#নয়নতারা_৪
#জেরিন_আক্তার_নিপা
নয়নতারা পা টেনে নিয়ে ইতস্তত গলায় বলল,
—আমার কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।’
তখন ঝিনুক এসে হাজির। তেতে উঠে সে বলে,
—কচু ঠিক আছিস। ঠিক মত হাঁটতে পারিস না এখনো। এখন আবার মুখে মুখে চাপা করছিস। চুপ করে বোস। মামা ডাক্তার ডাকছে।’
অসহায় মুখে নয়নতারা ঝিনুকের দিকে তাকায়।
—আবার ডাক্তারও ডাকা লাগবে! ‘
—অবশ্যই। পা ভেঙে গেলে ডাক্তার ডাকা লাগবে না? ল্যাংড়ি হয়ে বসে থাকলে বিয়ে হবে না।’
নক্ষত্র এতক্ষণ চুপ করে ছিল। হাড্ডি তো ভাঙেইনি মচকেও যায়নি। বেকায়দায় পা পড়ে সামান্য একটু ব্যথা পেয়েছে। জায়গাটা লাল হয়েছে মাত্র। এখনো ফোলে ওঠেনি। তাতেই এরা যা করছে! পা ভেঙে গেলে মনে হয় শহর জুড়ে হরতাল লাগিয়ে দিত। সে বলল,
—ডাক্তার ডাকতে হবে না। কিছুই হয়নি।’
ঝিনুক অবাক।
—কিছু হয়নি মানে? কত ব্যথা পেল!’
নক্ষত্র সত্যিই এবার বিরক্ত হলো। এরা নিজেরাই তো তাহলে একেকজন ডাক্তার। হাড্ডি ভেঙে গেলে বা চমকে গেলে পা ফোলে ব্যাঙ হয়ে যেত। পায়ে হাত দেবার সাথে সাথে ব্যথায় চিৎকার করে জ্ঞান হারাত। যেহেতু এসব কিছুই হয়নি তাহলে চোট খুবই সামান্য। সে এতক্ষণ ধরে নয়নতারার পা ম্যাসাজ করে দিয়েছে।
—সামান্য ব্যথা পেয়েছিল। এখন ঠিক আছে। তারা তুমি পা ফেলো তো। দাঁড়াও দেখি এখনো ব্যথা আছে কিনা। একটু হাঁটো।’
নয়নতারা একবার ইমন, একবার ঝিনুক তারপর নক্ষত্রর দিকে চেয়ে উঠে দাঁড়াল। নিচে পা ফেলে হালকা ভর দিল। না ব্যথা নেই। তারপর একটু হাঁটল। কোনো ব্যথাই নেই। হাসি মুখে ঝিনুকের দিকে ফিরে বলল,
—সত্যিই ব্যথা নেই।’
ঝিনুক যারপরনাই অবাক হলো। এটা কী করে সম্ভব! অবিশ্বাস্য চোখে নক্ষত্রকে দেখল সে। তার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো,
—আপনি কি ডাক্তার?’
নক্ষত্র হাসল। একবার নয়নতারাকে দেখে বলল,
—এখনো লাইসেন্স প্রাপ্ত ডাক্তার না হলেও আর এক বছরের মধ্যে হয়ে যাব।’
—মেডিকেল স্টুডেন্ট! আপনি ডাক্তারি পড়ছেন?’
—হ্যাঁ।’
ঝিনুক ইলার জন্য মনে মনে গর্ববোধ করল। চালাক মেয়েটা ডাক্তার পোলা পটিয়ে নিয়েছে! খুশিতে গদগদ করে সে ইমনকে দেখিয়ে নক্ষত্রর হাত ধরে বলল,
—ধন্যবাদ। অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাদের নাচের বাকি পর্বটা শুধুমাত্র আপনার জন্য ভন্ডুল হয়নি। আপনি বসুন না। আবার নাচ শুরু হবে। বরের নাচ তো দেখাই হলো না।’
সবাই এসে নয়নতারাকে হাঁটতে দেখে আকাশ থেকে পড়তে লাগল। তার একমাত্র ফুপু বলল,
—ভাঙা পায়ে হাঁটছিস কিরে তুই!’
—পা ভাঙেনি ফুপু। ভাঙলে হাঁটতে পারতাম? ‘
—ছোট মেয়ে তুই কী জানিস ভেঙেছে নাকি ভাঙেনি? ডাক্তারি বিদ্যার কিছু বুঝিস তুই? আমি জানি পা ঠিকই ভেঙেছে।’
—ফুপু তুমি…
নক্ষত্র হেসে ফেললে নয়নতারা কথা শেষ করতে পারল না। এত লজ্জা লাগছে তার! নিজের ভুলে পড়ে গিয়ে কী কাণ্ডটাই না বাঁধিয়েছে। লোকটা মনে মনে তাকে কী ভাবছে হ্যাঁ!
নক্ষত্র ঝিনুকের মা’র কথা শুনে হাসছে। যার পা ভেঙেছে সে জানে না, উনি নাকি ঠিকই জানেন। বোঝা যাচ্ছে এখন পা না ভাঙলেও জোর করে ভাঙাবে। তারপর ডাক্তার এসে রায় দিলে এরা মেনে নিবে। ঝিনুক মা’কে ধমক দিল,
—আহ মা! নয়নের পা ভেঙেছে আর ও জানবে না! বলছে তো ওর কিছু হয়নি। তবুও তোমরা…আর ডাক্তার সাহেব নিজেই বলেছেন ওর কিচ্ছু হয়নি। সামান্য ব্যথা।’
চোখ কপালে তুললেন মহিলা।
—ডাক্তার সাহেব কে? কখন এলো ডাক্তার?’
—আসতে হবে কেন? এই বাড়িতেই তো আছে। উনিই তো নয়নের পা ঠিক করে দিয়েছেন।’
ঝিনুক নক্ষত্রকে দেখিয়ে কথাগুলো বলেছে। সবাই এই কথা জানার পর এবার নক্ষত্রকে নিয়ে পড়ল। তার প্রশংসা একেক জনের মুখে খইয়ের মত ফুটছে। ধন্যবাদ ও দোয়া দিয়ে দিয়ে তাকে ভরিয়ে তুলেছে। নক্ষত্র মনে মনে হাসল। যাক এদের মনোযোগ আকর্ষণ করা গেছে তাহলে। তার দিকে ওরা নজর দিয়েছে। নয়নতারার জন্য সবার চোখে আজ তার বিশেষ স্থান হয়েছে। সবাই তাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। এভাবে চললে বেশিদিন লাগবে না। অল্প দিনেই এই বাড়ির জামাই হয়ে যেতে পারবে। সবাই আবার স্টেজে ফিরে গেছে। ঝিনুক মাইক হাতে নিয়ে স্টেজে উঠে সবার উদেশ্যে কিছু বলছে। নক্ষত্র এদিক ওদিক নয়নতারাকে খুঁজলো। ও ব্যথা পেয়েছে বলেই তার কাজ এতটা সহজ হয়েছে। অজান্তেই হোক নয়নতারা তাকে সাহায্য তো করেছে। একটা ধন্যবাদ তো দিতেই হবে। তখনই ইলা ওর পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলল,
—বাব্বাহ! তোমার নাম সবার মুখে মুখে। তুমি তো সবার কাছে হিরো হয়ে গেছ।’
নক্ষত্র ফিরে ওকে দেখতে দেখতে ইলা স্টেজের কাছে চলে গেল। সে হেসে ফেলল। স্টেজে এখন আকিব উঠেছে। কোন গানে নাচবে সে সেটা খোঁজা হচ্ছে। সবার ওইপাশে একটা চেয়ারে নয়নতারা বসে আছে। বড় ভাই বোনদের কাণ্ড দেখে হাসছে সে। নক্ষত্র মুচকি হেসে তার দিকে এগোলো। আকিবের নাচ দেখার মত ছিল না। বারবার এক স্টেপই করে যাচ্ছিল। বাড়ির লোক হৈহৈ গালাগালি করে ওকে স্টেজ থেকে নামিয়ে দিয়েছে। সবার পরে এবার ঝিনুকের পালা। ঝিনুক ওড়না বেঁধে নিয়ে চোখে কালো সানগ্লাস লাগিয়ে স্টেজে উঠেছে। মনে হয় কালা চশমা গানে নাচবে। নয়নতারা বসে ছিল। তার মুখে হাসি লেগেই আছে। নক্ষত্র পেছন থেকে গিয়ে ওর কাঁধের উপর ঝুঁকে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল,
—ধন্যবাদ।’
ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে নয়নতারা। হুড়মুড়িয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নক্ষত্র মুচকি হেসে অন্যদিকে চলে গেল। নয়নতারা হাত পা কাপছে। সেই স্মেল! এই ঘ্রাণ তার নাকে চেনা চেনা ঠেকছে। হ্যাঁ চেনাই৷ এই ঘ্রাণের সাথে পরিচিত সে। তখন ছাদে… নয়নতারা বিস্ময় নিয়ে চোখ বড় বড় করে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আছে। জ্বীনটা যখন পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে রেখেছিল। তখন এই স্মেল পেয়েছে সে। এখন ঠিকই এই স্মেলই আকিব ভাইয়ার বন্ধুর সাথেও পেয়েছে।
বিড়বিড় করল নয়নতারা।
—তাহলে কি উনিই… উনি আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব করেছেন!’
কান্না পেয়ে গেল নয়নতারার। সে ভয় পায় জেনেও কেউ এরকম কীভাবে করতে পারে? আকিব ভাইয়ার বন্ধু এতটা বাজে! তাকে ভয় পাইয়ে মজা নিয়েছে! এখন আবার ধন্যবাদ বলছে।
—কিন্তু ধন্যবাদ কেন? উনার তো সরি বলা উচিত ছিল। সরি না বলে ধন্যবাদ বলছে! পাগল লোক। সবার আড়ালে আমাকে একা পেয়ে ভয় দেখায়। আবার সবার সামনে ভালো মানুষ সাজে।’
নয়নতারার মাথায় আরেকটা প্রশ্ন উঁকি দিল। তখন সন্ধ্যায়ও কি এই লোকই! মুখ হাঁ হয়ে গেল তার। হ্যাঁ কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকারের মাঝে এই লোকই তার মুখ চেপে ধরেছিল। একই স্মেল ওইসময়ও পেয়েছে সে। তখন খেয়াল করেনি। এখন সব ক্লিয়ার হয়েছে।
—আল্লাহ! লোকটা তো ভয়ংকর বাজে। আকিব ভাইয়া ওর বন্ধুর ব্যাপারে জানে! উঁহু, জানলে নিশ্চয় ওকে বাড়িতে নিয়ে আসত না। একটা ক্যারেক্টারলেস লোক এই বাড়িতে সবার চোখের সামনে ভালো মানুষ সেজে ঘুরছে। ছি! সবার সামনে সাধুপুরুষ। আড়ালে গেলেই তার নোংরা চেহারা বেরিয়ে আসে। মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করে। আমার সাথেই দুই বার করেছে। বাবাকে বলতে হবে। এই লোককে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিবে বাবা। আকিব ভাইয়া এরকম মানুষকে বন্ধু বানায় কেন?’
স্টেজে ঝিনুক নাচছে। নাচের মাঝে সে নেমে এসে ইমনের হাত ধরল। গান এখনো বাজছে। সে ইমনকে টেনে স্টেজে নিয়ে যাচ্ছে। ইমন রাগ হয়ে উঠলেও বাকি সবার উৎসাহে তাকে বাধ্য হয়েই ঝিনুকের সাথে যেতে হলো। মনে মনে রাগে ফেটে পড়লেও বাইরে তা দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ির সবাই এখানে উপস্থিত। ঝিনুক তাকে টেনে আনায় মাইন্ড করবে তো দূর বরং ওরা ঝিনুকের এই কাজে আরও মজা পাচ্ছে। তাকেও নাচার জন্য অনুরোধ করছে। ইমন না নাচলেও ঝিনুক তাকে ছাড়ছে না। দাঁতে দাঁত চেপে মূর্তি হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে সে। এই ঝিনুককে কাঁচা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। ইমন মনে মনে বলল,
—একা পাই তোকে কালনাগিনী। মজা দেখাব। তোর ঠ্যাং যদি আমি ভেঙে না দিয়েছি তাহলে আমার নামও ইমন না। ভাঙা ঠ্যাং নিয়ে নাচিস তুই।’
ইমনের রাগ দেখে ঝিনুকের মজা লাগছে। আজকের জন্য যথেষ্ট বিনোদন হয়েছে। গান শেষে দাঁড়িয়ে গেল সে। ইমন সাথে সাথে নেমে গেল। ঝিনুক হাঁপাচ্ছে। আড়চোখে ইমনের চলে যাওয়া দেখে বলছে,
— শালা কালসাপ এক্স। বিয়ে করবে তুমি! করো না, করো৷ কে আটকাচ্ছে তোমাকে? তোমার বিয়ে করার শখ যদি মিটিয়ে না দিয়েছি না তাহলে আমার নামও ঝিনুক না।’
অনেক রাত করে সবাই ঘুমাতে গেল। বাকি দিনগুলোর মত যে যার রুমে না ঘুমিয়ে, যে যেখানে জায়গা পেল সেখানেই শুয়ে পড়ল। নয়নতারা মা, ফুপুর সাথে শুয়েছে। মা’কে আকিব ভাইয়ার বন্ধুর কথা বলবে ভেবেও আর বলা হলো না। কাল হলুদ। অনেক আয়োজন। বাড়িতে অনেক লোক। আত্মীয় স্বজন সবাই। বিয়ে বাড়িতে এই কথা তুলে নতুন করে কোন ঝামেলা তৈরি করা ঠিক হবে না। ইমন ভাইয়ার বিয়ে শেষ হয়ে গেলে তখন তো লোকটা চলেই যাবে। শুধু যতদিন লোকটা এখানে আছে ততদিন ওর থেকে একটু সাবধানে থাকতে হবে। তাহলেই হলো। নয়নতারা ঠিক করল ভুলেও ওই লোকটার কাছে যাবে না আর। ওই লোক আশেপাশে থাকলেও সে চলে আসবে। ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করল নয়নতারা। মনে মনে ভাবল,
—কী বাজে লোক! ও আবার আমার পা ধরেছিল! এবাড়িতে আসার ওর উদেশ্য কী? বিয়ে বাড়িতে সুন্দর সুন্দর মেয়ের দেখা পাবে বলে! বন্ধুর বাড়িতে এসেছে। এখানে এসেও বন্ধুর বোনের সাথে… ছি!’
নয়নতারার ঘুম আসছে না। মানুষটাকে দেখে তো ভালোই মনে হয়। ভেতরে ভেতরে যে শয়তান নাচে তা কে বলবে!
—সকালেই ঝিনুক আপু আর ইলা আপুকে বলতে হবে। ওরা ওকে টাইট দিয়ে ছাড়বে। ছ্যাচড়া ছেলে। আকিব ভাইয়াটা মানুষ পেল না বন্ধু বানানোর জন্য।’
বাড়ির সবাই যখন ঘুমে তখন ইলা চুপিচুপি নক্ষত্রর সাথে দেখা করতে আসে। হাতে পানির বোতল। কারো সামনে পড়ে গেলে বাহানা বানাতে পারবে যে, পানি খেতে এসেছে। নক্ষত্রর ঘুম নেই। নিজের ঘর ছাড়া সে ঘুমাতে পারে না। এখানে এসেছে আজ দুই রাত ধরে মনে হয় তিন ঘন্টাও ভালো করে ঘুমাতে পারেনি। ইলাটাও তার খোঁজ নেয় না। কার জন্য এত কষ্ট করছে সে! ইলার জন্যই তো নাকি? সে তো পরিবারকে সময় দিয়ে ওর কথা ভুলেই যায়। ইলা বারান্দা দিয়ে আসছিল। নক্ষত্র এক টানে ওকে পাশের দেয়ালের সাথে চেপে ধরে। হঠাৎ ভয় পেয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিল ইলা। নক্ষত্রকে দেখে সামলে নেয়। রেগে গিয়ে বলে,
—তুমি! হার্ট অ্যাটাক করাবে নাকি?’
—এখন তোমার আসার সময় হলো? কতক্ষণ ধরে পুরো বাড়ি পায়চারি করে যাচ্ছি আমি।’
—সবাইকে তো ঘুমাতে দিবে নাকি? জেগে থেকে কেউ দেখে ফেললে! তবে আজ তুমি যা করেছ তাতে আমাদের বিয়ের কথা উঠলে বাড়ির অনেকেই রাজি হয়ে যাবে। ফুপু তো আকিবকে তোমার বাড়ি কোথায়, বাবা মা কী করে এসব জিজ্ঞেস করছিল। তারও একটা মেয়ে আছে।’
ইলার মুখ বাঁকানো দেখে হেসে ফেলল নক্ষত্র।
মেয়ে মানুষ গুলা এতটা জেলাস হয় কেন?
—আমি কোন প্ল্যান বানানোর আগে তোমার বোনই একটা পথ করে দিল। হাতুড়ি ডাক্তারি বিদ্যা দেখিয়ে টুপ করে কয়েকজনের মন জয় করে নিলাম।’
—হুম।’
/