মেঘ পরশে বর্ষণ পর্ব ৭

#মেঘ_পরশে_বর্ষণ
মোর্শেদা হোসেন রুবি

৭||
আরশকে কলকলিয়ে হাসতে দেখে মনটা অপার আনন্দে ভরে উঠেছে মেঘার। ছেলে যে তার সুস্থতার দিকে যাচ্ছে এটা বোঝার জন্য বড় ডাক্তার হবার দরকার নেই। আরশ হাসছে খেলছে দুধ খাচ্ছে। আগের মত কান্না করছেনা। সারাটা রাত সাউন্ড স্লিপ ঘুমাচ্ছে। এই সিমটম গুলো ওর সুস্থতা প্রমানের পক্ষে যথেষ্ট। যদিও মাঝে মধ্যে বুড়োদের মত খুক খুক করে কাশছে । তারপরেও সেটা ধর্তব্যে আসার মত না। তবু নার্স এলে তাকে জিজ্ঞেস করাতে সে পজিটিভ উত্তরই করল। তখনই মেঘা সিদ্ধান্ত নিল যে আজই আরশকে ডিসচার্জ করিয়ে বাড়ী ফিরে যাবে। এখানে আর একমুহূর্ত মন টিকছে না। যদিও কথা ছিল আজকের দিনটা দেখে আগামীকাল বা পরশু আরশকে ছাড়া হবে। কিন্তু আরশের শারিরীক অবস্থার উন্নতি দেখে মেঘা নিজেই গিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলল। অনুরোধ করল যেন আরশকে আজকেই ছেড়ে দেয়া হয়। যেহেতু ইঞ্জেকশনের ডোজ শেষ। নতুন স্যালইনও আর দেয়া হয়নি। নেবুলাইজারের প্রয়োজন হলে এলাকার ডিসপেনসারি গুলোতেও এভেইলেবল। কাজেই মেঘা আর থাকতে রাজী নয়। অবশেষে ডাক্তার ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন।
-” আচ্ছা, বাচ্চাটাকে আমি আরেকবার দেখব। নিউমোনিয়ার পেশেন্ট সে। বললেই তো হুট করে ছেড়ে দেয়া যায় না। আপনি একটু পরে নিয়ে আসুন বেবীকে।”

মেঘা রুমে চলে এল। বাচ্চাকে কোলে নেবার আগে সে প্রথমে বাসায় ফোন করল। আম্মার সাথে কথা বলে তাকে এটা জানানো দরকার। তিনি না এলে মেঘা একা যাবে কীভাবে।
ফোন করতেই কোহিনুর বেগম ধরলেন,
-” কে, মেঘা নাকি? ”
-” জি ! ইয়ে, আম্মা আপনি কখন আসবেন? ”
-” আমি তো বিকালের দিকেই আসি বাবুরে দেখতে। কেন, কী হইসে ? ”
-” না মানে, আপনি যদি কষ্ট করে এখনই চলে আসতেন তাহলে ভাল হতো আম্মা। আমাকে একটু বাসায় যেতে হবে তো। আপনি ততক্ষণ বাবুর কাছে বসবেন। আমি ঐ চেইনটা নিয়ে একবারে নিউমার্কেট হয়ে তারপর ফিরব।”

কোহিনুর থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ নিরব থেকে তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, ” তুমি বাড়ীতে আইবা? কও কী ? বাড়ীতে যহন আমি থাকুম না তহন তুমি একলা আইলে তো এরা তোমার চুল ছিঁড়ব।”
-” মানে ? ”
-” মানে মুনে আমি আইসা কমুনি। অহন এত কথা ফুনে কওন যাইব না। আচ্ছা, তোমার ভাই ভাবির খবর কী ? হেরা কী বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে।”
-” আপনাকে তো সবই বলেছি আম্মা।”
-” তুমিও কইছো আমিও শুনছি। অহন এইসব রাগ গুস্সা থোও আর ভাইরে ফোন দেও। সুরমা তোমারে অপমান করনের ধান্ধা খুজতেয়াছে। সামনে পাইলে হেয় তুমারে কাঁচা চাবায়া খাইব ।”
-” কিন্তু কেন, আমি তার কী ক্ষতি করেছি ? ” মেঘা ভয়ে ঢোক গিলল।
-” আল্লাহরে। সব কথা অহনই শুনবা ? ”
-” আম্মা, আজ না হোক কাল আমাকে তো বাসায় আসতেই হবে। তাহলে আজই নয় কেন। এখানে পার ডে মোটা টাকা বিল উঠছে। একটা দিন আগে এলে আমার অনেকগুলো টাকা সেভ হবে। তাছাড়া আপনি আমাকে কয়দিন পাহারা দিবেন আম্মা ?
-” তোমার কথা আমি বুঝছি। কিন্তু আজকা সুরমা তোমারে একলা পাইলে কী না কী ঝামেলা করে তাই ডরাই। সবদিন তো আর এই ডর থাকেনা। ”
-” খুব খারাপ কিছু হয়েছে আম্মা? ” বলতে গিয়ে গলাটা কেঁপে উঠল মেঘার। শ্বাশুড়ী আম্মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” ফোন রাখো। আমি আইতাছি।” বলে কোহিনুর নিজেই ফোন কেটে দিলেন।

মেঘার হাত পা সমানে কাঁপতে লাগল। প্রচন্ড টেনশনে মাথা ধরে গেল ওর। বাসায় আসলে হয়েছেটা কী ? সুরমা ভাবি ওর ওপর কেন রাগ করবেন। বর্ষণ তো সেদিন তার সামনে দিয়েই এখানে এল। আজ আবার নতুন কী ঘটল ?
মেঘা অস্থিরচিত্তে কেবিন থেকে বারান্দায় চলে এল। নয় তলার বারান্দা থেকে রাস্তাটা পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। মনে মনে হিসাব কষল। আম্মা যদি এখনই রওনা দেন তাহলে রিক্সা পেতে মিনিমাম পাঁচ দশ মিনিট। এ পর্যন্ত আসতে আরো পনের মিনিট। ধরা যাক, রাস্তায় অনেক জ্যাম। তাহলেও আধাঘন্টার বেশী লাগার কথা না। ওহ্, আম্মা কখন আসবে।

ফের কেবিনে চলে এল মেঘা । আরশ এখন ঘুমাচ্ছে। একটু আগেই ওকে ফিডার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে মেঘা। মিনিমাম তিনচার ঘন্টা ঘুমাবে সে। ভেবেছিল এই সময়টা কাজে লাগাবে কিন্তু আম্মার সাথে কথা বলার পর সব এলোমেলো লাগছে। কী যে হলো আবার। ওহ্, আল্লাহ রহম করো। সুরমা ভাবির অনাচার থেকে বাঁচাও আমাকে।

কাঁটার উপর কাটছে সময়গুলো। কেবিন রুম আর বারান্দা পায়চারী করে সময় পার করতে লাগল মেঘা। ঘড়ির কাঁটা যেন আজ স্থির হয়ে আছে এক জায়গায় । জায়গা ছেড়ে নড়ছেই না। এরই মধ্যে ফোন বাজলে কলজেটা প্রায় লাফিয়ে উঠল মেঘার। মোবাইলটা হাতেই ছিল। রিসিভ করতে গিয়েও থেমে গেল বর্ষণের নাম দেখে। কয়েক সেকেন্ড ভাবল। ছেলেটাকে এড়ানোর জন্যই ওর এত আয়োজন কিন্তু ছেলেটা যেন বারবার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে। ওর প্রতি কৃতজ্ঞ মেঘা। সেকারণেই ওর ছেলেমানুষীকে পাত্তা না দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বর্ষণের মধ্যে সেই লক্ষণ দেখা যাচ্ছেনা। অন্তত নিজেকে গুটিয়ে নেবার কোন চেষ্টাই ওর মাঝে নেই। বরং ওর স্থির ধরণের কাজকর্ম আর হাবভাব মেঘাকে আরো চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে।
সত্যি বলতে সুরমা ভাবির ভাই না হলে মেঘা চোখ বন্ধ করে ওকে মেনে নিত। কারণ বর্ষণ সৎ আর অকপট। পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে বেড়ায় না। তাছাড়া মেঘা নিজেও চরম বিপদে আছে। এভাবে সে নিজেও স্বস্তিতে বাঁচতে পারছে না। প্রত্যেকটা দিন অত বিষাক্ত নজরের তীর আর বাজে মন্তব্য শুনে মাঝেমধ্যে আর বাঁচতে ইচ্ছে করেনা। তারপরেও নিজেকে বোঝায়। মেঘা জানে, এগুলো ওকে ততদিন শুনতে হবে যতদিন ওর শরীরে যৌবন থাকবে। তবে এরপরেও যে হায়েনার দল ওর পিছু ছাড়বে তা নয়। উপার্জনক্ষম মহিলাকে কিছু ছেলে সুবিধের জন্যই বিয়ে করতে চায়। এটা অনেকটা এক ঢিলে দুই পাখি মারার মত। বউ তার ঘরের প্রয়োজনও মেটাবে আবার তাকে রোজগার করেও খাওয়াবে। এমন মজা কী গাছে ধরে ? মেঘা এসব বোঝে। তারপরেও বর্ষণকে বিয়ে করতে রাজী হবেনা কারণ সে সুরমা ভাবির ভাই। প্রয়োজন হলে মেঘা ঐ বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে যাবে কিন্তু বর্ষণের কথায় ভুলবে না। সুরমা ভাবি মানুষ হিসেবে বড় মারাত্মক। আর এটা গত তিন বছরে হাড়ে মাংসে টের পেয়েছে মেঘা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সালাম দিল মেঘা। বর্ষণ সালামের জবাব নিয়ে বলল, ” আমার আপা ফোন করেছিল আপনাকে ? ”
-” কোন্ আপা ? মানে আমাকে উনি ফোন করবে কেন ? “মেঘার মনে এবার অজানা ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল।
বর্ষণ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ” না, মানে। আমি বাসায় বলে ফেলেছি তো , তাই।”
-” কী বলে ফেলেছেন? “রুদ্ধশ্বাসে বলল মেঘা। বর্ষণ শান্ত স্থির চিত্তে বলল,
-” কী আর বলব। সরাসরি বলে দিয়েছি যে, আমি বিয়ে করলে মেঘাকেই করব। কোন হিমা টিমাকে না। ওরা চালাকি করে আমার আকদ করানোর প্ল্যান করেছিল। সে কারণেই বলতে বাধ্য হয়েছি।”
-” মানে ? এজন্য আপনি আমার নাম বলবেন? ” অস্ফুটে বলেই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মেঘা। ” এসব কেন বলেছেন আপনি? ”
-” কারণ আমি সত্য বলতে পছন্দ করি। আচ্ছা ছাড়ুন, আরশ কী করে ? ”
-” আপনি ছাড়ুন আরশের কথা। আগে বলুন আপনি এসব কথা কেন বলেছেন ! নাকি পরোপকারের সুযোগটা ভালভাবেই নিচ্ছেন।”
-” আপনার ভাবনা বদলানোর সাধ্য নেই আমার। কিন্তু যেটা বলেছি সেটা সারারাত ভেবে তারপর বলেছি। না বুঝে বলিনি। ইন ফিউচারে আমি এমনটাই করব।”

মেঘার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুততর হল। কী বলে এই ছেলেকে ঝাড়বে কথা খুঁজে পেল না। ওপাশ থেকে বর্ষণ বলল, ” আমি আরশের দায়িত্ব নিতে চাই মেঘা । প্লিজ, না করবেন না প্লিজ।”
মেঘা স্তম্ভিত। বাকরুদ্ধ। কিছুটা হয়ত আপ্লুতও। কিন্তু সেটা খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। হঠাৎ চোখগুলো জ্বালা করে উঠল ওর। একরাশ ভয় আর যন্ত্রণা এসে ওর সমস্ত ভালোলাগাকে এক নিমিষেই ধুয়ে মুছে দিয়ে গেল। কান্না চেপে বলল,
-” বর্ষণ…!” আপনি জানেন না আপনি কী করেছেন। আপনার এই পাগলামির কারণে আজ আমার শেষ আশ্রয়টাও নড়বড়ে হয়ে গেল। ছেলে আর শ্বাশুড়ীকে নিয়ে বেশ ভালই ছিলাম। কিন্তু আপনি আমার শান্তিটাও কেড়ে নিলেন। কেন এমন করলেন আপনি ? এখন কী হবে আমার ? কী করব আমি, বলুন ? ”
-” সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে আমার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাওযা। তাহলেই সব ঝামেলার আগুন বর্ষণের বারিপাতে নিভে যাবে। বড় আপা তো বড়আপা, পৃথিবীর কারো সাধ্য নাই আপনার দিকে চোখ তুলে তাকায়। কাঁটা কম্পাস দিয়ে সবার চোখ গেলে দেব আমি।”
-” একটা থাপ্পড় মেরে তোমার দাঁতগুলো ফেলে দেব আমি বেয়াদব ছেলে। লাই পেয়ে মাথায় উঠেছ ! বেয়াদব বলেই বড়বোনের বয়সী মেয়েকে বেহায়ার মত বিয়ের প্রস্তাব কর আর নির্লজ্জের মত ভবিষ্যত পরিকল্পনা কর। খবরদার যদি আর আমার সামনে আসো তো। দ্বিতীয়বার তোমার মুখ আমি দেখতে চাই না আমি। আমার বাচ্চার জন্য যা করেছ তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ কিন্তু তাই বলে আমার সম্পর্কে যা ইচ্ছে তাই বলার অধিকার তোমাকে দেয়া হয়নি । এক্ষুণি সুরমা ভাবিকে ফোন করো আর তাকে শান্ত করো। তাকে বলো যে , আমার ব্যপারে তুমি ভুল করেছিলেন। এমনটা ভাবা উচিত হয়নি তোমার। আর এরকম কিছুই হবে না । এটাও বলবে যে ফ্যামিলি যা বলে তাই শুনবে। ঠিক আছে ? ”

-” তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন আমি এগুলো বলব আর ঐ সিংহীমামীকে বিয়ে করতে রাজী হয়ে যাব?”

-” ওসব আমি জানি না। কিন্তু আমার আর আমার বাচ্চার ত্রিসীমানায় তুমি আসবেন না খবরদার। যদি আসো…তো একদম ভাল হবেনা বলে দিচ্ছি। তুমি আসলেই একটা অমানুষ। শুধু তোমার কারণেই আজ এত বড় বিপদে পড়তে হয়েছ আমাকে ।” বলেই হু হু করে কেঁদে ফেলল মেঘা। তারপর ফোন কেটে দিয়ে দু হাতে মুখ ঢেকে কাঁদল কিছুক্ষণ।

কয়েক মিনিট পর উত্তেজনা প্রশমন হবার পর সরাসরি ভাইয়াকে ফোন করল মেঘা। ধরল ভাবি।
মেঘা ফোন ধরেই হঠাৎ তেতে উঠল, ” কি ব্যপার? ভাইয়ার ফোন তুমি ধরেছ কেন? ”
-” ওমা, এ কীভাবে কথা বলিস তুই মেঘা। তোর ভাইয়ের ফোন আমি ধরব না তো কে ধরবে? ”
-” তাই ? তা ভাইয়া যখন তোমাকে সেক্রেটারী নিয়োগ করেছিল তখন কী বলে রেখেছিল যে মেঘা নামের কেউ ফোন করলে তাকে কোন কিছু না জানাতে ? শুনলেই হার্ট এটাক হবে তার ? বলে রেখেছিল ? নাকি ভাইয়া ধরেই নিয়েছে যে তার বোন মরে গেছে? যদি ভাইয়া এটা ধরে নেয় তো বলে ফেলো, আমিও ধরে নেব যে আমার ভাই মরে গেছে।”

ওপাশে নিরব। কয়েক সেকেন্ড পর ধাতস্থ হয়ে রেহানা বলে উঠল, ” কী হয়েছে রে তোর ? এরকম পাগলের মত আচরণ করছিস কেন ? সব ঠিক আছে তো? ”
-” সে খবর দিয়ে তুমি কী করবে ? তোমার দরকার ছিল নিজের গতি করার, করেছ। বিয়ের আগে খোঁজ নিয়েছ পাত্র লাওয়ারিশ কিনা। বাপ-মা ভাই-বোন ফোরটিন জেনারেশনের খবর নিয়ে তারপর যখন জেনেছ সব আছে এবং সে ভাল পরিবার থেকে বিলং করে তখনই তাকে বিয়েটা করেছ। আর বিয়েটা হয়ে যাবার পর জামাই হয়ে গেল একলা তোমার। তখন আর জামাই এর ফ্যামিলির কাউকে তার আশেপাশে আর সহ্য হয়না। এটাই যদি মনে ছিল তো এতিম খানা থেকে কাউকে খুঁজে নিয়ে বিয়ে করলে না কেন ? তাহলে অন্তত আমি আজ অভিভাবক হারা হতাম না।”
রেহানা স্তব্ধ হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। মেঘা সরোষে ফোন কেটে দিয়ে আবারও কেঁদে ফেলল। কান্নার শব্দে যেন আরশের ঘুম না ভাঙ্গে সেই ভয়ে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে রাখল সে। কোনভাবেই নিজের আবেগ সামলাতে পারছেনা সে।

একটু পরেই আবার ফোন বাজল মেঘার। মেঘা সেদিকে তাকিয়েও দেখল না। অনবরত কেঁদেই চলল সে। ফোনটা অনেকক্ষণ বেজে বেজে থেমে গেল। তারপর আবার নতুন করে বাজতে লাগল।
ঠিক এমন সময়েই কোহিনুর বেগম ঘরে ঢুকলেন। মেঘাকে ওভাবে মাটিতে বসে কাঁদতে দেখে দ্রুত ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন। ওর মাথায় হাত রাখলেন। এতক্ষণ যাওবা আবেগ নিয়ন্ত্রণে ছিল। এবার আর পারল না। শ্বাশুড়ীর হাঁটু জড়িয়ে ধরে এবার উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল মেঘা। কোহিনুর ওর মাথায় হাত বুললেন।
-” চুপ করো। মাইনষে শুনলে কী কইব। এইটা হাসপাতাল। নিজের বাড়ী ঘর না।”

অনেকক্ষণ কান্নার কারণেই হোক বা মনের কিছু খেদ উগরে দেবার কারণেই হোক। মেঘার মনটা হালকা হয়ে এল। আঁচলে চোখ মুছে মাটি থেকে উঠে বসল সে। অনেকক্ষণ কান্না করার ফলে ওর চোখ আর নাকের ডগা টুকটুকে লাল হয়ে আছে। এখন আর কাঁদছে না মেঘা। তবে চোখ বেয়ে আপনা হতেই পানি গড়িয়ে পড়ছে কিছুক্ষণ পরপর।
কোহিনুর বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগোতক্তির সুরে বললেন, ” আল্লাহয় যেমুন জুয়ান মাইনসেরে বিধবা না করে। বড় অশান্তি গো মা। আমি নিজেও এক বিধবা। আমি জানি এইটার কী কষ্ট। বিধবার এই কষ্ট আরো বাড়ায়া দেয় আমগো সমাজ। থাউক, কাইন্দ না। ”

মেঘার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল কান্নার দমকে। একটু পর ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ” সুরমা ভাবি কী বলেছে আপনাকে ? ”
কোহিনুর বেগম লম্বা করে শ্বাস ফেলে বললেন, ” বহুত কিছু কইসে। সব শুইনা কী করবা। তার চেয়ে তোমার ভাইরে খবর দাও। তোমারে আইসা নিয়া যাউক। সম্পত্তির লাইগা ভাইবো না। আমার আরশের অংশ তারই থাকব। তয় কিছুদিন সময় দরকার। সম্পত্তি ভাগাভাগির কথা আমি বাড়ীতে উঠামু। তয় অখন না। আরেকটু সময় যাইতে দাও। সম্পত্তি ভাগ অইলে তহন আরশের অংশ তুমি বুইঝা নিবা আর তহন তুমি আলাদা থাকতে পারবা। আপাতত কয়েকটা মাস কষ্ট কইরা ভাইয়ের বাড়ীতে উঠ। সুরমারে কুনু বিশ্বাস নাই। হেয় তো তোমার অপিসেও লোক পাঠাইছিল। ঐখানেও নাকি তোমার নামে অনেক বদনাম পাইসে। অপিসে তোমার নামে নালিশ কইরা আইসে সুরমার বাপ আর অর মাইজা বোইনের জামাই। কয় অপিসেও বলে তোমার নামে অনেক বদনাম। এডি কী সত্য কথা? “কোহিনুর বেগম তাকালেন মেঘার দিকে।

মেঘার মনে হল ওর পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল মেঘার। শ্বাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে মনে হল চারপাশ ঝাপসা হয়ে আসছে। বুকটা অসম্ভব ধড়ফড় করছে মেঘার। এর মধ্যেই শ্বাশুড়ীকে বলতে শুনল, ” আমি অগো কথা বিশ্বাস করিনি। যাউক, অহন তোমার ভাইরে ফুন দেও। সব ঘটনা জানাও তারে। তোমার পাশে তারে অহন দরকার।”
-” ভাইয়া তো ঢাকায় নেই আম্মা। খুলনাতে। ভাইয়ার শ্বশুরবাড়ী খুলনা হওয়ায় ও অনেকদিন ধরেই ঐদিকে পোস্টিং নেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু পার্মানেন্ট হতে পারেনি। কিন্তু এমনিতে অফিসের কাজ নিয়ে আজকাল ঐদিকেই দৌড়ায় বেশী। ঢাকায় তো এখন ভাইয়াকে পাওয়া যাবেনা।”
-” তা না যাউক। কিন্তু তোমার খবরটা তো জানাইবা কমপক্ষে। হাজার হইলেও ভাই। কোনোদিন সে কইব যে এতকিছু হইল খবর তো কিছুই জানাস নাই। সে আসুক চায় না আসুক। তোমার জানান তুমি জানাও। আর বিয়ার পরে ভাইরা অমন তালুই হয়া যায়। এইটা নতুন কিছু না। ”

মেঘা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণ মুছতে যাবার সময়ই ফোনটা আবার বেজে উঠল। সেদিকে তাকাতেই দেখল ভাইয়ার ফোন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবশেষে ফোনটা ধরল মেঘা। ভাইয়ার কণ্ঠ পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। হু হু করে কেঁদে ফেলল। মেঘার বড় ভাই হাসান বোনকে সান্তনা দিয়ে এদিকে অবস্থা জানতে চাইলে স্বল্প কথায় ওকে পরিস্থিতি জানাল মেঘা।
সবশুনে হাসান কেবল বলল, ” তুই ভাবিস না। আমি কালই ঢাকা আসছি। আর এত কাঁদিস না। এত কান্না করার মত কিছু হয়নি। আমি কাল সকালের বাসেই রওনা দেব।” ফোন কেটে দিয়ে চোখ মুছল মেঘা। কথাটা যে ওর বুকে এই মুহূর্তে কতটা বল যোগালো তা মেঘার মত যারা অসহায় কেবল তারাই বলতে পারবে।

=====

কোহিনুর বেগম তার ব্লাউজের ভেতর থেকে একটা পলিথিনের ব্যাগ বের করে মেঘার হাতে দিলেন, ” গুনো তো কত আছে।”
-” এটা কী আম্মা ? ”
-” নিচতলার ভাড়া। আহনের সময় বুইড়ারে সামনে পাইসিলাম। কইলাম, নাতিটা অসুস্থ। ভাড়াটা দিয়া দিলে উপকার হয়। বেটা শুইনাই লগে লগে ট্যাকাটা বাইর কইরা দিসে।”
-” কিন্তু এটা তো বাসা ভাড়ার টাকা। মানে ভাইয়ারা তো জানতে চাইবে।”
-” আরে, তুমি আগে ঠেকা সারো। হেরা কী জানব নাকি যে তুমি নিছো ? তুমি এদিকের বিল দিয়া বাড়ী চলো আগে । তারপর চেইন মেইন যা আছে বেইচ্চা ঐ ট্যাকা দিয়া এইটা শোধ দিও। তহন কামাইল্লার হাতে ট্যাকাটা দিয়া কমু ভাড়া দেরীতে পাইছি।”
-” ওহ্ কিন্তু ভাড়াটিয়া যদি বলে দেয় যে ভাড়া আপনার হাতে দিয়ে ফেলেছে? ”
-” কইবো না। আহনের সময় মানা কইরা আইছি। বেটায় যা বুজনের বুইজা গেছে। যাও অহন ডাক্তরের লগে কথা কইয়া আসো।”

কথা না বাড়িয়ে মেঘা আরশকে কোলে নিয়ে ডিউটি ডাক্তারের রুমে চলে এল। তিনি মেঘাকে দেখে মাথা নাড়লেন, ” কাম ইন।” তারপর পাশের সিঙ্গেল বেডটা ইশারা করলে মেঘা বাচ্চাটাকে তার উপর শুইয়ে দিল।
ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে আরশকে বেশ ভালভাবে চেক করলেন। তার প্রতিক্রিয়া মুখোভাবে বোঝা গেল না। দেখা শেষ হলে তিনি গম্ভীর মুখে বললেন ,” বুকের শব্দটা যদিও এখন আর নেই। তারপরেও আমার মনে হয় আরেকটা দিন থেকে গেলে ভাল করতেন। এমনিতে হি ইজ ফাইন।” শুনে মেঘা মাথা নাড়ল।
-” না, আপা। আমি আজই চলে যেতে চাই। ইটস টু এক্সপেনসিভ ফর মি।”
-” কিন্তু আপনার হাজবেন্ড তো বলে গিয়েছিলেন অন্য কথা। তারও ইচ্ছা বাচ্চা পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তিনি মুভ করবেন না। যাই হোক, এটা আপনাদের স্বামী স্ত্রী’র ব্যপার !”
মেঘার মুখ দিয়ে প্রায় ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কথাটা। বলতে চাইছিল,’ ঐ লোকটা নিজেকে আমার হাজবেন্ড পরিচয় দিয়েছে বুঝি ? কিন্তু কী ভেবে বলল না। কী দরকার সবার কাছে ঢোল পিটিয়ে। এখান থেকে চলে গেলেই তো শেষ। কাজেই এদের বলা না বলা সমান। তাছাড়া সব জায়গায় এত কৈফিয়ত দিতে ভালো লাগে না।

প্রায় পনের মিনিট লাগল ছাড়পত্র পেতে। এদিকে মেঘা চলে যাচ্ছে শুনে বুয়াগুলো ভীড় করল কেবিনে। এ আরেক যন্ত্রণা। এমনিতেই টাকার সমস্যা। এর মধ্যে এদের দাবীদারও কম নয়। যতটা সম্ভব নিজের সাধ্যের মধ্যেই টিপস দেবার কাজটা সারলো মেঘা। তারপর সবকিছু গুছিয়ে বেরিয়ে এল ক্লিনিক থেকে।
নিচে নামতেই বর্ষণের মুখোমুখি হয়ে গেল ওরা। বর্ষণ রীতিমত হতভম্ব। মেঘাকে সে এইসময় এই অবস্থায় মোটেই আশা করেনি।
কোহিনুর বেগম স্বাভাবিক গলায় বললেন, ” আমগো একটা টেক্সি ভাড়া কইরা দেও তো বাবা।”
বর্ষণ মেঘার দিকে তাকাল। মেঘা মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। এমনিতেই নাক মুখ ঢাকা। তার উপর মুখ আড়াল করে রাখায় ওর অভিব্যক্তি দেখার সুযোগ হলো না বর্ষণের। সে সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে ট্যাক্সির খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।
মিনিট দশেকের মধ্যেই ক্যাব নিয়ে ফিরে এল বর্ষণ। কোহিনুরের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে ডিকিতে তুলল। আরশকে কোলে নেবার জন্য হাত বাড়াল। কিন্তু মেঘা সেই হাতকে এড়িয়ে গিয়ে আরশকে নিয়েই ট্যাক্সিতে উঠে বসল।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বর্ষণ নিজেও উঠে বসল সামনের সিটে। মেঘা হঠাৎ তীক্ষ্ম স্বরে বলে উঠল, ” আপনার কী মনে হয় আমরা রাস্তা চিনিনা ? কেন উঠেছেন আপনি ? ”
-” বড়বোনের শ্বাশুড়ীকে একা ছেড়ে দেবার মত অভদ্র নই বলে। ” উদাসীন কণ্ঠে জবাব দিয়ে পেছনে তাকাল বর্ষণ, ” খালাম্মা, আপনি ঠিকমত বসেছেন তো ? ”

কোহিনুর কোন জবাব দিলেন না। বর্ষণও আর কোন কথা বলল না। মেঘা সারারাস্তা ভাবতে ভাবতে এল, বাড়ী ফিরে কী জবাব দেবে সে। সুরমা ভাবি ওদের একসাথে ফিরতে দেখলে কী করবেন কে জানে। বর্ষণ কেন যে সব জেনেও না জানার মত করছে আল্লাহই জানে। এমন পাগলামি ওর জন্য যতটা সহজ, মেঘার জন্য ততটাই বিপদজনক। ছেলেটা যেন ওকে ইচ্ছে করেই বিপদে ফেলছে।

বাড়ীর কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ গাড়ী থামাতে বলল বর্ষণ। তারপরই দরজা খুলে নেমে গিয়ে ড্রাইভারকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে বলল, ” ঐ লাইটপোস্টটার সামনে গিয়ে থামবেন। সবুজ গেট। খালাম্মা আমি গেলাম। আস্সালামুআলাইকুম। “বলে মেঘার দিকে একবারও না তাকিয়ে নিজের মত চলে গেল বর্ষণ । মেঘা এবার হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here