকে সুযোগ দিই নি। আজ নিজে কি করে ক্ষমা পাবো আশা করছি? জীবনসঙ্গী হয়ে থাকা তো দূর, বন্ধু হয়ে কেউ পাশে থাকবে তার যোগ্যও তো আমি নই। নো প্রবলেম নিহার। অযথা মিছেমিছির এই সম্পর্কে তোমাকে আটকে রাখবো না আর। তুমি চাইলে——।

-তুমি কি সত্যি এসেছ আবরার? নাকি নতুন করে স্বপ্নে তোমাকে কল্পনা করার রোগে ধরেছে আমাকে? কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করলে হ্যালুসিনেশন নয়, সেরকম কিছু নয় তো?

এতো টেনশনের মধ্যেও নিহারের প্রশ্ন শুনে আবরার হেসে ফেললো। নিহার অবাক চোখে আবরারের দিকে তাকিয়ে থেকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এসে আবরারের পাশেই বসে আবরারকে ছুঁয়ে দেখলো।লোকটা সত্যিই এসেছে কিনা। আবরার থতমত খেয়ে হাসি থামিয়ে নিহারের হাতটা ছুঁয়ে দিলো।

-আমি সত্যিই এসেছি নিহার। স্বপ্ন না। বড্ড বেশি দেরি করে ফেলেছি হয়তো। তবু এসেছি। তোমার আশ্রয়েই এসেছি। ফিরিয়ে দিও না প্লিজ?

-কত বছরের প্রতীক্ষার পরে তুমি আসলে। আবার চলেও যেতে বলছ? এতোগুলো দিন অপেক্ষা করেছিলাম কি তোমার ‘না চাইলে চলে যেতে পারো’ শোনার জন্য? খুব স্বার্থপর তুমি বুঝলে? এতোগুলো দিন আমি তোমার পথ চেয়ে অপেক্ষা করেছি, আর দু মিনিট তোমার কথার জবাব দিলাম না বলে তুমি চলে যেতে বলতে পারলে?

-সরি নিহার? সরি? এই দেখো? কান ধরছি তো? সরি না প্লিজ?

নিহার একটু ভাব নিয়েই ঠোঁট বাঁকিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করতেই আবরার নিহার হাত টেনে ধরে নিজের কাছে এনে চোখে চোখ রাখলো। নিহার একটু চমকে উঠে আবরারের দিকে তাকাতেই আবরারের জিজ্ঞাসু চোখের দৃষ্টিতে বন্দী হয়ে গেল নিহারের চোখ জোড়া। আবরার আলতো হাতে নিহারের গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিতেই নিহার কেঁপে উঠে আবরারের হাতটা ধরে ফেললো।

-সত্যি নিহার শেষবারের মতো একটা সুযোগ দাও? এতোগুলো বছরের ভুলগুলো শুধরে নিতে চাই আমি। তার জন্য কি শাস্তি দিবে, তাও মাথা পেতে নিতে রাজি আমি। শুধু দিনশেষে সমস্ত ক্লান্তিগুলো ভুলে তোমার কোলে মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমাতে চাই একটু। কত বছর একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারি না আমি জানো? প্রতিটা মূহুর্তে মনে হয় এর চেয়ে বুঝি মরে গেলেই কষ্টটা কম হতো আমার—-।

-ছি! কিসব বলো? আমার মাঝে আশ্রয় খুঁজতে এসেছ? নাকি এসব আজেবাজে গল্প শোনাতে এসেছ রাতদুপুরে? যত্তসব! সরো তো? ঘুম আসছে আমার। তোমার এসব মাঝরাতের বকবক শোনার ইচ্ছে আমার নেই। মরে যাওয়ার ইচ্ছে এতোই যখন তাহলে আবার তোমার সঙ্গী বোতল আর গ্লাস নিয়ে বাগানেই চলে যাও না? আমাকে শোনাতে এসেছ কেন?

নিহার বিরক্ত হয়ে আবার সরে আসার জন্য ছটফট করছে দেখে আবরার নিহারের কোমড় জড়িয়ে আটকালো নিহারকে। মেয়েটা রাগ করে সরে যাওয়ার যত চেষ্টা করছে, আবরারও ততই নিবিড় করে নিহারকে নিজের সাথে বেঁধে নিচ্ছে। নিহার এবারে চোখ পিটপিট করে আবরারের দিকে তাকালো।

-কি সমস্যা তোমার? ঘুম আসছে বললাম না? তোমার মতো এতো রাত জাগার আমার অভ্যেস নেই বুঝলে? সরো এখন। নীলা কি করছে দেখে আসি। মেয়েটা কি করছে কে জানে—–।

-তুমি নিজেই এতো বকবক করে পালাতে চাইছ কেন বলো তো নিহার? আমি তো জাস্ট তোমাকে একটা প্রশ্নই করলাম। সেটার উত্তরটা দিয়ে তারপর যাও? আর তোমার রাত জাগার অভ্যেস আছে কি নেই সেটা গত ছ’সাত বছরে আমার ভালোই জানা হয়ে গেছে। নতুন করে আরো অনেক কিছু জানার আছে অবশ্য। বাট সেটা তোমার আনসারের উপরে নির্ভর করবে।

-এখনও যদি তুমি নিজের প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে থাকো তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই।

-কি আনসার দিলে তুমি?! তোমার মাঝে হারাতে চাইছি শোনার পর তো তাড়িয়েই দিচ্ছ বারবার। এর জন্যই বলে খুব করে যেটা পাওয়ার লোভ হবে, তার ধারে কাছেও ঘেঁষতে নেই। তখন আর তোমার নিজেরই দাম থাকবে না। হুহ।

-একদম ঠিকই বলেছ। খুব করে তোমাকে চাই বলেই এতো দূরে ঠেলে দাও। এখনও ধরা দিতে চেয়েও তোমার তাড়িয়ে দেয়ার কথাটাই আগে মনে পড়ছে।

-আরে?! নিহার?

কথাগুলো বলতে বলতে নিহারের চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোঁটা কান্নার জল গড়িয়ে পড়তেই আবরার ব্যস্ত হাতে নিহারের মুখটা দু হাতে আলতো করে তুলে ধরে চোখে চোখ রাখলো।

-তোমাদের মেয়েদের চোখে এতো পানি কি করে আসে আমি বুঝি না বাবা। কিছু একটা বলা হয়েছে কি হয়নি ওমনি সাগর নদী সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আরে বাবা! কান্নাটা থামাও না এবার? এবার তুমি নিজেই ক্লিয়ার করে বলো কি চাও? তুমি যা চাও তাই হবে এবার থেকে। হ্যাপি?

-আমি সবসময়ই শুধু তোমাকেই চেয়ে এসেছি আবরার। যেদিন প্রথমবার তোমার বাবা আমাদের বাসায় তোমার আমার সম্বন্ধটা নিয়ে কথা বলতে এসেছিল, সেদিন প্রথমবার তোমার ছবি দেখে তোমাকেই চেয়েছি। প্রায় সব আয়োজন করার ফাঁকে তুমি যেদিন জানিয়ে দিলে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো সেদিনও শুধু তোমাকেই চেয়েছিলাম। বাবার বন্ধুর ছেলে হওয়ার সুবাদে তোমার বিয়ের দাওয়াত পেয়ে যেদিন বুকে পাথর রেখে তোমার বরযাত্রী হতে গিয়ে ভাগ্যের ফেরে বউ হয়ে ফিরেছি সেদিনও শুধু তোমাকেই চেয়েছি। বিয়ের পর প্রথম রাতেই তুমি যখন সারারাত একবারের জন্যও রুমে এলে না তখনও শুধু তোমাকেই চেয়েছি। গত ছ’সাতটা বছরে নীল, বাবা, এই সংসার, সব কিছুর মাঝে শুধু তোমার অস্তিত্বটাকেই খুঁজে গেছি। বারবার সেই অস্তিত্বে তোমাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েও হারিয়ে ফেলেছি। তবুও আমার সমস্ত অস্তিত্বে তুমিই মিশে আছো সবসময়।

-সুযোগ পেলেই খোঁটা মারতে হবেই হবে তাই না ম্যাডাম? আপাতত খোঁচা না পেরে নিজের মতামত দিয়ে ফেলুন?

-আপনাকে চাই বুঝলেন? আমার সকাল, বিকেল, সন্ধ্যে, রাতে-প্রতি মূহুর্তে আপনাকে চাই। এতোগুলো বছর যে দূরে দূরে থেকেছেন তার প্রতিটা মূহুর্ত আমি জলদী জলদী পুষিয়ে নিতে চাই। একটা সেকেন্ডও ছাড় দিবো না এবারে। আপনি তাড়িয়ে দিতে চাইলেও যাবো না।

-এটা কি হলো? বন্ধুত্বের অফার দিলাম, ম্যাডাম তো দেখি ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিট অপশনটা বেছে নিয়েছেন। ব্যাপারটা কেমন হলো?

-উমমম। ব্যাপারটা যেমনই হোক, আমার অস্তিত্বে যে মানুষটা মিশে আছে, তাকে নিজের করে চাই। এবার আপনি নিজের মতামত দিন। লেটস বি ফ্রেন্ডস?

-ফ্রেন্ডশিপ উইথ বেনিফিট!?

আবরারের ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নটা শুনেই নিহার এবারে খিলখিল করে হেসে ফেললো। এতোগুলো বছরে এই প্রথমবার মেয়েটাকে এভাবে হাসতে দেখে আবরারের ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো। যে মানুষটা এতোগুলো বছর ওর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে তার থেকে নিজেকে আর কতই বা আড়াল করে রাখবে আবরার? নাকি এমন দূরত্বটা আধো উচিত ওদের মাঝে?

অন্যদিকে, খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিহার ওষুধ খাইয়ে দেয়ার চুপচাপ শুয়ে রইলো নীলা। পায়ের ব্যথাটা আগের চেয়ে কিছুটা কম। শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় ঘুমে চোখ বুজে আসতে শুরু করেছে নীলার। আধো ঘুম, আধো জাগরণের মাঝেও গত রাতের অনুভূতিটা আবার যেন স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে নীলার। সেই একই স্পর্শ, একই ঘ্রাণ, একই অনুভূতি। শুধু চোখ মেলে তাকিয়ে স্বপ্ন না বাস্তব সেটা দেখারই শক্তি পাচ্ছে না মেয়েটা। ঘুমের ওষুধের কার্যকারিতার রেশ কাটিয়ে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়েই শেষে চোখ মেলে তাকাতে সফল হলো মেয়েটা। চোখ মেলেই এতো বড় একটা সারপ্রাইজ পাবে মেয়েটা আশাও করে নি। আধো আলো আধো আঁধারিতে কারো উপস্থিতি টের পাচ্ছে মেয়েটা। কিন্তু মানুষটা যে কে সেটাই খেয়াল করতে পারছে না বেচারি। লোকটা কি জিহান? নাকি অন্য কেউ?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here