সুপ্ত ভালোবাসা পর্ব ৩১+৩২

#সুপ্ত_ভালোবাসা

#পর্ব_৩১

#Tahmina_Akther

-ফুল আর একটু পরেই অফিস থেকে বের হবো। তোমার কিছু লাগবে,নিয়ে আসবো?

-না কিছু লাগবে না।

-আচ্ছা, রাখছি তাহলে বাড়িতে এসে কথা হবে।

-হুম

হিয়া কল কেটে হেঁটে চললো ছাঁদের উদ্দেশ্য। বিকেলের সময়টাতে ছাঁদে বসে থাকতে ভালো লাগে।অরিনকে সাথে নিয়ে ছাঁদের ফুল গাছ গুলোতে পানি দিয়ে বসে বসে নানান গল্প করছে অরিন আর হিয়া।এরই মাঝে গেটে গাড়ি ঢুকার শব্দ পেলো।হিয়া দৌঁড়ে ছাঁদের কার্নিশে গিয়ে দাঁড়ালো।

অভিক গাড়ি থেকে বেরিয়ে চাবিটা দারোয়ানের হাতে দেয়ার সময় ছাঁদের দিকে চোখ যায়। সেখানে থেকে হিয়া যে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে বুঝতে পারলো।অতি দ্রুত বাড়িতে প্রবেশ করে ওর রুমে চলে এলো।এরপর, অফিসের জামাকাপড় ছেড়ে ওয়াশরুম ঢুকলো শাওয়ার নিতে।

শাওয়ার শেষে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলো হিয়া রুমের সোফায় বসে আছে । হাতে টাওয়াল নিয়ে হিয়ার পাশে গিয়ে বসলো।হিয়া মুচকি হেসে অভিকের হাত থেকে টাওয়াল নিয়ে চুল মুছিয়ে দিলো। হিয়ার নিত্যদিনকার কাজের মাঝে অভিকের গোসল শেষে চুল মুছিয়ে দেয়া আরেকটি কাজ। চুল মোছা শেষ হতেই অভিক হিয়ার হাত ধরে পাশে বসিয়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে বললো,

-অফিস থেকে এলে তোমার হাতের পরশ পেলে সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষে দূর হয়ে যায়। কেন এমনটা হয় বলতে পারবে তুমি?

-আমি কি ভাবে বলবো কেন এমন হয়? হালকা কিছু খাবে বানিয়ে আনবো?

-না থাক। এমনিতেই কিছু খেতে ভালো লাগছে না।শুধু কফি বানিয়ে আনলে চলবে।

হিয়া কিচেন থেকে কফি বানিয়ে নিয়ে গেলো অভিকের জন্য। রুমে যেতেই দেখতে পেলো অভিক সোফাতে ঘুমিয়ে পড়েছে।তাই ওকে আর জাগালো না হিয়া।
ওর গায়ে চাদর জরিয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে বের হয়ে অরিনের রুমে চলে গেলো হিয়া। অরিনের রুমে যেয়ে ওকে পেলো না হিয়া।

মোবাইল বের করে অরিনকে কল দিবে তার আগে স্ক্রীনে একটি মেসেজ এলো।মেসেজ চেক করতেই দেখলো অরিনের মেসেজ।

“ভাবি,আমি আমার বান্ধবী তমাদের বাড়িতে এসেছি। চিন্তা করো না আমার জন্য আর মা’কে আমি বলে দিয়েছি আজ তমাদের বাড়িতে থাকবো। তোমাকে বিকেলে এই কথা বলতেই ছাঁদে এসেছিলাম কিন্তু কথার ফাকে ভুলে গিয়েছিলাম।খেয়ে নিও তোমরা দু’জন ”

মেসেজটি পড়ে হালকা দীর্ঘ শ্বাস ফেললো হিয়া। বাড়িতে কেউই নেই সকলে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছে।অভিক, আমি আর অরিন ছিলাম বাড়িতে। কিন্তু এখন তো অরিনও নেই!

————–

চারপাশে এত অন্ধকারে ছেয়ে আছে কেন?রাত হয়ে গেলো নাকি? খাট থেকে নেমে রুমের লাইট অন করে ঘড়িতে সময় দেখলাম। তখন রাত দশটা বাজে বিকেলে ঘুমিয়ে এখন জেগে উঠলাম। হিয়া কোথায় আমাকে একটিবারও ডাকলো না!

ঘুম চোখে নিয়ে হিয়াকে খুঁজতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো অভিক।সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো। কিন্তু না হিয়া এখানেও নেই।এরই মাঝে কিচেন থেকে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ ভেসে এলো।

অভিক কিচেনে যেয়ে দেখলো, হিয়া কি যেন রান্না করছে? মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করলো। প্রথমে ভয় পেয়েছিলো হিয়াকে না দেখে।
আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে হিয়ার পিছনে দাঁড়িয়ে ওর কানের কাছে হাউউউ বলে উঠলো।

বেচারি আচমকা আক্রমনে ভয়ে চিৎকার দিয়ে দৌঁড়ে বের হতে চাইলেই অভিকের বুকে ধাক্কা খায়।অভিককে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে ঝাপটে ধরলো হিয়া। ভয়ে ওর পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো।

অভিক হিয়াকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।মনে মনে নিজের করা কাজে বেশ লজ্জিতবোধ করলো।আসলে সে বুঝতে পারেনি হিয়া এরকম রিয়েক্ট করবে।হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে অভিক মৃদুস্বরে বললো,

-বৌ সরি।আসলে আমিই এমনটা করেছি। বুঝতে পারিনি তুমি এভাবে আতঙ্কিত হয়ে পরবে।

অভিকের থেকে এমন কথা শুনতে পেয়ে হিয়া মাথা তুলে তাকালো। এরপর, আস্তে করে অভিকের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আবারও চুলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

অভিক বুঝতে পারলো তার বৌ’টা তার উপর অভিমান করেছে। হিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো, কি রান্না করছে তার ফুলটা?
মুরগির মাংস ভূনা, গরুর রেজালা, ডিম ভাজা,ইলিশ মাছ ভাজা এবং পোলাও।

অভিক এতসব রান্না দেখে হিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,

-কি ব্যাপার আজ খাবারের এত আয়োজন? কেউ আসবে না কি? আর বাড়ির কাউকে দেখছি না যে?

-কেউ আসবে না এমনিতেই মন চাইলো এইসব রান্না করতে। আর বাড়ির সবাই গ্রামের বাড়িতে গেছে শুধু তুমি,আমি আর অরিন বাদে।

-আমাকে কেউ একটিবারও বললো না ?

-তোমার মোবাইলে কল করেছিলো কিন্তু সংযোগ হচ্ছিল না তাই তোমাকে জানাতে পারেনি।

-সবই বুঝলাম তবে অরিন কোথায়?

-ওর বান্ধবী তমার বাড়িতে গেছে। এখন নিশ্চয়ই তোমার খুদা লেগেছে হাতমুখ ধুয়ে আসো। টেবিল খাবার দিচ্ছি খেয়ে নাও।

অভিক চটজলদি হাতমুখ ধুয়ে চলে এলো।ততক্ষণে হিয়া সব খাবার টেবিলে গুছিয়ে রাখলো।চারদিকে বাহারি খাবারের গন্ধ মৌ মৌ করছে। অভিক একটি চেয়ার টেনে হিয়ার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিলো। এরপর,ওর প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললো,

-এতক্ষণ, অনেক কষ্ট করে রান্না করেছো। এবার আমি না হয় তোমায় খাবার সার্ভ করে দিলাম।

-তুমিও বসে পরো। খাবার ঠান্ডা হয়ে গেলে খেতে টেস্ট লাগবে না।

-খাবো একশর্তে যদি তুমি খাইয়ে দাও। আমি জানি তুমি আমার উপর অভিমান করে আছো।কিন্তু, বিশ্বাস করো আমি বুঝতে পারিনি আমার এহেন কাজে তুমি ভয় পাবে! আর কখনো এইরকম করবো না বৌ। প্লিজ এবারের মতো মাফ করে দাও?

অভিক দু’হাতে কান ধরে বাচ্চাদের মতো মুখ করে কথাগুলো বলছিলো হিয়ার সঙ্গে। এরকম করে কথা বললে কেউ কি আর অভিমান করে থাকতে পারে?
হিয়ার অভিমানও গলে পানি হয়ে গেছে। ওর প্লেট থেকে খাবার নিয়ে অভিকের মুখের সামনে এক লোকমা তুলে ধরলো।অভিক হালকা হেসে হিয়ার হাত থেকে খাবার খেয়ে নিলো।খাবার খেতে খেতে অভিক হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলছে,

-আজ কতদিন পর তোমার হাতে খাবার খেলাম।অসুস্থ ছিলাম বেশ ছিলাম অন্তত তোমার হাতের খাবার, যত্ন সবই পেতাম। কিন্তু, এখন তো কিছুই পাচ্ছি না।

অভিকের এই কথার বিপরীতে হিয়া কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না তাই চুপ করে ছিলো।হিয়াকে চুপ করে থাকতে দেখে অভিকও আর কিছু বললো না। এর পরের সময়টুকুতে দু’জন চুপ করে খাবার খাচ্ছিলো।

খাবারের পর্ব শেষ হতেই দু’জনে মিলে সব গুছিয়ে রেখে দিলো।হিয়ার বেশ ঘুম পাচ্ছে তাই ও রুমে চলে গেলো।এখন তো আর অভিকের ঘুম আসবে না তাই ও চলে গেলো ছাঁদে।

রাতের আকাশজুড়ে আজ আঁধারের খেলা।হয়তো বৃষ্টি নামবে তাই! সময় এখন মধ্যেরাত চারদিকে নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ।মাঝে মাঝে দূর থেকে দু’একটা কুকুরের ডাক ভেসে আসছে।

জ্বলন্ত সিগারেট দুই ঠোঁটের মাঝে রেখে একটান দিয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে ধোঁয়া গুলো উড়িয়ে দিলো।অভিকের মনটা আজ ভিষণ রকমের তেঁতো হয়ে আছে।কিন্তু, কেন বুঝতে পারছে না?হয়তো রফিক সাহেবর কথার প্রেক্ষিতে।

আজ দুপুরের লাঞ্চের পর রফিক সাহবে আসেন ওদের অফিসে।অনেক পুরনো ক্লাইন্ট অভিকদের।ব্যবসায়িক কিছু খুচরো আলাপ থাকলেও বেশিরভাগ আলাপ ছিলো অভিক আর হিয়ার দাম্পত্য জীবনকে ঘিরে। রফিক সাহবে বিনা সংকোচে ওদের বৈবাহিক সম্পর্ক কেমন সরাসরি অভিককে জিজ্ঞেস করলো।অভিক বললো,

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো।কিন্তু আপনি কেন এভাবে প্রশ্ন করছেন?

-ভালো হলে তো ভালো। কিন্তু, তোমার ওয়াইফ মানে হিয়া জামানের তো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছিলো আবার নাকি সেই ছেলের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো।এখন কথা হলো, সে কি আসলে তোমাকে মেনে নিতে পেরেছে নাকি সেই ছেলেকে মনে প্রাণে এখনো ভালোবাসে?

অভিক বেশ চটে গিয়েছিলো ভদ্রলোকের এই কথার প্রেক্ষিতে তবুও নিজেকে শান্ত রেখে হাসিমুখে কথা কাটিয়ে দিলো।লোকটি বয়সে ওদের থেকে গুরুজন তাই আর কথা বাড়ায়নি।

রফিক সাহেব চলে গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু উনার কথার রেশ গুলো অভিকের মনে রয়ে গেলো।

” ফুল কি তবে আমাকে এখনও আমাকে ভালোবাসতে পারেনি? নাকি ওর মনে এখনো আহানের পদচারণা প্রায়শই হয় ”

কথাগুলো নিজের মনে মনে আওরাচ্ছে অভিকে। এরই মাঝে ওর গায়ে বিন্দু পানির স্পর্শ পেলো। অভিক ওর সম্বিত ফিরে পেতেই দেখতে পেলো আকাশ থেকে বর্ষণের ঢল নেমেছে। ভিজতে ভালোই লাগছে অভিকের অন্তত এই বৃষ্টির পানির পরশে তার হিয়া প্রতি যে সন্দেহ জেগেছে তা যেন ধুয়ে মুছে যায়।

————

জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছিটে আসতেই হিয়ার ঘুম ভেঙে গেলো।পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো অভিক নেই। ধড়ফড়িয়ে উঠে পরলো হিয়া এত রাতে গেলো কোথায়?

পুরো বাড়িতে খুঁজেও যখন পেলো না তখন অভিকের মোবাইলে কল করলো কিন্তু ওর মোবাইল রুমেই বেজে উঠলো। হিয়া কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। একবার ভাবছে, ওর ছোট আব্বুকে কল দিয়ে জানাবে কি না? কিন্তু, এতরাতে উনাদের কল দিয়ে এই বৃষ্টির রাতে অভিককে পাওয়া যাচ্ছে না কথাটি বলা কতটুকু যৌক্তিকতা হবে বঝতে পারছে না।

হঠাৎই, হিয়ার মনে হলো অভিক ছাঁদে নয়তো। দৌঁড়ে ছাঁদে যাওয়ার জন্য রুমে থেকে বের হতেই একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলো হিয়া আর অভিক।

হিয়া উঠে পড়লো অভিকের উপর থেকে।উঠে দাঁড়াতেই ওর গায়ে শীত শীত অনূভুত হলো।আসলে অভিক বৃষ্টিতে ভেজার ফলে ওর পুরো শরীর ভিজে আছে। হিয়া ওর সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাওয়ার কারণে ওর শরীরও ভিজে যায়।

এতরাতে অভিককে ভেজা গায়ে দেখে বেশ রেগে গেলো হিয়া।

-এতরাতে কোত্থেকে এলে তুমি তাও আবার ভেজা শরীর নিয়ে? সেদিন না সুস্থ হলে এখন কি আবারও অসুস্থ হতে ইচ্ছে করছে না কি?

-ছাঁদে ছিলাম।হঠাৎই বৃষ্টি নেমে পড়লো। আর সত্যি কথা বলতে কি, আমার আজ বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ ভালো লাগছিলো।

-হুম, ভালো লাগছিলো। শরীরে অসুখের কারখানা নিয়ে বসে থাকো তুমি,তাই না?

-আমার অসুখ হলে তোমার কি? তুমি তো আর আমাকে ভালোবাসো না? শুধু শুধু এত হাইপার হওয়ার প্রয়োজন নেই। যদি আমি অসুস্থ হই তুমি আর আমার সেবা করো না ঠিক আছে।

-এখানে সেবার কথা আসছে কেন? আমি বলেছি তোমার ভালোর জন্য আর তুমি সব উল্টো মিন করছো।

-আমি কোনোপ্রকার উল্টো মিন করছি না। তুমি এখনও আহানকে ভালোবাসো তাই না? তাই এখনো আমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারো নি তুমি?
রফিক সাহবে ঠিকই বলেছেন তুমি আমাকে ভালোবাসো না।

অভিকের কথা শুনে হিয়া যেন আকাশ থেকে পড়লো। কি বলছে এইসব?তারমানে, রফিক সাহবের কথায় ও এমন আচরণ করছে!

শুধুমাত্র এই কারণে অভিক সাহেব এমন উদ্ভট বিহেব করছে!
হিয়া হালকা হেঁসে অভিকের খুব খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। ঠিক ততটুকু কাছে যতটুকু কাছে দাঁড়ালে একে অপরের শ্বাসপ্রশ্বাসের নিশ্বাসটুকু অনুভব করা যায়।
অভিকের গলা জড়িয়ে ধরলো হিয়া। এরপর, ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

-তুমি কি জানতে চাও আমি তোমায় ভালোবাসি কি না ?

অভিক মাথা নাড়িয়ে হু বললো।

-আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা আহান। ওর মাধ্যমে আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম, পৃথিবীর সবচেয়ে দামী অনূভুতি ভালোবাসার অনূভুতি। কিন্তু, ওকে হারিয়ে যখন আমি ছিলাম সঙ্গি হারা পাখির মতো দিশেহারা, অনূভুতিহীন।ঠিক তখনই আমার জীবনে কেউ এলো তার ভালোবাসার আহ্বান নিয়ে। সে ভালোবাসায় ছিলো না তার চাওয়ার চাহিদা। সে শুধুই আমাকে ভালোবেসেছে নিস্বার্থ ভাবে। তার একটু একটু ভালোবাসায় নতুন করে প্রেমে পরেছি আমি। আমার মনে আবারও বসন্ত এসেছে কোকিলের কলরবে প্রানবন্ত হয়েছে আমার হৃদমাঝার।

শুধুমাত্র তাকেই ভালোবেসে আমি আমার বাকি জীবনটুকু অনায়াসে পার করতে চাই।

কিন্তু, এখন সে যদি আমাকে বলে, তাকে আমি ভালোবাসি না। তাহলে,আমার অনুভুতির যন্ত্রণার ভার কে সইবে বলো,অভিক?

হিয়ার কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারছে না অভিক। ও যেন অবাকের সপ্তম আসমানে আছে।তাই শিওর হওয়ার জন্য হিয়াকে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

-তুমি যা বলছো তা কি সত্যি ফুল?

-হুম, সত্যি সত্যি সত্যি। ফুল তার অভিককে অনেক ভালোবাসে। তার অভিকের বুকে মাথা পেতে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ভালোবাসা উপভোগ করতে চায়। অভিক, দিবে তো আমায় তোমার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত ভালোবাসা?
#সুপ্ত_ভালোবাসা

#পর্ব_৩২

#Tahmina_Akther

আমার বুকে কারো গাঢ় নিশ্বাসের আছড়ে পড়ছে। কিন্তু, চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না।
চট করে গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম, ফুল বেঘোরে আমার বুকে মাথা পেতে ঘুমাচ্ছে।

দেখে মনে হচ্ছে কত রাতের নির্ঘুম সে আজ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে!
ফ্যানের বাতাসে ওর বেবি হেয়ার গুলো বারবার কপালে ছড়িয়ে যাচ্ছে। আলতো হাতে ওর কপাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে শব্দহীন চুমু খেলাম।

কি জানি ও আমার স্পর্শ টের পেলো কি না?
এবার বেশ গাঢ় ভাবে আমার গায়ে সেঁটে রইলো।

গতকাল, রাতে হিয়ার মুখে প্রত্যেকটি শব্দ আমার হৃদস্পনন্দকে বাড়িয়ে তুলেছিলো। কত চমৎকার, সাবলীলভাবে তার মনের কথা আমায় নির্দ্বিধায় বলে দিলো।ওর রাতের বলা কথাগুলো এখনো আমার কাছে প্রাণবন্ত লাগছে,
যেন এখনো আমার কর্ণগুহরে প্রতিধ্বনি হচ্ছে ফুলের কথাগুলো,

“ফুল তার অভিককে অনেক ভালোবাসে। তার অভিকের বুকে মাথা পেতে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ভালোবাসা উপভোগ করতে চায়। অভিক, দিবে তো আমায় তোমার হৃদয়ে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত ভালোবাসা?”

তখন ফুলের প্রতিউত্তরে অভিকের গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছিল না।

হিয়ার মুখে উচ্চারিত এক একটি শব্দ যেন অভিকের সারা শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে।

হিয়ার ভালোবাসার স্বীকারোক্তিতে অভিকের হৃদস্পন্দন যেন আজ বলছে,
“অভিকের হৃদয় থাকা সুপ্ত ভালোবাসা তবে আজ মুক্তি পেলো হিয়ার ভালোবাসায়”

আজকের এই নিকেষ কালো আঁধার, মেঘাচ্ছন্ন বর্ষনের রাতে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি তিনটি বাক্য তারই ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে শুনবে ভাবতেও পারেনি।
তার ফুল যে আজ তার হৃদয়ের গহীনে থাকা সুপ্ত ভালোবাসার একছত্র মালিক হতে চাইবে তা শুধু অকল্পনীয় ছিল মাত্র!

অভিক পরম আবেশে হিয়াকে জড়িয়ে নিলো নিজের বাহুডোরে। হিয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়ার পর মনে হলো, কতদিনের তৃষ্ণার্ত মরুভূমিতে আজ এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়েছে।

হিয়া চুপটি করে অভিকের বুকে মাথা পেতে আছে। অভিক হিয়ার মাথায় চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– কি হয়েছে ফুল? চুপ করে আছো যে?

-কোথায় চুপ করে আছি! আমি তোমার দ্রুতগতিতে চলা হৃদস্পনন্দন অনুভব করছি। তোমার এই হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে যেন আমার নামে প্রতিধ্বনি হচ্ছে।

-ফুল?

-হুম,

-তুমি কি সত্যি বলছো? আমার না বিশ্বাস হচ্ছে না! মনে হচ্ছে সবই আমার স্বপ্ন।একবার জেগে গেলে, এই নিকেষ কালো আঁধার, মেঘাচ্ছন্ন বর্ষনের রাতে তোমার ভালোবাসার অনূভুতিকথন, তোমাকে জড়িয়ে ধরার এই স্পর্শ সবই যেন হারিয়ে যাবে অতলগহ্বরে।

-সব সত্য;এই নিকেষ কালো আঁধার, মেঘাচ্ছন্ন, বর্ষনের এই রাত,তোমার জন্য আমার ভালোবাসার অনূভুতিকথন, তোমাকে জড়িয়ে ধরার এই স্পর্শ সবই সত্য। যতটুকু সত্য আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা ঠিক ততখানি সত্য।

অভিকের বাহুডোর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো হিয়া। এরপর, ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

-আজ অনেক কথা হয়েছে এখন চলো। এতরাত পর্যন্ত জেগে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। চলো ঘুমাবে। যা কথা হবে কাল সকালে।

ওর কথা শেষ হবার পরমূহুর্তে, অভিক হিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,

-আজ আর কোনোকিছুতে মন নেই। আজ শুধুই ফুলের অনুভূতিকথনে, তার পরশে তার সুবাসে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছে।

হিয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলার আগে হিয়াকে উঁচিয়ে ধরে,

এক তপ্ত চুমুতে তার অধরযুগল আগলে ধরলো অভিক তার ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে।কিছু সময় অতিক্রম হবার পর অভিকের উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় হতে মুক্তি পেলো হিয়ার ওষ্ঠদ্বয়।

অভিকের এই আচমকা চুমু হিয়ার কাছে ছিলো সাংঘাতিক। লজ্জা নিবারণের জন্য জায়গা না পেয়ে অভিকের বুকে মুখ লুকানোর বৃথা চেষ্টা চলছিলো হিয়ার মাঝে।হিয়ার কান্ড দেখে হেসে রুমের দিকে পা বাড়িয়ে এগিয়ে চললো।

——————-

গতকাল রাতের কথাগুলো মনে পড়তেই মনটা আনন্দে ছেঁয়ে গেলো অভিকের। এরইমাঝে, হিয়ার ঘুম ভেঙে গেলো।কিন্তু, জেগে উঠার পর যখন দেখলো সে অভিকের বাহুডোরে আবদ্ধ ঠিক তখনি গতকালের এক একটি ঘটনা সুক্ষ্ম ভাবে মনে পড়ে গেলো।
চট জলদি অভিকের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

ঘুম থেকে জাগার পর থেকে ওয়াশরুমে যাওয়া পর্যন্ত হিয়া একটিবারও অভিকের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।

হয়তো লজ্জায়! হিয়া ওয়াশরুমে ঢুকতেই অভিক খিলখিলিয়ে হেসে ফেললো। অভিকের এই হাসির শব্দে ওয়াশরুমের থাকা হিয়াও হেসে ফেলেছিলো। কিন্তু, অভিকের অগোচরে।

—————

এরপরের দিন গুলো ছিলো স্মৃতিতে আঁটকে রাখার মতো। একজোড়া চড়ুই পাখির মতো সারাদিন জোড়ায় জোড়ায় থাকতো অভিক আর হিয়া।
অফিস থেকে ফিরে আসার সময় হিয়ার জন্য ফুচকা বা আইসক্রিম। কখনোবা, ছাদে রাতের আকাশে দু’জনের গায়ে চাঁদের আলো মাখানো।কখনোবা পরিবারের সকলের অগোচরে রাতে লং ড্রাইভে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ভোরে বাড়িতে ফিরে আসা।

এখন দু’জনকে কেউ দেখলে ভাববে হয়তো সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিক যুগল। যারা তাদের জীবনের প্রথম ভালোবাসা নামক অনুভূতিতে সিক্ত।

জামান পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যের মনে আনন্দের জোয়ার বইছে অভিক আর হিয়াকে একসাথে হাসিখুশিতে থাকতে দেখে।
তাদের মনে বিধাতার উদ্দেশ্য একটি প্রার্থনা যেন, অভিক হিয়া যেন সবসময় এমন ভালোবাসাময় অনুভূতির চাদরে মোড়ানো থাকে!

———————

নিত্যদিনের মতো বাড়ির সকলে মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে হালকা ভাজাপোড়া খাবার খাচ্ছিলো।
হিয়ার মা, অভিকের মা আর হিয়া মিলে সবাইকে নাশতার প্লেট আর চায়ের কাপ এগিয়ে দিচ্ছিলো।
অভিক বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকতেই পরিবারের সকল সদস্যকে একসাথে বসে থাকতে দেখলো।ছোট ছোট পা ফেলে খালি সোফায় যেয়ে বসে পড়লো।হিয়া যখন দেখলো অভিক এসেছে ঠিক তখনি দৌড়ে কিচেনে যেয়ে লেবু কেটে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে লেবুর শরবত বানিয়ে এনে অভিকের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

হিয়ার হাত থেকে গ্লাসটি নিয়ে শরবতটি এক নিশ্বাসে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো।
এবার যেন ভিতরটা ঠান্ডা লাগছে। হালকা গলা ঝেঁড়ে নিয়ে তার চাচ্চুকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– বড় আব্বু, খুব জরুরি একটা কথা ছিলো।

-কি কথা বলো?
চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন হিয়ার বাবা।

-আসলে কি ভাবে বলি কথাটা? আসলে মানে নিঝুম ভাইয়া কল করেছিলো।তখন জানলাম ফুপি নাকি অনেকটা অসুস্থ কিন্তু আমাদের জানাতে চাইছেন না। আমাদের যতটুকু জানিয়েছে তাও নোভার জোরাজুরিতে।

– বলিস কি?এখন কি অবস্থা শালিনীর?
উদ্বিগ্নের স্বরে বললেন অভিকের বাবা।

-ফুপির শরীরের অবস্থা নাকি একেবারে খারাপ। ওখানকার বেশ ভালো ভালো ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু ভালো হচ্ছে না।

-নিঝুমকে বল শালিনীকে নিয়ে বাংলাদেশ চলে আসতে। আমরা ওর চিকিৎসা দেখাশোনা সবকিছু করবো।
হিয়ার মা বললেন।

-আসলে বড় মা আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে ওই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরো উন্নত তাই ফুপিকে বাংলাদেশে আনা নিশ্চয়ই বোকামী হবে।

-তাহলে এখন উপায়?

-আসলে নিঝুম ভাই একা ব্যবসা, ফুপির দেখাশোনা সবকিছু সামলাতে পারছে না তাই কিছুদিনের জন্য আমাকে আমেরিকায় যাওয়ার রিকোয়েস্ট করছে। তাছাড়া, বাড়ির কেউ এখন ফুপির কাছে যেতে পারবে না সে জায়গায় আমার ভিসা প্রসেসিং ঠিক আছে। তাই বারবার আমাকে বলছে আমি যেন সেখানে যাই। এখন তোমরা বলো আমার কি করা উচিত?

-এই মুহূর্তে তোর সেখানে যাওয়াটা উচিত আমি মনে করি অভিক।শালিনী সুস্থ হলে তুই নাহয় চলে আসবি।
হিয়ার বাবা সহ সকলেই বললেন অভিক জন্য ওর ফুপির কাছে যায় শুধু হিয়া বাদে।

—————–

রাতের খাবার সকলে ঠিকভাবে খেলেও হিয়া আর অভিক খেতে পারলো না। যেন কেউ গলায় ঠেস দিয়ে রেখেছে!

আনুমানিক রাত ১১টার দিকে অভিক মোবাইলে কথা বলতে বলতে রুমে প্রবেশ করলো। রুমের চারদিকে তাকিয়ে হিয়াকে দেখতে পেলো না। মোবাইলে কথা শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দেখলো হিয়া দোলনায় দু’হাঁটুর মাঝে মাথা গুজে বসে আছে।
ধীরপায়ে এগিয়ে হিয়ার সামনে যেয়ে ওর মাথায় হাত রাখলো।

মাথায় কারো হাতের পরশ পেতেই হিয়া মুখ উঁচু করে দেখলো অভিক দাঁড়িয়ে আছে।
অভিককে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে যেন হিয়ার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গেলো।

আচমকা হিয়াকে কাঁদতে দেখে অভিক ঘাবড়ে গেলো। হিয়ার পাশে বসে ওর হাত ধরে বলছে,

-এই ফুল কি হয়েছে? কান্না করছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে? আরে কিছু তো বলবে?

কান্নার দমকে হিয়ার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছিল না তবুও আঁটকে আঁটকে বলছে,

-তুমি আমেরিকায় চলে গেলে আমি কি ভাবে থাকবো অভিক? তোমার অস্তিত্ব ছাড়া আমার নিজেকে অস্তিত্বহীন মনে হয়।

অভিক এতক্ষণে বুঝতে পারলো তার বৌ’টা কেন কাঁদছে? হিয়াকে একহাতে জড়িয়ে ওর মাথা কাঁধের একপাশে রেখে বললো,

-তুমি কি চাও না ফুপি সুস্থ হোক?

-হুম

-তাহলে তো আমাকে যেতে হবে। কারণ, বিদেশ বিভূঁইয়ে নিঝুম ভাইয়ার পক্ষে এত কিছু একহাতে সামলানো সম্ভব না। আর ফুপির তো আমাদের প্রতি হক আছে তাই না? এমনিতেই ফুপি আমাদের ওপর রেগে আজ সারে চার বছর ধরে বাংলাদেশ আসে না। এখন যদি নিঝুম ভাই অনুরোধ করা সত্ত্বেও না যাই তাহলে ব্যাপারটা বিশ্রি দেখাবে বুঝলে বৌ।

-কিন্তু, ফুপি যদি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায় তাহলে তুমি চলে আসবে।
“কারণ, তোমায় ছাড়া এক একটা ক্ষণ আমার জন্য মৃত্যু যন্ত্রণার সমান”

#চলবে
#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here