প্রণয়স্পর্শী পর্ব ১

বিয়ের লাল বেনারসি পরিহিত মেঘলা প্রান-পন ছুটছে ট্রেনের দিকে৷ হাতে ব্যান্ডেজ করা, কপাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে৷ ট্রেন বেপরোয়া হয়ে আগে ছুটে যাচ্ছে তার গন্তব্যে কে কি করলো তা নিয়ে তার পরোয়া কোথায়? সে তো বে-পরোয়া৷ প্রানপন ছুটে ট্রেনের শেষ প্রকোষ্ঠে উঠলো মেঘলা৷ মানুষ তখন ঘুমে বিভর৷ আর ঘুমাবেই বা না কেন? রাত প্রায় ১ টা বেজে গেছে এখনো কি কেউ তার মত জেগে থেকে ট্রেনের পিছনে ছুটবে নাকি?
কিন্তু সে ও তো অকারনে ট্রেনের পিছনে ছুটছে না হাজার বিপদ পেরিয়ে যে এখানে আসতে পেরেছে এই অনেক, এখন শুধু ঢাকা নামক গন্তব্যে পৌছাতে পারলে কিছুটা হাল্কা হবে সে৷ সত্যি কি হাল্কা হতে পারবে?
যার থেকে পালিয়ে আসলো কতদিনই বা পালিয়ে থাকতে পারবে? বাঁচতে দিবে কি সে মুক্ত-ভাবে? নাকি আবার সেই নরক জীবনে ফিরে যেতে হবে মেঘলার?
ও যদি প্রজাপতি হতো নীড় ছাড়া প্রজাপতি? প্রজাপতির মতো মুক্ত আকাশে ছুটতো রঙের খোজে? মেঘলার জীবনটা কি রঙিন হবে কখনো?

ছোট থেকেই বড় চাচা-র বাড়িতে বড় হয়েছে মেঘলা, মা মারা যাওয়ার পর বাবাকে খুজে পাওয়া যায় না মেঘলার অনেক জায়গা খুজেও পাওয়া যায়নি৷ মানুষ বলে কেউ যদি বেখেয়ালে হারিয়ে যায় তাকে খুজে পাওয়া যায় কিন্তু যে নিজ থেকে নিরুদ্দেশ হয় তাকে খুজে পাওয়া দুষ্কর৷

হঠাৎ কিছু ভয়াবহ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসতেই ভয়ে কুকড়ে উঠলো মেঘলা৷ চোখ থেকে বেড়িয়ে এলো মূল্যহীন পানি, যে পানির মূল্য কখনো কারো কাছেই ছিল না৷
দীর্ঘশ্বাস ফেলে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়েও কোনো খালি জায়গা খুজে পেলো না বসার জন্য কিছুটা সামনে এগিয়ে যেতেই শেষ মাথায় পুরো একটা সিট পেলো ওদিকে এগিয়ে যেতেই দেখলো ওই সিটের বিপরীত মুখী সিটে একটা ছেলে বসে আছে মুখের সামনে বই ধরে আছে তাই মুখটা স্পষ্ট নয়৷ তাও কোনো প্রকার অনুমতি না নিয়ে সে সিটে বসে পরলো মেঘলা, নিষ্পাপ নির্বোধ চোখ দুটি দু-দন্ড স্থির নেই দু-তিন দিন যাবৎ৷
কিছুক্ষণ গোলগোল চোখে সামনে থাকা ব্যাক্তি কে পরখ করলো, কে জানে ব্যাক্তিটি কি করছে৷ এখনো তার বইয়ের ভিতরেই মুখ বইয়ের কভার পেইজ এ বড় বড় অক্ষরে ইংলিশ লেখা ” CARDIAC SURGERY ”
বই-টার দিকে কিছুক্ষন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলো৷ চোখ ভারি হয়ে আসছে মেঘলার ক্লান্ত চোখটা ঘুমানোর জন্য বার বার লেগে আসছে তাই চোখ বন্ধ করে পিছনে হ্যালান দিয়ে বসে মেঘলা৷

— ‘ হেই মিস হু আর ইউ??? ‘
হঠাৎ চোখ-টা লেগে আসতেই কারো গম্ভীর কন্ঠ কর্ণকুহরে পৌছাতেই ধরফরিয়ে উঠে মেঘলা৷
আদো আদো চোখে সামনে থাকা ব্যাক্তিটিকে দেখে পরোয়া না করে আবার চোখ বন্ধ করতে যাবে তখনি ব্যাক্তিটি রূঢ় কন্ঠে বলে,
— ‘ এই মেয়ে কথা কি কানে যায় না? কে তুমি?
আর এখানে বসার পার্মিশন কে দিলো তোমায়? ‘

মেঘলা পরলো এবার মহা বিপদে, কি বলবে এখন? আর ট্রেনের সিটে বসতে টিকিট লাগে তা সে জানতো কিন্তু পার্মিশন যে লাগে তা তো জানতো না৷ খালি সিট ছিল তাই বসেছে পার্মিশন কার থেকে নিবে?
মেঘলা মাথা নিচু করে গলা খাদে নামিয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
— ‘ আমি মেঘলা,
কোথাও সিট খালি ছিলো না তাই এখানে বসেছিলাম তা ছাড়া সিট-টা ফাকা ছিলো৷ ‘

পাশে থাকা ব্যাক্তিটি কপাট রাগ দেখিয়ে রাগী চাওনি নিক্ষেপ করে বলে,
— ” হোয়াট রাবিশ ফাকা ছিলো তাই কারো পার্মিশন না নিয়ে বসে পরবে নাকি ? ‘

চোখের চশমা-টা তর্জনী দিয়ে একটু ঠেলে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
— ‘ দুঃখিত আমি এতোকিছু ভেবে দেখিনি৷ ‘
ব্যাক্তিটি বিরবির করে বলে,
— ‘ ম্যানার্স লেস, ষ্টুপিড কোথাকার৷ ‘
বলে মেঘলার দিকে পরখ করে ব্যাক্তিটি, মেঘলার পরনে বিয়ের শাড়ি সদ্য বিয়ে থেকে পালিয়েছে তা বোধগম্য হলো তার আজ কাল বিয়ে যেমন খেলা হয়ে গেছে মা বাবা-র ইচ্ছের দাম টুকু দেয় না৷
— ” স্টুপিড সিললি গার্ল৷ ”
বলে নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো ব্যাক্তিটি৷
মেঘলার বড্ড রাগ হচ্ছে তাও কোনো কথা বললো না ব্যাগটা নিয়ে উঠে ট্রেনের দরজার সামনে গিয়ে দাড়ালো মেঘলা৷ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না কি বলবে? মধ্যরাতে কারো সাথে ঝগড়া থেকে এখানে দাড়িয়ে থাকাটা শ্রেয় বলে মনে করলো মেঘলা৷
রাতের আকাশ-টা তে অদ্ভুত মহোনীয়তা বিরাজ করে কি সুন্দর আধার ভরা আকাশ মাঝে মাঝে কিছু তারার বিচরন দেখছে এই আকাশটার মতো মেঘলা ও একা৷ বড্ড একা৷

অনীল আকাশটা জুরে তারার বিচরন
আজ হোক না কিছু সময়,
তার আর আমার একাকিত্বের কথোপকথন ❤️

আপন মনে আওরালো মেঘলা, সারা-টা জীবন এমন একাকিত্বেই কি কেটে যাবে? বিষাদ কি কাটবেই না?
বাতাসের তালে তাল মিলিয়ে সামনের অবাধ্য চুল গুলো উরছে পিছনের হাত খোপাটা ঢিলে হয়ে ঘাড়ে ঝুলে আছে৷
হাজার ভাবনার ভির মেঘলার মন গহীনে ৷ মানুষ বড়ই স্বার্থপর আজ কাল, ওখানে একটু বসলে ক্ষতি কি ছিল? খুব কি ক্ষতি হতো তার? মেঘলা আড়ষ্ঠ চোখে একবার ব্যাক্তিটির দিকে তাকালো কি গম্ভীর হাব-ভাব করে বসে ফ্লাক্স থেকে চা ঢালছে৷ ব্যাক্তিটি ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে বাম হাত দিয়ে কপালে আসা চুল গুলো পিছনে ঠেলে দিলো, মেঘলা কিছুক্ষন গোলগোল করে তাকিয়ে অন্য দিকে ফিরবে তখনি দুজনের চোখাচোখি হলো মেঘলা ইতস্ত হয়ে অন্য দিকে ঘুরলো৷
তখনি কারো ফোনের তীব্র রিংটোন কানে এলো পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে সেই ছেলেটির ফোন এসেছে৷
ছেলেটি গম্ভীরমুখে ফোনটা ধরে বলে,
— ‘ হ্যালো ডক্টর শোভন স্পিকিং৷ ‘

” ডক্টর ” কথাটা শুনে কিছুক্ষন অবাক নয়নে তাকালো মেঘলা, ওপাশে কি বললো শুনলো না মেঘলা৷
শোভন রেগে ওপাশের ব্যাক্তিকে বলে,
— ‘ ইউসলেস কোথাকার, তোর জন্যই তো ফ্লাইটটা মিস হলো আর এই সো কল্ড ট্রেনে করে যেতে হচ্ছে৷ আফটার সেভেন ডেইস তুই ফোন তো দূরে থাক আমার সামনেও আসবি না, নাও যাস্ট গেট লস্ট৷ ‘

বলে ফোন রেখে দিলো৷ এমন রাগ দেখে মেঘলা শুকনো ঢোক গিললো ডক্টররাও এতো রাগী হয়? এ ডাক্তার এর কাছে রোগী-রা যায়?
এতো সুন্দর মানুষ এতো রাগী হয় কি করে?
ওদিকে আর তাকালো না মেঘলা বাইরেই তাকিয়ে রইলো প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে এমন দাঁড়িয়ে আছে হঠাৎ-ই আকাশে মেঘ ছেয়ে গেলো কিছুক্ষনের মাঝেই বাইরে ঝড়ের তান্ডব হতে লাগে৷
অবাক না হয়ে পারলো না মেঘলা আকাশটা একটু আগেই পরিষ্কার ছিল এখন ঝড়ের তান্ডব শুরু হয়ে গেলো৷
এখানে আর দু-দন্ড দাড়ালে ভিজে একাকার হয়ে যাবে দরজা থেকে সরে গুটি গুটি পায়ে শোভনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মিনমিনিয়ে বলে,
— ‘ ডাক্তার সাহেব আমি কি এখানে বসতে পারি? ‘
শোভন অবাক হলো মেয়েটার মুখে “ডাক্তার সাহেব ” কথাটা শুনে৷
কিছু একটা ভেবে না করতে গিয়েও বাইরে ঝড়ের তান্ডব দেখে গম্ভীরমুখে বলে,
— ‘ সিট৷ ‘
মেঘলা খুশি খুশি মনে বসলো, ঠোঁটের লেপ্টে থাকা নজর কারা মিষ্টি হাসিটা শোভনের নজরে পরলো পরক্ষনে বিরক্ত নিয়ে চোখ সরিয়ে ফেললো৷
বাইরে তুমুল বেগে বাতাস বইছে বৃষ্টি এতোটা নেই, শোভনকে পরখ করলো মেঘলা উজ্জ্বল শ্যামলা হলেও চেহারাকৃতি বেশ মোহনীয় ঠোঁটের নিচে ডান সাইডে কালো কুচকুচে মাঝারো সাইজের একটা তিল রয়েছে, ক্লিন সেভ করে হয়তো তাই দাড়িরে ছিটে ফোটাও নেই৷ চুল গুলো খারা খারা চাচি থেকে একদিন শুনেছিল চুল খারা ছেলেদের রাগ নাকি অনেক হয়৷ তাই বলে হয়তো উনিও রাগী?
প্যাচহীন মন এর কথা হঠাৎ ঠোঁট বেয়ে মৃদু আওয়াজে বাইরে চলে এলো মেঘলার,
— ‘ আপনি খুব সুন্দর ডাক্তার সাহেব৷ ‘
নিজের কথায় নিজেই হতভম্ব মেঘলা পরক্ষনে মুখে দুই হাত চেপে বড় বড় চোখে তাকায়৷ শোভনের কর্ণকুহরে কথা যেতে রেগে কিছু বলতে যাবে এর আগেই ট্রেনটা বিশাল আওয়াজ করে থেমে যায় বাইরে কিছু হট্টগোল এর আওয়াজ আসছে, শোভন মেঘলা দুজনেই সেদিকে তাকায়৷ মেঘলার মনে হঠাৎ-ই অজানা আতংক বিরাজ করছে৷ যার থেকে পালালো সে কি এসেছে?
ভয়ে মেঘলার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, তাহলে কি শেষ রক্ষা হলো না? সে এসে পরেছে??

চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,,

#প্রণয়স্পর্শী
#Tafsia_Meghla
#প্রথম_পর্ব

[ ভালো এবং খারাপ যেমনি লাগুক নিঃসংকোচে অবশ্যই মন্তব্য করবেন ❤️❤️ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here