দীর্ঘ ছ’বছর পর আমার প্রাক্তন স্বামী রাফির সঙ্গে আমার দেখা হলো আর এরমধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আমার বর্তমান স্বামী আদিল রহমান।
রাফি হসপিটালে এসেছে তার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে। হয়তো তার বাচ্চাটা অসুস্থ আর দেখে মনে হচ্ছে মেয়ে বাচ্চা। রাফির দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললাম আমি। আজ সে তার মেয়ের জন্য কতই না চিন্তিত অথচ যেদিন রাফি জানতে পারলো, আমার গর্ভে মেয়ে সন্তান সেদিন ও আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো। একটি বার খোঁজ নিয়ে জানতে চাইনি, তার স্ত্রী নামক প্রানীটা বেঁচে আছে কি না?
অথচ সেই রাফি আজ স্ত্রীকে একহাতে ধরে রেখেছে অন্যহাতে তার মেয়েকে বুকের কাছে আগলে রেখেছে।
-এই রুশা কি ভাবছো? বাচ্চাটির বাবা-মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করো বাচ্চাটির কি সমস্যা?
আদিলের কথায় আমি পুরোনো স্মৃতিচারণে ব্যাঘাত ঘটলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিলের খুব কাছে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বললাম,
-আদিল,আমি আজ রাউন্ডে থাকতে চাই না। বাড়িতে চলে যাবো শরীরটা ভালো লাগছে না।
আদিল রুশার মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে,হঠাৎ করে কি হলো আবার? আচমকা, রুশার চোখের জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। আদিল, হতবম্ভ হয়ে রুশাকে বললো,
-আচ্ছা, চলে যাও। তবে যাওয়ার আগে তোমার সুলতানা ম্যামকে বলো আমি ডাকছি তাকে ইমার্জেন্সি।
রুশা কোনোভাবে গা ঢাকা দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। ভাগ্যিস, মুখ ঢাকা ছিল নয়তো রাফি আজ তাকে চিনে ফেলতো। হয়তে আদিলের সাথে রাফির পরিচয় হতো আর এতে ব্যাপারটা বিশ্রি রুপ ধারণ করতো।
মাঝে মাঝে কিছু বাজে পরিস্থিতিতে আমরা জরিয়ে যাই। অথচ, বাস্তবিক অর্থে আমরা কখনোই চাইবো না আমাদের অতীত এসে আমাদের বর্তমানকে ধ্বংস করে ফেলুক।
সেদিন, বাড়িতে ফিরে যাবার রায়হান আঙ্কেল বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন,
-কেন চোখ লাল হয়ে আছে?আদিল কিছু বলেছে? যদি কিছু বলে থাকে তাহলে বাবাকে বল ওকে কল করে এখুনি বাড়িতে আসতে বলি।
-না, বাবা। আদিল কিছু বলেনি আমায়। আপনি চিন্তা করবেন না। এমনিতেই চোখদুটো কেন যে লাল হয়ে আছে?
রায়হান আঙ্কেলের কাছ থেকে কোনোমতে প্রশ্ন এড়িয়ে রুমে চলে এলাম।
রুমে আসার পরপরই আদিলের কল এলো আমার মোবাইলে। চোখের পানি মুছে কল রিসিভ করতেই আদিল জিজ্ঞেস করলো,
-মাধুর্য, বলবে না কি হয়েছে তোমার? কান্না করছিলে কেন পাখিটা?
আদিলের এমন মিষ্টিমাখা কথা শুনে আমার কান্নার বেগ যেন বহুগুন বেড়ে গেলো। কারণ, এই মানুষটি দীর্ঘ বারো বছর অপেক্ষার পর আমাকে আপন করে পেয়েছে। আমাকে নিয়ে তার পৃথিবী। মাঝে মাঝে বিধাতার কাছে শুকরিয়া আদায় করি সেদিন আমি সেই নরক থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম বলে আদিল নামক ভালো মানুষটার কাছে আসতে পেরেছি।
-তোমার মাধুর্যের মন আজ ভীষণ খারাপ। এখন তুমি বলো কি করলে তার মন ভালো হবে?
-আমার মাধুর্যকে বলে দাও উনার দুদিন পর ওয়ালিমার অনুষ্ঠান এবং এরপরের দিন সোজা হানিমুন কক্সবাজারে।
-সত্যি!
-জি, সত্যি। এখন তুমি কান্নাকাটি বন্ধ করো খাওয়াদাওয়া করে ঘুমাও। বিকেলে শপিংয়ে যাবো তুমি,আমি,নাজ, আয়াত- কাজল এবং আরশি মা’কে নিয়ে।
-ওকে।
-রুশা?
-হুম?
-তুমি কেন কান্না করো মাধুর্য?অতীত চলে গেছে তাকে মনে করে আজ বর্তমানে এসে মন খারাপ করো না। শুধু একটা কথা মনে রাখবে তোমার অতীত যাই ছিলো কিন্তু তোমার বর্তমান-ভবিষ্যৎ আদিলকে ঘিরে।
-হুম,মনে রাখবো।
—————————-
বাসরঘরে বসে আছি একহাত ঘোমটা দিয়ে।অপেক্ষা
করছি আদিলের জন্য।আমার কোলে বসেই বারবার আমার ঘোমটা তুলে মুখ দেখছে কাজল আপুর পুচকি মেয়ে আরশি আর পাশে বসে আছে কাজল আপু।
দরজার সামনে থেকে হট্টগোল শোনা যাচ্ছে, হয়তো আদিলকে এই রুমের মধ্যে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না তাই।
হুট করে নাজ আমার সামনে এসে কোমরে হাত রেখে বললো,
-বিয়ে করেছিস,ভালো কথা কিন্তু আমাদের স্যারকে কেন বিয়ে করতে হলো তোর? এখন না উনার কাছ থেকে জোর করে টাকা চাইতে পারছি না দুষ্টমির ছলে কিছু বলতে পারছি। আমি পোড়াকপালি যেদিকে যাই সেদিকে টাকা কমে যায়।কেন, হয় এমন? দেখ রুশা আমি বলে রাখছি, তোর সদ্য বিয়ে হওয়া স্বামী যদি আমাদের আবদারকৃত টাকা না দেয়, তবে আজ যে তোদের বাসররাত এই কথা তোরা দুজনে ভুলে যাবি।
রুশা ঘোমটা তুলে নাজের মুখের দিকে তাকালো। দেখলো বেচারি টাকা না পেয়ে কেমন হাসফাস করছে? রুশা এবার কাজলের দিকে তাকালো, কাজল রুশার চাহনি দেখে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আরেকদিকে তাকিয়ে রইলো। রুশা হালকা হেসে নাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-শেষের যেই কথাগুলো আমাকে বলেছিস, সে কথাগুলো যদি তুই আদিলকে এখন বলতে পারিস, তবে আমি তোকে পাঁচহাজার টাকা দিব।
-দোস্ত, মানে আমি কিভাবে এই কথা স্যারকে বলবো?
-তোমাদের আর কিছু বলা লাগবে না, যাও গিয়ে আয়াতের কাছ থেকে টাকা ভাগ করে নাও।
আদিল রুমে প্রবেশ করতে করতে কথাগুলো বললো।
রুশা আদিলের কন্ঠ শুনতে পেয়ে ঘোমটা টেনে মুখের সামনে নামিয়ে ফেললো।নাজ এক দৌঁড়ে রুমের বাইরে চলে গেলো কাজল উঠে দাঁড়ালো চলে যাবার জন্য।
এরইমাঝে আদিল গিয়ে আরশিকে রুশার কোল থেকে নেয়ার সময় কি যেন বললো রুশার কানে?রুশা লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো।
-ভাগ্যিস, ঘোমটার আড়ালে আমাকে দেখা যাচ্ছে না নয়তো আমার লজ্জা পাওয়া সকলেই দেখে ফেলতো।মনে মনে কথাগুলো বললো রুশা।
আরশিকে কোলে নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেলো আদিল। আদিলের পিছু পিছু কাজলও বের হয়ে গেলো।
বেশ কিছুসময় অতিবাহিত হওয়ার পর আদিল ঘরে আসলো।এরপর,দরজা বন্ধ করে দিয়ে সর্বপ্রথম লাইট অফ করে দিলো।মোবাইলের ফ্ল্যাশ অন করে এগিয়ে গেলো ড্রেসিংটেবিলের দিকে। ড্রয়ার খুলে অনেকগুলো মোমবাতি বের করলো। এরপর, একে একে সব মোমবাতি জ্বালিয়ে ঘরের মাঝে সাজিয়ে রাখলো।
অতঃপর, আদিল ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো রুশার কাছে। রুশা যখন আদিলের উপস্থিতি টের পেয়েছে ঠিক তখন থেকে শক্ত হয়ে বসে রইলো। আচমকা, নিজের ওড়নায় কারো স্পর্শ পেতেই চোখ মেলে তাকালো রুশা৷
রুশা দেখলো আদিল তার খুব কাছে এসে বসেছে। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারলো না রুশা।
নিজের বন্ধ চোখের পাতায় ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই রুশা ফ্রিজড হয়ে গেলো। আদিল রুশার কানে কাছে গিয়ে বললো,
-আমার এত পুরোনো বৌ তারপরও দেখছি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।
রুশা নিশ্চুপ হয়ে আছে। আদিল রুশাকে বলছে
-বহুবছর আগে আমার মনে আকাঙ্ক্ষা জেগেছিল, আমার মাধুর্যকে যেদিন আমার করে পাবো সেদিন যেন তার পরনে সবুজ লেহেঙ্গা থাকে। আমাদের বিয়ে যে পরিস্থিতিতে হয়েছিলো তাতে সবুজ লেহেঙ্গার কথা মনে থাকার কথা নয়। কিন্তু, আজ সেই আকাঙ্ক্ষা আমার পূরণ হয়েছে। আমার মাধুর্য আমার সামনে সবুজ লেহেঙ্গা পরে বধু বেশে বসে আছে।জানো, মাধুর্য সবুজ রঙটার মাঝে চোখের আলাদা শান্তি আছে বুঝলে। আবার সেই শান্তি পাওয়া যায় তোমার আদলে একঝলক তাকালে।
-আমি বোধহয় এই পৃথিবীর একমাত্র বউ যার গায়ে সবুজ লেহেঙ্গা পরনে।আমার স্বামীর কি উদ্ভট রুচি!
-তোমার স্বামীর রুচি অত্যন্ত রুচিসম্মত।যদি বিশ্বাস না হয় তবে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে পারো।
বলেই রুশাকে কোলে তুলে নিলো আদিল এরপর,আয়নার সামনে গিয়ে রুশাকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে বললো,
-এবার দেখো তোমার স্বামীর রুচি কেমন?
রুশা হেসে ফেললো আদিলের কথা শুনে। আদিল রুশার হাসিমুখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো।
-আশা তো ছেড়ে দিয়েছিলো, ভেবেছিলো কখনো তার মাধুর্যকে নিজের করে পাবে না কিন্তু আল্লাহ ওকে দিয়েছেন।
মনে মনে কথাগুলো বলে রুশাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো আদিল। এরপর,রুশার কপালে নিজের কপাল ঠেকিয়ে বললো,
-“মাধুর্য, সমর্পণ করবে কি আজ তোমার তনু-অন্তঃকরণ আমার সনে”
#চলবে
#শেষ_বিকেলে_এলে_তুমি
#সিজন_২
#সূচনা_পর্ব
#Tahmina_Akhter
/