প্রিয় প্রহর ২ পর্ব -০৯

#প্রিয়_প্রহর২
লেখনীতে: #নুরুন্নাহার_তিথি
#পর্ব-৯ (কিছু সত্য)
আয়ানা সাদিয়া ও সাবিলাকে মোবাইল থেকে ধ্রুবের রিপোর্টটা দেখালে ওরাও স্তব্ধ হয়ে যায়। আয়ানা বিমর্ষ হয়ে বলে,
–এটাই ওর আমাকে ইগনোর করার ও ছেড়ে যাবার কারন! ওর হঠাৎ করে আমার সাথে রুড বিহেভ ও ইগনোর করা আমার বোধগম্য হচ্ছিলো না। কিন্তু ওর যে ক্যান্সার এটা আমার ধারনারো বাহিরে ছিলো।

সাদিয়া আয়ানাকে আগলে ধরে। সাদিয়া ও সাবিলা এমতাবস্থায় কি বলবে তারা বুঝতে পারছে না। দরজার বাহির থেকে নীড় ও মেঘ শুনেছে সব।

______ড্রয়িংরুমে বসে আছে মিস্টার মুনতাসির ও তার পুরো পরিবার। আয়ানা মাথা নিচু করে বসে আছে। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে ধ্রুবের অসুস্থতার কথা। এখন মিস্টার মুনতাসির কি বলবে সেটাই দেখার পালা। মিসেস নূর ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে সাথে নীড়, মেঘ, সাবিলা ও সাদিয়া।
গলা খাঁকারি দিয়ে মিস্টার মুনতাসির বলে,

–আমেরিকার ফ্লাইটের টিকেট কাটো। ভিসা তো রিনিউ করা আছে। স্বপরিবারে যাবো আমরা।

আচমকা এই কথা শুনে আয়ানা তার বাবার দিকে তাকায়। ছলছল করছে তার আঁখিযুগল। মিস্টার মুনতাসির মেয়ের পাশে গিয়ে বসেন। এরপর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলেন,

–রোগ নিরাময় হয় প্রথমে মন থেকে। মনের জোড় কমে গেলে ঔষুধ তখন ঠিকভাবে কার্যকর হয়না। অন্যান্য বাবা-মায়ের মতো আমি ও তোমার মা না। তুমি নিজেও একজন ডাক্তার। তোমরাও জানো মৃত্যু পথযাত্রি রোগীকেও বাঁচার ইচ্ছা জাগাতে বলো তোমরা। কেনো বলো? এই কারনেই তো যে সে যেনো মনের জোড় না হারায়। মনের জোড় দিয়ে অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় হয়। মানুষের মন খুশি থাকলে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস ডোপামিন নিঃসরণ করে। তখন মানুষ প্রফুল্লিত থাকে। তখন শরীরে রোগ নিরাময়কারী ড্রাগ ও মেডিসিন দ্রুত কাজ করে। আর ধ্রুবর খুশি তুমি। তুমি ওর পাশে থাকলে মনের জোড় পাবে। আর তুমিও ভালো থাকবে। আমি আমার মেয়েদের চিনি। আমার দুই মেয়েই তার মায়ের একটা স্বভাব তো পেয়েছে যে মনে দ্বিতীয় কাউকে প্রিয় প্রহরে জায়গা দিবেনা। তবে আরু পুরোপুরি তোমার মায়ের স্বভাব। এইজন্য বাবা হয়ে মেয়ের জীবন রিস্কে ফেলছি।

আয়ানা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিরবে অশ্রু ঝরাতে থাকে। মিসেস নূর ওড়নার কোনা দিয়ে চোখ মুছেন। সাবিলা মেঘকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আর সাদিয়া আপ্লুত হয়ে নীড়ের হাত খামচে ধরে।

নীড় বুঝে পায়না! এই মেয়ে (সাদিয়া) প্রেগনেন্ট হবার পর থেকে তাকে (নীড়) ক্ষণে ক্ষণে চিমটি, খামচি, কামড় দিতে থাকে কেনো!

আর মেঘ! সেও বুঝতে পারছেনা যে সাবিলা প্রেগনেন্সির স্টেজে এসে কষ্টেও কাঁদে, আনন্দেও কাঁদে! মানে কথায় কথায় সে ছিঁচকাঁদুনে হয়ে গেছে। অতি আনন্দে মানুষ কাঁদে তবে ভ্যা ভ্যা করে গঙ্গা-যমুনা বাইয়ে কাঁদে!😕

সাদিয়া ও সাবিলা দুজনের এখন দুই মাস শেষ হয়ে কয়েকদিন পড়লো প্রেগনেন্সির। আর আমেরিকার ফ্লাইটের আগে ওদের প্রেগনেন্সির তিন মাস পূর্ণ হয়ে যাবে।

_______
জার্মানিতে নিজের রুমের ব্যালকনিতে বসে আছে আরোহী। হাতে তার ধোঁয়া উঠানো গরম কফি। এখন মধ্যরাত। আরোহী তার ফিলিপ আঙ্কেল ও এনা আন্টির বাড়িতে থাকছে। উনাদের একটা মেয়ে ও ছেলে আছে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে আর ছেলে অন্য শহরে লেখাপড়া করে। আর উনাদের বাড়ি খালি থাকে তাই আরোহীকে উনাদের সাথে থাকতে বলেছে। ছোটবেলা থেকে পরিচিত তাই।

অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহ। আরোহী এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গর্ভকালীন সব চিহ্ন ফুটে উঠেছে। পেট কিছুটা উঁচু হয়েছে। কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর ভাবছে কেনো সে মানে ঠিক কি কারনে সব কিছু প্রায় জানার পরেও জার্মানিতে এসেছে!
__________★★
শুভ্রর সাথে হোটেলে হওয়া ঘটনার দুইদিন আগে জেসিকারা সরোয়ার্দি হসপিটালে কাছেই এক রেস্টুরেন্টে আলাপ করছিলো। ভাগ্যবশত শিলা সেখানে তার স্বামী সহ লাঞ্চ করতে এসেছিল। শিলার স্বামী ওয়াশরুমে গেলে শিলা তার পেছোনের টেবিল থেকে কিছুটা পরিচিত দুটি গলা শুনতে পায়। পরিচিত মেয়ে কন্ঠের একজন বলছে,

–আমার মনে হয়না যে ওই মেয়ে ভিডিওটা দেখে চুপচাপ বসেছিল। নিশ্চই সত্য ভিডিওটা বের করে ফেলেছে! নাহলে দেখো, ওই ভিডিও দেওয়া হয়েছে এক সপ্তাহ হয়ে এলো কিন্তু ওদের দুজনের কোনো ঝগড়ার আভাস পেলাম না। আরোহী চুপ করে থাকার মতো মেয়ে না। সে হাঙ্গামা করতোই।

আরেক পরিচিত মেয়ে কন্ঠ বলছে,
–আই থিংক ওটা যে ফেক ছিলো বুঝে গেছে। এবার আমাদের সরাসরি সেটা দেখাতে হবে। যাতে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। এবং অবশ্যই ডাক্তার সাদাদ ও বাকিরা কেউ একজন কালকে প্রাইভেট নাম্বার থেকে ফোন করে বলবে যে ওটা একটা ডেমো ছিলো। আমার মনে হয় সার্ভার থেকে এতোক্ষনে আসল ভিডিওটা বের করে ফেলেছে। এটাও বলবে যে, ” ডেমো ভিডিও এবং রিসেন্ট ইংল্যান্ডে যে একসাথে জেসিকার সাথে ছবি গুলো আছে যা জেসিকা জেদ করে তুলেছে সেগুলো আজ রাতেই পাঠাবে।

অপরিচিত ছেলে কন্ঠের একজন বলে,
–তাহলে পরশুদিন কাজটা করতেই হবে।

শিলা ওদের কথোপকথন ঠিকঠাক বুঝতেছে না তবে এটুকু বুঝেছে যে শুভ্র ও আরোহীর ব্যাপারে কথা হচ্ছে। তখনি শিলার হাসবেন্ড চলে আসে আর শিলাও সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলে। একপ্রকার ভুলেই যায়।

আরোহীর কাছে সেদিনই আসল ভিডিওটা আসে। আরোহী যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তবে কে বা কারা এমন চক্রান্ত করছে সেটাই বুঝতে পারছে না। ওই আপত্তিকর ছবি গুলোও ইডিটেড তবে বাকি ছবি গুলো রিয়েল। জেসিকা শুভ্রর গালে কিস করছে সেগুলো রিয়েল। আরোহীর ইচ্ছে করছে শুভ্রকে সব বলতে সাথে প্রেগনেন্সির কথাটাও। তবে কি ভেবে যেনো আর বলে না। আরোহীর মনে হচ্ছে জেসিকাও ইনভলব আছে এতে। এখন যদি শুভ্র বা পরিবারের কেউ প্রেগনেন্সির কথা জানে তো জেসিকা বা শত্রুরাও জেনে যাবে। আর আসলে জেসিকা করছে কিনা তার কোনো প্রমান নেই।,সার্ভার থেকে বলা হয়েছে, এই ভিডিওটার মতোই এঙ্গেল চেঞ্জ করা একটা ভিডিও নাকি সাত বছর আগে এক ঘন্টার জন্য ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছিল। পরে সেটা ডিলিট করা হয়েছিল।

পরেরদিন আরোহীর কাছে শুভ্র ও জেসিকার কিছু ছবি আসে। যেখানে শুভ্র হাসছে আর জেসিকা শুভ্রকে একপাশ থেকে জড়িয়ে রেখেছে। কোনোটাতে জেসিকা পরে যেতে নিয়েছে আর শুভ্র তাকে ধরে ফেলেছে। আবার কোনোটা পার্টিতে কাপল ডান্স! (কাপল ডান্স করেছিলো ইংল্যান্ডে ওই হসপিটালের ডাক্তাররা মিলে ছোট করে আড্ডার আসর করেছিলো)

এগুলো দেখে আরোহীর রাগ হচ্ছে। প্রচন্ড রাগ। শুভ্র কি এই জেসিকার অহেতুক গায়ে পরা স্বভাব দেখে না! কথায় কথায় গায়ে পরে এই মেয়ে। শুভ্র এগুলোকে ওয়েস্টার্ন কালচার ভেবে যেনো গায়েই লাগায় না।

সেদিন শুভ্রর সাথে আরোহীর কিছুটা বাকবিতণ্ডা হয়। রাতের বেলা বাড়ি ফিরার পথে মূলত আরোহী বলে,

–তুমি ইংল্যান্ডে গিয়ে তো ওয়েস্টার্ন কালচার ভালোই রপ্ত করে ফেলেছো। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে আমার ব্যাচমেট রসিদের (সাদাদের বন্ধু) সাথে কথা বলতে বলতে বাহিরে আসছিলাম আর ইটের কনার সাথে পা লেগে পড়ে যেতে নিছিলাম তো সে আমায় সামলায়। আর তুমি তা দেখে এখনো গম্ভীর হয়ে আছো। নিজে যে ইংল্যান্ডে গিয়ে মনে হয় সাধু হয়ে ছিলে! মেয়েরা তার গায়ে এসে পরে আর সে কিছু বলে না। হুহ।

শুভ্র গাড়ি থামিয়ে করে বলে,
–কিসের মধ্যে কি! ওদের দেশের কালচারে আমি ছিলাম। আর আমি তো কারো গায়ে ইচ্ছে করে হাত দেইনি। তোমাকে ওই ছেলে কোমড় পেঁচিয়ে কেনো ধরবে? আমার বউকে সে কেনো ধরবে? দেখো, তুমি আমার কাছে কি তা আমিই জানি। তোমার জন্য আমি অতিরিক্ত জেলাস হয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন।

দুজনেই মুচকি হাসে। তারপর হাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাড়ি ফিরে।

তার পরেরদিন মানে হোটেলের ঘটনার দিন,,
জেসিকা শুভ্রর কেবিনের পানিতে তরল হাই পাওয়ারের কিছু মিশায়। এরপর করিডোরের শেষপ্রান্তে যায় ফোনকল করতে। শিলা ওয়াড থেকে রাউন্ড দিয়ে বেরিয়ে চলে যেতে নিবে তখন দেখে জেসিকা চুপিসারে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। এই ওয়াডটা করিডোরের শেষপ্রান্তে তাই সে জেসিকার একটা কথা শুনতে পায় যে,

” সব রেডি! আমি পানির সাথে মিশিয়ে দিয়েছি। ”

শিলার এবার খটকা লাগে। তার পরশুদিনের কথা মনে পড়ে যায়। জেসিকা কথা বলে পেছোনে ঘুরার আগেই শিলা আবারো ওয়াডে ঢুকে যায়। জেসিকা চলে যাবার পর শিলা ওর উপর নজর রাখার জন্য এক বিশ্বস্ত নার্সকে বলে।

আধঘণ্টা পর নার্স শিলাকে খবর দেয় যে,
” ডাক্তার শুভ্র অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই তার ফ্রেন্ড ডাক্তার জেসিকা তাকে চেকআপ করে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। ”

শিলা খবর পেয়েই বুঝে যায় আজকে শুভ্রর সাথে কিছু হবে। সে কি করবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ ভেবে আরোহীর কথা মনে পড়ে। আরোহীকে ফোন করে তারপর এগুলো বলে।

আরোহী এগুলো শুনে ঘাবড়ে যায়। যদি তার শুভ্রর সাথে কিছু করে জেসিকা! আরোহী ফোন কেটে শুভ্রর নাম্বারে ডায়েল করে কিন্তু নাম্বার সুইচড অফ বলছে।
কিছুক্ষণ পর আরোহীর ফোনে কিছু ছবি আসে যেখানে জেসিকা শুভ্রর শার্ট খুলছে। আরেকটাতে জেসিকা শুভ্রকে জড়িয়ে ধরেছে।
এই ছবি গুলোর সাথে একটা মেসেজ,
” এবার আর ডেমো ভিডিও না। সরাসরি লাইভ দেখতে নিচের ঠিকানার হোটেলে চলে আসেন। ”

আরোহীর মাথা তখন পুরো হ্যাং। সে কি করবে ভেবে না পেয়ে শিলাকে ফোন লাগায়। তারপর এগুলো বলে। শিলা বলে,

–আরোহী তুমি যাও। আর দেখো শুভ্রর কোনো দোষ তো নেই। জেসিকারা ওরে ফাসাচ্ছে।

–আমি নিতে পারছিনা এগুলো। এই অবস্থায় এতো প্রেশার! আমি সত্যি নিতে পারছি না। যদি ওরা খারাপ কিছু করে ফেলে!

কথাটা বলেই আরোহী ফোন হাতে নিয়ে কান্না করে ফেলে। ফোনের অপর পাশ থেকে শিলা আরোহীকে কি বলে শান্তনা দিবে বুঝতে পারছে না। তারপরেও বলে,

–আমাদের কাছে কোনো প্রমান নেই। সলিড কোনো প্রমান নেই। জেসিকা শুভ্রর কেবিনের পানির গ্লাসটাও সাথে করে নিয়ে গেছে। কারন গ্লাসটা নেই। আমাদের বুঝে কাজ করতে হবে। ওরা যেভাবে শুভ্রকে ফাসাচ্ছে ত্তে মনে হচ্ছে ওদের পরিকল্পনা খুব শক্ত। তোমাকে শক্ত থাকতে হবে। দেখো এরপর কি হয়।

আরোহী এরপর হোটেলে যায়। আর ওসব দেখে। হোটেলটা খুব নামিদামি। হোটেল রুমে যাওয়ার সময় এক হ্যাংলা মতো ছেলে আরোহীকে রুম পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আরোহী সেখানে গিয়ে দরজা খুলে দেখে, ফ্লোরে শার্ট-প্যান্ট, আর মেয়েদের পোশাক যা জেসিকা পরিহিত ছিলো ছবিতে।

আরোহী সেখানে দাঁড়ায় না। হোটেল থেকে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে শিলাকে ফোন করে বলে। শিলার সাথে কথা বলা অবস্থায় আরোহীর ফোনে মেসেজ আসে,

” যদি আজকের ঘটনা শুভ্র জানতে পারে তাহলে শুভ্রর ছবিগুলো ভাইরাল হতে এবং আজকে যা হয়েছে সব রেকর্ড করা আছে। সব ভাইরাল হবে। তোমাকে শুভ্রর লাইফ থেকে চলে যেতে হবে। ডিভোর্স দিয়ে দূরে কোথাও। তাহলেই শুভ্রর মান-সম্মান বাঁচবে।”

আরোহী এমতাবস্থায় শিলাকে বলে। তখন শিলা বলে,
–তুমি টেনশন করো না। আই থিংক ওদের মধ্যে কিছুই হয়নি। আর হলেও শুভ্র নির্দোষ। আমাদের অভিনয় করতে হবে। তারপর ওই হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ বের করতে হবে। আর পুলিশ কেসটাও করা যাবে না বিকজ তাতে তারা ছবি ভাইরাল করবে। তোমাকে দূরে কোথাও যেতে হবে কিছুদিনের জন্য।

চলবে ইনশাআল্লাহ,
বাকিটা কালকে😷।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কার্টেসি ছাড়া দয়া করে কপি করবেন না। রিচেক করা হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here