গল্পের নাম – #ফাল্গুনের_ঢেউ
পর্ব – ১ #ধূর্ততা
লেখিকা – Zaira Insaan
বিয়ের আসরে এসে বর হিসেবে ৬০ বছরের বয়স্ক লোক দেখে ভড়কে গেল মিহি। তব্দা মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পাশে মালিহা কে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,, “এটাই বর?”
মালিহার উত্তর শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো তার।
তার মা প্রণিমা পাশে এসে দাঁড়াতেই মিহি স্বর নামিয়ে বলল,,
“বৃদ্ধাশ্রম থেকে এটাকে নিয়ে আসছো আমাকে বিয়ে দেবার জন্য!?”
প্রণিমা চোখ রাঙালেন আর দাঁতে দাঁত চেপে বলেন,,
“চুপচাপ বস কথা না বলে।”
মিহি চরম অবাক হয়ে বলল,, আমি বিয়ে করবো না তোমরা ধোঁকা দিছো আমাকে, এখনি মানা করো এদের কে।”
বধূকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সবাই একে অপরের কানে কানে কথা বলতে লাগলো। প্রণিমা কঠিন চোখে তাকালেন তারপর তার হাত চেপে ধরে বললেন,,
“বড় বড় ব্যবসা বাণিজ্য আছে উনার কোটি টাকার মালিক তুই সুখি থাকবি এখন আর কথা বলিস না।”
মিহি যেন অবাকের সীমা পার করলো হাত ফট করে ছাড়িয়ে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে বলল,,
আমি এই বৃদ্ধ লোকটির সাথে সংসার করবো! তোমার মনে হয়? এখনি মানা করো নাহলে আমি এমন কিছু করে ফেলব যার জন্য তোমরা মোটেও প্রস্তুত থাকবা না”
চমকে উঠে ভ্রু কুঁচকালেন প্রণিমা। মিহি তাকালো রুগল সাহেবের দিকে তিনি যেন দৃষ্টি লুকাচ্ছেন মেয়ের কাছ থেকে। মিহির দিকে না তাকিয়ে অন্য কারোর সাথে কথা বলতে ব্যস্ততা ভান ধরলেন। মিহি উপস্থিত সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে প্রণিমা কে বলল,,
“এদের কিছু বলছো না কেন?”
পাশ থেকে শ্রেয়া বলেন,, কি হয়েছে কোন সমস্যা?”
প্রণিমা মেকি হেঁসে না বলে মিহির দিকে তাকিয়ে বলেন,,
“মান সম্মান দিক থেকে একটু চিন্তা কর হুটহাট কাজ করিস না, আমরা ভেবে চিন্তে তো পাত্র দেখেছি, বস এবার!”
“মান সম্মান এর জ্বালা আমি আমার জীবন তো ধ্বংস করতে পারবো না, বুঝেছি তুমি কিছুই করবা না, যা করার আমারি-ই করতে হবে, আম সরি মা!”
প্রণিমা ভ্রু কুঁচকালো কি করতে যাচ্ছে মিহি তা টের পেয়ে তার হাতের কব্জি ধরলেন।
টান মেরে হাত ছাড়িয়ে রুগল সাহেবের দিকে এক পলক তাকিয়ে মিহি শাড়ি দুহাতে চেপে ধরে সোজা দৌড় দিল গেটের দিকে। উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে যায়। সবাই তার এহেন কান্ডে বিস্মিত হয়ে যায়। রুগল সাহেব সাঁটসাঁট চোখে তাকালেন প্রণিমার দিকে যেন মেয়ে ভাগানো সব দোষ তার।
উপস্থিত সবাই যেন এক সুযোগ পেয়ে গেল গিবত করার অতঃপর একে অপরের কানাঘুষা করা শুরু হয়ে গেল….
_______________
রাস্তার মাঝখানে এসে পড়ে মিহি। হাঁপিয়ে উঠলো দরুণ। তার মা বাবা যে এতো বড় ধূর্ততা করলো তার সাথে ভেবেই গা রেগে আগুনের মত জ্বলে উঠে। ২৮/২৯ বছরের পাত্র দেখিয়ে ৬০ বছরের এক বুড়ো লোকের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ করতে চেয়েছিল তারা। মাথায় কিছু আসছে না তার। অনেক দূর জায়গায় চলে এসেছে।
যার পরিবেশ শান্ত, নিস্তব্ধ। ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। রাস্তার এক পাশে বসে পড়লো চুলে হাত ডুবিয়ে। মাথা ঝিমঝিম করছে। ভারি ভারি গহনাগুলো সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে সে। বারবার পুরোনো কথা গুলো যেন তার মাথায় কোঠর ভাবে বারি দিচ্ছে। সাঁজ বারের সময়ও মিলি তাকে কিছু বলে নি। চোখ বুজে নিল কিছুক্ষণ। চোখের কর্ণিসে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়লো গালে অজান্তে। দুই হাঁটুতে মাথা রেখে ক্রন্দন শুরু করল সে।
কিছু সময় পেরিয়ে গেল অশ্রুসিক্ত যেন থামার নাম নেই!
দূর থেকে এক বড় গাড়ি আসলো তার নিকটে থামলো সেই গাড়ি। পরিবেশ চুপচাপ হওয়ার কারণে কান্নার আওয়াজ যেন স্পষ্টশীল। গাড়ির ভেতর থেকে এক লোক লাইট ছুঁড়ে মারে তার দিকে। এক রমণী কে মাঝরাতে কাঁদতে দেখে থতমত খেয়ে গেল সেই লোক, আওয়াজ উঁচু করে বলল,,
“এই মেয়ে এখানে বসে বসে কাঁদছো কেন?”
মাথা উঠালো সে। কৃত্রিম সাঁজ লেপ্টে গেছে, চুলগুলো এলোমেলো হতেই তাকে অন্ধকারে ভয়ংকর লাগছে। যেন এখনি এসে খুন করবে! মিহি এ সময়ও বাজখায় গলায় বলল,,
“জেনে কি করে ফেলবেন? সমস্যা সমাধান করবেন?”
ভ্যাবাছেকা খেয়ে গেল সেই লোক। বলল,,
“আজকাল কার পোলা মেয়েরা ছেকা টেকা খাইয়া রাস্তার পাশে বইসা বইসা কাঁদতা থাহে!”
মাথা এমনে গরম হয়ে আছে মিহির কথাটি শুনে মাথার রগ উব্রে গেল, ঝাঁঝালো কন্ঠে ঝাড়ি মেরে বলল,,
“সমস্যা কি আপনার!? যান তো নাহয় আপনার বউ ছেকা দিয়ে বেঁকে দিব আপনারে।”
চোখ বড়বড় করলো লোকটি আসলেই তো তার বউ অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছে তার ফিরার, স্বরণ হতেই গাড়ি স্ট্রার্ট দিল। যাওয়ার আগে একটা কথা বলে গেল,,
“এই মেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি যাও, এ রাস্তা নিরাপদ নয় এখানে রাতে চোর, ডাকাত, গুন্ডা মাফিয়া’রা ঘুরাফেরা করে! যাও বাড়ি যাও।”
বলে দ্রুত চলে গেল। কথাটি শুনেই ভড়কে গেল মিহি।
_________________
হলে হট্টগোল মেচে গেল। পরিবেশ বাজেভাবে ফুটে উঠেছে। সবকিছু সামলাতে পারছেন না রুগল সাহেব। এসব চেঁচামেচি তে হাঁপিয়ে উঠছেন তিনি। ইতিমধ্যে বর সাহেব ও তার পরিবার দুনিয়ার সব তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান করে চলে গেল। যারা বর্তমানে উপস্থিত আছে তারাই যেন বাড়তি ঝামেলা করছে। রুগল সাহেব এক কোণায় বসে মাথা নিচু করে আছেন। তার এই মেয়ে যে তাকে এসবে মুখ দেখাবে তা কখনো কল্পনা করেননি তিনি। বড্ড বেশি ভুল করেছেন তিনি। মিলি প্রণিমা ও রুগল সাহেব কে মনমরা অবস্থায় দেখে সবাইকে হাত জোর করে মাথা নুয়ে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,,
“আপনারা আসতে পারেন, ঝামেলা করবেন না অহেতুক!”
আশেপাশে মহিলা গুলো ঠাট্টা করে বলল,,
“দেখো দেখো, বোন বিয়ের দিন সবার সামনের থেকে পালিয়ে গেছে আর এর কত তেজ! লজ্জাও করে না ছিঃ।”
এক দফা অপমান খেল মিলি। থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কঠিন গলায় বলল,,
“আপনার লজ্জা করছে না এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে?
যেতে যেহেতু বলছি তো যান দাঁড়িয়ে আছেন কেন!?”
হা হয়ে গেল তারা। পেছন থেকে প্রণিমা ‘মিলি’ বলে ধমক দিয়ে উঠেন। চুপ করে গেল সে। নাহলে এতক্ষণে আরো অনেক কথা শুনিয়ে দিত। মিলি রক্তুচোখে তাকালো উপস্থিত সবার দিকে। মাথা প্রচুর গরম করে দিয়েছে এরা। তার ইশারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে সবাইকে যেতে বলছে। এক এক করে সবাই চলে গেল। যেতেই মিলি প্রণিমা পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রণিমা হতাশা জোড়ানো কন্ঠে বলেন,,
“মান সম্মান সব ডুবিয়ে পালিয়েছে এই মেয়ে।”
মিলি রুঢ় হয়ে বলল,,
“নিজেদের মান সম্মান আপনারা নিজেরাই ডুবিয়েছেন।”
প্রণিমা ও রুগল সাহেব তাকালেন ওর দিকে। মিলি কিছুক্ষণ থেমে ঝাঁঝালো কন্ঠে আরো বলল,,
“কি দরকার ছিল ওকে মিথ্যা জানিয়ে বিয়ের আসরে আনার? ভালো হয়েছে যে সে এখান থেকে পালিয়েছে, ৬০ বছরের বুড়ো হাবলা লোক একটার সাথে ধরিয়ে দিচ্ছো তার উপর দুইবার ডির্বোসি সেই লোক…টাকা আয় করতে করতে বয়স তো হারাইছে সাথে বউ কেও।”
এতটুকু কথাতে রেগে ঝনঝন হয়ে উঠলেন প্রণিমা। উঠে দাঁড়িয়ে থাপ্পর মারতে যাবে এমন সময় শাম্য ও ইমন দৌঁড়ে আসলো। হাঁপিয়ে উঠে ইমন বলল,,
“মিহি কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
ভেঙে পড়লেন প্রণিমা। রুগল সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। এখন কি এসবে সে নিজের মেয়েকে হারিয়ে ফেলেছেন! মিলির মধ্যে কোন চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে না সে শান্তভাবে বলল,,
“কিছু হবে না ওর।”
অবাক হয়ে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকালো সবাই।
______________
কিছুক্ষণ সাঁটান মেরে বসে রইল মিহি। কোথায় যাবে স্কূপ পাচ্ছে না সে। আশপাশ তাকালো অন্ধকারে ডুবে আছে রাস্তা। ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়ালো। দু তিনবার শুকনো ঢোক গিললো ভয়ে। তারপর ধীরে ধীরে সামনে হাঁটা শুরু করল। নিজের কপাল নিজে ঠুকরাচ্ছে, কি থেকে কি হয়ে গেল!
কোথায় যাচ্ছে সে নিজেও জানে না!
পাগলের মত রুপ নিয়ে সোজা হেঁটে চলছে। যে কেউ দেখলে ভয়ে ইতিমধ্যে স্ট্রোক করে ফেলবে। মোবাইল ও নেয় নি যাতে বিপদের সময় কাউকে কল করে পেতে পারে। কিছু দূর যেতেই থেমে গেল সে। মেঘ জোরতোরে গর্জন করে উঠলো এতে লাফ মেরে উঠল মিহি। বৃষ্টি আসা উপক্রম। মেঘ বড়ই ভারি হয়ে এসেছে। বিরক্ত হয়ে ‘চ’ উচ্চারণ করে উঠে। এখন এসব ভারি গহনা ও শাড়ি পড়ে কোথায় যাবে? ভেবে পাচ্ছে না তাও অত চিন্তা করলো না যা হবে তা দেখা যাবে। হাঁটা ধরতেই একদল কুকুর তাকে দেখে পেছন থেকে শব্দ করে উঠলো। ভয়ংকর আওয়াজ এর কারণে পরিবেশ ও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। বুক ধ্বক করে উঠলো তার। পেছনে ফিরে দেখলো না শুধু হাত কিড়মিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।
আস্তে করে মুখ ফঁসকে ডেকে উঠলো,, “আম্মু”।
আবারো সেই শব্দ চরম করে উঠতেই মিহি জোরে চিৎকার মেরে সাহস জুগিয়ে সোজা দৌড় দিল। যত দূর যাওয়া যায় তত দূর যাচ্ছে! আশপাশ দেখছে না। সামনে বড় গাড়ির লাইট চোখে মুখে পড়তেই মুখ বাজেভাবে কুঁচকে এলো তার।
চলন্ত অবস্থায় পিটপিট করে চোখ খুলল অতঃপর লাইটের কারণে চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসাতেই সামনের মানব টাকে দেখতে পেল না।
সামনের লোকটির কাছে এসে পা ভেঙে মাথা ঘুরিয়ে তার বলিষ্ঠ দেহে ঢলে পড়লো মিহি।
(চলবে…)