#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২২
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আরহাম রাতেই সবে মাত্র গোসল সেরে তোয়ালা দিয়ে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে খালি গাঁয়ে বেড়িয়ে পড়লো। মেহেভীন সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ঘুড়ে, নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো। আরহাম মেহেভীনের দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো, ‘এইভাবে পিছনে ঘুড়লে কেন? ‘
মেহেভীন নিজের চোখ জোড়া বন্ধ করেই বললো,
‘ আপনি বেশরম হতে পারেন আমি না। তাই পিছনে ঘুড়ে আছি। ‘
আরহাম ক্ষিপ্ত সুরে বললো, ‘ এই স্টুপিড মেয়ে একদম আমাকে বেশরম বলবে না। কি করেছি আমি?’
‘ঘরে একটা মেয়ে আছে অথচ তার সামনে আপনি খালি গাঁয়ে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন। লজ্জা করেনা?বেশরম লোক টা। ‘
‘বেশরম রাইট? ‘
কথাটি বলে, আরহাম কিছু একটা ভেবে,মেহেভীনের দিকে এগোতে লাগলো। মেহেভীন ভয়ে ঢুগ পিছাতে লাগলো। মেহেভীন পিছাতে পিছাতে পড়ে যেতে নিলে,আরহাম মেহেভীনের হাত খপ করে নিজের কাছে টেনে নিলো। আরহামের ফর্সা শরীর থেকে টপটপ করে পানি পানি মেহেভীনের হাতে গিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। মেহেভীনের দৃষ্টি নিচের দিকে। আরহামের দৃষ্টি মেহেভীনে সীমাবদ্ধ। আরহাম মিহি কন্ঠে বললো, ‘ তুমি আমার বউ। ‘
‘বউ ‘ ডাকটি শুনে মেহেভীনের বুকটা ধক করে উঠলো। মেহেভীন আরহামের দিকে তাকাতেই, আরহাম উচ্চস্বরে হেসে বললো, ‘ নকল বউ তুমি আমার। নকল বউ হলেও বউ শব্দটা তো আছে তোমার নামের সাথে। আমার মনে হয় না বউয়ের সামনে খালি গাঁয়ে বের হলে,সমস্যা হবে। ‘
আরহাম কথাটি বলেই নিজের কাবার্ডে নিজের টি-শার্ট খুঁজতে শুরু করলো। মেহেভীনের কানে এখনো ‘বউ ‘ ডাকটি বেজে চলেছে। কি সুন্দর একটা শব্দ। আরহামের মুখে বেশ লাগছিলো।
______
মেহেভীনের সকালে ঘুম থেকেই উঠে শুনতে পায় আরহামের বাবা ফিরে এসেছে। আরহামের বাবা এসেছে শুনে, মেহেভীন মাথায় ওড়না পেচিয়ে নীচে নেমে আসে। নীচে গিয়েই মেহেভীন আরহামের বাবা আকবর সাহেবকে দেখে, পা ধরে সালাম করতে নিলে,তাতে বাঁধা দেন তিনি। পত্রবধুকে দেখে মিষ্টি হেসে বললেন,
‘ একদম এইসময় ঝুঁকবে না বউমা। সব কিছুই শুনেছি আমি। সত্যি তুমি খুব মিষ্টি। আমার হাদারামটা প্রেম করতে না পারলেও, বিয়েটা করতে পেরেছে এইটাই অনেক। বিয়ে করে আমার ঘরে মিষ্টি একটা মেয়ে নিয়ে এসেছে।’
আরহামকে এইভাবে হাদারাম বলে সন্মোধন করায় আরহামের কপালে বিরক্তি ভাজ পড়ে যায়। যার মানে সে হাদারাম নামে যথেষ্ট অসন্তুষ্ট। তার ভাষ্যমতে, সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান। মেহেভীনের মতো একদমই স্টুপিড নয় সে। তাহলে তাকে কেন দেওয়া হলো হাদারাম নামক উপাধি। মেহেভীন মুচকি হাসে আরহামের দিকে তাকায়। মেহেভীনের টিটরাকিমূলক হাসিতে আরহাম রাগ নাকের ঢগায় চলে আসে। তবুও সে চুপ থাকে। এই স্টুপিড মেয়েকে সেও সঠিক সময় এলে,মজা দেখাবে। আকবর সাহেব মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ আমার হাদারাম টা একেবারের তর সইলো না। বিয়েও করে ফেললো আবার বাচ্ছাও। যাক বাচ্ছা হওয়ার পরে, না হয় আমরা বড় করে বউভাতের অনুষ্টানটা করে ফেলবো। আমার যে কি খুশি লাগছে। আরহামের মা তুমি বরং মিষ্টিগুলো রাহেলাকে দিয়ে বের করিয়ে নাও।তোমার কথামতো তিনশোর মতো প্যাকেট এনেছি।পরে লাগলে আরো আনবো। ‘
আরহামের বাবার কথা শুনে, মেহেভীন সামনের দিকে তাকায়। পুরো ড্রইং রুম জুড়ে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে ভর্তি৷ মনে হচ্ছে আরহামের বাবা
আস্ত মিষ্টির দোকান যেন তুলে এনেছে। মেহেভীন এতোকিছু দেখে বললেন,
‘আংকেল এইসব কি করেছেন? এতো মিষ্টের কি প্রয়োজন ছিলো? ‘
আকবর সাহেব নরম সুরে বললেন,
‘ একদম আমাকে আংকেল বলবে না। আমি কি তোমার আংকেল হই? আমাকে বাবা বলে ডাকবে। জানো আমার ছোটবেলা থেকেই একটা মিষ্টি মেয়ের খুব শখ ছিলো, কিন্তু আল্লাহ দিলেন দুই হাদারাম। কিন্তু এখন সমস্যা নেই। আমাদের ঘরে এখন আমাদের মিষ্টি মেয়ে এসে পড়েছে তাইনা রাজিয়া? ‘
আরহামের মা রাজিয়া সায় দিয়ে বললেন, ‘একদম।’
আরিয়ান কথাটি শুনে তেলে বেগুন জ্বলে বলে,
‘বাবা ইটস নট ফেয়ার। তুমি ভাইয়াকে বলেছো ঠিক আছে। বাট আমাকে একদম হাদারাম বলবে না। ‘
সবাই আরেকদফা হেসে উঠে। আরহাম মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। আকবর সাহেব আবারো বললেন,
‘ এখানে তো কম মিষ্টি মা। আমার তো উচিৎ ছিলো হাজারো মিষ্টি নিয়ে আসা। আমার নাতি-নাত্নি আসবে বলে কথা। আমি আমার নাতি-নাত্নির সাথে খেলবো ঘুড়বো আরো কত কিছু করবো। ‘
আরহামের বাবার কথা শুনে মেহেভীন চুপ হয়ে গেলো। সে আরহামের দিকে তাকালো। আরহামের দৃষ্টি এখনো ল্যাপটপেই রয়েছে। আরিয়ান হয়তো বুঝতে পারলো মেহেভীনের মনের অবস্হা।
আরহামের মা এগিয়ে এসে বললো, ‘ এইসব কিছু করার জন্যে ফিট থাকতে হবে না? তার জন্যে তো ঠিকমতো ওষুধ খেতে হবে। তুমি এখনো তোমার প্রেশারের ওষুধ টা খাও নেই। ডক্টর হয়ে যদি এমন অনিয়ম করো, তাহলে বাকিরা কি করবে? ‘
আকবর সাহেব মিহি হেসে বললেন,
‘ যথা আজ্ঞা মহারানী চলুন। এখুনি ওষুধ টা খেয়ে নেই। ‘
আরহাম মা হেসে উঠেন। আরহামের মা ও আরহামের বাবা উপরে চলে যান। তারা চলে যেতেই, মেহেভীন আরিয়ানের কাছে এসে বললো,
‘ এইবার আমার মনে হচ্ছে আমার এই বাড়িতে আর থাকার উচিৎ হবে না। ‘
মেহেভীনের কথা শুনে, আরহাম এবং আরিয়ান উভয়েই মেহেভীনের দিকে তাকায়। আরিয়ান মেহেভীনের কাধে হাত রেখে বলে,
‘কি হয়েছে মেহু? তুই হঠাৎ এইরকম কথা বলছিস কেন? ‘
মেহেভীন নিজের চোখের জলটুকু মুছে বলে,
‘ আসলে আমার ভিতরে এক অপরাধবোধ কাজ করছে। এই মানুষগুলো কত সরল-সোজা। কতটা ভালো। বিনা প্রশ্নে আমাকে ও আমার সন্তানকে নিজেদের পরিবারের অংশ বানিয়ে দিলো। এমনকি আমার সন্তানকে নিয়ে ভবিষ্যৎ এ কত স্বপ্ন। যখন তারা সত্যটি জানবে তখন কি হবে আরিয়ান? তাদের সব স্বপ্ন তো এক নিমিষেই ভেঙ্গে যাবে। আমি কী করে পারবো তাদের সাথে এইরকম বিশ্বাসঘাতকতা করবো? আমি তো জানি কেউ বিশ্বাসঘাতকা করলে, ঠিক কতটা কষ্ট পেতে হবে। ‘
আরহাম শান্ত সুরে বললো,
‘ আরিয়ান তোর স্টুপিড ফ্রেন্ডকে চুপ করতে বল। সেকেন্ডলি অনেকময় ভালো কিছুর সূচনার জন্যে কিছু মিথ্যে সত্যের থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান।’
মেহেভীন থেমে যায়। আরহাম আবারোও বলে,
‘একজন নিষ্পাপ শিশু সুষ্টুভাবে নিরাপত্তার সাথে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবে। এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে? নিউ বেবীর ভালোর জন্যে এইটুকু মিথ্যেটা আমাদের বলতেই হবে। ‘
আরহামের ফোন বেজে উঠলো। অফিস থেকে ফোন করেছে। আরহাম সবাইকে বিদায় জানিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
______
আরহাম অফিসে ঢুকতেই, রুশা তার সামনে এসে বলে,
‘গুড মর্নিং স্যার। ‘
‘মিস রুশা আপনি হঠাৎ পথ আটকে দাড়ালেন যে, কোন সমস্যা? ‘
রুশা মাথা চুলকে বললো, ‘স্যার আসলে আপনি বলেছেন আমাদের চট্টগ্রামের প্রযেক্টের কথা। প্রযেক্টটার জন্যে আমাদের ২-৩ দিনের মাঝেই চলে যেতে হবে। আপনি যদি আমার সাথে একটু আমার কেবিনে গিয়ে, প্রযেক্টটা বুঝিয়ে দিতেন তাহলে খুব ভালো হতো। ‘
আরহাম রুশাকে এড়িয়ে বললো, ‘হুম। আপনি এই বিষয়ে তাহসানের সাথে কথা বলে নিয়েন, আমি ওকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি। আমি আসছি। আমার একটু কাজ আছে। এক্সকিউজ মি। ‘
আরহাম নিজের কেবিনে চলে যায়। রুশা তাচ্ছিল্যের হাসি হাঁসে। সে খুব ভালো করেই জানে আরহাম তাকে এড়িয়ে চলার জন্যে কথাগুলো বলেছে।
_____
অভ্র নীচে নেমে দেখে মায়রার বাবা এসেছেন।মায়রার বাবাকে দেখেই, মায়রার বাবাকে অভ্র সালাম দেয়। মায়রার বাবা বললেন,
‘ এতো ভালো সুখবরটা পেয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। একেবারে মিষ্টি নিয়েই চলে এসেছি দেখা করতে। ‘
ইশরা বেগম হাসিমুখে বললেন, ‘ বেশ করেছেন। এইরকম একটা সুখবর না পেয়ে কি থাকা যায়? ‘
মায়রার বাবা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ আমার মেয়েটা কত্ত বড় হয়ে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে। সেদিনই তো আমার মেয়েটা কত বায়না করতো। আজ সে নিজেই এখন মা হতে চলেছে। আচ্ছা মা তুই ভালো আছিস তো? ‘
বাবার প্রশ্নে মায়রা তার শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকায়। তার শাশুড়ি তাকে কিছু একটা বুঝায় চোখের ইশারায়। মায়রা নিচু স্বরে বলে,
‘ আমি একদম ভালো আছি বাবা। খুব সুখে আছি। ‘
মায়রার বাবা তার মেয়ের কথা শুনে প্রশান্তি হাসির দিলেন। নিজের কথাতে নিজেই অবাক হলো মায়রা। সে কতটা পরিবর্তন হয়ে গেছে। যে মেয়ে বিয়ের আগে অব্দি সামান্য ব্যাথা পেলে পুরো বাড়ি জুড়ে চিৎকার করতো। সে কিনা এখন অভ্রের দেওয়া প্রতিটা আঘাত সহ্য করে, হাসিমুখে বলে দিচ্ছে সে সুখি। একেই হয়তো বলে,বিয়ের পরে মেয়েদের পরিবর্তন। অভ্র নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ আমাকে এখুনি অফিসে যেতে হবে। আম গেটিং লেট। সো বায়। ‘
অভ্র কথাটি বলে, চলে যেতে নিলে মায়রার বাবা উঠে দাড়িয়ে, অভ্রের হাতে একটা খাম ধরিয়ে বললো,
‘ অভ্র মায়রা এখন প্রেগনেন্ট। মায়রা আমার কাছে আবদার করেছে যেন, তুমি মায়রাকে নিয়ে চট্টগ্রামের ট্রিপে নিয়ে যাও। আমি চাইলে বিদেশের ট্য্যুরের ব্যবস্হা করে দিতে পারতাম,কিন্তু এখন মায়রার অবস্হা যা তাতে বিদেশে যাওয়া ঠিক হবেনা। আমি ট্রিপের সব ব্যাবস্হা করে দিয়েছে। ‘
‘কিন্তু…..’
অভ্রের কথার মাঝেই মায়রার বাবা বললেন,
‘ দেখো অভ্র এইসময় একটু ট্যুরে গেলে মনটাও ভালো থাকে। মায়রারও এখন মন ভালো করাটা খুব দরকার তুমি প্লিয না করো না। ‘
অভ্র মায়রার সাথে আপাতত না যেতে চাইলেও, মায়রার বাবা ও ইশরা বেগমের জোড়ের জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সে রাজি হলো চট্টগ্রামের জন্যে।
_______
আরহাম অফিস থেকে কিছুটা দেরী করেই আজ ফিরেছে। সে তার রুমে ঢুকেই দেখে, মেহেভীন বিছানায় বসে আছে মাথা নিচু করে। আরহাম তার কাঁধের ব্যাগটা রেখে, মেহেভীনের কাছে এসে বললো,
‘ এনি প্রব্লেম? ‘
মেহেভীন কোনরকম মাথা উচু করে বললো,
‘সকল থেকেই প্রচন্ড বমি করেছি। খেতে পারছি না কিছু। আরিয়ানের দেওয়া ওষুধ টা খেয়েছি,তবুও ঘুম আসছে না। একটু ঘুম হলে ভালো লাগতো। ‘
আরহাম মেহেভীনের পাশে বসে বললো,
‘শুয়ে পড়ো। ‘
‘মানে? ‘
আরহাম কথা না বাড়িয়ে, মেহেভীনের মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে, আস্তে করে মেহেভীনের মাথাটা টিপে দিতে থাকে,যেন মেহেভীনের ঘুম আসে। মেহেভীন আরহামের কান্ড দেখে বলে,
‘কি করছেন কি? আপনি এখন আমার মাথা টিপে দিবেন? সবে মাত্র অফিস থেকে এলেন। কিছু তো খেলেও না। ‘
আরহাম ধমক দিয়ে বলে,
‘ স্টুপিড একটা। বেশি কথা বলো। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। ‘
কথাটি বলেই, আরহাম মেহেভীনের চুলে বিলি কেটে দিতে থাকে। মেহেভীন আরহামের ধমক শুনে চুপ হয়ে গেলো। মাথাটা তার সত্যিই ব্যাথা করছিলো, এখন কিছুটা শান্তি লাগছে। মেহেভীন চোখ বন্ধ করে ফেলে।
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আরহাম মেহেভীনের মাথা বুলাতে বুলাতে, খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। মেহেভীন আরহামের হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।ঘুমের মাঝে হঠাৎ করেই মেহেভীন উঠে পড়ে, এতে আরহামের ও ঘুম ভেঙ্গে যায়। আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আর ইউ অকে? এনিথিং রং? ‘
মেহেভীন মুখ চেপে ওয়াশরুমে চলে যায়। আরহাম বুঝতে পারছে মেহেভীনের বমি আসছে। মেয়েটাও সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি, তার মধ্যে বমির জন্যে আরো দূর্বল হয়ে যাবে। মেহেভীন ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে যায়। আরহাম উঠে গিয়ে, মেহেভীনের হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে, মেহেভীনের দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। মেহেভীন পানিটা আস্তে করে খেয়ে নিয়ে, বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রচন্ড দূর্বল লাগছে তার শরীরটা। আরহাম মেহেভীনের দিকে প্রশ্ন নিক্ষেপ করে বলে,
‘বেশি খারাপ লাগছে? আমি কি আরিয়ানকে ডেকে আনবো? ‘
মেহেভীন কোনরকম বলে,
‘তার প্রয়োজন নেই। আরিয়ান কেবলমাত্র ওটি করে ফিরেছে। একটু ঘুমাচ্ছে এখন। শুধু শুধু বিরক্ত করার প্রয়োজন নেই। আপনিও তো সেই কখন এসেছেন কিছু তো খেলেন না। আপনি বরং খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। ‘
কথাটা বলার সাথে সাথে মেহেভীনের বমি চলে আসে। এইবার মেহেভীন আরহামের শার্টের উপরেই বমি করে ফেলে। আরহাম পুরো শার্ট নষ্ট হয়ে গেছে। মেহেভীনের অপরাধের চোখে তাকিয়ে থাকে আরহামের দিকে। মেহেভীনের বিড়বিড় করে বলে,
‘মেহেভীন এইবার তুই একেবারে গেলি রে। এমনিতেই মানুষটা মাত্র অফিস থেকে এলো তারমধ্যে আবার তার নষ্ট করে ফেললি তুই। ‘
মেহেভীন ভাবলো আরহাম বোধহয় তাকে অনেক বকাবকি করবে, এইভাবে বমি করে তার শার্টটা নষ্ট করে ফেলায়। কিন্তু আরহাম এইসব কিছুই করলো না। আরহাম চমৎকার হাসি দিয়ে বলে,
‘ডোন্ট বি প্যানিকড ওকে? প্রেগ্ন্যাসির সময় এইসব কিছুই নরমাল। ঘন-ঘন বমিও হয়। এইসব নিয়ে এতো চিন্তার কিছুই নেই। তাই তুমি একটু বসো। আমি এখুনি চেঞ্জ করে নিয়ে আসছি। ‘
আরহাম উঠে ওয়াশরুমে চলে যায়। মেহেভীন অবাক পানে আরহামের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। সে শুধু ভাবছে আরহাম কীভাবে সহ্য করলো? অন্য একটা মেয়ে তার গায়ে বমি করে ফেললো, সে ঘৃণায় মুখ ছিটকে নিয়ে যাবে। বকাবকি করবে। তা না করে উল্টো হেসে দিয়ে মেহেভীনকে ভালো করে বুঝিয়ে, চেঞ্জ করতে চলে গেলো। কেমন অদ্ভুদ ভালো মানুষ আরহাম। আচ্ছা অভ্র যদি এখন এইসময় এইরকম পরিস্হিতিতে থাকতো? তাহলে কী করতো? নিশ্চই আরহাম যা করেছে, তার উল্টোটা করতো। এইরকম একটা বাজে পরিস্হিতিতে আরহামের মতো দায়িত্ববান মানুষটাকে পেয়ে, মেহেভীন সত্যি নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছে।
__________
মায়রা খুশিমনে নিজের লাগেজ গুছিয়ে ফেলছে। বাবাকে বলে সে অভ্রকে চট্টগ্রামের ট্যাুরের জন্যে রাজি করিয়ে ফেলেছে। মায়রার ধারণামতে অফিসের এতো কাজের চাপে বোধহয় অভ্রের মেজাজ সবসময় উগ্র থাকে,তাই এইভাবে মায়রার সাথে খারাপ আচরণ করে ফেলে,কিন্তু একটিবার দুজনে মিলে কোথাও ঘুড়তে চলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ট্যাুরে শুধু অভ্র এবং মায়রা থাকবে। দুজন একা বেশ আনন্দ নিয়ে ঘুড়ে বেড়াবে পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে। এই বেড়ানোর ছলে, মায়রা তার এবং অভ্রের মাঝে সব দূরত্ব মিটিয়ে ফেলবে,তাদের মাঝে কোন মেহেভীন নামক কাটা থাকবে না। মায়রা তার পেটে হাত রাখে। এই সন্তানের ভবিষ্যৎ এর জন্যে হলেও সব ঠিক হতে হবেই। মেহেভীনকে কিছুতেই মায়রা অভ্রের জীবনে ফিরে আসতে দিবে। মায়রা বারান্দায় গিয়ে দেখে, অভ্র কোথাও নেই। অভ্র আবার কোথায় গেলো? অভ্রকে খুঁজতে খুঁজতে মায়রা ড্রইং রুমের কিনারা গিয়ে শুনতে পেলো অভ্রের গলা। অভ্র ফোনে কাউকে কিছু বলছে।
________
আরহাম ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আরেকটা শার্টটা পড়ে,সোজা রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে। মেহেভীন বুঝতে পারলো না আরহাম হঠাৎ কোথায় গেলো?
মেহেভীন আরহামের পিছন পিছন নীচে চলে গেলো।
এখন প্রায় গভীর রাত। বাড়িতে সবাই এখন ঘুমিয়ে আছে।আরহাম রান্নাঘরে গিয়ে, সুপ বানানো শুরু করলো মেহেভীনের জন্যে। মেহেভীন তা দেখে,আরহামের কাছে গিয়ে বললো,
‘ কি করছেন কি? আপনি তো এখনো ও কিছুই খাননি। নিজে না খেয়ে, আমার জন্যে সুপ বানাচ্ছেন কেন? আমি এখন সুপ খাবো না। ‘
আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ একদম স্টুপিডের মতো কথা বলবে না। সকাল থেকে না খেয়ে, শুধু বমি করছো। এইভাবে চলতে থাকলে তো অসুস্হ হয়ে পড়বে। চুপচাপ টেবিলে বসো। ‘
মেহেভীন কিছু বলার আগেই আরহাম আরেকদফা মেহেভীনকে রামদমক দিলো। মেহেভীন ধমক খেয়ে চুপচাপ বসো পড়লো। লোকটা এমনভাবে ধমক দেয়, যেন কোন সুস্হ মস্তিষ্কের মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। মেহেভীনের তো এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
আরহাম সুপটা বানিয়ে, টেবিলে রেখে মেহেভীনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘চুপচাপ সুপটা খেয়ে নাও। নো মোর টক।’
মেহেভীন মাথা নাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। আরহাম নিজের জন্যে লুডুস বানাতে চলে গেলো। আজকের রাতটা লুডুস খেয়েই, সে কাটিয়ে দিবে।
আরহাম মেহেভীনের দিকে কড়া নজর রেখে রান্না করছে,যেন মেহেভীন পুরোপুরি সুপটা খায়। মেহেভীনের আরহামের দিকে মুচকি হেসে খাওয়া শুরু করলো। এই মুচকি হাঁসির মানে বুঝতে পারলো না আরহাম। মেহেভীম মুচকি হাসার সঠিক কারণ হচ্ছে আরহামের এই ছোট্ট ছোট্ট যত্নগুলো। সব মেয়েই হয়তো এইরকম একজন স্বামী পাওয়ার জন্যে প্রতিক্ষা করে। আরহামের প্রেয়সী যে হবে, সে নিশ্চই খুব ভাগ্যবতী হবে,কিন্তু কে সেই ভাগ্যবতী? আচ্ছা তার মতো ভাগ্য যদি মেহেভীনের হতো তাহলে কী খুব খারাপ হতো? অভ্র ও যদি আরহামের মতো হতো তাহলে মন্দ হতো না। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই,আরহাম লুডুসটা নিয়ে এসে বসে পড়লো।
আরহাম ভ্রু কুচকে বললো,
‘ এইযে স্টুপিড মেয়ে। সুপটা যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়াল আছে তোমার? সত্যি স্টুপিড এর কত প্রকার
কাজ আছে তা তোমাকে না দেখলে বুঝা যাবে না। ‘
আরহাম কথাটি বলেই, নিজের খাওয়া বাদ দিয়ে মেহেভীনের সুপের বাটি নিয়ে মেহেভীনকে খায়িয়ে দিচ্ছে। আরহামের কান্ডে মেহেভীন আনমনে হাসে আরেকবার। সত্যি তার ধারণা ভূল। অভ্র চাইলেও আরহামের মতো হতে পারবে না।মেহেভীন আনমনে বললো,
‘ আরহাম হাসান তালুকদার একজনই আছে। সবাই আরহাম হাসান তালুকদার হতে পারেনা। ‘
_____
ফারিয়া পুরো পাড়া জুড়ে আজ সবার বাড়িতে ঘুড়েছে। বাড়িতে আজ সে কিছুতেই যাবে না। বাড়িতে গেলে নিশ্চিত জুতোর বাড়ি খেতেই হবে। ফারিয়ার স্যার আজ তার মানে বাড়িতে বিচার দিয়েছে। গনিত পরীক্ষায় আবারো ফেল করেছে সে।
ফারিয়া ভাবে তার মাথায় গবর থাকলে, কি সে করবে? সব করার তো ওই ডক্টরের করতে হবে। আচ্ছা ওই ডক্টর তো কল করলো না? ফারিয়া নিজ থেকেই আরিয়ানকে ফোন করলো। আরিয়ান ঘুমাচ্ছিলো, ফোনের আওয়াজ পেয়ে সে ধরফরিয়ে উঠে বসে। সে ভেবেছে হয়তো হসপিটাল থেকে ফোন করেছে, তাই সেই দ্রুত ফোন রিসিভ করে। ফোন রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে তেজি গলায় মেয়ের কন্ঠে বলে,
‘ এইযে ডক্টর সাহেব শুনছেন? ‘
‘সরি কে আপনি? আমার এখন ডিউটি নেই। আমি ঘুমাচ্ছি। সো বায়। ‘
‘একদম কাটবেন না। আপনি আমাকে ফারিয়া।চিনেছেন? যার নাম্বার আজ সকালে নিয়েছেন। আপনার চিকিৎসার কি হলো?আমি বাড়িতে ঢুকতে পারছি না আর এদিকে আপনি শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন?কেমন ডক্টর আপনি?’
আরিয়ান মাথায় হাত দিয়ে দিলো। আজ এই মেয়ের জন্যে তার ঘুম আজ হারাম হয়ে যাবে।
________
মায়রা আরেকটু কাছে গিয়েই শুনতে অভ্র কাউকে ফোনে বলছে,
‘একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকে চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে। আমি যত দিন থাকবো না ততদিন তোকেই মেহেভীনের সব খবর আমাকে দিতে হবে। তোর যত টাকা লাগে আমি দিবো।কিন্তু যে করেই হোক মেহেভীন কোথায় আছে ঠিক কার সাথে সব ইনফরমেশন আমার লাগবে। যতক্ষন পর্যন্ত মেহুর খবর পাচ্ছি না ততক্ষন পর্যন্ত আমি শান্তি পাচ্ছি না রে। ‘
কথাটি বলেই অভ্র ফোনটা কেটে দেখে,মায়রা তার দিকে অশ্রুমাখা চোখে তাকিয়ে আছে। অভ্র সেই চোখের চাহনীকে গুরুত্ব না দিয়ে চলে যেতে নিলে,মায়রা অভ্রের হাত ধরে ফেলে।
চলবে…ইনশা-আল্লাহ।
[কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু]#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২৪
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
প্রেগ্ন্যাসির সময়টায় মায়রার মতো কোনো মেয়েই চাইবে না, নিজের স্বামী তার প্রাক্তনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকুক। অভ্র এখন মায়রাকে নিয়ে চিন্তা করার সময়, তা না করে অভ্র তার প্রাক্তন স্ত্রীর চিন্তায় চিন্তিত। মায়রা আর নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারছে না। তাই অভ্রের হাত ধরে, অভ্রের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বলে, ‘ আচ্ছা অভ্র কিসের এতো দরদ তোমার মেহেভীনের উপর? তুমিই তো একদিন বলেছিলে মেহেভীন শুধুমাত্র তোমার ব্যবহারের বস্তু মাত্র। তাহলে কেন তার জন্যে আজ তোমার এতো চিন্তা। আমি প্রেগন্যান্ট অভ্র। আমার গর্ভে আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন বেড়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। তুমি তাকে নিয়ে, চিন্তা না করে মেহেভীনকে নিয়ে পড়ে আছো? তুমি ঠিক কি চাইছো বলো তো অভ্র? ‘
অভ্র মায়রার হাত নিজের থেকে ছাড়িয়ে, মায়রার বাহু শক্ত করে চেপে ধরে। এতে মায়রা ব্যাথায় কুকড়ে উঠলো। অভ্র তেজি গলায় বলে উঠলো,
‘ শুনতে চাও সত্যি কথা? তাহলে শুনে নাও। আমার পক্ষে তোমাকে কিংবা তোমার ন্যাকামি গুলো সহ্য করা পসিবল হচ্ছে না। আমি আমার প্রাক্তন স্ত্রীর চিন্তা করবো। কেননা একদিনের জন্যে হলেও, আমি তাকে নিজের বউ হিসেবে কবুল করে নিয়েছিলাম। তাই সে কোথায় থাকছে কিংবা কার সাথে থাকছে আমাকে তা জানতেই হবে। তুমি আমার সন্তানের মা হতে চলেছো তাই চুপচাপ তোমার কথামতো চট্টগ্রাম যাচ্ছি, কিন্তু ভূলেও ভাব্বে না আমি তোমার জন্যে যাচ্ছি।আমি আমার মায়ের অনুরোধ ফেলতে পারিনা,তাই যাচ্ছি।তুমি শুধু ততটুকুই অধিকার বিস্তার করবে আমার উপর,যতটুকু অধিকার আমি তোমাকে দিবো। ‘
অভ্র মায়রা একপ্রকার ধাক্কা দিয়েই, নিজের থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। মায়রা হাত শক্ত করে দাড়িয়ে থাকে তা পাশে থাকা ফুলের টবটা হাতে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে। যা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যায়। যেমনটা আজ মায়রার মনটা অভ্র টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে দিয়েছে। মায়রার ইচ্ছে করছে এখন গিয়ে মেহেভীন নামক কাটাটাকে মেরে ফেলতে। মায়রার মনে হচ্ছে মেহেভীন হচ্ছে এখন তার জীবনের সবথেকে বড় কাটা। যাকে উপড়ে ফেলতে পারলে বোধহয় তার এবং অভ্রের জীবনটা আবারো সুখময় হয়ে উঠবে। মায়রা নীচে ধপ করে বসে পড়ে। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে তার।
__________
মেহেভীনকে সম্পুর্ন সুপটা খায়িয়ে, আরহাম নিজের খাবারটুকুও শেষ করে ফেলে। অতঃপর আরহাম মেহেভীনকে আস্তে করে ধরে নিয়ে গিয়ে, খাটে শুয়িয়ে দেয়। আরহাম নরম কন্ঠে বলে,
‘ তুমি আপাতত ঘুমাও। আমি সোফায় ঘুমাচ্ছি। সমস্যা হলে আমাকে ডেকে তুলবে, স্টুপিডের মতো নিজে নিজে কিছু করতে যাবে না। ‘
মেহেভীন বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ায়। আরহাম তার বালিশটা নিয়ে, সোফায় ঘুমাতে চলে গেলো। আরহাম দেখলো আরহামের ফোন বেজে উঠছে।রুশা ফোন করেছে। আরহাম ফোনটা হাতে নিয়ে, সোফায় বসেই রিসিভ করলো। আরহাম বললো,
‘ এনিথিং রং রুশা? ‘
‘রুশা ‘ নামটি শুনে মেহেভীন তার চোখ খুলে ফেললো। কে এই রুশা? আরহামের সেই প্রেয়সী নয়তো? ফোনের অপরপাশ থেকে রুশা ক্লান্ত গলায় বললো,
‘ আজকে খুব ক্লান্ত লাগছিলো স্যার। তাই আপনাকে ফোন দিলাম। আপনার গলাটা শুনতে বড্ড শুনতে ইচ্ছে করলো।
জানেন স্যার? আমরা যখন আমাদের খুব কাছের কারো গলা একটু শুনি, তখন আমাদের ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে যায়। আপনি হয়তো নিজেই জানেন না আপনি আমার কতটা কাছের। কতটা আপন। স্যার কিছু বলছেন না কেন? একটু কথা বলুন না। ‘
আরহাম আর শুনলো না রুশার না বলা ব্যক্ত বানীগুলো। সঙ্গে সঙ্গে কেটে দিলো রুশার ফোন। রুশা তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। আরহাম সবসময় রুশার অনুভুতিগুলো বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে। রুশা মুচকি হেসে বললো,
‘স্যার আপনাকে অনুভুতি সম্পর্কে আর কি বলবো আমি? যে নিজেই অনুভুতিগুলো বুঝতে চায়না, তাকে বুঝানো শুধুমাত্র বৃথা ছাড়া আর কিছু না। ‘
আরহাম বারান্দায় চলে যায়। আরহাম জানে রুশার মনে আরহামের জন্যে অন্যরকম অনুভুতি আছে, যা আরহাম কখনো চায়না। এক তরফা তো সবকিছু হয়না।রাত বেশ গভীর হয়ে উঠেছে। শহরে রয়েছে একপ্রকার নিস্তব্ধতা। আরহাম এই মুহুর্তে খুব করে চায় কেউ তার পাশে থাকুক। নিজের পাশে কারো উপস্হিতি টের পেয়ে, আরহাম ঘাড় কাত করে দেখে মেহেভীন। মেহেভীনের দিকে তাকাতেই মেহেভীন নিচু গলায় বললো,
‘ আপনিই তো বলেছিলেন অনুভুতিগুলো সুন্দর হয়। তাহলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন কেন ভালোবাসার অনুভুতি থেকে। ‘
‘ রুশার অনুভুতি থেকে পালাচ্ছি। রুশার আমাকে পছন্দ করে আমি নয়। আমার কাছে তো অনুভুতি সর্বদা সুন্দর। ‘
আরহামের কথায় মেহেভীন আরহামের দিকে তাকায়। আরহাম মৃদ্যু হেসে বলে,
‘ জানো মেহেভীন? আমরা যখন অন্য কারো ভালোবাসার মায়াজালে নিজেদের জড়িয়ে ফেলি, তখন পৃথিবীর অন্য কোন অনুভুতি আমাদের মনটাকে স্পর্শ করতে পারেনা। আমিও হয়তো এমনই একজনের মায়াতে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে,সেই মায়া কাটিয়ে, অন্য কারো অনুভুতি অনুভব করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি কাটাতেও চাইনা সেই মায়া। ‘
মেহেভীনের বুকটা কেন যেন কেপে উঠে কথাগুলো শুনে। তারমানে তার ধারণা সঠিক। আরহামের জীবনেও কেউ আছে। কিন্তু কে সেই ভাগ্যবতী? বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে মেহেভীনের।
‘ শুয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। ‘
মেহেভীন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
[লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
ফারিয়া আরিয়ানকে ফোন দিয়েই বললো,
‘এইযে মিঃ ডক্টর সকালে যে এতো ভাষন ছাড়লেন কই গেলো আপনার সেই ভাষন? চিকিৎসা শুরু না করে আপনি ঘুমাচ্ছেন? এদিকে আমার মা আমার জন্যে জুতো নিয়ে বসে আছে। আজকে যদি আমি জুতোর বাড়ি খায় আই প্রমিস এর দায়ে আপনাকে আমি জেলে ঢুকাবো। ‘
আরিয়ান এইবার নড়েচড়ে বসলো। অতঃপর গলাটা পরিষ্কার করে বললো,
‘ আর ইউ সিরিয়াস? মানে এখানে আমার দোষটা কোথায়? নিজে ফেল করবেন আবার তার জন্যে জুতার পেটানো খেলে সেই দোষ আমার? এখানে তো বলা যায় যত দোষ নন্দ ঘোষ। ‘
ফারিয়া সঙ্গে সঙ্গে ধমক দিয়ে বললো, ‘চুপ করুন আপনি। আপনার প্রবাদ বাক্য শুনতে আমার ফোনের টাকা খরচ করে আপনাকে ফোন দেইনি।
আগে বলুন কী করলে আমার মাথায় একটু ঘিলু হবে? ‘
আরিয়ান কিছু একটা ভাবলো। এই বজ্জাত মেয়েকে উচিৎ শিক্ষা দিবে সে। তার রাতের ঘুম হারাম করেছে। আরহাম কিছুক্ষন পরে বললো,
‘আমাকে এখন ভিডিও কল করুন। ‘
‘ ওয়াট? ‘
‘ ওয়াট ফোয়াট না করে, ভিডিও কল করুন। চিকিৎসা করবো আপনার। ‘
ফারিয়া আরিয়ানের নাম্বারে ভিডিও কল করে। ভিডিও কল করার সঙ্গে সঙ্গে আরিয়ান তাকিয়ে দেখে, ফারিয়া বাইরে আছে। আরিয়ান বললো,
‘ আপনি বাইরে কেন এতো রাতে? বাসায় যাননি এখনো? ‘
‘ আরে ভাই বললাম না? বাসায় গেলেই আজ মায়ের জুতোর বাড়ি খেতে হবে। তাইতো রাস্তায় দাড়িয়ে আছি। ‘
আরিয়ান কিছু একটা ভেবে বাকা হেসে বললো,
‘ পারফেক্ট। এখানেই হবে। ‘
‘কি হবে? ‘
‘ আপনার চিকিৎসা। এখুনি একশোবার কান ধরে উঠবশ করুন। ‘
ফারিয়া চিৎকার করে বলো, ‘ এমা! একদম না। আমি কিছুতেই করবো না। ‘
আরিয়ান মুখে হাত দিয়ে বলে,
‘ ওকে তাহলে রাখছি। আমি আপনার চিকিৎসা করবো না। যান বাড়ি গিয়ে মায়ের জুতোর বাড়ি খান। ‘
আরিয়ান ফোনটা কাটতে নিলে, ফারিয়া তাতে বাঁধা দিয়ে বলো,
‘ এমা! না প্লিয কাটবেন না। আচ্ছা আপনি যা বলছেন। সেইটাই করবো আমি। ‘
কথাটি বলে ফারিয়া ফোনটার ক্যামেরায় বেঞ্চে সেট করে, কান ধরে উঠবশ করতে থাকে। আরিয়ান তো বেশ মজা নিচ্ছে ভিডিও কল দিয়ে। মেয়েটা সত্যি খুব বোকা।ফারিয়া কানে ধরে উঠবশ করছে আর আরিয়ানের পুরো গোষ্টি ধুয়ে দিচ্ছে। ফারিয়া বিড়বিড় করে বলে,
‘ব্যাটা খাটাশ ডাক্তারের ঘরে ডাক্তার যদি আমার মাথায় ঘিলু না আসে, তাইলে তোর আমি পিন্ডি চটকামো। আমারে দিয়া কান ধরে উঠবশ করানোর শখ জন্মের মতো মিটিয়ে দিবো। ‘
°__________
মেহেভীন ঘুম থেকে উঠে দেখে পুরো রুমটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। আরহাম সত্যি পুরো ঘরটাকে অনাগত বাচ্ছার জন্যে সুন্দর করে সাজিয়েছে। যেমনটি মেহেভীন চেয়েছিলো। মেহেভীন উঠে গিয়ে, বাচ্ছার জন্যে নিয়ে আসা ছোট্ট বিছানায় হাত বুলায়। এই ছোট্ট বিছানায় যখন তার ছোট্ট সোনা ঘুমিয়ে থাকবে, তখন কিন্তু বেশ লাগবে। মেহেভীন মুচকি হাসে। তখনি আরহাম অনেকগুলো প্যাকেট হাতে নিয়ে, রুমে ঢুকে। এতোগুলো প্যাকেট দেখে ভ্রু কুচকায় মেহেভীন। আরহাম প্যাকেটগুলো রেখে বলে, ‘ দেখো তো কেমন হয়েছে?’
মেহেভীন প্যাকেটগুলো খুলে দেখে প্যাকেটে সব ছোট্ট ছোট্ট বাচ্ছাদের পোষাক। প্রায় দশটার মতো প্যাকেট আছে। মেহেভীন এইসব দেখে বলে,
‘ এইগুলো কার জন্যে? ‘
আরহাম হাসিমুখে বিছানায় বসে বলে,
‘ কেন? নিউ বেবীর জন্যে। যে আসছে। আর মাত্র ছয়টা মাস তারপরই নিউ বেবী চলে আসবে। পছন্দ হয়েছে? আমি শুধু আপাতত কিছু কিনে রাখলাম। আমি ভাবছি বেবীর জন্যে আরো ড্রেস কিনবো এবং একটা ছোট্ট মিনি সাইজের কাবার্ডও কিনবো। যেখান শুধু নিউ বেবীর সব ড্রেস থাকবে। ‘
আরহাম বেবীর জন্যে নিয়ে আসা ড্রেসগুলো বের করে, মেহেভীনকে দেখাচ্ছে। মেহেভীন শুধু আরহামকে দেখেই যাচ্ছে মানুষটা কতটা খুশি। মানুষটা কি ভূলে গেলো বাচ্ছাটার জন্ম হয়ে গেলেই মেহেভীন ও তার সন্তান এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। হয়তো ভূলে গেছে। মেহেভীন একবার ভাবলো আরহামকে এইসব করতে মানা করবে, কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলো মানুষটা কত খুশি। শুধু শুধু মানা করে ,মানুষটার মুখের হাসিটাকে বিলপ্ত করার কোন মানেই হয়। মানুষটা হাসছে হাসুক একটু। বড্ড সুন্দর লাগে মানুষটাকে হাসলে। আরহামের হাসি দেখে মেহেভীন নিজেও হাসলো।
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২৫
#Jannnatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীন আরহামের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে ভাবলো লোকটার এই হাসিমুখটাকে দেখে,যেকোন রমনী সারাটাজীবন পার করে দিতে পারবে। আচ্ছা অভ্রের আগে যদি আরহাম মেহেভীনের জীবনে আসতো,তাহলে হয়তো মেহেভীনের জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। আরহামের ভালোবাসায় জীবনটা অন্যরকম সুন্দর হতে পারতো।
নিজের মাথায় এইরকম উদ্ভুট ভাবনা চলে আসায়, মেহেভীন নিজের মাথায় নিজেই টুকা মারে। এইসব কি ভাবছে সে? তার কি এতো ভাগ্য আছে যে, আরহামের মতো মানুষ তাকে ভালোবাসবে। আরহাম তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। সেই ভাগ্যবতী রমনীকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে চায় মেহেভীন। আরহামের তো চমৎকার মানুষ যাকে ভালোবাসে, সে নিশ্চয় খুব বিশেষ কেউ হবে। মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই, আরহাম বিঘ্ন ঘটিয়ে বলে,
‘ এইযে মেয়ে তখন থেকে কি এতো ভাবছে বলো তো? ‘
‘ আরহাম সাহেব আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কিছু কিছু মানুষ যদি আমাদের জীবন একটু আগে আসতো, তাহলে বোধহয় কিছু পরিনতি সুখময় হতো। ‘
মেহেভীনের কি হলো কে জানে মেহেভীন কথাটি বলেই উঠে বারান্দায় চলে গেলো। সে আরহামকে নিয়ে এতোক্ষন ধরে যা ভাবছিলো, যা ভাবতে গেলেই মেহেভীনের মুখে লজ্জা এসে ভীর করে। সে কীভাবে আরহামকে নিয়ে ভালোবাসার কথা ভাবলো? তার মনে কী নতুন কোন অনুভুতি উঁকি দিচ্ছে? যাকে বলে ভালোবাসার অনুভুতি। আরহাম মেহেভীনের পিছনে এসে বলে, ‘ কি হলো এইভাবে উঠে চলে এলে কেন?’
আরহামের সামনে মেহেভীনের কেন যেন দাড়াতে ইচ্ছে করছে না, মেহেভীন দৌড়ে রুমের বাইরে চলে যায়। আরহাম তাজ্জব বনে যায়। মেয়েটার হঠাৎ কি হলো?
আরিয়ান কাল রাতে একপ্রকার ঘুমায়নি বলতে গেলে। কিছুক্ষন পরেই, আরিয়ানকে হসপিটালে চলে যেতে হবে। আরিয়ান বাগানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো, তখনি তার চোখ যায় বাগানে থাকা দুই প্রেমিক-প্রেমিকার দিকে। যারা আর কেউ নয় বাড়ির কাজের মহিলারাহেলা এবং ড্রাইভার মজনু। মজনু কিছুটা ভাব নিয়ে রাহেলাকে বলছে,
‘ বুঝছো নি রাহেলা? আমাগো গ্রেরামে মাইনষে আমারে আবার অনেক সম্মান করে। তোমার যখন আমার বউ কইরা গ্রেরামে লইয়া যামু। সবাই খালি তোমার দিকে চাইয়া থাকবো। তুমি তো চাইয়া থাকার মতোই সুন্দরী। ‘
রাহেলাকে ‘ সুন্দরী ‘ বলে সন্মোধন করায় লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নেয় রাহেলা। মজনু রাহেলার আরেকটু কাছে গিয়ে বলে,
‘ রাহেলা সুন্দরী তোমার হাত টা একটু দাও তো দেখি। ওইদিন তো কুদ্দুস আইসা পড়ছিলো। শালাডা আইসা সব শেষ করে দিছিলো। ‘
রাহেলা লজ্জা নিয়েই, মজনুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। আরিয়ান নিজের চোখ বন্ধ করে ধমকে বলে,
‘ এই তোমরা থামো ভাই। আমি এখনো সিংগাল। এইসব প্রেম-ভালোবাসা আমার সামনে একদমই এলাও না। ‘
সঙ্গে সঙ্গে রাহেলা নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। তার ইচ্ছে করছে মাটি ফাক করে ঢুকে যেতে। ছোট সাহেব তাকে এখন কি ভাব্বে? মজনু তো পারলে এখন চিৎকার করে কাঁদতো। তার রোমান্সের সময়েই শুধু সবাই এসে বাঁধা দেয়। রাহেলা লজ্জায় দৌড় দেয়।
মেহেভীন দৌড়ে নীচে নেমে বাগানে আসতেই, রাহেলার সাথে ধাক্কা খায়। মেহেভীন কোনরকম ‘সরি’ বলে। রাহেলাকে পায় কে? সে তো দৌড়। মজনুও দুঃখে বাগান থেকে চলে গেলো। আরহাম বারান্দায় দাড়িয়ে সব কান্ড দেখছে। আরহাম বললো,
‘ বুঝলাম না। সবার হচ্ছে টা কি? সবাই এতো লজ্জা পাচ্ছে কেন?’
আরহামের মা এইসব দেখে বললেন,
‘ কিরে আরিয়ান রাহেলার আবার কি হলো? ‘
আরিয়ান হাসতে হাসতে এসে বললো,
‘ লজ্জা পেয়েছে মা। প্রেম করতে গিয়ে, লজ্জা পেয়েছে। তুমি বরং এইবার রাহেলা মজনুর বিয়েটা দিয়েই দাও। ‘
আরহামের মা হাসেন। আরিয়ান খেয়াল করলো, মেহেভীনের মুখেও লজ্জায় ভাব। আরিয়ান মেহেভীনের কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘রাহেলার লজ্জার কারণটা বুঝলাম,কিন্তু তুই এতো লজ্জা পাচ্ছিস কেন বইন? ‘
আরিয়ানের প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় মেহেভীন। মেহেভীন আরহামের দিকে তাকাতেই খেয়াল করলো, আরহামের দৃষ্টি মেহেভীনের মাঝেই সীমাবদ্ধ। আরহামের এমন দৃষ্টিতে আরেকদফা লজ্জা পেলো মেহেভীন। মেহেভীনর আচরণ সব কিছুই আরিয়ানের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
________________
ইশরা বেগম মায়রার ঘরে এসে দেখে,মায়রা ঘরের এক কোনে চুপটি মেরে বসে আছে। ইশরা বেগম মায়রার দিকে এগিয়ে গিয়ে, মায়রার পাশে বসে বললেন,
‘ তোমার মুখটা এমন শুকনো লাগছে কেন মায়রা? ‘
মায়রা চুপ হয়ে রইলো। ইশরা বেগম জানেন মায়রার কি হয়েছে। অভ্রের আওয়াজ তিনি নীচ থেকেই শুনেছেন। অভ্রের মাথায় মেহেভীনের ভূত খুব ভালো করেই ঢুকেছে,তিনি তা বুঝতে পারছেন। মায়রা নিরবতা ভেঙ্গে বললো,
‘ আমি বোধহয় অভ্রকে ধরে রাখতে পারলাম না। অভ্র মেহেভীনকে ভূলতেই পারছে না। ‘
ইশরা বেগম মায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ মায়রা তুমি এইভাবে ভেঙ্গে পড়ো না। তুমি তো এখন একা নও। তোমার সাথে এখন আমার বংশের প্রদীপ আমার অভ্রের সন্তান ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। তাই বলছি একটু শান্ত হও। চট্টগ্রামে ট্রিপে তো পরশু যাচ্ছো। সেখানে তুমি এবং অভ্র থাকবে শুধু। সেখানে মেহেভীন নামক কোন ছায়া থাকবে না তোমাদের জীবনে। দেখবে অভ্র আবারো তোমাকে ভালোবাসবে। ‘
নিজের শাশুড়ির কথায় নিশ্চিন্ত হয় মায়রা।
___________
অভ্র প্রতিদিনই অফিস থেকে এসেই প্রথমে মেহেভীনের রুমে ঢুকে। একটু শান্তির জন্যে। মেহেভীনের ঘরে প্রতিটা কোণায় কোণায় মেহেভীনের স্মৃতি জমে আছে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অভ্র আজকেও অফিস থেকে এসে,প্রথমে মেহেভীনের রুমে ঢুকে,কিন্তু রুমে ঢুকেই সে হতবাক। মেহেভীনের জিনিস সব ফেলে দিচ্ছে জবেদা। জবেদা হচ্ছে অভ্রদের বাড়ির কাজের লোক। এইভাবে মেহেভীনের জিনিস ফেলে দেওয়ায়, অভ্রের মাথায় আগুন ধরে যায়। অভ্র জবেদার থেকে জিনিসগুলো নিয়ে বলে,
‘ হাও ডেয়ার ইউ? কার পারমিশনে তুমি মেহুর জিনিসে হাত দিয়েছো? ‘
‘ আমার পারমিশনে। ‘
ইশরা বেগম কথাটি বলে রুমে ঢুকেন। অভ্র অবাক হয়ে বলে,
‘ মা তুমি এইসব কেন করতে বলেছো? ‘
‘ কেন আবার? শুধু শুধু এইসব জিনিস রেখে কি লাভ? ঘরটা খালি করে দেওয়ায় ভালো। ‘
অভ্র ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
‘ ব্যাস মা। তোমার অনেক কথা শুনেছি আমি। এই কথাটি আমি শুনতে পারবো না। এখান থেকে মেহুর একটা জিনিসও সরানো হবে না। যদি তা করা হয়,তাহলে এর ফল খারাপ হবে। ‘
অভ্র গটগট করে রুমে চলে গেলো। ইশরা বেগম হতভম্ভ হয়ে গেলেন। যে ছেলে তার মুখের উপর কথা বলতে সাহস দেখাতো না,সে ছেলে কিনা তাকে একপ্রকার শাসিয়ে চলে গেলো। এইসব হচ্ছে টা কি?
___________________ [লেখিকা জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
ড্রইং রুমে আরিয়ান ও আরহামের বাবা বসে আছেন। আরহামের মা বার বার মেহেভীনকে খেতে বলছে, কিন্তু মেহেভীন কী খাওয়ার মতো মেয়ে? সে কিছুতেই খেতে চাচ্ছে না। আরিয়ান টিভি দেখতে দেখতে বলে,
‘ ভাবি তুমি এখন ভালোমতো খেয়ে নাও, নাহলে ভাই এসে ধমকে তোমাকে খাওয়াবে। ‘
আরিয়ান বলতে দেরী হলেও,আরহাম তা কাজে করে দেখাতে দেরী করালো না। আরহাম অফিস থেকে এসেই মেহেভীনের কান্ড দেখে রামধমক দিয়ে বললো,
‘ এই স্টুপিড! তুমি খাচ্ছো না কেন? তোমাকে ঠিক কি বললে তুমি একটু ঠিক হবে?’
মেহেভীন ঠোট উল্টিয়ে বলে,
‘ আমার খেতে ইচ্ছে না করলে কি করবো আমি? ‘
আরহামের মা বললেন,
‘ আহা আরহাম মেয়েটাকে এইভাবে বকিস না। ‘
আরহামের বাবা খবরের কাগজ ভাজ করে বললেন,
‘ আমার মেয়েটাকে একদম বকবে না এইভাবে আরহাম। প্রেগন্যান্সির সময় মেয়েদের রুচি থাকে না। একটু ভালো করে বুঝিয়ে খাওয়াতে হয়। ‘
আরহাম তার কাঁধের ব্যাগটা রেখে, বললো,
‘ তোমাদের কি মনে হয়? আমি বলেনি? এই স্টুপিড মেয়ে ভালো কথা শুনার মেয়ে না। ওকে ধমকিয়েই খাওয়াতে হবে। আমি যে কি করবো আমি জানি না।
পরশু আমি চট্টগ্রাম যাচ্ছি কাজে। এই কয়দিন তো এই স্টুপিড টা তার সব আজগুবি কাজ করবে। ‘
আরিয়ান কিছু একটা ভেবে বললো,
‘ ভাই আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে? ‘
‘কি? ‘
‘ আমি, ভাবি আর তুই একসাথে চট্টগ্রাম যাই। তুই কাজ করবি আর আমরা ঘুড়বো। তুই ভাবির উপর নজর ও রাখতে পারবি। ‘
আরহামের বাবা সঙ্গে সঙ্গে বললেন,
‘ ইহা সত্যিই উত্তম প্রস্তাব। আমার মনে হয় মেহু মায়ের এইসময় একটু ঘুড়াঘুড়ি করলে,মনটাও ভালো থাকবে। তুই কি বলিস আরহাম? ‘
আরহাম মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ আমার কোন আপত্তি নেই।’
মেহেভীনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো এতোদিন পর সে কোথাও ঘুড়তে যাবে।
তৎক্ষনাক আরিয়ানের ফোনটা বেজে উঠলো। আরিয়ান তাকিয়ে দেখে ফারিয়া ভিডিও কল করেছে। আরিয়ান উঠে বাগানের দিকে চলে যায়।
আরিয়ান ফোন রিসিভ করতেই তার চোখ যায় ক্লান্তিতে মিয়ি যাওয়া মেয়েটার দিকে। চোখ-মুখে একরাশ ক্লান্তি তবুও মেয়েটাকে ভালো দেখাচ্ছে।
ফারিয়া ক্লান্তিমাখা গলায় বললো,
‘ এইযে ডাক্তার সাহেব আপনার কথামতো এক কিলোমিটার রাস্তা আমি দৌড়িয়েছি। আমার তো অবস্হা বেহাল। এখন একটু ঘিলু আসবে তো মাথায়? ‘
আরিয়ান মুচকি হেসে বললো,
‘ সবে তো শুরু মাত্র। এখনো আর কিছু করতে হবে আপনাকে তবেই আপনার বুদ্ধি বৃদ্ধি পাবে। ‘
আরিয়ানের কান্ড পিছন থেকে মজনু দেখে ফেললো। আরিয়ান ভিডিও কলে একটা মেয়ের সাথে মুচকি মুচকি হাসছে। নিশ্চই এই মেয়েটা আরিয়ানের প্রেমিকা হবে। তাহলে তো কথাটা জানাতে হবে সবাইকে। আজ আরিয়ান মজনুর সাধের রোমান্সের বারোটা বাজিয়েছে, সেও আজকে দেখাবে মজা। কথাটি ভেবে, মজনু দৌড়ে বাড়িতে এসে হাপাতে হাপাতে বললো,
‘ আপনারা এহানে খাড়াইয়া আছেন? ওইদিকে আরিয়ান ভাইজানতো প্রেম- পেরেতি করতাছে। ‘
কথাটি শুনার সাথে সাথেই আরহাম কেঁশে উঠে। আরহাম বাবার মুখ থেকে চা বেড়িয়ে যায়। আরিয়ানের মা দাড়িয়ে পড়ে। মেহেভীনের মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। আরহামের বাবা ধমক দিয়ে বলে,
‘ কি বললি? আমার হাদারাম টা কি করছে? ‘
‘ আরিয়ান ভাইজান প্রেম-ভালোবাসা করতাছে হাইসা হাইসা একটা মাইয়ার লগে। ‘
আরিয়ান যা করেছে তার থেকেও দ্বিগুন বানিয়ে বানিয়ে মজনু বলছে সবাইকে। আরহামের মা ঝাটা হাতে নিয়ে বলে,
‘ হতচ্ছাড়া। কই সে? আজ ওর খবর আমি নিচ্ছি। ‘
কথাটি বলেই আরহামের মা বাগানে চলে যায়। আরহামের মায়ের পিছন পিছন বাকি সবাইও যায়। আরিয়ান আর কিছু বলতে চাচ্ছিলো ফারিয়াকে, তখনি সে খেয়াল করে তার মা ঝাড়ু হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে। আরিয়ান কি বুঝলো কে জানে? সে কট করে ফোনটা কেটে দৌড়ানো শুরু করলো। ফারিয়াও বুঝতে পারলো না আরিয়ান হঠাৎ এইভাবে কেটে দাওয়ার মানে কি?
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২৬
#Jannnatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
আরহাম মেহেভীনের ঘুমন্ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাঁসছে। মেয়েটার মুখে এখনো খাবার লেগে আছে। সত্যিই পুরো বাচ্ছা মেয়েটা। ঠিক করে খেতেও পারেনা। আরহাম মেহেভীনকে খায়িয়ে বাইরে গিয়েছিলো, মেহেভীন খাবারটুকু খেয়েই,ঘুমিয়ে পড়েছে। আরহাম টিস্যু বের করে, মেহেভীনের মুখটা পরিষ্কার করে দেয় যত্ন করে। আরহাম কি হলো কে জানে, কিছুক্ষন মেহেভীনের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো। হয়তো সেই চাহনীতে ছিলো, শুধুই মুগ্ধতা।
অতঃপর মেহেভীনের পাশেই বসে,ল্যাপটপ হাতে নিয়ে, অফিসের কিছু কাজ করতে লাগলো। মেহেভীনের ঘুম ভেঙ্গে যায়। মেহেভীন নিজের চোখ খুলে দেখে, আরহাম তার পাশেই বসে ল্যাপটপ হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। মেহেভীন কোনরকম উঠে,আরহামের থেকে ল্যাপটপ টা নিয়ে, আরহামকে ভালো করে শুয়িয়ে দেয় বিছানায়। মেহেভীন আরহামের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ আরহাম সাহেব এই স্টুপিড মেয়েটার খেয়াল রাখতে রাখতে আপনি নিজের খেয়াল রাখাটাই ভূলে গেছেন। ‘
কথাটা বলে মেহেভীন উঠতে নিলে, তার হাত টান পড়ে। সে তাকিয়ে দেখে আরহাম তার হাতজোড়া আকড়ে ধরে, ঘুমাচ্ছে। মেহেভীন বিছানায় বসে পড়ে। আরহামের পাশেই বসে,হেলান দিয়ে বসে থাকে।মেহেভীন আপাতত চাইছে না নিজের হাত টা সরিয়ে, আরহামের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে। মেহেভীন চোখে পুনরায় একরাশ ঘুম এসে ধরা দিচ্ছে। মেহেভীন নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে আস্তে আস্তে।সে জানে সে সবসময়ই নিরাপদ আরহামের কাছে। আরহাম মানুষটাই এতোটা ভরসার। আরহাম ও মেহেভীন উভয়েই গভীর ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।
_________
আরিয়ান নিজের পায়ে গরম শেক দিচ্ছে। আজ আচ্ছা দৌড়ানি খেয়েছে সে। আরিয়ানের মা ছেলের জন্যে কফি নিয়ে আসতেই, তার ছেলে মুখ ঘুড়িয়ে ফেলে অভিমানে। কিছুক্ষন আগে মজনুর কথা শুনে, আরিয়ানের মা আরিয়ানকে ঝাড়ুর বাড়ি দেওয়ার জন্যে, আরিয়ানের পিছন পিছন দৌড়াতে থাকে। এমনকি দুই তিনটে ঝাড়ুর বাড়ি দিয়েও ফেলে। হঠাৎ এইরকম ঝাড়ুর বাড়ি দেওয়ার কারণ আরিয়ান জানতে চাইলে, তার মা বলে দেয় মজনুর বলা কথাগুলো। অতঃপর আরিয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবাইকে বলে সে শুধু তার কলিগের সাথে অপারেশন এর ব্যাপারে ভিডিও কলে কথা বলছিলো,সেইটা না বুঝে মজনু সবাইকে উল্টো কথা বলেছে। যদিও আরিয়ান সত্যি কথাটা বলেনি। আরিয়ানের কথা শুনে, আরিয়ানের মাসহ সকলের ভূল ধারণা ভেঙ্গে যায়। এমনকি মজনু নিজের বোকামির জন্যে, যথেষ্ট বকাও খায়।
ছেলেকে চুপ থাকতে দেখে, আরিয়ানের মা বললেন,
‘ আমি তো বুঝিনি রে। তুই এভাবে রাগ করে থাকিস না বাবা। ‘
আরিয়ান মুখ ফুলিয়ে থাকে। আরিয়ান মা আবারোও বলে,
‘ কেউ যদি এইভাবে রাগ করে থাকে, তাহলে আমি ভেবেছিলাম আজকে আলুর পরোটা করবো। তা আমি করবো না। ‘
‘ আলুর পরোটা’ আরিয়ানের সবসময়ই পছন্দ। তার পছন্দের খাবার হবে শুনে, আরিয়ান সঙ্গে সঙ্গে তার মাকে বললো,
‘ মা আমি একদম রেগে নেই। আমি সব ভূলে গিয়েছি। এখন তাড়াতাড়ি গিয়ে পরোটা বানাও। ‘
ছেলের কান্ড দেখে আরিয়ানের মা মুচকি হেসে বললেন,
‘ পাগল ছেলে আমার। আচ্ছা তুই দাঁড়া আমি আসছি। ‘
কথাটি বলেই আরিয়ানের মা রান্নাঘরে চলে যায়। আরিয়ানের মা চলে যেতেই, আরিয়ানের ফোনটা বেজে উঠে। আরিয়ান দেখে ফারিয়ার ফোন। আরিয়ান ফোনটা রিসিভ করার সাথে সাথেই, ফারিয়া উৎকন্ঠি হয়ে বলে,
‘ ডক্টর সাহেব আপনি ওইসময় ফোন কেটে দিলেন কেন? আমার কি কোথাও ভূল হয়েছে?’
আরিয়ান বিড়বিড় করে বললো,
‘ ওইসময় তো আমি ঝাড়ু বাড়ি খেতে ব্যস্ত ছিলাম, তাও তোমার জন্যে। ‘
‘কি বললেন? ‘
‘ না মানে, বলছিলাম কি আসলে আমার নেট প্রব্লেম হয়ে গিয়েছিলো তাই কেটে দিয়েছিলাম। ‘
‘ওহ আচ্ছা। যে কারনে আপনাকে ফোন দিলাম। সেইটাই তো বলা হলো না। ‘
‘কিসের জন্যে? ‘
ফারিয়া ফিসফিস করে বললো,
‘ আমি না আমার বন্ধু-বান্ধুবীদের সাথে ট্যাুরে যাচ্ছি। তাই এই কয়দিন আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো নাম তাই চিকিৎসাও নিতে পারবো না। আমি বরং ট্যাুর থেকে এসে, আপনার সাথে যোগাযোগ করবো ওকে? ‘
ফারিয়ার সাথে কয়দিন আরিয়ানের যোগাযোগ থাকবে না, কথাটি ভেবে আরিয়ানের মনটা কেন যেন খারাপ হয়ে গেলো। আরিয়ানের ভাবনার মাঝেই ফারিয়া বলে,
‘ ডক্টর সাহেব আমি রাখছি আল্লাহ হাফেজ। ‘
‘ আল্লাহ হাফেজ। ‘
ফারিয়া ফোনটা কেটে দিলো। তার ও মনটা খারাপ হয়ে গেলো হঠাৎ করে।
__________________
আরহাম সকালে উঠেই দেখে মাথাটা তার ভিষন ধরেছে। এই সময় চা হলে মন্দ হতো না। আরহাম উঠতে নিলে, তার চোখ যায় পাশে থাকা চায়ের কাপে। আরহাম চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে দেখে তার পাশে ছোট্ট চিরকুট। তাতে লিখা,
‘ শুভ সকাল আরহাম সাহেব। এইবার একটু নিজের খেয়াল টাও রাখুন। ‘
আরহাম জানে এইসব মেহেভীনের কাজ। আরহাম মুচকি হেসে চায়ে চুমুক দিলো।
_____
আরহাম এয়ারপোার্টে দাড়িয়ে আছে তাহসান, রুশা ও বাকি অফিস কলিগদের সাথে। কিছুক্ষন পরেই তাদের চট্টগ্রামে যাওয়ার ফ্লাইট। আরহাম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। তাহসান আরহামের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
‘ তুই নাকি গাড়িতে করে আসবি আরহাম? তুই তো আমাদের সাথে প্লেনে করেই চলে আসতে পারিস। ‘
আরহাম চাইলে আরিয়ান এবং মেহেভীনকে নিয়ে
প্লেনে করেই যেতে পারতো, কিন্তু এখন মেহেভীন প্রেগনেন্ট। এই অবস্হায় মেহেভীনের প্লেনে উঠা ঠিক হবে না। আরহাম ভেবেছে মেহেভীনকে নিয়ে গাড়ি করেই নিয়ে যাবে। আরহাম বললো,
‘ আমি গাড়ি করেই যাবো। তোরা যা। আমি ঠিক পৌঁছে যাবো। ‘
রুশা বুঝতে পারলো না আরহাম কেন তাদের সাথে যাচ্ছে না? জানার আগ্রহ থাকলেও, সে মুখে তা প্রকাশ করলো না। রুশা ঠিক করেছে, চট্টগ্রামে গিয়েই সে তার মনের কথা খুলে বলবে আরহামকে।
আরহামের থেকে বিদায় নিয়ে, সকলের প্লেনে উঠে গেলো। আরহাম গাড়ি করে বাড়ির ফিরে আসার পথে, তার মাকে ফোন করলো। আরহামের মা এবং মেহেভীন একসাথে মিলে কাপড় গুজাচ্ছে। আজকে রাতেই আরহাম, মেহেভীন ও আরহাম বেড়িয়ে পড়বে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আরহামের মায়ের ফোন বেজে উঠতেই, তিনি তা রিসিভ করার সাথে সাথেই আরহাম বললো,
‘ হ্যালো মা? তোমাদের প্যাকিং করা সব শেষ? ‘
‘ হয়ে গেছে প্রায়।’
‘ আচ্ছা শুনো তুমি মেহেভীনের সব ওষুধগুলো একটু দেখে নিও। ও যা স্টুপিড ওষুধ গুলোও ঠিকমতো নিতে পারবে না। ‘
‘ হুম বাবা। বুঝেছি আর কিছু? ‘
‘ মেহেভীনের পথে বমি হতে পারে, তাই ব্যাগেও কিছু আচার দিয়ে দাও। ‘
আরহামের মা হেসে বললেন,৷ ‘ সব রেখেছি আমি। বউকে নিয়ে তোর এতো চিন্তা বাপ রে বাপ। ‘
আরহাম বললো, ‘ চিন্তা করবো না? যা স্টুপিড মেয়ে একটা। নিজের একটুও খেয়াল রাখবে না। আমি তো পারলে এইরকম জার্নির জায়গায় মেহেভীনকে নিতাম না,কিন্তু মেহেভীন তো মেহেভীনই। সারাদিন শুধু স্টুপিড কাজ করে বেড়াবে। আমি তো ওকে রেখে গেলেও ওখানে গিয়ে, শান্তিমতো কাজ করতে পারবো না। আমার মাথায় শুধু এইটাই ঘুড়পাক খেতো স্টুপিড মেয়েটা নিজের খেয়াল না রেখে,সব স্টুপিডের কাজ করছে। ‘
কথাগুলো একদমে বলে কেটে দিলো আরহাম। ফোনটা স্পিকারে ছিলো যার কারনে আরহামের কথা মেহেভীন ও শুনেছে। যদিও তাকে স্টুপিড বলেছে, তবুও তার কেন যেন এই স্টুপিড ডাকটাকেই বড্ড আপন মনে হচ্ছে। এই মানুষটার কত চিন্তা তাকে নিয়ে। মেহেভীন তো তার কেউ না। তাহলে শুধু দায়িত্ববোধের জন্যে একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে নিয়ে এতোটা চিন্তা করে? আরহামের মা মেহেভীনের ললাটে ধরে বললেন,
‘ মেহু মা দেখলি? আমার ছেলেটার ঠিক কতটা চিন্তা তোকে নিয়ে। আমার ছেলেটা এতোটা ভালোবাসো ফেললো কি করে রে? আমার ছেলেটা কতটা বেখায়ালি ছিলো, আজ সে কতটা খেয়াল রাখে তোর। কতটা ভালোবাসলে,মানুষ এইভাবে চেঞ্জ হতে পারে। ‘
‘ভালোবাসার ‘ কথা শুনে মেহেভীনের বুকটা ধক করে উঠে। আরহাম তাকে ভালোবাসে? এইসব কি ভাবছে সে। সে তো জানে আরহাম শুধু দায়িত্ব পালন করছে। তবুও মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়। সবটাই কি দায়িত্ব?
_________
অভ্রের মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে,মায়রা এবং অভ্র গাড়িতে বসে পড়ে। মায়রার মনে তো অনেক খুশি। এইবার সে সবকিছু ঠিক করে ফেলবে। যদিও অভ্রের মুখে হাঁসির বিন্দুমাত্র ছিঁটেফোটাও নেই। তার মন শুধু মেহেভীনের মাঝে সীমাবদ্ধ। মায়রা অভ্রকে বললো,
‘ অভ্র কি ভাবছো? ‘
‘ তেমন কিছু না। ‘
অভ্র গাড়ি চালানো তে মনোযোগ দিলো। দুজনের মাঝে পিন পিন নিরবতা। দুজন একসাথে থেকেও আজ কতটা আলাদা!
_________
আরহাম, আরিয়ান ও মেহেভীন গাড়ি দিয়ে রওনা হয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। সামনের সিটে ড্রাইভার মজনু এবং তার পাশে আরিয়ান। পিছনের সিটে মেহেভীন এবং আরহাম। আরহাম ল্যাপটপে কাজ করছে, এবং আড়চোখে মেহেভীনের দিকে তাকাচ্ছে। মেহেভীনে জানালার কাছে ঘেষে বসে আছে। মেহেভীনের মনটা হুট করেই আজ খারাপ হয়ে গেলো। কেন যেন তার মনে হচ্ছে সামনে যা হবে, তা ভালো হবে না। নিশ্চই কিছু একটা খারাপ হবে।
এখন বেশ রাত। নিস্তব্ধ রয়েছে শহরটা। রাতের শহর দেখতে বেশ ভালো লাগে।
আরিয়ান তার ক্যামেরা দিয়ে রাস্তায় বসে থাকা বিভিন্ন মানুষের মুহুর্তে ক্যামেরাবন্দী করে রাখছে।
সামনে পিচঢালা রাস্তা, তাই মজনু কিছুটা ঘুড়িয়ে গাড়িটা চালায়,যার ফলে তাল সামলাতে না পেরে মেহেভীন………..
#তুমি_আছো_মনের_গহীনে 💖
#পর্ব- ২৭
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
মেহেভীন তাল সামলাতে না পেরে,আরহামের বুকে গিয়ে পড়লো। আরহামও শক্ত করে মেহেভীনকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। মেহেভীন ‘সরি ‘ বলে উঠতে চাইলে, আরহাম মেহেভীনকে আরো শক্ত করে মিশিয়ে বলে,
‘ স্টুপিড মেয়ে যদি নিজেকে সামলাতে না পারে, তাহলে তো আমাকেই আগলে রাখতে হবে তাইনা? তুমি বরং আমার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ো। সামনে আরো পিচঢালা রাস্তা আছে। এই অবস্হায় বার বার ঝাক্কি খাওয়াটা ঠিক নয়। ‘
মেহেভীন কিছুটা সংকোচ নিয়ে বললো,
‘ কি করছেন কি? আরিয়ান দেখছে তো? কি ভাব্বে ছাড়ুন। ‘
আরহাম কন্ঠে মধুরতার সুর এনে বললো,
‘ ছাড়বো না। আরহাম হাসান তালুকদার এতো তোমাকে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। হোক সেটা দায়িত্ব কিংবা ভালো…’
আরহাম বাকি কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। মেহেভীন আরহামের দিকে তাকিয়ে রইলো অদ্ভুদ দৃষ্টিতে। আরহাম কি যেন বলতে চাইছিলো। কিন্তু বললো না। মেহেভীনের জানতে ইচ্ছে করলো আরহামের মুখে সেই অব্যক্ত বাণী।
আরিয়ান পিছনে না ঘুড়েই বললো,
‘ আমি কিছুই দেখছি না। আমি তো ছবি তুলতে ব্যস্ত। এতো কিছু দেখার সময় নাই আমার। ‘
‘ দেখলে তো কিছুই দেখছে না আরিয়ান। তুমি বরং আমার বুকেই নিশ্চিন্তেই ঘুমিয়ে পড়ো। তাহলে এতো ঝাক্কি খেতে হবে না। ‘
আরহামের কথা শুনে মেহেভীন লজ্জা পেয়ে গেলো। আরহাম স্মিত হাসলো। মেহেভীন আরহামের বুকেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো। এই বুক হয়তো তার জন্যে সব থেকে নিরাপদ। আরহাম মেহেভীনের দিকে তাকিয়েই রইলো। এইরকম মনোমুগ্ধকর মুহুর্তটিকে
ক্যামেরাবন্দী করতে একদমই ভূললো না আরিয়ান।
মজনু গাড়ি চালাতে চালাতেই হাসলো।
___________
দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে আরহাম, আরিয়ান ও মেহেভীন চট্টগ্রামে পৌঁছে গেলো বেশ সকালেই। আরহাম একটা ফাইভ স্টার হোটেল বুক করে ফেললো,যেখানে তাদের সব অফিসের কলিগরা উঠেছে। রুশা,তা্হসানসহ বাকি সকল কলিগরা আপাতত চট্টগ্রাম শহরটাকে একটু ঘুড়ে দেখতে গিয়েছে। আরহাম এখনো তাদের সাথে দেখা করিনি। ভেবেছে একেবারে রাতের মিটিংয়েই সকলের সাথে দেখা করে ফেলবে। যদিও আরহাম তাহসানকে ফোন করে বলে দিয়েছে সে পৌঁছে গেছে। যেহুতু এখানে আরহামের বাবা-মা কেউ নেই। তাই আরহাম মেহেভীনের জন্যে আলাদা রুম বুক করে ফেলে,যদিও রুমটা আরহামের রুমের পাশের রুমটি।
মেহেভীন, আরহাম, আরিয়ান এবং মেহেভীন সকালের নাস্তা করতে লাগলো ফাইভ স্টার হোটেলের ব্রেকফাস্ট টেবিলে। মেহেভীন খেতে গিয়েও পারছে না। এতো পথ জার্নির করার ফলে, সে যথেষ্ট ক্লান্ত। আরহাম মেহেভীনের অবস্হা বুঝতে পেরে বললো,
‘ মেহেভীন তুমি বরং রুমে চলো। আমি বরং কোন স্টাফকে দিয়ে তোমার খাবার টা রুমে আনিয়ে নিচ্ছি। আর আরিয়ান তোরা খেয়ে না। ‘
মেহেভীন ও আরিয়ান সম্মতি জানায়। আরহাম নিজের খাবার টা না খেয়েই, মেহেভীনের হাত ধরে আস্তে আস্তে করে মেহেভীনের রুমের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। মজনু দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ আমাগো বড় ভাইজান আমাগো ভাবিরে কত্ত ভালোবাসে। আহা উনাগো দেখলে আমার খালি দেখতেই ইচ্ছা করে। ‘
আরিয়ান কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
‘ দোয়া করিও মজনু। সবসময় যেন এইরকম থাকে। ‘
‘ আমি আর রাহেলা তো সবসময় দোয়া করি। আমাগো বড় ভাইজান আর বড় ভাবি যেন সবসময় এমই থাকুক। এদের ভালোবাসার উপরে যেন কারো শয়তানের বদ নজর না পড়ে। ‘
আরিয়ান স্মিত হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
________
অভ্র গাড়িটা ফাইভ স্টারে হোটেলের সামনে রাখলো। মায়রা এবং গাড়ি থেকে নেমে গেলো। হোটেলটার দিকে তাকিয়ে অভ্রের কেমন একটা অদ্ভুদ অনুভুতি হচ্ছে।মনে হচ্ছে এখানেই সে তার কাঙ্খিত কিছু পেয়ে যাবে। অভ্র বুঝতে পারছে না, তার এমন অদ্ভুদ অনুভুতির কারণ কী? মায়রা এগিয়ে এসে, অভ্রের কাধে হাত রেখে বলে,
‘ অভ্র….’
মায়রার ডাকে হুশ ফিরে অভ্রের। মায়রা বললো,
‘ অভ্র ভিতরে যাবে না? এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে। ‘
‘ হুম যাচ্ছি চলো। ‘
মায়রা ও অভ্র তাদের লাগেজ নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। মেহেভীনকে নিয়ে এসে, আরহাম কাউন্টার থেকে তাদের রুমের কার্ড নিয়ে, তাদের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। আরহাম ও মেহেভীন চলে যেতেই, কাউন্টারে অভ্র ও মায়রা কাউন্টারে চলে এলো। কাউন্টারে বসে থাকা স্টাফ অভ্রদের উদ্দেশ্য বললেন,
‘ স্যার আপনাদের কয়টা রুম লাগবে? ‘
‘ জ্বী আমাদের জন্যে একটা রুম বুক করে দিন। ‘
মেহেভীনের কানে অভ্রের কন্ঠের প্রতিধ্বনি আসে। মেহেভীন পিছনে ঘুড়ে দেখে কেউ নেই। মেহেভীনের মনে হচ্ছে অভ্র এখানেই আছে। কিন্তু অভ্র এখানে কি করে থাকতে পারে? মেহেভীনের ভাবনার মাঝেই, আরহাম বলে উঠে,
‘ এখানে দাড়িয়ে কি করছো? ভিতরে চলো। ‘
আরহামের কথা শুনে আর কিছু না ভেবে, মেহেভীন নিজের রুমে চলে যায়। আরহাম মেহেভীনকে ঘরে খায়িয়ে দিয়ে, নিজের রুমে এসে, শুয়ে পড়ে। কালকে মজনু নিজের হাতে ব্যাথা পাওয়ায়, আরহামই নিজে ড্রাইভ করে এসেছে। আরহাম তার ব্যাগটা রেখে, বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দেয়। মেহেভীন টিপ টিপ করে আরহামের রুমে ঢুকে। মেহেভীনের ধারণাতমতে, আরহাম এখন গভীর ঘুমে আচ্ছান্ন। এইটাই সুযোগ! মেহেভীন আস্তে আস্তে আরহামের কাছে গিয়ে, আরহামের কাছে গিয়ে বসে পড়ে। আরহামের কপালে লেপ্টে থাকা সিল্কি চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে, কপালে মালিশ করে দিতে থাকে। মেহেভীন জানে আরহামের মাথা প্রচন্ড ধরেছে তাই সে মালিশ করে দিতে এসেছি। আরহাম যদি জানে এই অবস্হায় মেহেভীন এসেছে, তাহলে রামধমক দিবে। কথাটি ভেবে মেহেভীন মুচকি হাসে।
আরহাম ঘুমের মাঝেই মুচকি হাসে,যা মেহেভীনের অগোচর হয়ে থাকে।
_________
অভ্র লাগেজ টা রেখে, ওয়াশরুমে চল যায়। মায়রার মনে তো অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করছে। আরহাম ওয়াশরুম থেকে বেড়োতেই, মায়রা অভ্রের কাছে আবদারের সুরে বলে,
‘ অভ্র আজ ডিনারের পরে, আমাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে? আগের মতো? ‘
অভ্রের কথাটি শুনেই চোখ-মুখে ধরা দিলো একরাশ বিরক্তি। সে বিরক্তির সুরে বললো,
‘ দেখো মায়রা আমি আজকে যথেষ্ট টায়ার্ড। এতো রংঢং করার ইচ্ছে নেই আমার। আমাকে প্লিয এখন একা ছেড়ে দাও। ‘
‘ অভ্র…এইসব বলছো কি তুমি! আগেও তো কত টায়ার্ড থাকতে তুমি। সারাদিন অফিসের কাজ করে, আমার বায়না মিটানোর জন্যে, কত লং ড্রাইভে নিয়ে গিয়েছো? আজ এতোটা চেঞ্জ কেন হলে, অভ্র?’
মায়রা চোখ ছলছলো হয়ে উঠছে কথাগুলো বলতে বলতে। অভ্র জবাব দিলো না।
‘ ডিনার করতে চলো। ‘
কথাটি বলেই প্রস্হান করলো অভ্র। মায়রা বরাবরের মতো আশাহত হলো।
______________
এদিকে,,
মেহেভীন নিজের রুমে এসে পানির গ্লাস হাতে নিতেই দেখে, তার পাশে ছোট্ট চিরকুট। তাতে লিখা,,
‘ প্রেয়সী! তুমি সবার খেয়াল রাখো। এদিকে আমার অন্তরের খবর কী রাখো? উহু একদমই না।
আমার অন্তরটা জ্বলে পুড়ে খাড় হয়ে যাচ্ছে, তোমাকে না পাওয়ার অসুখে সেই খবর রাখো? চিন্তা করোনা। ঠিক আমি তোমাকে নিজের করে নিবো। ‘
চিরকুট টা দেখে মেহেভীনের অতিমাত্রায় রাগ হলো। কে এই আগন্তক? দুইদিন পর পর উদয় হয়? যত্তসব! মেহেভীন চিরকুট টা ফেলে দেয়। আরিয়ানের ডাক আসে ডিনারের জন্যে। মেহেভীন নিজের ভাবনাটা চেপে রেখে, নীচে চলে যায়।
আরহামও নীচে বসে আছে। মেহেভীন নীচে নেমে আসে। মেহেভীন নীচে নামতেই, তখনি কেউ এসে আরহামকে জড়িয়ে ধরে। তাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় মেহেভীন। আরিয়ান ও বসা থেকে উঠে যায়। আরহাম কিংবা আরিয়ান কেউ তাকে এখানে আশা করেনি। মেহেভীন যেন তাকে দেখে ঘোরের মাঝে চলে যাচ্ছে।
চলবে….ইনশা-আল্লাহ।