অস্তিত্বে_তুমি পর্ব ৫

#অস্তিত্বে_তুমি
#পর্ব_৫
#সুলতানা_পারভীন

-তোর সাহস হয় কি করে এতো রাতে তুই আমার বাড়িতে আসিস? তাও আবার আমি বাড়ি আছি জেনেও এসেছিস? আমার বোনটার জীবনটা নষ্ট করতে কেন এতো উঠে পড়ে লেগেছিস তুই? কি চাস কি তোরা সবাই মিলে? আমার জীবনটা তছনছ করে দিয়ে শান্তি হয় নি তোদের? এবার আমার আদরের বোনের জীবনটা নষ্ট করতে এসেছিস? কি ভাবিস কি তোরা সবাই? আমার সামনে আমার বোনটারও একই দশা হবে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো? কক্খনো না। আমার বোনের জীবনটা নষ্ট করার আগে আমি তোদের সবাইকে একটা একটা করে পিঁপড়ের মতো পিষে মারবো। তোকেও, কায়রাকেও, তোকে বাঁচিয়ে রাখা তোর ওই মিথ্যেবাদী মামা মামী, আমার বোনের কাছে ঘেঁষতে চাওয়া প্রত্যেকটা ধোঁকাবাজকে আমি গুনে গুনে খুন করবো। তোকে দিয়েই নাহয় উদ্ভোধন করি আজকে। একটা একটা করে সবাইকে খুন করে নাহয় নিজেও এই জীবনটা থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নিবো।

জিহানকে পিছন থেকে শক্ত করে জাপটে ধরা মানুষটা যে আবরার সেটা বুঝতে জিহানের দেরি হলো না। ছেলেটার জন্য কেন যেন একটু মায়াই লাগলো জিহানের। কিন্তু অতীতের কিছু তিক্ত স্মৃতি সেই অনুভূতিটাকে টিকতে দিল না জিহানের মনে। আবরার যতটা আক্রোশে জিহানকে জাপটে ধরেছিল নিজের কথাগুলো বলতে বলতে সেই আক্রোশটাও যেমন কমে এলো, তেমনি হাতের বাঁধনটাও কিছুটা শিথিল হয়ে এলো। জিহান একবারের চেষ্টাতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবরারের মুখোমুখি হয়ে তাকাতেই আবছা আলোতেও আবরারের টলমল মদ্যপ রূপটা দেখতে পেল। এই লোকটাকে এক সময় নিজের সুপারম্যান মনে করতো জিহান। আর তার সুপারম্যানকে আজ তার শত্রু হয়ে এই পরাজিত সৈনিকের রূপে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিহানের কেমন লাগছে জিহান হয়তো নিজেও জানে না। মনের মধ্যে সদ্য কৈশোর পার করা উঠতি যুবকের মনটা বড্ড বেশি কাঁদে এই লোকটার জন্য। সেদিনের সেই আবরার! কি থেকে কি হয়েছে আজ! কিন্তু যখন চোখের সামনে কায়রা বা দুজন বয়স্ক দম্পতির গলায় দড়ি দেয়া লাশ ভেসে ওঠে তখন এই আবরারকেই খুন করতে সমস্ত শরীরের রক্তগুলো টগবগ করে ফুটতে থাকে। শুধু একটাই বাধা আটকায় প্রতিবার জিহানকে। এই লোকটা নীলার ভাই, জিহানের নীলা, যার জন্য জিহান সব ছাড়তে পারলে এই লোকটাকে তিলে তিলে মারার ইচ্ছেটাকে মারতে পারবে না জীবনেও।

-কি ভেবেছিস কি তুই? আমি বাড়িতে থাকার পর, আমার সামনে দিয় তুই আমার বোনের সাথে দেখা করতে যাবি? এতোই সহজ? খুন করে ফেলবো তোকে আমি। খুন করে ফেলবো আবার যদি নীলার ধারে কাছেও দেখি। এই সব সস্তা আবেগের দাম নেই তোদের কাছে। কথাটা সময় থাকতে আমি বুঝি নি। বাট আমার বোনকে আমি এই ভুলটা করতে দিবো না মরে গেলেও।

-সস্তা আবেগ? সস্তাই তো। এতোটাই সস্তা যে বিয়ের আসরে একটা মেয়েকে অপেক্ষায় রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়া যায়। এতোটাই সস্তা যে নিজেকে ব্যবসার পণ্যের মতো বেচে দেয়া যায়। এতোটাই সস্তা যে টাকার জন্য যাকে বিয়ে করা তার সাথে কুকুর বেড়ালের মতো ব্যবহার করা যায়।

-তুই আর তোর বোন নাটক করতে ওস্তাদ! বাহ! বিয়ের আসর! বউ! ব্যবসা! হা হা হা! দারুণ বলেছিস জিহান। হাজারটা স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি একটা মানুষকে নিয়ে। কখনো কল্পনাও করি নি তার চাহিদা আমাতে নয়, অন্য কিছুতে ছিল। ও নিজের জিনিস তো আদায় করে নিয়েছে। আর আমি বিয়ে করলাম বলেই অপরাধী! হা হা হা।

-আবরার!

আবরারের কথায় জিহান রীতিমতো রেগে গিয়ে টলমল পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবরারের টিশার্টের কলার চেপে ধরলো। আবরার তখনো পাগলের মতো হা হা করে হাসছে। এই মাতাল লোকটাকে কিসের জন্য শায়েস্তা করবে সেটাই জিহানের মাথায় ঢুকছে না। যে লোকটার জন্য জিহানের পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে গেল, সেই লোকটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওকে ন্যায় অন্যায়ের পাঠ শিখাচ্ছে! এই মূহুর্তে জিহানের ইচ্ছে করছে লোকটাকে খুন করতে। কিন্তু কারো কাছে তো ও দায়বদ্ধ। নইলে আবরারের পুরো পরিবারটাকেই এতোদিনে ধ্বংস করে দেয়ার মতো ক্ষমতা জিহানের তৈরি হয়েছে।

-কি হলো মারবি? মেরে ফেল জিহান। আমি যতদিন বেঁচে আছি তোদের কারো একটা উদ্দেশ্যও সফল হতে দিবো না। তোদের মত ছোটোলোক, ধোঁকাবাজ, ইতর, প্রতারককে আমার বোনের ধারেকাছেও আসতে দিবো না। আই প্রমিস।

-আমরা ইতর? ধোঁকাবাজ? আর তুই কি? এতো বছর ধরে তোকে বাঁচিয়ে রেখেছি কেন জানিস? তোকে তিলে তিলে মারবো বলে। সেদিন নিজের দোষ, নিজের সব অন্যায় তুই নিজের মুখে স্বীকার করবি। আর তখন তুই নিজে আমাকে বলবি তোকে এই ধোঁয়াশার জীবন থেকে মু্ক্তি দিতে।

-হাহ। হা হা হা। নাইস জোক মিস্টার জিহান।

-এন্ড ওয়ান মোর থিংক। আমরা ধোঁকা দিচ্ছি বললি না তুই? তুই নিজে কি করছিস? তোর পি.এ কি যেন নাম মেয়েটার? ইয়েস! সুনয়না। ভালোই এক্টিং করে মেয়েটা। নাটকে কাজে লাগাতে পারিস।

-ওহ! রাইট! সুনয়না! ওই মেয়েটাই তো তোর পোল সব খুলে দিল না? হুহ। বেচারা জিহান। এতোদিন ধরে যে নাটকটা বানাচ্ছিল। সেটা এভাবে ফ্লপ খাবে আশাও করিস নি রাইট? কিন্তু একটা কথা জানিস কি জিহান? সবাই তোদের মতো ঠগ বা জোচ্চোর হয় না। কেউ কেউ নিজের দায়িত্বটাকে নিজের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্য দেয়। আর টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায় না যেমনটা তুই আর তোর পরিবার হয়ে যাস।

-হা হা হা। ওয়াও! দারুণ উপলব্ধি মিস্টার আবরার খন্দকার। এখন দেখছি মিস সুনয়নার চেয়ে আপনার এক্টিংটা দারুণ হচ্ছে। আমাকে নীলার জীবন থেকে সরিয়ে দিতে কি সুন্দর করে নিজের পি.এ কে ইউজ করলেন, আর এখন জোচ্চোর, ঠগ, প্রতারক সব আমার ঘাড়ে? নিজের পি. এ কে আমার ফার্ম হাউজে পাঠিয়ে আবার আমাকেই নীলার চোখে কালার করলেন! ওয়াও! আর আমি ক্যারেক্টারলেস হলাম আমি! আপনি সাধু পুরুষ!

-আমি সুনয়নাকে পাঠিয়েছি? নাকি তুই ওকে তোর ফার্মহাউজে ডেকেছিস?

-ওয়াও! এবার নতুন কাহিনী বানাচ্ছেন মিস্টার খন্দকার? কোনো লাভ নেই। নিজের মনগড়া হাজারটা কাহিনী রেডি করে নিন। নীলাও তো একদিন আপনার এই ভালো মানুষির মুখোশটার পিছনের পিশাচটাকে চিনতে পারবে। সেদিন কি করবেন? আমি যেমন আমার বোনকে হারিয়েছি, সেদিন আপনিও নিজের আদরের বোনকে হারাবেন। আপনার মাথার উপর থেকে বাবার ছায়া, পাশ ফিরে যেদিন নিজের স্ত্রী বলে যাকে দু পয়সার দাম দেন না সেই মেয়েটাকেও পাবেন না সেদিন বুঝবেন প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণাটা কেমন হয়।

-খবরদার জিহান! নীলা, বাবা বা নিহার কারো যদি কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করিস তাহলে তোকে আমি—–।

-কি করবেন মিস্টার আবরার খন্দকার? চাইলে বহু আগেই অনেক কিছু করতে পারতাম। কিন্তু আপনার মতো আড়াল থেকে পিঠে ছুরি মারার তো আমার অভ্যেস নেই। আর আপনার ওয়াইফ? উনাকে নিজের বোনের মতোই সম্মান করি আমি। তাই আর যা করি না কেন নিজের বোন যাকে ভেবেছি তার ক্ষতি করবো না কখনো। অবশ্য মনে হয় আপনার মতো লোকের সাথে এতোগুলো বছর থাকার চেয়ে বড় ক্ষতি আর কিছু উনার জন্য হতেই পারে না।

-মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ জিহান।

-ইয়া, আই উইল। বাট আই হ্যাভ এ কোশ্চেন মিস্টার আবরার। বাড়িতে থেকেও যার সাথে পাড়া প্রতিবেশীর মতোও কথা বলার সময় পাও না তুমি, মিস বিহেভ করো প্রতিনিয়ত, স্ত্রী বলে হয়তো কারো সামনে আজ পর্যন্ত পরিচয়ও দাও নি, তাকে নিয়ে তোমার এতো মাথাব্যথা কেন?

-সেই কৈফিয়ত তোকে দিবো না আমি জিহান।

-আমাকে না দাও কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দিও। একবার নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো যে মেয়েটাকে এতোটা অপমান করে এসেছ দিনের পর দিন সে কিসের আশায় তোমার পথ চেয়ে রাত জাগে। কিসের আশা বুকে বেঁধে সে এই বালির সংসারটা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। তারও তো কিছু আশা কিছু স্বপ্ন ছিল একদিন। সবই তো মিথ্যে হয়ে গেছে। তবু কেন যাচ্ছে না তোমাকে ফেলে এটা কখনো ভেবেছ তুমি মিস্টার আবরার সাহেব? যাকে ভালোবেসেছ তাকে প্রতিনিয়ত অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছ, যে তোমাকে ভালোবেসে তোমার ছায়া হয়ে পাশে থাকতে চায় তাকে দু পয়সার দাম দাও না। জীবনে চাও টা কি? আবার বলো আমরা ধোঁকা দিচ্ছি। নিজেকে যে নিজে কত বড় ধোঁকা দিচ্ছ সেটা আগে নিজেকে বোঝাও। তারপর অন্যের দোষ ধরতে এসো। তোমার মতো লোকের সাথে অযথা তর্ক করে নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই। আর সম্ভবত আমার কতা বোঝার মতো অবস্থাও তোমার নেই। আর না আমাকে আটকানোর। সো মিস্টার আবরার খন্দকার, মিট ইউ সুন।

কথাগুলো শেষ করেই আবরারের দিকে তাকিয়ে হতাশ একটা ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে দেয়ালের দিকেই এগিয়ে গেল জিহান। অন্যদিকে জিহান যে চলে যাচ্ছে সেদিকে যেন হুঁশই নেই। তার কানে জিহানের কথাগুলোই যেন বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ একজন বুক চিড়ে বের হয়ে নিহারের প্রতি করা প্রত্যেকটা অন্যায়ের সাক্ষী দিচ্ছে আজ আবরারের কাছে। আজ একই দিনে নিহারের সাথে যা যা মিস বিহেভ করেছে সেগুলোই চোখের পর্দায় ভেসে উঠে জিহানের কথাগুলোর সত্যতার প্রমাণ দিচ্ছে আবরারকে। আসলেই তো আবরার ঠকিয়েছে নিহারকে। অন্য কারো উপরে জমা রাগগুলো প্রতিনিয়তই এই মানুষটাকেই দেখিয়ে গেছে। তবু মানুষটা রাতের পর রাত আবরারের অপেক্ষায় বসে ছিল। কিসের আশায়? যে সম্মানটা মেয়েটা ওকে দিয়েছে এতোগুলো বছর ধরে দিয়েছে সেটা পাওয়ার কি আসলেই যোগ্য সে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here