#সুখের_পাখি
৭
তনু কিছুটা শান্ত হয়েছে। তবে ফোঁপাচ্ছে এখনও। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিল। নাক টেনে বাচ্চা মেয়েদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
–‘বাবা শুনলে বকবে। তুমিও তো আমাকে খারাপ মেয়ে ভাববে। আমি পড়াশোনা করি না শুধু শুধু স্কুলে যাই। এমনটা ভাববে সবাই।’
–‘কে এমনটা ভাববে? কার অত সাহস! তুই এসব কথা ভেবে মন খারাপ করিস না তো মা। কেউ তোকে খারাপ ভাববে না। অনেকদিন গ্যাপ গেছে তো। আরও নতুন স্কুল। সবকিছু বুঝেশুনে নিতে একটু সময় লাগবে এই যা। নইলে তুই যে ভালো ছাত্রী এটা আমি জানি।’
–‘তুমি ভাবছো না তো তনু পড়াশোনায় একেবারে গোল্লা?’
সাবিনা তনুর কথায় হেসে ফেলল। তনুর মাথায় আলতো করে ভালোবেসে চাপড় দিয়ে বলল,
–‘পাগলি মেয়ে। কাপড় পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়। সেই সকালে না খেয়ে বের হয়। সারা দিন কোনো খাওয়া নেই। এখনও পেটে কিছু পড়েনি। এরকম না খেয়ে থাকলে ভালো নাম্বার আসবে কীভাবে শুনি? পরীক্ষায় ভালো করতে হলে ভালো করে রাত জেগে পড়তে হবে। রাত জেগে পড়তে হলে শরীরে শক্তি লাগবে। ঠিকমতো না খেলে সেই শক্তিটা আসবে কোত্থেকে হ্যাঁ!’
–‘আমি পরীক্ষা ভালোই দিয়েছি ফুপু আম্মা। সবগুলো অংক করেছি। একটাও বাদ রেখে আসিনি। তবুও আমাকে একশো থেকে মাত্র বত্রিশ দিল! সব ওই বুইড়া টাকলার শয়তানি। ওই শয়তান ইচ্ছে করে আমাকে ফেল করিয়ে দিয়েছে। আমি জানি ও আমাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। একদিন ওর ক্লাসে মিতার সাথে কথা বলেছিলাম বলে আমাকে আর মিতাকে ওই টাকলা পুরো ক্লাস দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। ওই শয়তান ইচ্ছে করে আমার খাতায় দুই তিনটা শূন্য বেশি লাগিয়ে অংক ভুল ধরেছে।’
তনুর পাগলামি কথাবার্তা শুনে সাবিনা তরুণী মেয়েদের মতো খিলখিল করে হাসতে লাগল। তনু কপাল কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে ফুপু আম্মাকে দেখছে। এভাবে হাসার কী হলো তনু বুঝতে পারছে না। সাবিনা অনেকক্ষণ হাসল। হাসি থামাতে পারছে না সে। তনু মুখ বাঁকিয়ে বসে রইল। ফুপু আম্মার হাসি পাচ্ছে! তার তো রাগে গা জ্বলছে। ওই বুইড়া টাকলা অংক স্যারকে খুন করতে ইচ্ছে করছে। শয়তানটা জেনে-বুঝে ওকে কম নাম্বার দিয়েছে। সাবিনা অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে কোনোরকমে বলল,
–‘ওরে তনু, তুই কী দিয়ে গড়া রে! এরকম পাগল মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি। তুই এখনও বাচ্চাই রয়ে গেছিস। কবে বড় হবি রে তনু?’
–‘তুমি জানো না ফুপু আম্মা। আমি তোমাকে একদিন স্কুলে নিয়ে যাব। ওই স্যার সত্যিই একটা মিচকা শয়তান। তুমি ওর মুখ দেখেই পেটের শয়তানি ধরতে পারবে।’
সাবিনা হাসতে হাসতে বলল,
–‘আচ্ছা যাব। এখন তুই কাপড় ছেড়ে বাইরে আয়। তুই লাফালাফি ছুটাছুটি না করলে আমার বাড়ি ভূত বাড়ি মনে হয়।’
সাবিনা চলে যায়। তনুর মন হালকা হয়েছে। তবে এখনও মন খারাপ ভাব পুরোপুরি কাটেনি। সে পরীক্ষায় ফেল করেছে শুনলে ইহান ভাই তার সম্পর্কে কী ভাববে? ভাববে সে অনেক খারাপ একটা মেয়ে। যে মেয়ে পরীক্ষায় ফেল করে সে ভালো হয় নাকি? তনুর সব চিন্তা যেন ইহানকে নিয়েই। ফেল করেছে বলে তার কষ্ট হচ্ছে না। ইহান তার সম্পর্কে কী ভাববে সেটা নিয়েই যেন কষ্ট হচ্ছে।
সাবিনা বিকেলে ছাদে আসে। ইহানের সাথে তার জরুরি কিছু কথা আছে। সে অবশ্য তনুকে নিয়েই কথা বলতে এসেছে। দরজার সামনে এসেই সাবিনা বলল,
–‘তুই যে কেন বেডরুমে থাকিস না বুঝি না আমি। ছাদের এই মুরগির খোপে পড়ে আছিস। আমার বাড়িতে এতগুলো ঘর কেন দিয়েছি? থাকার মানুষ নেই যখন তখন বাড়ি বিক্রি করে দেই। পায়রার খোপের মতো ছোট ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠি।’
কয়েকটা সিঁড়ি বেয়েই সাবিনার হাঁপানি উঠে গেছে। ঘনঘন দম নিচ্ছে সে।
–‘আমার হাঁটুতে ব্যথা। সিঁড়ি ভাঙতে পারি না। এটা খুব ভালো করেই জানিস তুই। তবুও এই আস্তানা ছাড়তে রাজি না। ছেলের কথা মনে পড়লে আমি যে এসে তোকে দেখে যাব সেটাও পারি না। ঘরে থাকলে অন্তত যেতে আসতে আমাদের কয়েকবার দেখা তো হতো। এখন তো সেটাও হয় না। এখন তোদের কাছে আমার কোন দাম নেই। আমি মরে যাই তখন বুঝবি মা কী জিনিস।’
ইহান মায়ের শেষের কথায় বিরক্ত হলো। চোখে মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল,
–‘মরার কথা আসছে কেন মা!’
সাবিনার রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল,
–‘আসবে না! অবশ্যই আসবে। একশোবার আসবে। আমি মরলে তোরা শান্তি পাবি। আমার মর্মও বুঝবি। কথায় আছে না, দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝা যায় না। তেমনই মা থাকতে মায়ের মর্ম বোঝা যায় না।’
–‘বাজে বকো না তো মা। কী এজন্য এসেছ সেটা বলো।’
সাবিনা চুপ করে থেকে রাগ সামলে নিলেন। ছেলে, স্বামী কারো কাছে তার দাম নেই। স্বামী সারাবছর দেশ-বিদেশে থাকে। স্ত্রী একা বাড়িতে কীভাবে সময় কাটায় সেটা উনার ভাবার বিষয় না। আর ছেলে দুইটা। বড়টাও হয়েছে বাপের মতো হাড়বজ্জাত। বিদেশে পড়াশোনা করবে সে! কেন দেশে কি কলেজ ভার্সিটির অভাব পড়েছে? লোকে দেশে থেকে লেখাপড়া করছে না? ছোট বান্দর সারাদিন গিটার হাতে এই ছাদের ঘরে পড়ে থাকে। স্বামী সন্তান নিয়ে তার গুছিয়ে সংসার করার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। তনুরা এসেছে বলে তার দিনগুলো এখন আগের থেকে ভালো যাচ্ছে। সে এতো মানুষ ভালোবাসে অথচ তার বাড়িতেই মানুষ নেই। ছেলেদের বিয়ে করিয়ে বউ আনবে। ওদের ছেলেমেয়ে হবে। তার বাড়ি মানুষে গমগম করবে। নাতি নাতনিদের নিয়ে ছুটে খেলে তার দিন কেটে যাবে। কই কিছুই তো হলো না। হলেও কবে হবে কে জানে। সে বেঁচে থাকতে এসব স্বপ্ন সত্যি হবে? নাকি মরে গিয়ে উপরে বসে এসব দেখতে হবে!
–‘কী হলো মা? কী ভাবছ। কিছু হয়েছে? বাবা কল করেছিল। আমাকে নিয়ে তোমায় কিছু বলেছে।’
ইহানের চেহারা শক্ত হয়ে যাচ্ছে দেখে সাবিনা তাড়াতাড়ি করে বলে উঠল,
–‘না,না। তোর বাবা কিছু বলেনি। অন্য ব্যাপারে এসেছি।’
–‘হুম। ব্যাপারটা কী বলো।’
–‘তনুকে প্রাইভেট পড়া তো তুই।’
–‘কি!’
–‘চেঁচাচ্ছিস কেন?’
–‘তোমার কথা বুঝলাম না।’
–‘তনুকে প্রাইভেট না পড়ালেও কয়টা দিন এমনিতেই পড়া। ওকে একটু অংক টংক দেখিয়ে দিবি। একটু বুঝিয়ে দিবি। নতুন স্কুলে এসে মেয়েটার পড়াশোনায় বড় রকমের চাপ পড়েছে। কয়দিন আগে পরীক্ষা গেল না। আজ রেজাল্ট দিয়েছে। অংকে খারাপ হয়েছে। পাগল মেয়ে এই নিয়ে বাড়িতে এসে সে কী কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে! আমি অনেক বুঝিয়ে ওকে শান্ত করেছি। পাগল মেয়ে শেষে এটা বলছে, বুড়ো টাকলা অংক স্যার নাকি ইচ্ছে করে ওকে ফেল করিয়ে দিয়েছে। ওই শয়তান নাকি তনুকে দেখতে পারে না। ক্লাসেও দাঁড় করিয়ে রাখে। ওর সঠিক অংকে নাকি দুই তিনটা শূন্য বেশি লাগিয়ে ফেল করিয়ে দিয়েছে। শোন মেয়ের কথাবার্তা! তনুটা এখনও ভীষণ বাচ্চা রে। মা মরা মেয়ে ওকে আমি আরও আগেই কেন নিজের কাছে নিয়ে আসলাম না। বাবারা কি মায়ের মতো ভালোবাসা দিতে পারে? মেয়েটার এতদিন হয়তো অনেক কষ্ট হয়েছে। মেয়েদের কত কথা থাকে যা শুধু মায়েদের সাথে শেয়ার করা যায়। চাইলেও সব সমস্যার কথা বাবাকে জানানো যায় না। ওকে আমি আমার কাছেই রেখে দেব। এখানে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাবে।’
সাবিনা নিজের সাথেই যেন কথা বলছে। ইহান মায়ের কথাগুলো শুনল। কতক্ষণ চুপ থাকল। তারপর কী যেন ভেবে বিরক্ত গলায় বলল,
–‘আমি কাউকে পড়াতে টড়াতে পারব না মা।’
সাবিনা আশ্চর্য চোখে ছেলেকে দেখল। বিস্ময় মাখানো গলায় বলল,
–‘কেন?’
–‘আমার কাজ আছে। ভীষণ ব্যস্ত দিন কাটে আমার। হাতে একদম সময় নেই।’
সাবিনা তেত উঠে বলল,
–‘কী এত কাজ তোর শুনি! সারাদিন তো শুয়ে বসেই কাটাস। তবুও নাকি হাতে সময় নেই। তোর কোন কথা শুনতে চাই না আমি। তনুকে পড়াবি তুই। তুই বরাবরই অংকে ভালো ছিলি। নিজের জ্ঞান নিজের ভেতর রেখে না দিয়ে অন্যের মাঝেও একটু বিকশিত কর। তনুকে পড়ালে তোর জ্ঞান কমে যাবে না।’
–‘স্কুলে স্যারদের কাছেই তো পড়তে পারে।’
–‘বাড়িতে তুই থাকতে স্কুলে স্যারের কাছে পড়তে যাবে কেন? তুই সময় নিয়ে বুঝিয়ে পড়াবি। এতে তনুরই ভালো হবে। কিছু না বুঝলে যখন তখন তোর কাছ থেকে জেনে নিতে পারবে। তুই তো আর স্যারদের মতো সময় ধরে ত্রিশ মিনিট, এক ঘন্টা পড়াবি না।’
ইহান বিড়বিড় করে বলল,
–‘ওটাই তো সমস্যা মা। যখন তখন আমার ঘরে চলে আসবে। ওই মেয়ে বেশিক্ষণ আমার সামনে থাকলে…
কথা শেষ করার আগেই সাবিনা ধুম করে ইহানের পিঠে তাল ফেলল। ইহান ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে বাঁকা হয়ে গিয়ে বলল,
–‘মা!’
–‘বিড়বিড় করিস কী হ্যাঁ? মায়ের কথা শুনিস না তুই। দিনদিন আমারও অবাধ্য হচ্ছিল! মেরে পিঠের ছাল তুলে দেব তোর। বেশি বড় হয়ে গেছো এটা ভেবো না। আমি এখনও তোকে মারতে পারব। তোর বিয়ে হয়ে গেলে দুই তিন বাচ্চার বাপ হলে তখনও তুই আমার হাতে মার খাবি। ছেলেপুলে বউয়ের সামনেই খাবি।’
–‘আচ্ছা, আচ্ছা। পাঠিয়ে দিও তোমার ভাইঝিকে। কিন্তু আমার একটা শর্তে আছে। ওর কোন তেড়িং বেড়িং মানব না আমি। আমার কাছে পড়লে আমাকে স্কুলের স্যারদের মতোই মানতে হবে। দরকার পরলে মেরে মেরে পড়াব। তখন কিন্তু তুমি আমাকে কিছু বলতে পারবে না। আর তোমার আদরের ভাইঝিও তোমার কাছে বিচার দিতে পারবে না। আমার ছাত্রীকে আমি যেভাবে খুশি সেভাবে পড়াব। কারো নাক গলানো পছন্দ করব না। তোমারও না। রাজি আছো?’
সাবিনা অসহায় মুখ করে ছেলের মুখের দিকে তাকাল।
–‘তুই মারবি ওকে?’
–‘ইচ্ছে করে তো আর মারব না। তবে দরকার পড়লে মারতে হবে।’
–‘তোর যা রাগ বাবা! এখন তো আমার ভয়ই হচ্ছে। মেয়েটাকে বেশি বকাঝকা করিস না। মারিসও না। একটু মানিয়ে নিস তুই। ও তো এখনও অনেক ছোট। তুই বড় না। বড় ভাইয়ের দায়িত্ব পালন করিস।’
–‘ভাই!’
ভ্রু কুঁচকে ইহান মা’র দিকে দেখল। সাবিনা নির্বিকার।
–‘হ্যাঁ ভাই। তনু আমার ভাইয়ের মেয়ে হলে ও তোর মামাতো বোন না! তুই ওর ভাই হোস না।’
–‘তোমার নিজের তো কোনো ভাইবোন নেই মা। সব তো পাতানো ভাই। মুখে বলা ভাই। লতাপাতার ভাই। ওই মেয়ে আমার বোন হয় কীভাবে? আমার কোন বোন টোন লাগবে না। আমি কারো ভাইও হতে পারব না। অত দায়িত্ব আমাকে দিয়ে পালন হবে না।’
–‘আচ্ছা, আচ্ছা। অত রেগে যাচ্ছিস কেন তুই? ভাই হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে না। তুই শুধু মেয়েটাকে মারধর করিস না। যা অভিমানী মেয়ে! অল্প বয়স। ওর ভালোর জন্য কিছু করলেও সেটা এখন ও বুঝবে না। সেই বয়স ওর হয়নি।’
–‘হুম
#সুখের_পাখি
৮
সাবিনা যখন তনুকে কাল থেকে ইহানের কাছে পড়তে যেতে বলল। কথাটা শুনে তনুর মাথায় আস্ত আকাশটাই যেন ভেঙে পড়ল। এর থেকে ভালো ফুপু আম্মা তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতো। সেটা হাসি মুখে মেনে নিতে পারত তনু। কিন্তু ইহানের কাছে পড়তে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। ইজ্জতের ফালুদা করতে চায় না তনু। ইহান জেনে যাবে সে অংকে বত্রিশ পায়। ফেল করা ছাত্রী ও। সাবিনা বলতে থাকে তনু শুনে যায়। মাথা দোলায়। হু হা করে।
–‘শুনছিস না নাকি তনু? ইহানের কাছে কাল থেকে পড়তে যাবি।’
তনু এতক্ষণ ভেবে একটা উপায় পেয়েছে। সে তাৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
–‘আমি তো স্কুলে প্রাইভেট পড়ি ফুপু আম্মা।’
–‘পড়লেও ওইটা ছেড়ে দিবি। ইহান অনেক ভালো অংক পারে। সাইন্স নিয়ে পড়েছে ও। তোকে সুন্দর করে বোঝাবে। তখন দেখবি অংকে তোর নাম্বার সত্তর আশির উপরে আসবে।’
তনু বুদ্ধির ঘোড়া ছুটিয়েও আর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। ফুপু আম্মা যেভাবে চেপে ধরেছে। তাতে ওর ছোটা মুশকিল হয়ে যাবে।
তনু ইহানের কাছে পড়তে যাবার ভয়ে রাতে বাবার সাথে কথা বলল। সরাসরি বলতে পারল না। অন্য ভাবে বলল,
–‘বাবা আমরা কবে এই বাড়ি থেকে চলে যাব?’
–‘আমি তো যেতেই চাইছিলাম। গত মাসেই ভাড়া বাড়ির ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম। সাবিনা শুনে অনেক রেগে গেল। ওর কসম দিল। বলেছে আর কোনোদিন এই বাড়ি ছেড়ে যাবার নাম নিলে ওর মরা মুখ দেখব।’
তনু বিড়বিড় করল।
–‘এবার হয়েছে কাজ।’
–‘কিছু বললি?’
–‘না।’
তনু কতক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবল। তারপর বলল,
–‘ফুপু আম্মা আমাকে ইহান ভাইয়ের কাছে প্রাইভেট পড়তে বলছে।’
–‘ভালোই তো। এতে তোরই সুবিধা হবে।’
–‘কচু হবে।’
–‘এমন বলছিস কেন? ইহান পড়াশোনায় অনেক ভালো।’
–‘তাই তো অর্ধেক ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ঝুলে আছে। পুরোটা হতে পারল না। হওয়ার আগেই পড়াশোনাই ছেড়ে দিল। অত ভালো ছাত্র তাহলে মাঝপথে এসে ব্রেক কষলো কেন?’
তনুর এলোমেলো কথা আজ বাবা বুঝতে পারেন না। মেয়ের মাথায় হঠাৎ হঠাৎ পাগলামির ছিট উঠে। তখন যা মুখে আসে তা বলে।
–‘ফুলি আপা, ইহান ভাই কেমন রাগী গো? মানে ওর রাগের ধরনটা কেমন? বকাবকি করে? নাকি মারেও।’
–‘ভাইজানের তো রাগ নাই। আমি তো দেখি নাই। আমি অন্যায় করলে ভাইজান পুরষ্কার দেয়। মাথা খারাপ মানুষ বুঝছো তনু। পাগলাটে। মাথায় পাগলামির ছিট আছে। ওইদিন মাছের পুসকুনি ভাইঙা ফেললাম। আমারে গালি দিল না। চাকরি নট করল না। উল্টা পাঁচশো টেকার কচকচা নোট হাতে দিল। তবে আম্মাজান কয় ভাইজানের নাকি অনেক রাগ। রাগ উঠলে মাথা ঠিক থাকে না।’
ফুলি গলা খাদে নামাল। তনুর দিকে ঝুঁকে এসে এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
–‘এই বাড়ির বড় সাহেব আছে না। ভাইজানের আব্বা। উনার সাথে ভাইজানের বনিবনা হয় না। আমি কয়েকদিন বাপ বেটার চিল্লাচিল্লি শুনছি। কেউ থেকে কারো গলা কম না। বাপ এক চিক্কার দেয়। পোলা আরও জোরে দুইটা দেয়। বাপের লগে রাগ করেই তো পড়াশোনা ছাড়ছে। গানবাজনা সাহেবের শত্রুর সমান। ভাইজান বাপেরে শিক্ষা দিতে ওইসব জিনিসই ধরছে।’
তনু আজ ফুলি আপার কাছে নতুন খবর পেল। এই কথাগুলো আগে জানত না সে। এই বাড়িতে আসার পর ইহানের বাবার সাথে ওর সম্পর্কের কথা কেউ তনুকে জানায়নি। তনু জানতোই না বাবা ছেলেতে এতো রেষারেষি। তাহলে বাবাকে জ্বালাতে ইহান ভাই পড়াশোনা ছেড়েছে। আর সেদিন তনু বোকার মতো কতগুলো কথা বলল ইহান ভাইকে। উনি পড়াশোনার গুরুত্ব ঠিকই বুঝেন। শুধু রাগে আর জেদের বশে নিজের ফিউচার নষ্ট করছেন। অবশ্য ওর গানের গলাও মাশা-আল্লাহ। নাম করতে পারবে একসময়।
–‘ইহান ভাইয়ের বাবার অনেক রাগ?’
–‘আরে দূর রাগ। ওই বেডা ভাইজানরে দুই চোখে দেখতে পারে না।’
–‘কেন দেখতে পারে না?’
তনুর অবাক লাগল। কোন বাবা আবার ছেলেকে দেখতে পারে না কীভাবে? ইহান ভাই কি ওর নিজের ছেলে না?
ফুলি বলতেই যাচ্ছিল। তখনই তার ডাক পড়ল। ইহান ডাকছে।
–‘ফুলি। এই ফুলি, চা কোথায়? এখনো চা দিলি না। চাকরির মায়া কেটে গেছে নাকি তোর?’
ফুলি তাড়াহুড়ো করে উঠে। ফিসফিস করে বলে,
–‘পরে কমুনে। এহন যাই বুঝছো। নইলে ভাইজান আমার চাকরি নট করে দিবে।’
তনু ভাবনায় পড়ে যায়। এই বাড়ির অনেক কথাই সে এখনও জানে না। ইহান ভাই সম্পর্কে তার এখনও অনেক কিছুই অজানা। ফুলি আপার কাছে ইহান ভাই ফেরেশতার মতো মানুষ। আবার ফুপু আম্মা ওকে রাগী বলে। তনু নিজেও সেটাই ভাবে। তার সাথেও তো একদিন রাগ দেখিয়েছে। তবে সেটাকে রাগ না বলে খারাপ ব্যবহার বললেই ঠিক হবে। পরে অবশ্য সরিও বলেছিল। নিজে থেকে গানও শুনিয়েছে। তনুর ছোট মাথা এতো চাপ নিতে পারে না।
–‘দূর! ইহান ভাই অর্ধেক ভালো। অর্ধেক খারাপ। ৫০% রাগী, বদমেজাজি। ৫০% মিষ্টি স্বভাবের ভদ্র ছেলে।
পরের দিন তনুকে ইহানের কাছে পড়তে যেতে হলো। তনু স্কুল থেকে আসার পর সাবিনা কম করে হলেও একশো বার ইহানের কাছে পড়তে যাওয়ার কথা তনুকে মনে করিয়ে দিয়ে গেছে। তনু না করার কোন কারণই খুঁজে পাচ্ছে না। আর সে না করলেও ফুপু আম্মা তার কথা শুনবে নাকি?
রাজ্যের দ্বিধা, সংশয়, জড়তা নিয়ে তনু বইখাতা হাতে নিয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। ইহানের ঘরের সামনে এসে যেন পা পাথর হয়ে যায়। আর এক পা-ও আগাতে পারে না। দরজার সামনেই জমে দাঁড়িয়ে থাকে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম হচ্ছে তনুর। তনু বেশ বুঝতে পারছে আজ সে কিছু একটা উল্টাপাল্টা করে বসবে। ইহান ভাইয়ের সামনে ভয়ে জ্ঞান হারালে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হয়ে যাবে। সে যে ইহানকে মনে মনে কত ভয় পায় তা শুধু তনুই জানে। কাঁপা হাতে দরজায় টুকা দিয়ে মৃদু গলায় তনু ডাকল।
–‘ইহান ভাই!’
সাথে সাথে ভেতর থেকে ইহানের গলা ভেসে এলো।
–‘কে তনু? এসো।’
তনু তবুও সাথে সাথে ভেতরে ঢুকে না। একটু সময় এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। থ্রী কোয়ার্টার তো সারাক্ষণ খালি গায়ে থাকে। ঘরে সে জামা গায়ে দিয়ে বসে থাকবে এমনটা ভাবাই যায় না। তনু ইহনাকে একটু দিল। জামাকাপড় পরে নিক।
–‘কী হলো? চলে গেলে নাকি?’
–‘না,না। যাই নি।’
বলতে বলতে তনু ভেতরে এলো। যাক বাবা, ইহান আজ অন্তত খালি গায়ে নেই। কালো একটা টিশার্ট পরে আছে। ফর্সা গায়ে এতো মানিয়েছে! তনু হাঁ করে চেয়ে থাকল। ইহান বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে থাকল। বলল,
–‘বসো। মা বলছিল তুমি নাকি পড়তে আসবে। তা কী নিয়ে পড়ছো?’
তনু ইহানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তার হয়েছেটা কী হ্যাঁ? এরকম পাগল পাগল লাগছে কেন? ইহান উত্তরের অপেক্ষায় আছে। এই মেয়েকে পড়ানো তার জন্য রিস্কের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। অল্পবয়সী মেয়েগুলোর মন কখন কী চায় আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। ইহান এবার কঠিন গলায় ধমকের সুরে বলল,
–‘কথা বলছো না কেন? এরকম বোবা লেগে থাকলে তো তোমাকে পড়ানো মুশকিল হয়ে যাবে।’
চিউচিউ করে তনু বলল,
–‘সাইন্স। সাইন্স নিয়ে পড়ছি।’
ইহান বিরক্ত হলো। মনে মনে বলল,
–‘অংকে বত্রিশ পায় ওই মেয়ে নাকি আবার সাইন্স নিয়ে পড়ছে! ফেল করে আবার কান্নাকাটি করে স্যারের বদনাম করে। স্যার ইচ্ছে করে ফেল করিয়ে দিয়েছে। এই মেয়ে তো সাঙ্ঘাতিক চিজ। দেখা যাবে আমার কাছে পড়ে আমার নামেও বদনাম করে বেড়াচ্ছে।’
–‘বিছানায় বসো। আজ প্রথম দিন। পড়াব না আজ। পড়াশোনা কাল থেকে শুরু হবে। শোনো, আমার কাছে পড়ার সময় কোন তিড়িংবিড়িং চলবে না। যেটুকু সময় পড়তে আমার কথা শুনতে হবে। পড়ার সময় আমি তোমার স্যার বুঝলে। চেনা মানুষ তাই এটা ভেবো না যে পড়া না পারলে ছাড় দেব তোমাকে। আমার অনেক রাগ জানো তো? রেগে গেলে তোমার পিঠে বেতও ভাঙতে পারি। ধমকের আগেই যে কান্নাকাটি করে ভাসিয়ে ফেলতে তেমনটা মোটেও চলবে না।’
তনু ঢোঁক গিলল। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে তার। ওই বুইড়া শয়তানই তো ভালো ছিল। নতুন করে এই আজরাইলের হাতে পড়ল। তনুর কপাল এতো খারাপ কেন? শিক্ষক ছাত্রীর ভালোবাসা নিয়ে কতো গল্প উপন্যাসই তো পড়েছে সে। তনু মনে মনে বলল,
–‘আমার কপালে হয় বুইড়া টাকলা স্যার জুটবে। যে আমাকে ফেল করিয়ে দিবে। নয় ফুপু আম্মার থ্রী কোয়ার্টার ছেলে জুটবে। একটা সুন্দর ভালো মানুষ কেন আমার স্যার হতে পারে না?’
–‘পানি খাবে তনু?’
–‘হ্যাঁ! না, না। পানি খাব না।’
–‘আচ্ছা। বই বের করো তো দেখি তুমি কতটুকু পারো। আর কেমন পারো।’
তনুর এই মুহূর্তে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু উপায় নেই। পালাতে সে পারবে না। আর পালালেও কাল তো আবার আসতেই হবে।
ইহান বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে এমন একটা ভাব করল যেন সে আগে থেকে তনুর ফেল করার কথাটা জানে না।
–‘পরীক্ষা না দিয়েছিলে। রেজাল্ট দিয়েছে?’
হায়, হায়! রেজাল্টের কথা শুনে লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে তনুর। এখন কী বলবে? কীভাবে বলবে, ইহান ভাই আমি ফেল করেছি। ফেল্টুস ছাত্রী আমি। আপনার ছাত্রী একটা ফেলুরি স্টুডেন্ট। যে অংকে একশো থেকে মাত্র বত্রিশ পায়। এক নাম্বারের জন্য ইজ্জত হারায়।’
তনুর মুখের অবস্থা দেখে ইহানের মজাই লাগছে। ভেতরে ভেতরে হাসছে সে। মেয়েটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ইহান সরাসরি তনুকে দেখছে না। আড়চোখে দেখছে। তনু তো তার দিকে তাকাচ্ছেই না। ভুলেও তাকালে ইহান চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।
–‘কী হলো? রেজাল্ট দেয়নি!’
–‘দিয়েছে।’
–‘অহ। কোন সাবজেক্টে কত পেয়েছ?’
তনুর এখন কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করছে। জীবনে কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে সে! লজ্জা পেতে পেতে মরে গেলে এই দায় কে নিবে?
কাঁদো কাঁদো মুখ করে তনু মাথা নুইয়ে বসে আছে।
ইহান অনেক কষ্টে হাসি চেপে বলল,
–‘ইংরেজিতে কত পেয়েছ?’
–‘ঊনআশি।’
–‘বাহ! এক নম্বরের জন্য এ’প্লাস মিস। আরেকটু ভালো করে পড়লে এ’প্লাস পেয়ে যাবে। আর অংকে?’
তনু যদি ম্যাজিক জানতো তাহলে এক্ষুনি অদৃশ্য হয়ে যেত। আর কখনও ইহানের সামনে পড়ত না। কক্ষনো না।
–‘অংকে কত পেয়েছ তনু?’
ইহান নাছোড়বান্দা। আগে থেকে জেনেও মেয়েটাকে লজ্জা দিচ্ছে। এমনটা করতে ভালো লাগছে তার। তনুর লজ্জা রাঙা মুখ, অপমানে নুইয়ে ফেলা মাথা, দুঃখে কষ্ট ছলছল করা চোখ। সব মিলিয়ে এইভাবে তনুকে দেখতে ইহানের ভালো লাগছে। মায়া লাগছে মেয়েটার উপর। আবার ওকে জ্বালানোর লোভও সামলাতে পারছে না।
–‘বত্রিশ।’
ইহান আর কথা বাড়াল না। সে বুঝতে পারছে আরও কথা বাড়ালে তনু এখন কেঁদে ফেলবে। মা যদি জানতে পারে প্রথম দিনই ইহান তার আদরের ভাইঝিকে কাঁদিয়েছে তাহলে তার নিজের কপালেও খারাবি আছে। তাই তনুকে আর না ঘাঁটিয়ে ইহান ছোট্ট করে বলল,
–‘অহ।’
চলবে🌼
Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা
চলবে🍁