সন্ধ্যা নামার পরে পর্ব ১

একটু আগে আমার বিয়ে হয়ে গেল। আমার ইচ্ছেতে নয়। বরং জোর করে ধরে বেধে গ্রামের মানুষ বিয়েটা দিয়ে দিল। একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল না এখানে আমাদের ভূমিকা কতটুকু। ডাক্তার সাহেব আমাদের গ্রামে প্রতিমাসে দু’বার আসেন। গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করেন। গতরাতে বাবার খুব শ্বাসকষ্ট বেড়েছিল। সাথে জ্বর তো আছেই। আমার এ ছোট্ট জীবনে একমাত্র বাবা ছাড়া আর কেউ তো নেই। তাই বাবার অসুস্থতায় পাগলের মত ছুটে গিয়েছিলাম ডাক্তার সাহেবের কাছে। তখন আমার মনে এটা ছিল না, রাত কতটা গভীর। কিংবা আমার মত সমর্থ মেয়ে একজন পুরুষকে ডাকলে তাতে যে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়। সে যদি ডাক্তারও হয় তবে তাতেও সমস্যা। ডাক্তার সাহেব আমার সাথে রাতে বাবাকে দেখতে এসেছিলেন।

বলাই বাহুল্য যে বাবাকে যদি ডাক্তার না দেখতেন তবে হয়তো খারাপ কিছু একটা হয়ে যেত। বাবার অবস্থা বেগতিক দেখে ডাক্তার থেকে গেলেন আমাদের বাড়িতে। আমি অনেকবার বলার পরও তিনি গেলেন না। বাবার দুইপাশে আমরা দুজন বসে থেকে রাত কাটিয়েছি। ভোর রাতের দিকে কখন আমার ঘুম এসে গিয়েছিল আমি বুঝতেই পারিনি। যখন ঘুম ভাঙল তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। পাশের বাড়ি মকবুল চাচাসহ গ্রামের আরও কয়েকজন এসে ভিড় করেছে আমাদের ঘরে। তাদের ডাক্তার সাহেব কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু অন্যরা বলতে দিচ্ছে না। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় কিছু না বুঝতে পারলেও ধীরে ধীরে বিষয়টা ভয়াবহভাবে আমার কাছে ধরা দিল। ভয়ে তখন আমার পুরো শরীর কাঁপছে।

সবার এক কথা আমার সাথে ডাক্তার সাহেবের খারাপ কোনো কিছু হয়েছে যার একমাত্র সুরাহা হচ্ছে বিয়ে। আমি মকবুল চাচার পায়ে পড়ে কাঁদতে লাগলাম অনেকবার বললাম এমন কিছুই হয়নি। বাবা অসুস্থ বলেই শুধু উনি এসেছেন। কেউ আমার কোনো কথাই শুনল না। বরং নানারকম নোংরা কথা বলে যাচ্ছিল আমাকে। বাবা কোনোরকম উঠে বসলেন। একে তো শরীর রোগে জর্জরিত তার উপর এমন একটা ঘটনায় আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাইরে থেকে অনেকে বলছে, “গ্রামে এসে মেয়েদের সাথে ফুর্তি করে চলে যাবে। এ হবে না। সবকিছুর একটা শেষ আছে। যে করেই হোক এ ডাক্তারকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে।”

তাদের প্রতিটি কথা আমার মনে হাজার গুণে ভয়ের বৃদ্ধি করছিল। ডাক্তার সাহেব অনেক চেষ্টা করেও কাউকে কিছু বুঝাতে পারলেন না। অবশেষে বাবাকে বললেন, “আপনি বলেন আমরা কী খারাপ কোনো কিছুতে জড়িয়েছি? আপনি তো ছিলেন এ ঘরে।”

বাবা আমাদের অবাক করে দিয়ে হাত জোড় করে বললেন, “আমার মাইয়াডারে বিয়া কইরা নেনে বাবা। নয়তো এ গ্রামের মানুষ তারে বাঁচতে দিব না। রক্ষা করেন ডাক্তার সাহেব।”

বাবার কথা শুনে আমরা একে অপরের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। শেষ পর্যন্ত বাবাও এমনটা বলতে পারলেন! ঘর ভরতি মানুষ তখন লাই পেয়ে আরও বেশি কটুকথা বলা শুরু করল। বাইরে ততক্ষণে কাজী সাহেব এসে গেছেন। সেই অবস্থায় আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। বাবার কথার পর ডাক্তার সাহেব আর একটা কথাও বললেন না। যে যেভাবে বলল সেভাবেই করলেন। আমি সই করার আগে তার দিকে একবার তাকিয়ে ছিলাম যদি একবার সে বলে এ বিয়ে সে করতে চায় না। তবে আমি কিছুতেই এ বিয়ে হতে দিতাম না। কিন্তু সে তেমন কিছুই করল না। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে সই করে দিল।

বিয়ে হয়ে গেল আমাদের। ধীরে ধীরে লোকজন কমতে লাগল। যাওয়ার সময় মাতব্বরসহ কয়েকজন ভালো করে বলে দিয়ে গেলেন ডাক্তার সাহেব যাতে আমাকে সাথে করে চট্টগ্রাম নিয়ে যান। ডাক্তার সাহেব তাদের নিশ্চিত করলেন তিনি নিয়ে যাবেন। সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে পেয়ারা গাছের নিচে মোড়াতে গিয়ে বসলেন। জানালা দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে উনাকে কতটা অসহায় দেখাচ্ছে। এত বড় একজন ডাক্তার এখানে মানুষের সেবা করতে এসেছেন। আর এখানেই তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের শেষ করে দিল।

আমি বাবার দিকে এই প্রথম রাগান্বিত চোখে তাকালাম। বাবা অসহায়ের মত মাথা নিচু করে বসে ছিলেন। বাবাকে বললাম, “কী করে এটা করতে পারলে তুমি বাবা? এটা করে সমাজের কাছে তুমি প্রমাণ করে দিলে আমি সত্যি পাপ করেছি। এটা কেন করলে বাবা?”

কান্নায় আমার কথা ভেঙে ভেঙে আসছিল তখন। অনেক কষ্টে বললাম, “বাবা ও-ই লোকটা শুধু তোমাকে সুস্থ করার জন্য রাত জেগে এখানে বসে ছিল। আর তুমি কী করে এটা করলে তার সাথে? কারো ভালো মানুষির সুযোগ তুমি নিতে পারো না। তুমি কী ভেবেছো বিয়ে হয়ে গেছে মানে আমি কিছু করতে পারব না। দেখো কী করি। ডাক্তার সাহেবকে বলব যত তাড়াতাড়ি পারে ডিভোর্সের ব্যবস্থা করতে। এ বিয়ে মানি না আমি।”

রাগে দুঃখে কখন যে আমার গলার আওয়াজ এত বেড়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। ডাক্তার সাহেব বাইরে থেকে এসে আমার গালে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। আমি হতবাক হয়ে গালে হাত দিয়ে শুধু তারদিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে বললেন, “একজন অসুস্থ মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলছো তুমি! মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এখন সবকিছুর আগে উনাকে সুস্থ করে তোলা দরকার। তারপর তুমি যত ইচ্ছে তার উপর রাগ ঝেড়ো।”

আমি যেন আরেকটা ধাক্কা খেলাম যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর! এ লোক তো ভালো নয়। বিয়ে না করতেই বউয়ের গায়ে হাত তুলে! একে তো এখনই ডিভোর্স দেয়া দরকার। ক্ষোভে আমার আরও বেশি কান্না পেল।

হঠাৎ অভদ্র ডাক্তার সাহেবের গলার আওয়াজে আমার সম্বিৎ ফেরে। তিনি উৎকণ্ঠা হয়ে বললেন, “নিরা তাড়াতাড়ি একটা গাড়ি ডাকো। তোমার বাবার অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। এখনই হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”

আমি তড়িঘড়ি করে উঠে বললাম, “আপনি তো ডাক্তার। আপনি চিকিৎসা করুন না। হাসপাতালে যেতে যেতে যদি বাবার কিছু হয়ে যায়?”

তিনি আবারও রাগি গলায় বললেন, “বেশি বুঝা বন্ধ করবে তুমি? এখন উনাকে অক্সিজেন দিতে হবে। সেটা নিশ্চয়ই এখানে সম্ভব নয়? একদম পাকামি করবে না। যা বলছি করো কুইক?”

আমি দৌঁড়ে গিয়ে পাশের বাড়ির রাকিবকে পাঠালাম গাড়ির জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি এসে গেলে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পুরো রাস্তায় এই অভদ্র ডাক্তার আমাকে ধমক দিয়েই গেছেন। একটু কাঁদতে লাগলেই উনার ধমকে চুপসে যেতে হয়েছে। বুঝতে পারলাম আমাকে বিয়ে করে তিনি খুব অসন্তুষ্ট তাই এমন রাগ ঝাড়ছেন আমার উপর। পুরো রাস্তায় আর একটা টু শব্দটি করিনি। শুধু মনে হয়েছে যদি লোকটা আবার মাইর দেয়। নিজের উপর রাগ হচ্ছিল। বারবার নিজেকে অতি তুচ্ছ ফেলনা মনে হচ্ছিল। যাকে খুব সহজেই অজানা অচেনা এক ব্যাক্তির ঘাড়ে তুলে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া বাবার জন্য চিন্তা তো আছেই।

বাবাকে ভেতর নিয়ে গেল আমাকে বলল বাইরে থাকতে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে বললেন বাবা এখন ভালো আছেন। অক্সিজেন দেয়া হয়েছে। আমি ভেতরে গিয়ে বাবার পাশে বসে রইলাম। তিনি একবার বাবাকে দেখে চলে গেলেন। সারাদিন আর এলেন না। একজন নার্সকে দিয়ে আমার জন্য খাবার পাঠিয়ে দিলেন। কিছুতেই এ লোকের দয়া নিতে ইচ্ছে করল না তাই খেলাম না। চুপচাপ নিজের দূর্ভাগ্যের কথা ভাবতে লাগলাম। ঠিক করলাম বাবা সুস্থ হলেই ডাক্তার সাহেবকে মুক্তি দিয়ে আগের মতো জীবন যাপন করব।

★★★

বাবার জন্য ওষুধ আনতে নিচে গিয়েছিলাম এসেই শুনি উনি এসে বাবাকে দেখে গেছেন। মনে মনে শান্তি পেলাম। অন্তত এ লোকটার সাথে দেখা তো হলো না। রাত নামতেই বাবাকে কিছুটা সুস্থ মনে হলো। নার্স বাবার আর আমার জন্য খাবার দিয়ে গেলেন। বাবাকে খাইয়ে দিয়ে। শুইয়ে দিলাম। বাবা বললেন, “তুই খাবি না মা?”

“আমি খেয়ে নেব পরে। এখন ইচ্ছে করছে না বাবা। তুমি ঘুমাও।”

“তুইও তো কাল রাত থেকে ভালো করে ঘুমাতে পারিসনি। এখন ঘুমিয়ে পড়।”

আমি চাইলেও আমার এখন ঘুম আসবে না। তাও বাবাকে ঘুমাব বলে সান্ত্বনা দিলাম। কিছুক্ষণের ভেতর ক্লান্তিতে বাবার ঘুম এসে গেল। আমি কেবিনের বাইরে এসে অন্যরা কী করছে দেখতে বের হলাম। একটা লোক হঠাৎ আমার হাতে একটা মিষ্টি ধরিয়ে দিলেন। হেসে বললেন, “আমার একটা মেয়ে হয়েছে। দোয়া করবেন তার জন্য।”

আমি হাসলাম। হাসপাতালে সবসময় কষ্টের খবর থাকে। শুধু এ একটা বিষয়ে সুখের খবর হয়। লোকটা বাবা হয়েছে বলে কত খুশি। বললাম, “অবশ্যই দোয়া করব।”

উনি হেসে সামনে নার্সের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমিও সামনের দিকে হাঁটতে লাগলাম। কয়েকটি বেঞ্চিতে কয়েকজন লোক বসে আছে। বাবাকে যে নার্সটি দেখেন তিনি আমাকে দেখে বললেন, “নিরা তোমার বাবাকে দেখলাম ঘুমাচ্ছেন। এখন তুমিও একটু ঘুমিয়ে নাও। সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমার উপর।”

আমি অবাক হলাম উনি আমার নাম জানলেন কী করে। সেটা জিজ্ঞেস করব বলেও করলাম না।
বললাম, “আমি যাচ্ছি আপু।” তিনি হেসে বিদায় নিলেন।

কেবিনে এসে বাবাকে দেখলাম। তারপর পাশের চেয়াটা টেনে বাবার হাত ধরে বসে রইলাম। ছোট বেলায় মা মারা যাওয়ার পর বাবাই আমাকে লালন পালন করেছেন। আমার জন্য বিয়ে পর্যন্ত করেননি। আজ সেই বাবাকে এমন অসুস্থ অবস্থায় দেখে ভয় হচ্ছে। ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় করে। আমারও হয়েছে ঠিক তাই সবকিছু হারিয়ে বাবাকে হারানোর কথা ভাবতেও পারি না। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে ফেসবুকে ঢুকলাম। হুমায়ুন আহমেদ স্যারের কৃষ্ণপক্ষ উপন্যাসটি পড়া শুরু করলাম।

★★★

সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন ঘড়িতে সাতটা। রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই জানি না। হঠাৎ মাথার নিচে বালিশ দেখে চমকে গেলাম। আমি তো বাবার কেবিনে মাথা রেখে বসা অবস্থায় ঘুমিয়ে ছিলাম। তাহলে বালিশ এল কোথায় থেকে! ভাবলাম হয়তো নার্স এসেছিল রাতে। ঠিক তখনই নার্স এসে বললেন, “ডাক্তার অর্নব বলেছেন তোমাকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে নিরা। তোমার বাবাকে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে হবে। উনার কিছু পরীক্ষা করানো দরকার। যা আমাদের হাসপাতালে হবে না।”

আমি দাঁড়ানো থেকে বসে গেলাম। ভয় হতে লাগল আমার বাবার কিছু হলো না তো। নার্সকে জিজ্ঞেস করেল তিনি জানান। তেমন কিছু বুঝা যাচ্ছে না। তাই খুব তাড়াতাড়ি পরীক্ষা গুলো করিয়ে নেয়া দরকার।

আমি ডাক্তার অর্নবকে খুঁজতে লাগলাম। পেয়েও গেলাম তাকে বললাম, “আমার বাবার যত পরীক্ষা করানো দরকার আমি করিয়ে নেব। আপনার এতটা সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। এখন আপনি ফিরে যেতে পারেন। কালকের দিনটা আপনার জীবনে আসেনি বলেই মনে করবেন আশাকরি। আমার জন্য অনেক অপমানিত হতে হয়েছে আপনাকে। তার জন্য ক্ষমা চাইছি।”

আমি কী এমন বললাম জানি না। কিন্তু অভদ্রলোকটা আমাকে আবার ধমক দিয়ে বলল, “বাড়ি গিয়ে তৈরি হয়ে আসো। সময় খুব কম। এরপর তোমার জন্য, তোমার বাবার কিছু হয়ে গেলে আমাকে দায়ী করতে পারবে না।”

তার কথা শুনে আমার ভয় আরও বেড়ে গেল। আমি
বাড়ি এসে বাবার আর আমার প্রয়োজনীয় কিছু জামা কাপড় নিলাম। ডাক্তার অর্নবের গাড়িতে উঠলাম বাবাকে নিয়ে। মনে হলো চব্বিশ ঘণ্টায় মানুষের জীবন কতটা পাল্টে যেতে পারে। কতটা অসহায় হয়ে যেতে পারে মানুষ। আমার হেসে খেলে বেড়ানো জীবনটা এভাবে এলোমেলো কেন হয়ে গেল! কী অপরাধ করেছিলাম আমি!

হঠাৎ লেখলাম আমার পাশের সিটে বসলেন ডাক্তার সাহেব। ঠিক তখনই উনার ফোনে কল আসল। না চাইতেও তার ফোনের স্কিনে চোখ আটকে গেল আমার। যিনি কল করেছেন তার নাম দিয়া। অভদ্রলোকটা আমার দিকে তাকিয়ে কী ভেবে যেন ফোন ধরলেন না। ফোনটা মাথার সাথে ঠেকাতে লাগলেন। আমার মনে হলো এই মেয়েটা কে হতে পারে? উনার বউ নয়তো?

চলবে

#সন্ধ্যা_নামার_পরে
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here