অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ৬

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_৬
#সুলতানা_পারভীন

সকালে জানলা দিয়ে দিনের আধো আলোটা চোখে মুখে এসে পড়ায় ঘুমের রেশটুকু ধীরে ধীরে কেটে যেতে শুরু করেছে নীলার। তখনো রাতের নেশা ধরা স্পর্শগুলো যেন ওর গালে ঠোঁটে লেগে আছে এখনো। ঠোঁটে কারো উষ্ণ স্পর্শগুলো যেন ঘুমের ঘোরে আধো জাগরণের মাঝে টের পাচ্ছে মেয়েটা। অনুভূতিটা এতোটা বাস্তব মনে হলো নীলার কাছে যে মেয়েটা ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো জিহান এতোক্ষণ ওর পাশেই ছিল। কথাটা মাথায় আসতেই অজান্তেই মুখটায় লজ্জার লালিমা খেলা করে গেল নীলার। বালিশের নিচ থেকে হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা নিয়েই কয়টা বাজে সেটা চেক না করেই জিহানের নাম্বারেই কল করলো মেয়েটা। পরপর দুবার কল হওয়ার পরেই অপরপ্রান্ত থেকে কলটা রিসিভ হলো। নীলা ঢিপঢিপ বুকে জিহানের ঘুমকাতুরে কণ্ঠস্বরটা শোনার অপেক্ষায় রইলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না নীলাকে। অপরপ্রান্ত থেকে আধো ঘুম জড়ানো জিহানের কণ্ঠস্বরটা কানে এসে পৌঁছাতেই বুকের ঢিপঢিপটা যেন আরো খানিকটা বেড়ে গেল নীলার।

-গুড মর্নিং নীলপাখি। বউটাকে তো বলি নি আজ সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে দিতে, আর্জেন্ট একটা কাজ আছে আমার। ব্যাপার কি? খুব মিস করছিল নাকি আমার বউটা?

-আপনাকে নিয়ে কিসব স্বপ্ন দেখেছি কাল রাতে। এখন মনে পড়ছে না। তাই কল দিলাম। আর্জেন্ট কাজ আছে বললেন। কোথায় যাবেন? এতো সকালে কি মিটিং আছে কোনো?

-উমমমম। মিটিং না ঠিক। একজনের সাথে মিট করতে যাবো। উমম। এই নীল? তোমার পায়ের কি অবস্থা এখন? বেশি ব্যথা করছে? মেডিসিন নিবে কিন্তু মনে করে। নইলে কিন্তু বিয়ের আগে ব্যথাটা সারবে বলে মনে হয় না।

-আমার পায়ে! কই পায়ে কি হয়েছে? আমার পায়ে তো কিছুই—–।

জিহানকে ‘পায়ে কিছুই হয়নি’ কথাটা বলতে বলতেই নিজের ব্যান্ডেজে জড়ানো পায়ের পাতার দিকে চোখ পড়তেই রীতিমতো বোকা বনে গেল নীলা। পায়ে কি হয়েছে কথাটা ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরেই নিহারকে পাশে শোয়া দেখে চমকে উঠলো নীলা। কিছু একটা মনে পড়তে গিয়েও মনে পড়ছে না মেয়েটার। কিন্তু কি! মস্তিষ্কে জোর দিয়ে গত রাতে কি ঘটেছে মনে করার চেষ্টা করার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে আবার জিহানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসায় থমকে গেল নীলা।

-নীল? তুমি এখনো রাগ করে আছো আমার উপরে? বিলিভ মিহ আমি তোমাকে একটাবারের জন্যও চিট করি নি। কেউ একজন ইচ্ছে করে তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। আর সিচুয়েশনটাও এমনভাবে ক্রিয়েট করেছে যেন তোমার মনে হয় ওই মেয়েটার সাথে—–। বাট ট্রাস্ট মি। আমি রিসেন্ট প্রোজেক্টটার কাজ কম্পপ্লিট করতেই ফার্মহাউজে—। হয়তো রাতের ঘুমের ওষুধ আর প্রতিদিনকার অভ্যেসের কারণেই কলটা দিয়ে ফেলেছো। বাট ট্রাস্ট মি বউটা আমি আমার বউটাকে কখনোই ধোঁকা দিই নি, মরে গেলেও সেটা পসিবল না করা আমার পক্ষে। এই নীল? শুনতে পাচ্ছ? নীলপাখি? নীলা? একবার আমার কথাটা শোনো প্লিজ? তারপর তুমি যা করতে বলবে আমি মাথা পেতে সব শাস্তি মেনে নিবো, প্রমিস। নীল?

জিহানের শেষের কথাগুলো আর নীলার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। গতকালের জিহান আর ওই মেয়েটাকে ফার্মহাউজে দেখার ঘটনাটা মনে পড়তেই মোবাইলটা ফ্লোরে আছড়ে ফেলে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠলো। সত্যিই লোকটা ওর প্রতিদিনের অভ্যেস হয়ে গেছে। কি করে এই অভ্যেসটা বদলাবে নীলা জানে না। কিন্তু নিজের চোখে যে দৃশ্য ও দেখেছে সেটাই বা ভুলবে কি করে? জিহানের ফার্মহাউজ, জিহান আর ওই মেয়েটা! একা! ছি! কালই ওকে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপারটা ছিঁড়ে ফেলতে বলে আজ আবার নতুন কোন নাটক করতে চাইছে লোকটা! এতোটাই সস্তা ছিল ওদের ভালোবাসাটা যে চাইলেই মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে নেয়া যায়, আবার চাইলেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যায় ইউজড টিস্যু পেপারের মতো! এদিকে নীলার মোবাইলটা ফ্লোরে আছড়ে পড়ার শব্দে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসেছে নিহার। নীলাকে বালিশে মুখ গুঁজে ফোঁপাতে ফোঁপাতে কিছু একটা বিড়বিড় করতে দেখে নিহার নীলার চুলে হাত বুলিয়ে বেশ কয়েকবার ডাকলো। নীলা এতোক্ষণে মুখ তুলে নিহারকে দেখে নিহারের কোলেই মুখ লুকিয়ে আবার কাঁদতে লাগলো। নিহার অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার কান্না থামাতে না পেরে নিজেই প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড় হলো এবারে।

-নীলা? কি হয়েছে তোর? এমন করে কাঁদছিস কেন?কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বল? পায়ে ব্যথা করছে বেশি? এই লক্ষী মেয়ে না তুই? ভাবিকে বল প্লিজ কি হয়েছে? নীলা? শোন না? বল না আমাকে কি হয়েছে?

-ভাবি? বল তো এমন কেন হলো আমার সাথে? আমি কি করেছি বলো তো? একটা মানুষকেই নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালেবেসেছি, পৃথিবীর সবার চেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছি। অথচ সেই মানুষটাই! কলেজে ফ্রেন্ডরা হাজার বারণ করা স্বত্ত্বেও তার প্রেমে পড়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারি নি। তার এক কথায় কাউকে না জানিয়ে কোর্টে গিয়ে বিয়েটাও করতেও একবার ভাবি নি। অথচ সেই মানুষটা কাল কি বললো জানো? ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপারটা নিয়ে যেতে, যেন ছিঁড়ে ফেলে দিই। নইলে নাকি কাগজটা ইউজ করতে ইচ্ছে হতেও পারে। উনি তো খুব সহজে রেজিস্ট্রি পেপারটা কাগজ বলে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেও আমি কেন সেটাকে শুধু কাগজ বলে ছিঁড়ে ফেলতে পারছি না? কেন ভাবি কেন কেন কেন?

-নীলা? শোন না? এভাবে কাঁদিস না সোনা। দেখ কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। জিহান ভাইয়া তোকে কতো পাগলের মতো ভালোবাসে সেসব তো তুই নিজেই আমাকে বলেছিস। তাই না বল? হয়তো এমন কিছু হয়েছে যে ওই মূহুর্তে উনি তোকে কিছু বলতে চেয়েও পারে নি।

-কাল দুপুরে আমি আসার পর কতো সময় পার হয়েছে জানো তুমি? পুরো দিনটা চলে গেল। না একবার কল দিল, না একবার নিজে এলো। বাবা গিয়ে বিয়েটা ক্যান্সেলও করে দিয়ে এলো। তবু একটা বার কিছু বলেও নি জানো? তুমিই বলো আমি কি ভুল করেছি? আমাকে ভালোবাসে না কথাটা আমাকে বলে দিলেই তো পারতো। সাত দিন পরে বিয়ে, তা জেনেও সে——-। ও আমার কতোটা অভ্যেস হয়ে গেছে জানো? আমার এখানে, এখানে, এখানে সব জায়গায় মনে হয় ওর স্পর্শ অনুভব করি। ও নেই, তবু মনে হয় ও পাশেই আছে। যেন ছায়ার মতো মিশে আছে আমার সাথে। আজ দেখো ঘুম ভাঙ্গতেই প্রতিদিনের মতো কল করে ফেলেছি। কাল হয়তো আবার দিবো। ও তো আমার অভ্যেস হয়ে গেছে গো ভাবি। আমি কি করে বাঁচবো ওই মানুষটাকে ছাড়া। আমি মরেই যাবো—–।

-নীলা? কিসব আবোলতাবোল বলছিস এসব? সময় হলে ভাইয়া নিশ্চয়ই তোকে সবটা বুঝিয়ে বলবে। অন্তত একটু শান্ত হয়ে অপেক্ষা কর কয়েকটা দিন?

-না না না। তুমি জানো না। ওই মেয়েটা সত্যি সত্যি ওকে বশ করে ফেলেছে। মেয়েটাকে ওর অফিসেও দেখেছি আমি। ওকে দেখলেই কেমন ছুটে ছুটে আসতো। প্রচন্ড বাজে রকমের একটা মেয়ে। কিন্তু ও কেন ওই মেয়ের কাছে যাবে। আবার আমাকে বলেছে আমি রূপের সাথে হ্যাপি আছি—–।

-নীলা? সবসময় আমরা যা দেখি বা শুনি সেসব সত্যি হয় না রে পাগলি। তুই ভাবির কথাটা শোন? দেখবি জিহানের কাজ শেষ হয়ে গেলে তোকে নিজেই সব বলবে।

-ও মোটেও কোনো কাজে এমন করছে না। নইলে আমাকে বলে যেত। ও কখনো আমাকে কিছু না বলে করে নি। এবারই লুকিয়েছে। আর কেন লুকিয়েছে সেটা তে নিজেই দেখতে পেলাম। এর জন্য আমি প্রয়োজনে মরে যাবো, তবু কখনো মাফ করবো না ওকে। কিছুতেই না, কিছুতেই না।

নীলা আবার নিহারের কোলে মুখ ডুবিয়ে বাচ্চাদের মতো কান্না জুড়ে দেয়ার নিহার থ হয়েই বসে রইলো। জিহান যে কাল রাতে সত্যিই এসেছে কথাটা এই মেয়েকে কি করে বোঝাবে? দুজন মানুষ দুদিকে বিনা অপরাধে শাস্তি পাচ্ছে। এর পিছনে কার হাত আছে সেটাও জানে নিহার। কিন্তু ওর কিচ্ছু করার নেই। চাইলেও কিছু করতে পারবে না নিহার। কারণ এই দুটো মানুষের কষ্টে ও যতটা না কষ্ট পাচ্ছে, তার চেয়ে হয়তো হাজার গুণ বেশি কষ্ট পাচ্ছে ওই মানুষটার কষ্টে বা যন্ত্রণায় সহযাত্রী হতে না পেরে। জীবন মাঝে মাঝে এমন মোড়ে এনে কেন দাঁড় করিয়ে দেয় কে জানে?

অন্যদিকে, নীলার কলটা কেটে যেতেই কিছুক্ষণ থমকে নিজের বিছানায় শুয়ে থেকে ধীরে ধীরে উঠে রেডি হয়ে হসপিটালে গেল। হসপিটালের একটা বিশাল কেবিনের কাচের জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে রুমের ভিতরে তাকালো জিহান। বেডে একজন মানুষ বেশ অনেকগুলো নলের মাঝে রীতিমতো পেঁচিয়ে শুয়ে আছে। দেখে মনে হয় মানুষটা কি শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। অথচ এই স্লিপিং বিউটির মতো যে মানুষটা ঘুমিয়ে আছে তার ঘুমটা ভাঙ্গার জন্য কত বছর ধরে যে জিহান অপেক্ষা করে আছে সেটা শুধু জিহানই জানে। আরো কত বছরের অপেক্ষার পর কালো মেঘের ঘনঘটা পেরিয়ে হাসিমাখা সূ্র্যের মুখটা দেখতে পারবে সেটাই ভাবছে জিহান।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here