#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২৩
সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার ধীরে ধীরে ধরণী কে গ্রাস করে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে ধরণীও তলিয়ে যাচ্ছে নিকষকালো অন্ধকারে। বিশাল মালিক হাউজটি চারপাশে হরেক রকমের মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো। নানান রকম আলোয় ঝলমল করছে বাড়ি। বিশাল গেইট সাজানো হয়েছে গোলাপ ফুল দিয়ে। এক কথায় অসাধারন সাজে সজ্জিত পুরো বাড়ি। বাড়ির বাগানে বিশাল স্টেজ দেওয়া হয়েছে।
মায়ার সাজ শেষ হতেই মায়াকে সিমি নিয়ে গিয়ে স্টেজ এ বসিয়ে দেয়৷ সমস্ত মেহমানরা মায়াকে দেখে মুগ্ধ। সামরান এখনো আসে নি। সেলিনা মালিক সিমি কে গিয়ে দেখতে বলে সামরানের হলো কি না। সামরানের দরজার সামনে এসে সিমি দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে প্রবেশ করতেই সিমির চোখ কপালে,
–একিই!আপনারা দুজন একই শেরওয়ানি কেন পরেছেন? কোনটা বর সবাই কি করে বুঝবে?
–এটাই তো টুইস্ট। আমিও দেখি আমার শালিকা ওরফে ভাবিজান তার হাসবেন্ড কে চিনতে পারে না কি? বলেই শেহেরজাদ চোখ মেরে দিল।
সিমির গাল অটোমেটিক হা হয়ে গেল।
–এসব কি কথা বার্তা। আর ভাইয়া আপনিও ওনার কথা কেন ধরতে গেলেন? লোকে কি বলবে?
–তুমি এমন ভাব করছো যেন আমি বাসর করতে চাইছি! শেহের এর এমন কথায় সামরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। সিমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। দুজনের চেহারার দিকে তাকিয়ে শেহেরজাদ হাসলো।
–এইভাবে তাকিয়ে থাকার কোনো মানেই হয় না আই নো আমি হ্যান্ডসাম।
সামরান শেহেরজাদের পিঠে হালকা একটি চড় বসালো।
–হ্যান্ডসামের বাচ্চা এবার যাওয়া যাক সবাই ওয়েট করছে।
–অবশ্যই। বলেই শেহেরজাদ সিমিকে চোখ মেরে দিল। সিমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমীর আর শেহনাজ এসেছে। সেলিনা মালিক, সামাদ মালিক মায়ার পাশেই ছিলেন আমীর আর শেহনাজকে দেখে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে যায় সেলিনা মালিক। শেহনাজ কে জড়িয়ে ধরে।
–কেমন আছেন?
–ভালো আছি। আপনারা ভালো আছেন আসতে অসুবিধে হয়নি তো?
–না না অসুবিধে হয়নি। সেলিনা মালিকের সাথে কথা শেষ করে শেহনাজ মায়াকে জড়িয়ে ধরে।
–কেমন আছিস আম্মু..?
মায়া কিছু না বলে শেহনাজ কে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল,
–আরে কাদঁছিস কেন? সাজ নষ্ট হয়ে যাবে তো। কাল সকালেই তো নায়র যাবি কাদাঁর কি আছে?
–আমাকে তো সবাই ভুলেই গেছে। পাশে দাঁড়িয়ে বলে আমীর।
মায়া ছোট আব্বু বলেই জড়িয়ে ধরে আমীর কে।
–মাশাল্লাহ সুন্দর দেখাচ্ছে আমার মা টা কে। আমীর এর কথার উত্তর দিতে গিয়ে মায়ার চোখ পড়ে পেছনে। সিমি ধীর পায়ে এসে দাঁড়ায়। মায়া সিমির দিকে একবার তাকিয়ে আমীর এর দিকে তাকালো। মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে বলল,
— ছোট আব্বু পেছনে দেখো।
আমীর পেছনে ফিরতেই সিমিকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। শেহনাজের চোখে পানি টলমল করছে। সিমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একটি নীল কাতান শাড়ি পরেছে। চুল গুলো খোপা করা। খোপায় গাজরা। চোখ তুলে বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠল সিমি।
–আব্বুহ্!
আমীর পিছিয়ে যায়।
–আমাদের যাওয়া উচিৎ। শক্ত কন্ঠে বলে আমীর। সিমি দুপাশে মাথা নাড়তে থাকে। চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরছে।
সেলিনা মালিক এসে পাশে দাড়ালো,
–কেন চলে যাওয়া উচিৎ? সিমি আমার ছেলের বউ। ওই যে আমার শেহেরজাদের। বলেই সামরানের সাথে আসতে থাকা শেহেরজাদকে ইশারায় দেখালো সেলিনা মালিক। আমীর বা শেহনাজ কেউই শেহেরজাদ কে দেখেনি। শেহেরজাদ এর দিকে তাকিয়ে তারা অবাক হয়ে পড়ে। শেহেরজাদ আর সামরান জমজ। অবিশ্বাস্য চাহনী নিয়ে সেলিনা মালিকের দিকে তাকালো আমীর।
–হ্যা আমার দুই ছেলে। আর এরা জমজ। ভাইজান যা হয়েছে ভুলে যান। মেয়েকে আর দূরে সরিয়ে রাখবেন না। এত দিন আমার কাছে ছিলো না। অনেক দূরে পড়ে ছিল। আর দূরে সরিয়ে দেবেন না। বাচ্চারাই তো ভুল করবে। মাফ করে দিন। আর রাগারাগি করবেন না।
–হ্যা আমীর ভাই। আপনার দুই মেয়ে আমার ঘরে খুব ভালো থাকবে। আমার দুই ছেলেই অনেক ভালো। মাফ করে দিন। আর রাগারাগি করবেন না। পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে সামাদ মালিক।
মায়া এসে আমীর এর শেহনাজের সামনে দাঁড়ায়। পাশেই সিমি মাথা নিচু করে আছে। সিমিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে মায়া,
–ছোট আব্বু, আমার আপু আজ কতবছর পর এসেছে তোমার সামনে তুমি এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে? তুমিইতো বলতে তোমার মেয়েদের চোখের পানি তোমার কাছে তীর এর মত বিঁধে। তাহলে? মাফ করে দাওনা আপুকে। আমার আপু দেখো কেমন করে কাদঁছে। আমাদের তোমরা ছাড়া আর কে আছে বলো। তোমরা দূরে সরিয়ে দিলে বেঁচে থাকা যাবে কিন্তু আগের মত আর হাসি-খুশি থাকা যাবেনা। ক্ষমা করে দাও না। আমীর মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ার চোখ থেকেও পানি পড়ছে। মায়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে সিমির দিকে তাকায় আমীর। শক্ত কণ্ঠে শেহনাজ কে বলে,
–শেহনাজ ওদের বলে দাও ওরা যেন না কাদেঁ। আমি মরে যায়নি যে এইভাবে কাদঁতে হবে। আমীরের এমন কথা শুনে শেহনাজের মুখে হাসি ফুটে উঠে। সিমি চট করে নিজের বাবার দিকে তাকালো। ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। সিমিকে বুজে জড়িয়ে এক হাত বাড়িয়ে মায়াকেও কাছে টেনে নিলো আমীর। দুই বোন বাবার বুকে মিশে আছে। সামরান আর শেহেরজাদ এসে দাঁড়াতেই সেলিনা মালিক সালাম করতে বলে। দুইভাই সালাম করতে নিলেই আমীর ধরে নেয়,
–লাগবেনা। তোমাদের জায়গা আমার পদতলে না। বলেই দুজন কে জড়িয়ে ধরে।
ফাইজা এসেই মায়ার কাছে চলে গেল। স্টেজ এ মায়ার পাশে গিয়ে দাড়াতেই মায়া জড়িয়ে ধরলো।
–এত দেরী?
–আরে এড্রেস এত ভেতরে যে কি বলবো একটু কষ্ট হয়েছে।
–এই কারণে বলেছিলাম গাড়ি পাঠিয়ে দিই।
–থাক বড়লোকের বউ। আমার গাড়ি লাগবে না। তা আপনার বর কোথায় তাকে দেখছি না।
–আশেপাশেই আছে হয়তো। দাড়া আমার আপুর সাথে তোকে দেখা করাই।
মায়া সিমিকে ডাক দিলো। সিমি স্টেজ এ উঠতেই ফাইজা পেছনে ফিরে। ফাইজাকে দেখে যেন সিমির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। মুহুর্তেই হাসোজ্জল চেহারাটিত্র আঁধার নেমে এলো। মলিন মুখটা জুড়ে আতংক ছড়িয়ে আছে। ফাইজা ভ্রু কুঁচকে একবার সিমিকে দেখলো। তারপর বলল,
–তুইই?
সিমির হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে এ কার সাথে বন্ধুত্ব করলো মায়া?
–হ হ্যা আম আমি..
–তোরা একে অপরকে চিনিস? বিস্ময়কর কণ্ঠে প্রশ্ন করে মায়া।
সিমি কিছু বলার আগেই ফাইজা বলে ওঠে,
–কেন চিনবো না। ও আর আমি একসাথেই পড়েছি। শুধু তাই না ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। আর আমি ওর একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড। মায়ার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। তবে কি এই মেয়েটার কথায় আম্মা বলেছিলো? ফাইজাই কি…? মায়া কিছু ভাবতে পারছে না। মায়া সিমির দিকে একবার তাকালো। সিমির চেহারা দেখে মায়া বুঝতে পারে ফাইজাই সেই মেয়ে যে সামরান কে রিজেক্ট করেছিলো। সেলিনা মালিক মায়াকে দেখতে এসে ফাইজা কে দেখে চমকে উঠলো,
–তুমি এখানে?
–কেমন আছেন আন্টি?
–আমার প্রশ্নের উত্তর এটা না।
–আন্টি আমি মায়ার ফ্রেন্ড। মায়ার দিকে একবার তাকালো সেলিনা মালিক। মায়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ফাইজা মায়াকে কিছু বুঝতে না দেওয়ার জন্য বলে উঠে,
–আন্টির সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছিলো সেই সুবাদেই পরিচিত তাই না?
সেলিনা মালিক জোর করে হাসলেন। মায়া ও ফাইজা কে বুঝতে দিলো না। সিমিকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলল। সিমি শান্ত হওয়ার চেষ্টা চালিয়েই ব্যর্থ হচ্ছে বার বার। কারণ একবার শেহেরজাদ বা সামরান দেখে নিলে কেলেঙ্কারি বেধে যাবে। সিমি ফাইজাকে খাওয়ার জায়গায় নিয়ে গেল। খাবার টেবিলে না বসে ফাইজা সিমিকে জড়িয়ে ধরলো,
–সিমি আমি তোকে খুব মিস করেছি।খুব!
–ছাড় আমাকে। খেয়ে নে!
–মায়া আমার ব্যাপারে জানে না?
— না জানে না।
— সিমি আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। আমার সেদিন তেমন করা উচিৎ হয়নি। আমি সামরানের সাথে অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু হয়ে উঠেনি। আমি সামরান…..
ফাইজা কথা শেষ করার আগেই সিমি হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল,
–ব্যস ফাইজা। আর না! আর কিচ্ছু করিস না। যা হয়েছ্র তা ভুলে যা। তুই নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছিলি। এই সংসার এখন আমার বোনের। আমার বোনের সংসারে আর ব্যাঘাত ঘটাস না। আর ভাইয়াকে ভুলে যা। তোর জন্য ভাইয়া কম কষ্ট পায়নি। আর এখন যখন ভাইয়া সুখে থাকতে চাইছে ভাইয়াকে সুখে থাকতে দে। আর কিছু করিস না দোহাই লাগি।
–কিন্তু আমি সামরানকে ভালোবাসি সিমি।
–ভুললে চলবে না ভাইয়া বিবাহিত। আর আমার বোন তার বউ। ভাইয়া আমার বোনকে অনেক ভালোবাসে। আমি চাইনা ওদের পথে কেউ বাধা হয়ে আসুক।
–আমি বিশ্বাস করিনা। সামরান আমাকে অনেক ভালোবাসতো। ও আমাকে ভুলতেই পারেনা।
–ভালোবাসতো! বাসে না। আর তোকে ভাইয়া আসলেই ভুলতে পারবে না। কারন তুই কাজটাই তেমন করেছিস।
–কিন্তু সিমি আমি তো আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।
–সব ভুলের ক্ষমা হয়না ফাইজা। আর অনেক দেরী হয়ে গেছে। তোর জন্য আমিও আমার জীবন থেকে ৪টা বছর হারিয়ে ফেলেছি। আমি এখনো শেহেরজাদ কে মেনে নিতে পারিনি। শেহেরজাদ আর আমার সম্পর্কে শেহেরজাদই জোর দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। আমি চাইনা আমার বোনের জীবনে এমন হোক। তুই ওদের মাঝে আসবি না ব্যস!
–আমি সামরান কে একবার দেখতে চাই। আমি জানি আমি বুঝালে ও বুঝবে।
ফাইজার কথা শুনে সিমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,
–ফাইজা! কিসের ভিত্তিতে এসব বলছিস। তুই ভাইয়ার সামনে যাবি না। নিষেধ করছি শুনিস।
ফাইজা কিছু না বলে চলে গেল। সিমি ফাইজার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। এ কোন বিপদের আভাস পাচ্ছে সিমি। কি হবে? মায়া আর সামরানের জীবনে ফাইজা কি কাটা হয়ে দাঁড়াবে? সিমি আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।
বিঃদ্রঃ পড়ালেখার পাশাপাশি গল্প দিচ্ছি সবাই একটু জানাবেন কেমন হচ্ছে। যারা পড়ছেন তাদের মন্তব্য আশা করছি। আমার পেইজের রিচ কম। সবাই রেসপন্স করুন। সবার মতামতের অপেক্ষায় থাকি আমি।
চলবে…..???