#প্রেমজাল
পর্ব ২৩ [ বোনাস পর্ব ]
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন
ইতিমধ্যে অনেকটা ক্লান্ত লাগছে। দুই গ্লাস ঠান্ডা পানির সংমিশ্রণে লেবুর শরবত বানিয়ে হলরুমে চলে আসলাম। এক গ্লাস মালতিকে দিয়ে আমি আরেকটা গ্লাস নিলাম। মালতির চোখ মুখে ছিলো প্রশান্তি মাখা চাহনি। আমি মুচকি হেসে তার সাথে টিভি দেখার সাথী হলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের মাঝের পিনপন নীরবতা ভেঙ্গে এক নাগাড়ে অনেকবার কলিংবেল বাজলো। মালতি মুখে মহা বিরক্তি ভাব নিয়ে উঠে দরজা খুলো। দরজা ভেদ করে হুরমুড়িয়ে ঢুকলো পিচ্চি বাচ্চা-কাচ্চা থেকে দামড়া জোয়ান বুড়া সবাই। ক্ষণিকের মধ্যে নিশ্চুপ নিরিবিলি পরিবেশ থেকে কোলাহলপূর্ণ হয়ে গেলো চৌধুরী ম্যানসন। কেও সোফা, কেও চেয়ার দখল করে হাফাচ্ছে। এদিকে মালতি সিরিয়াল দেখা ভুলে গিয়ে সব জিনিসপত্র সামাল দিয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠলো। মালতি অনেক আগের থেকেই খানিকটা দাদিমণিকে ভয় পায়। তাই তার দাদিমণির দেখে আরো অস্থির হয়ে পরেছে। আমি রীতিমতো বিস্ফোরিত এদের কান্ডে। কোথা থেকে এলো এরা? তাও একসাথে। সারা স্বপ্নকুঞ্জ উঠে চলে এসেছে এখানে। সবার তো কালকে আসার কথা ছিলো হঠাৎ আজ কেন?
আমার ভাবনার মাঝে সুপ্পু আমার মাথায় হালকা চাপড় মারলো। আমি তার দিকে অভিমানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।
-‘ কীরে বোনু? তোর বিয়ের আগেই জামাই ভেগে গেলো নাকি? এমন বিধ্বস্ত বিধ্বস্ত টাইপ লাগসে কেন রে?’ বিদ্রুপ স্বরে বলতে লাগলো সুপ্পু।
আমি অভিমানী কাতর হয়ে ঠোঁট উলটে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। কথা না বার্তা নাই এসেই ঠুসঠাস মারা খুব দরকার?
ফুপিমণি ক্লান্ত মুখশ্রী নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
-‘ কি হয়েছে আহুপাখি? মন খারাপ নাকি?’
আমি প্রতিত্তোরে কিছু না বলে চুপটি করে ফুপিমণির পাশে গিয়ে তার কাধে মাথা রাখলাম। রিমি উৎফুল্লতার সাথে গদগদ করতে করতে বললো,
-‘ আরে ফুপিমণি সুহাপু আহানাপুকে বলেছে যে আহানাপুর বিয়ের আগেই জামাই ভেগে গেছে’
ছোট সবুজ রঙের টিনের কৌটা থেকে চুন পানে লাগিয়ে মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে দাদিমণি বললো,
-‘ বিয়ার আগে যদি শোয়ামির সংসার ভাইগগা যায় তাইলে কপাল খারাপ আর যদি বিয়ার হওয়ার পর শোয়ামির সংসার ভাইগগা যায়? সুখ পাইয়াও যদি অসুখী হয়, তাইলে হলো খয়রাতি মার্কা ফাটা কপাল’
দাদিমণির সোজাসাপটা কথা কারোর বোধগম্য না হওয়ায় সবাই ভাবার্থ বুঝতে চিন্তায় মগ্ন হলেও আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না। সে আমার ডিভোর্সের কথা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দিয়েছে। দাদিমণির কথা আমার কর্ণকুহর না হয়ে যেনো সোজা আমার বুকে এসে আঘাত করেছে। আমার মতো পোড়া কপাল হতো আর কারোর নেই। আমার জন্মের আগেই বাবা মারা যায়। মা জন্মের সময় মারা যায়। দু’ জন আমাকে দেখার আগেই এই দুনিয়া ছেড়ে দূর আকাশের তারা হয়ে যায়। পাড়ি জমায় অন্য এক কালে। পরকালে!! বাবা-মার ভালোবাসা পেলাম না। আর এখন স্বামী কপালে জুটেও পাই না। ভাবতেই চোখ টলমল করতে থাকে আমার। চাপা কান্না থামানোর জন্য জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফুপিমণিকে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
-‘ তোমাদের তো কাল আসার কথা ছিলো? আজ আসলে যে’
-‘ আজ আসি আর কাল আসি, একি তো হবে’
আমি হু হা বলার আগেই বড় কাকিমণি ত্যাচড়া ভাবে বললো,
-‘ কেন রে আহানা? একা মেয়ে জোয়ান ছেলের সাথে এক বাড়িতে গোটা একটা রাত কাটিয়ে মন ভরে নি নাকি?’
এবার নতজানু হয়ে টুপ করে চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোটা অশ্রু কণা বিসর্জন হয়েই গেলো। বড় কাকিমণি মনে হয় সবসময় আমাকে কথা শুনানোর জন্য উদ পেতে থাকে। যেখানে সুপ্পু পালিত মেয়ে হওয়ার পর এতো কথা শুনায় না, যতটা আমি তাদের বংশধর তাদেরই রক্ত হয়ে আমাকে শুনিয়ে থাকে বড় কাকিমণি। আমার বাবা-মার বিয়ের পর নাকি দীর্ঘসময় তাদের কোনো সন্তান-সন্ততি হয়নি। তখন সেই সুবাদে সুপ্পুকে পালক আনা হয়। কিন্তু তাকে বড় কাকিমণি অনেক স্নেহ করে থাকলেও প্রায়ই আমাকে বিভিন্ন ভাবে লাঞ্চিত করে। আমার জল্পনা কল্পনার মধ্যভাগে কেও গুরুগম্ভীর গলায় বললো,
-‘ আপনার নিজের কথাই আপনাকে ডাইরেক্ট ইন্ডাইরেক্টলি (Direct Indirectly) এতো বোঝানোর পরও আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার পরিবারের সদস্যকে কটু কথা শুনিয়ে লজ্জা পেয়ে মন ভরে না নাকি? অপপ্স!! অপমানে মন ভরে নি নাকি?’
আকস্মিকভাবে চির পরিচিত কণ্ঠ শুনে মাথা উচু করে তাকালাম। শার্টের ২টা বোতাম খোলা অবস্থায় শার্টের হাতা ফ্লোড করে বুকের মাঝে দুই হাত গুটিয়ে পুলিশ ইউনিফর্ম পরে দাঁড়িয়ে আছে আয়ান। চোখ তার ঈষৎ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চুল গুলো উশকুখুসকু হয়ে অবিন্যস্ত ভাবে কপাল ধারে। পরিচিত ককণ্ঠস্বর হলেও তার দেহমূর্তির বড্ড অচেনা লাগছে।
বড় কাকিমণির ঝাঝালো কণ্ঠে আমার হুস ফিরলো।
-‘ আয়ান তুমি কি আমাকে বাড়ি বয়ে এনে অপমান করতে চাইছো?….. (একটু থেমে) এই মেয়ে দেখি মায়ের থেকে কম যায় না। দেখো আবার তোমার মন ভুলিয়ে ভালিয়ে…’
বড় কাকিমণির কথার সমাপ্তি না ঘটতেই দাদিমণি জোরালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
-‘ আহ!! বড় বৌমা। কি শুরু করলে? আসতে না আসতেই! তোমার কি আমারে একটু শান্তিতে থাকতে দিতে ভাল্লাগে না?’
বড় কাকিমণি রাগে ফোস ফোস করতে করতে মুখ ঝামটি দিলো।
আয়ানও আর কোনো কথা না বাড়িয়ে রাগি ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে তরতর করে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।
সবার মাঝে নিস্তব্ধতা বিদ্যমান। মনে হচ্ছে কোনো এক ঝড় বয়ে গেলো।
ফুপিমণি আমার মাথা তার হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-‘ দুপুরে কি খেয়েছিস বাবুই পাখি?’
আমি কিছু না বলে আপাদমস্তক নতজানু করে রাখলাম।
ফুপিমণি ধমকের স্বরে বললো,
-‘ এই মেয়ে! হাত মোচাড়া মুচড়ি করছিস কেনো? খাস নি? কেনো?’
আমার জ্বরে এসেছিলো বলে সময় কখন পেরিয়ে গেছে বললে নিশ্চিত হাজারো প্রশ্নের ঝুলি নিয়ে বসবে। তাই সত্য খানিকটা চেপে আমি আমতা আমতা করে কাপা গলায় বললাম,
-‘ আসলে ফুপিমণি আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম তাই আর খাওয়া হয় নি’
বড় কাকিমণি তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো,
-‘ আম্মা দেখেন মেয়ের কাহিনি। কিছুই হলেই তো আমাকে চোখা রাঙাইয়া থামান। যে নিজে খাওয়া দাওয়া করতে পারে না, তাকে আরেকজনের জন্য পাঠানো হয়’
ফুপিমণি বড় কাকিমণির কথা পাত্তা না দিয়ে চেচিয়ে মালতি ডাকে সবার জন্য নাস্তা পানিত আয়োজন করতে। আর বাকিদের বলে ফ্রেশ হয়ে নিতে।
__________________
গরম ধৌয়া প্রবাহিত হচ্ছে সদ্য ভাজা আলু পুরি ও ডাল পুরি হতে। সাথে ফলের রস, আমার বানানো কেক আর কালোজাম। উপস্থিত সবাই সেই কাঙ্খিত মূহুর্তের প্রতীক্ষা করছে কখন সবার মধ্যমণি অর্থাৎ দাদিমণি খাওয়ার জন্য অনুমতি দিবে। একজন বাদে সবাই উপস্থিত আছে। অনুপস্থিতি একজন হলো দ্যা গ্রেট আয়ান চৌধুরী। পরিবারের আন্ডা বাচ্চা গুলো যেনো খাওয়ার মরি মরি অবস্থা। আয়ান মোবাইল স্ক্রলিং করতে করতে উপস্থিত হলো। সবার মুখে প্রশান্তির ছায়া।
-‘ অই যন্ত্রপাতি রাখ তো। আমরা সবাই তোর জন্য খাওয়া শুরু করি নাই, নানুভাই’ অত্যন্ত আহ্লাদী স্বরে মুখে হাসির ঝলক এনে বললো দাদিমণি।
আয়ান ফোন থেকে স্বাভাবিকভাবেই মুখ তুলে একবার দাদিমণির দিকে তাকালো।
পরক্ষণে দাদিমণির পাশে আদ্র ভাই দেখে চোখ-মুখ শক্ত করে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চেয়ারে বসে পরলো। তার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। যা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম।
আয়ান বসতেই দাদিমণির ইশারায় সবাই হামলে পরলো খাবারের দিকে। সবাই খাওয়ার এক পর্যায় ফুপিমণি ঘোষণা করলো কালকে শপিংমলে মার্কেট করতে যাবে। সবাই বেশ খুশি হলেও আমি মোটেও হলাম না। সবার মার্কেটিং খরচের দায়ভার দেওয়া হয়েছে বাড়ির বড় দুই ছেলে ওরফে আয়ান চৌধুরী ও আদ্রিয়ান আহমেদ আদ্রের অপর। আমার ভয়টা হলো এখানে। কালকে ভয়ংকর কিছু হতে চলেছে। বাঘ-হরিণ কি কখনো এক ঘাটে পানি খায়? আদ্র ভাই টুক টাক কথা বললেও আয়ান নাক মুখ খিচে গপাগপ খাচ্ছে। বেশ অভিমান লাগলো এই দিকটায়। সবাই কেক আর মিষ্টান্নর প্রশংসা করলেও উনি করলো না। এমনকি বড় কাকিমণি মুখ ফোসকে কালোজামের প্রশংসা করেছে। পরে অবশ্য কথার প্রসঙ্গ ঘুরিয়েছে। সবাই মুচকি হেসে তাকে আর লজ্জা দেয়নি৷
আদ্র ভাই খাওয়ার মাঝে কথা বলতে বলতে খাবার নাকে মুখে উঠে যায়। আমার কাছাকাছি পানি থাকায় আমি তাড়াহুড়ো করে পানি ঢেলে তার সামনে তুলে দেই। আদ্র ভাই স্বাভাবিক হলে আমি নিজের জায়গায় বসে পরতেই খেয়াল করি এক জোড়া চোখ আমার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে আছে। দেখার পরক্ষণই শুকনো একটা ঢোক গিললাম। কারণ, সেই চোখ জোড়া অধিকারী আর কেও না যাকে আমি চরমভাবে ভয় পাই। মিস্টার আয়ান চৌধুরী।
আয়ান তার মুখের খাবার শেষ করে প্লেট ঠেলে ওঠে যায়। উনাকে ফুপিমণি আটকালে রাগ মিশ্রিত ভাব নিয়ে বলে তার নাকি খাওয়া হয়ে গেসে। এরপরে আমার দিকে ভয়ংকর চাহনি নিক্ষেপ করে আর এক মূহুর্ত দেরি না করে তার ঐতিহাসিক মোবাইল নিয়ে চলে যায়। উনার চাহনি স্পষ্ট বলছিলো, আমাকে একবার কাছে ফেলে কেটে কুচি কুচি করে বুড়িগঙ্গায় ভাসাবে!!
আমি চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে খাওয়ায় মনযোগী হলাম।
#প্রেমজাল
পর্ব ২৪
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন
আয়নার সন্নিকটে সং সেজে ঢং না করেই হাতে দু’তিনেক ডার্ক শেডের লিপস্টিক নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে আছি আমি। ইতিমধ্যে মুখে আমার চরম বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠেছে। নিচের ঠোঁটের কাটা অংশ অভীক্ষণ করতেই ক্রোধে সর্বত্র গা রিন রিন করছে আমার। মানুষ কতটা নির্দয় পাষাণ হলে এমন মহা ভয়ংকর কাজ করতে পারে। আমি চক্ষু সন্নিবদ্ধ করেই তপ্ত শ্বাস ফেলে গাঢ় খয়েরী রঙের লিপস্টিক নিয়ে পরিশিষ্ট গুলো রেখে সেটা দিতে উদ্যোগী হলাম। সাথে অভিনিবেশ করতে লাগলাম আমার এই রকম নাজেহাল অবস্থার কারণ।
.
.
.
খাওয়া-দাওয়া সমাপ্তি ঘটিয়ে যে যার মতো নিদ্রায় নিমীলিত হলো। আমার সাথে সঙ্গ দিলো রিমি। আজ রাতে রিমি আমার সাথে আমার বরাদ্দ করা ঘরে ঘুমাবে। মনে মনে একটু শান্তি পেলাম। রিমি ঘুমালো অই বজ্জাতটা আজকের জন্য হলেও দূরে থাকবে। চোখের চাহনি দিয়ে যে থ্রেট প্রদান করেছে ভেবেই পর পর দুটো শুকনো ঢোক গিললাম আমি। ইতিমধ্যে রিমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেসে। আমিও এবার আমার দুর্বল ক্লান্তিমাখা শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই যেনো ঘুম পরী পরম আবেশে আমাকে নিয়ে ঘুম রাজ্যে পাড়ি দিলো।
মধ্যরাতে ঘুমের ঘোরে কারোর শীতল স্পর্শ অনুভব করতে লাগলাম৷ কেও আমার মুখশ্রীর অপর পরে থাকা অবাধ্য চুল পরম যত্নে গুছিয়ে দিলো। আমি অনেক খানিক কিছু অনুভব করতে পারলেও ঘুমের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারলাম না। এখন তো মনে হচ্ছে আমি আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি। ক্ষণিক সময় পর মনে হলো আমি স্বাভাবিক জায়গায় ফিরে এসেছি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো কেও আমাকে খুব কাছ থেকে দেখছে। কারোর উথাল-পাতাল নিশ্বাস আমার সারা মুখ গরম রেশ ফেলে যায়। তার থেকে আগত প্রবল কার্বন ডাই অক্সাইডে রীতিমতো আমার চারপাশের অক্সিজেনের ঘাটতি করে তুলেছে। আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম!! আমি ঘুমের আবেশেই মাথা এদিক সেদিক দিয়ে ছটফট করতে লাগলাম। কোনো লাভ হলো না। অতঃপর আলসেমি ভেঙ্গে এক বুক সাহস নিয়ে ক্রমশ বিলম্বে চাহনি সরু করে তাকালাম।
বারান্দার জ্বলন্ত বাতির মৃদু আলো ও ঘরের ড্রিম লাইটের আলোয় পুরুষালি প্রতিচ্ছবি দেখে চিৎকার করতে নিতেই কেও তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে আমার মুখ প্রবলভাবে পীড়ন করে ধরলো। যার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মুখ থেকে শুধু “আপউম..উম..উম” শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে। আমি গলা কাটা মুরগির ন্যায় আবারো ছটফট করতে করতে আমার মুখ থেকে হাত সরাতে চেষ্টা করলাম।
মুখের অপর থেকে হাতের চাপ কমতেই যেনো একটু স্বস্তি পেলাম। পর পর দুইবার দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিলাম। হঠাৎ চোখের মাঝে তীব্র আলোর আলোড়ন আসতেই চোখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেললাম। আকস্মিক ভাবে লাইট অন করে দেওয়ার কারণে চক্ষু স্নায়ু সহ্য করতে পারেনি। আস্তে আস্তে হাত সরাতেই আমি যেনো সপ্তম আকাশ থেকে পরলাম।
আয়ান তার ভ্রু যুগল সংকোচন করে এক দৃষ্টিতে আমার সম্মুখ পানে তাকিয়ে আছে। আমি খানিকটা হতভম্ব হলাম। উনি এই আধার মাঝরাতে আমার সাথে কি করে? আমার মধ্যিখানে বিচলিত ভাব উদয় হলো যখনি পরখ করলাম এটা আমার এই বাড়িতে বরাদ্দকৃত কাঙ্খিত ঘর নয়। অস্বস্তি ভয় নিমিষেই গ্রাস করে ফেললো আমায়।
আমি আয়ানের ঘরে? আয়ান আমাকে তার ঘরে নিয়ে আসলো কেনো? সে কি চায়? কেনোই বা এখানে এনেছে আমাকে? এরূপ হাজারো প্রশ্ন হাতছানি দিয়ে কুড়মুড় করতে লাগলো আমার উদরে।
আমি খানিকটা জোরালো তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠলাম,
-‘ আপনি আমাকে এখানে এই সময় এভাবে এই অবস্থা কী কারণে তুলে নিয়ে এসেছেন? ‘
উনি আমার প্রতুত্তরে আক্রোশ মিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিলেন,
-‘ এতো ষাড়ের মতো চিল্লাও কেনো? চিৎকার চেচামেচি করার কি আছে? চিল্লানোর উপর কি ডিগ্রী অর্জন করার ইচ্ছা আছে নাকি?’
আমি উনার কথায় রীতিমতো বেকুব বনে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। কিসব আজগুবি কথা বার্তা বলছেন উনি? মনোনিবেশে চরম কড়া শত খানিক গালাগাল করলাম উনাকে।
আয়ান আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসতেই আমি খানিকটা বিভ্রান্ত হলাম। উনাকে অবজ্ঞা করে সরে যেতেই উনি তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে আমার দুইপাশে স্থাপন করে বন্দি করে নিলেন তার বাহু বেষ্টনীর খাচায়। আমার দিকে তার মুখ ঝুকিয়ে মৌনতা ছিন্ন করে রাশভারী গলায় বললেন,
-‘ আদ্রর জন্য এতো ছটফটানি আর আমার সময় ঠুনকো হাওয়া? ইউ হেভ টু পে ফর ইট। ইউল ইউ রেডি?’
আমি উনার প্রতুত্তরে নিস্তব্ধ রইলাম। শুধু আলতো করে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলাম। উনি আমার ব্যাপারে অনেকটা পসেসেইভ (Possessive) দেখায়। এখন আমার সাথে ভয়ংকর কিছু হতে চলেছে। ইয়া আল্লাহ মাবুদ বাচাও। আমি শাস্তির প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য বললাম,
-‘ আ..আপ..আপনি ঘুমান না? মানে ঘুম ধরে না? শরীর খারাপ নাকি আপনার? ঔষধ খেয়েছেন?’
আয়ান তার অধর প্রান্তদ্বার যুগল প্রসারিত করে বললো,
-‘ এসব ফাউল ট্রিক আমার উপর প্রয়োগ করে কোনো লাভ নেই মিসেস চৌধুরী। তো বলেন আপনাকে কেমন শাস্তি দিবো? বউ হচ্ছে রোমান্স করার জিনিস তো…’ বলে আমার মুখে ফুক মারলো।
আমার মুখের অপর গরম হাওয়া প্রবাহিত হতেই আমি চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে ফেললাম। এই ছেলের মতিগতি একদমি ভালো না। মনে দোয়া দরূদ আওড়াতে লাগলাম। হে আল্লাহ! আমাকে এই যাত্রায় আমাকে বাচিয়ে দাও। শুধু আদ্র ভাই কেনো তার চৌদ্দ গোষ্ঠীর থেকে দূরে থাকবো। দোয়াতে মত্ত অবস্থায় উনার গম্ভীর কন্ঠে ঠান্ডা থ্রেট শুনে আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো।
-‘ জাস্ট অনান্স এগেইন, ঠোট কামড়াকামড়ি করেছো তো আই প্রমিস আমি নিজে তোমার এই গোলাপি সফট লিপ্স খেয়ে ফেলবো’
সারা শরীরে অদ্ভুত এক ঝংকার দিয়ে যাচ্ছে। আমি গভীরভাবে কিছু ভাবতে গেলে আনমনেই ঠোঁট আকড়ে ধরি। তাই বলে এমন হুমকি কেও দেয়? আমি ঠোট উল্টে ইনোসেন্ট ফেসে মোলায়েম স্বর নিয়ে বললাম,
-‘ এবারের মতো মাফ করে দেন। আপনি অনেক দয়ালু তাই না?’
আমার এতো করুণ ভরা কণ্ঠেও ব্যাটা বজ্জাতটার মন গলানো গেলো না। বরং তার মুখে প্রকাশ পেলো দুষ্টু হাসি।
-‘ অপরাধ যখন করেছো শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। ভেবেছিলাম তোমার অপর শাস্তি ছেড়ে দিবো কিন্তু বাঙালি হলো খেতে দিলে বসতে চায়, বসতে দিলে শুতে চায়। এখন তোমাকে হালকা ঢিল দিলেই উড়াউড়ি শুরু করে দিবে। কিন্তু এবার তো এটা হচ্ছে না মিসেস ওয়াইফি। তাই আমি আমার মতো করে শাস্তি দিবো’ বলে আয়ান তার মুখ আমার দিকে এগোতে লাগলো। আমার চোখ মুখে ভয়াতের ছাপ ফুটে উঠেছে। ঘরে এয়ার কুলার চলমান হওয়া সত্ত্বেও ইতিমধ্যে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম কণা জমা হচ্ছে। আমার চোখ এদিক অদিক চঞ্চল।
আমার নিচের ঠোটে তীব্র আঘাতে আমি ভাবনার জগৎ খন্ড বিখন্ড করে “আহহ..” করে উঠলাম। চোখের কার্নিশে এক ফোটা অশ্রু কণাও জমা হয়েছে।
আয়ান খানিক দূরত্বে রেখে সরে আসলো। আমি উনার দিকে রক্তিম দৃষ্টি আরোপ করলাম। উনার কোনো ভাবান্তর হলো না। উনার হাব ভাব দেখে মনে হয় যা করেছে একদম বেশ করেছে।
আমি মুখে রাগের আভা ফুটিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললাম,
-‘ আপনার কি সবসময় আমার সাথেই কামড়াকামড়ি করতে হয়? কামড়ানোর আর মানুষ পান না?’
উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
-‘ পাবো কই? বিয়ে তো আমি একটাই করেছি’ বলে স্মিত হাসলেন উনি।
তার কথার পুরো অংশ আমার কর্ণগোচর হলেও প্রথম অংশ ” পাবো কই? ” এইটুকুতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। না থাকলে নাই!! তাই বলে কি আমাকে কামড়াবে নাকি? এখন আমি এই ঠোটের বেহাল অবস্থা নিয়ে সবার সামনে যাবো কীভাবে?
আমি কাদো কাদো কণ্ঠে বলে উঠলাম,
-‘ আপনি অনেক পচা লোক’
-‘ জানি। কিছুই করার নেই, এমনো হতে পারে সারাজীবন এই পচা লোক নিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু কথায় আছে না শাসন করে যে সোহাগ করে সেই’ বলে পর পর আলতো ভাবে ঠোঁটের কাটা অংশে চুমু দিলো আয়ান। সাথে সাথে খামচে ধরলাম বিছানার চাদর। বারংবার বাজতে লাগলো সারাজীবন শব্দটির প্রতিধ্বনি। নিস্তেজ হয়ে গেলো আমার শরীর।
.
.
.
রিমির ডাকে স্মৃতি চারণ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। সে শপিং এ যাওয়ার উত্তেজনায় এককথায় অস্থির। সে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে এনগেজমেন্ট, গায়ে হলুদ, মেহেন্দী, সাঙ্গীত, বিয়ে, বৌভাত সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা কেমন ড্রেস কিনবে। রিমির নন্সটপ পকর পকর কথার মাঝে একবার নিজেকে আয়নায় পরখ করে নিলাম। উহু ডার্ক ম্যাট শেডে অতটাও খারাপ লাগছে না আমায়। হাতে ফোন নিয়ে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রিমির কথা শুনতে শুনতে নিচে নামলাম। পরক্ষণে যা দেখলাম তাতে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। হঠাৎ….
#চলবে…