সুখের পাখি পর্ব -০৯+১০

#সুখের_পাখি


তনুর পড়াশোনা গোল্লায় গেছে। বইখাতা টেবিলে ছড়িয়ে রেখে তনু সন্ধ্যা থেকে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বালিশে মুখ গুঁজে কতক্ষণ কাঁদল। এ কান্না কারণ ছাড়াই। তার মন খারাপের নির্দিষ্ট কোন কারণ নেই আজ। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ফুলির ডাকে ঘুম ভাঙল। ফুলি তনুর গা ধাক্কা দিয়ে ডাকছে।

–‘তনু! ও তনু। এই সন্ধ্যা রাইতে কেউ ঘুমায়! মাইয়ার কাণ্ড দেখো। টেবিলে বই খুলে রেখে সে পড়ে পড়ে ঘুমাইতেছে।’

ফুলির গলা শুনে মনে হলো সে মহা বিরক্ত। তনু কাঁচা ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

–‘কী হয়েছে ফুপি আপা!’

–‘কী হইব? কিছু না। বই খুইলা রাইখা ঘুমাইতাছো তুমি।’

তনু ভেবেছিল বাড়িতে কী না কী ঘটে গেছে। অথচ ঘটেনি কচুও। ফুলি আপা এমনি এমনি তার ঘুম ভাঙালো।
রাতে তনু খাবার টেবিলে গিয়ে বড়সড় একটা ধাক্কা খেল। আজ ইহান খাবার টেবিলে খেতে এসেছে! তনুর আগেই সে টেবিলে বসে আছে। ইহান রাতে বেশিরভাগ সময়ই না খেয়ে থাকে। দিনে তনু স্কুলে থাকে, ফলে ইহানের সাথে বসে খেতে হয় না তাকে। হলেও খুব কম সময়। শুধু ছুটির দিনগুলো। তনুর আজ ইহানের সামনে যেতে এতো লজ্জা করছে কেন? হয়েছে কী তার? মনে মনে তনু নিজেকে ধমকালো। সাবিনা ওকে দেখে বলল,

–‘দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আয় বোস। আজ তোর পছন্দের চিংড়ির চচ্চড়ি আর বেগুন ভর্তা করেছি।’

তনু ইহানের দিকে না তাকিয়ে চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসলো। তনুর উপস্থিতিতে ইহানের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সে নিজের মতো খেয়ে যাচ্ছে। মা, ফুলির সাথে গল্প করছে। ভুলেও তনুর দিকে তাকাচ্ছে না। সাবিনা সবাইকে একটা খুশির খবর জানালো। ইহানের বাবা বাড়ি ফিরছেন। আজ সন্ধ্যায় কথা হয়েছে। বলেছে দু’তিন দিনের মধ্যেই চলে আসবে। খবরটা সবার জন্য খুশির হলেও ইহানের জন্য না। বাবা বাড়িতে থাকলে তার সাথে কোনো না কোন বিষয় নিয়ে বাবার লাগবেই। ঝগড়া করতে ভালো লাগে না তার।
ফুপু আম্মার মুখে কথাটা শুনে তনু চট করে একবার ইহানকে দেখল। আর তখনই চোখাচোখি হয়ে গেল। তনু তাড়াতাড়ি করে চোখ নামিয়ে নিল। স্বামী ফিরে আসবে ফুপু আম্মা কত খুশি। অথচ বাবার আসার খবর শুনে ইহান ভাই খুশি না। বাকি সময়টা ইহান চুপচাপ খেলো। তনু চোরা চোখে ভাতের সাথে ইহানকেও গিলে খেলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনু মনে মনে বলল,

–‘ইহান ভাই গো! কী জাদু করলেন আপনি আমাকে! আপনার সবকিছুই আমার কাছে এতো ভালো লাগে কেন? আপনার হাঁটাচলা। আপনার কথা বলা। আপনার খাওয়া। এইযে আপনি এখন মুরগির ঠ্যাংটা খাচ্ছেন, আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? মনে হচ্ছে আপনার হাত থেকে ঠ্যাংটা কেড়ে নিয়ে ওটা আমি খেয়ে ফেলি। কিন্তু দুঃখের কথা দেখুন। আমি মুরগী একদম খেতে পারি না। গন্ধ শুনলেই বমি আসে। কিন্তু আপনি কত তৃপ্তি করে খাচ্ছেন। আমাদের কোনো কিছুতেই মিল নেই কেন ইহান ভাই? আপনার বাবার সাথে আপনার রাগারাগি। আমার বাবাই আমার দুনিয়া। আপনি কতো মমতাময়ী একজন মা পেয়েছেন। আমি অভাগী মায়ের মুখটাও মনে নেই। আপনি কতো বড়লোক। আর আমি আপনাদের দয়ায় আছি। আপনি ভালো গান করেন। আমার গলা শুনলে মানুষ দৌড়ে পালাবে। আপনি পড়াশোনায়ও কত ভালো। আমি ফেল্টুস ছাত্রী। অংকে বত্রিশ পাই। আপনার সাথে আমার কিছুরই মিল নেই। না একটা দিকে অবশ্য মিল আছে। আপনিও আমার মতো ফর্সা সুন্দরী। ছেলেরা এতো ফর্সা কেন হয় ইহান ভাই? আপনি এতো সুন্দর কেন? আপনি কালো হলে কি আপনাকে নিয়ে আমার এতো ভয় থাকতো? থাকতো না। তখন কোন মেয়ে আপনাকে পাত্তা দিত না। কিন্তু এখন, এখন তো মেয়েরা প্রথম দেখাতেই আপনার জন্য পাগল হয়ে যাবে। যেমন আমি হয়েছি। আপনাদের বাড়িতে এসে প্রথম দিনই ওই খালি গায়ের ছেলেটাকে দেখে আমি মরেছি।’

তনুর কান্না পাচ্ছে। গলার কাছে ভাত দলা পাকিয়ে উঠছে। বিষম খেল তনু। কাশতে কাশতে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। সাবিনা ব্যস্ত হয়ে উঠে এসে তনুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ফুলি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।

–‘ও তনু কী হইলো তোমার? ও তনু…

তনুর বাবা কী করবেন ভেবে পাচ্ছে না। একটা মানুষও কাজের না৷ কেউ যে তনুকে পানি খাওয়াবে সেটা করছে না। বরং অকাজ করে যাচ্ছে। ইহানের রাগ হলো। সে পানির গ্লাস নিয়ে নিজে তনুকে পানি খাইয়ে দিল। ফুলিকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।

–‘আহ ফুলি! চুপ না করলে তোর চাকরি নট। একটা কথা যেন না শুনি।’

চাকরি যাওয়ার ভয়ে ফুলি চুপ করে গেল। ইহান তার মা’কে রাগ দেখিয়ে বলল,

–‘ওকে পানি না খাইয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে গলার খাবার ছুটে যাবে? অত অস্থির কেন তুমি মা?’

মা’কে বকাবকি শেষ করে সে তনুকেও কড়া করে ধমক দিল।

–‘আর তুমি কি ছোট বাচ্চা? ভাত গলায় বাজে কীভাবে? আস্তে আস্তে খেতে পারো না। লাঠি নিয়ে কেউ তোমাকে তাড়া করছে? তাহলে অত তাড়াহুড়ো কিসের? ‘

সাবিনা করুণ মুখ করে বলল,

–‘মেয়েটাকে আবার বকছিস কেন?’

–‘বকা খাওয়ার কাজ করলে বকবো না! ও কি দুই তিন বছরের বাচ্চা মেয়ে?’

–‘বুঝতে পারেনি। থাক আর বকাবকি করিস না।’

ইহান কাউকে বুঝাতে পারছে না কেন রেগে যাচ্ছে সে। এই মেয়ে এতটা বেখেয়ালি কেন? তাকে দেখতে দেখতে গলায় খাবার আটকে মরে গেলে হবে?
এখন যদি সিরিয়াস কিছু হয়ে যেত। ইহান শুধু রাগটাই দেখাতে পারছে। তনুকে নিয়ে তার টেনশন কেউ দেখছে না।
তনু ঘরে এসে আরেক দফা কেঁদে নিল।

–‘আপনি এত ভালো কেন ইহান ভাই? আমার জন্য অত ভাবেন আপনি! নিজের হাতে আমাকে পানি খাইয়ে দিলেন। কিন্তু অমন করে বকলেন কেন? আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছে। আপনার উপর মাঝে মাঝে আমার এত রাগ হয়! আবার মন খারাপও হয়। যেমন এখন হচ্ছে। আমি তো জানি আমি যা চাইছি তা কখনও সম্ভব না। কোথায় আপনি! আর কোথায় আমি! আমাদের কোন মিল নেই। কখনও আমাদের মিল হবে এমনটাও আশা করি না। সাধ্যের বেশি চাইতে নেই। এতে শুধু দুঃখই মিলবে। আমি অনেক কিছুই বুঝি। যেমন এটাও বুঝতে পারছি, আপনাকে ভালোবেসে আমি শুধু কষ্টই পাব।’

তনুর দিন গুলো এভাবেই কাটতে থাকে। স্কুলে যায়। বাড়ি ফিরে ইহানের কাছে পড়তে যায়। রাতে ঘরে বসে মন চাইলে পড়ে নয়তো শুয়ে শুয়ে ইহানকে নিয়ে ভাবনার সাগরে ডুব দেয়। পড়ানোর সময় একদিন ইহান তাকে বকে। একদিন ভালো করে বুঝায়। একদিন পড়া বাদ দিয়ে গান শোনায়। ইহানের কাছে পড়ার আগে অংক তনুর জানের দুশমন ছিল। এখন তার কাছে অংক ততটাও কঠিন মনে হয় না। ইহান বুঝালে সহজই মনে হয়। আবার বুইড়া টাকলা ক্লাসে বুঝালে কিচ্ছু বুঝতে পারে না। সব মাথার উপর দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। ইহানের সাথে তার কথাবার্তার সম্পর্ক আগের থেকে অনেকটা উন্নতি হয়েছে। তনু যে তোতা পাখির মতো চটরপটর কথা বলতে পারে তা দেখে ইহান অবাক।
এই মেয়েকে পড়ানোর সময়টুকু তার কাছে জীবনের ভালো সময় গুলোর মধ্যে জুড়ে যায়। কখন সময় কেটে যায় বলতেই পারে না। ইহান অপেক্ষায় থাকে কখন তনু বাড়ি ফিরবে। কখন ছুটে সিঁড়ি দিয়ে উঠবে। তনুর পায়ের শব্দ পেলেই ইহানের বুক ধুকপুক করতে শুরু করে। ইহান বুঝতে পারছে তনুর মায়ায় পড়ে যাচ্ছে সে। এটা ঠিক না জেনেও নিজেকে আটকাতে পারে না। তনু বাচ্চা মেয়ে। এখনও অবুঝ। জীবন সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তার। তনু ভুল করতেই পারে। তনুর ভুলকে প্রশ্রয় দিয়ে সে নিজে আরও বড় ভুল করছে। না, এখন থেকে তনুর সাথে কঠিন হতে হবে। এখনই জীবনের সবথেকে বড় সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে তনু হয়তো ভবিষ্যতে পস্তাতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো সঠিক সময় নেওয়া উচিত। আবেগের বশে কোন ভুল করে ফেলুক তনু তা ইহান চায় না। মেয়েটা বড্ড অবুঝ।

নিজের ভাবনায় ডুবে ছিল ইহান। তাই আজ সিঁড়িতে তনুর আসার শব্দ পায়নি। চিত হয়ে শুয়ে দুই পা দেয়ালে ঠেস দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে তনুকে নিয়েই ভাবছিল সে। হঠাৎ তনু এসে তার সামনে দাঁড়াল। বিস্মিত চোখে ওকে দেখে বলল,

–‘ইহান ভাই আপনি সিগারেট খান!’

ইহান চমকালো। কিন্তু চেহারায় প্রকাশ করল না। তনু আজকাল না বলেই হুটহাট ঘরে চলে আসে। এটা যেন তার নিজেরই ঘর। যেকোনো সময় আসতে পারবে সে। এই অধিকার অবশ্য একটু একটু করে তনুকে সে-ই দিয়েছে। তাইতো আসার আগে নক করে না তনু। পড়া বাদেও কারণে অকারণে চলে আসে। এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা এমনি বসে থাকে। তার ঘরের জিনিসপত্র ঘাঁটে। গান শোনার জন্য ইহানের কাছে বায়না ধরে। ইহান শান্ত মুখে উঠে বসল। এখনও তার হাতে জলন্ত সিগারেট। নাক দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে।

–‘আপনিও সব ছেলেদের মতো সিগারেট খান!’

–‘কেন? সব ছেলেদের থেকে আলাদা হওয়ার আমার কি বিশেষ কোন কারণ আছে?’

–‘এসব খাওয়া ভালো না ইহান ভাই।’

–‘আমি জানি। তোমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। আমি তোমার শিক্ষক? নাকি তুমি আমার শিক্ষক?’

–‘আমারও ইচ্ছে ছিল জীবনে একদিন হলেও সিগারেট খাব। আপনার থেকে একটা খাই ইহান ভাই?’

ইহান হতভম্ব। রাগা উচিত এখন তার। তবুও রাগতে পারল না। অবাকই বেশি হলো।

–‘তুমি সিগারেট খাবে?’

–‘হ্যাঁ। ছেলেরা খেতে পারলে মেয়েরা কেন পারবে না? এখন তো ছেলেমেয়ে সমান অধিকার।’

–‘ছেলেরা খালি গায়ে বাইরে যেতে পারে। তুমিও কি ওড়না ছাড়া বাইরে যেতে পারবে? না পারলে ছেলেমেয়ে সমান অধিকার বলতে এসো না আমার সামনে।’

ইহান রেগেই বলল। কিন্তু তনু লজ্জায় মরে গেল। ইহান ভাইটা এতো ঠোঁটকাটা কেন? মুখে যা আসে তা-ই বলে যায়। সামনের মানুষটা যে লজ্জা পাবে তা ভাবে না। ইহান ছোট্ট ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট ফেলে আসে। ঘরে এসেই তনুকে বই বের করতে তাড়া দেয়। তনুর আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না। সে বায়না ধরা গলায় বলল,

–‘আজ পড়ব না ইহান ভাই। আজ গান শুনতে ইচ্ছে করছে। একটা গান শোনান না প্লিজ। সুন্দর একটা গান। যেটা শুনে মন ভালো হয়ে যাবে। আমার না আজকাল মনটা ভীষণ খারাপ থাকে। কারণ ছাড়াই কান্না পায়। কাঁদিও খুব। তবুও কষ্ট কম হয় না। কষ্ট কমানোর একটা গান শুনান না। আপনার গান শুনে আমার কষ্ট কমুক।’

তনুর আবদার রাখতে ইচ্ছে করছিল ইহানের। কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। তনুকে থামাতে হবে। ওর আর তনুর মাঝে একটা রেখা টানতে হবে। এই রেখার বাইরে কেউ যেতে পারবে না। না তনু এই রেখা পার করে তার দিকে আসবে। না ইহান যাবে। কঠিন গলায় ধমক দিল সে।

–‘আমার কাছে পড়তে আসো না গান শুনতে আসো? পড়ার সময় অন্য কোনো কথা না। আর কোনদিন আমার সামনে এসব কথা বলবে না। আমি তোমার স্যার। তোমার বন্ধু না। ভালো করে পড়তে পারলে আসবে নইলে এসো না। আমার অত শখ লাগেনি তোমাকে পড়ানোর। মাথায় গোবর। আবার পড়া রেখে কত আবদার।’

অপমানে তনুর চোখে পানি চলে এলো। ইহানের সামনেই কেঁদে ফেলল সে। ইহান তনুর চোখে পানি দেখেও গললো না। আরও কঠিন স্বরে বলল,

–‘কান্না বন্ধ। ন্যাকামি পছন্দ করি না আমি। কথার আগে চোখে পানি চলে আসে। চোখে কি নদী ফিট করে রেখেছ! এতো পানি আসে কোত্থেকে?’

তনু ইহানের সামনে আর দাঁড়াল না। ছুটে চলে এলো। ইহান অসহায় মুখে ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে রইল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–‘তুমি কেন এই ভুল করতে গেলে তনু? কেন এমন ভুল করলে! ভুল মানুষকে ভালোবাসা অনেক কষ্টের তনু। এই কষ্ট আমি তোমাকে দিতে চাই না। তুমি সহ্য করতে পারবে না। এখনও তুমি অনেক ছোট। মাত্র টেন-এ পড়ো। আরও কত জীবন পড়ে আছে তোমার। তুমি একদিন বড় হবে। তখন বুঝতে পারবে আমি তোমার ভালোর জন্যই আজকের এই ব্যবহার করেছি।
#সুখের_পাখি

১০
ঘরে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তনু হেঁচকি তুলে ফেলল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে মুখে ওড়না চেপে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ কারো কানে যাওয়া যাবে না। ইহান ভাইয়ের মাঝে মাঝে কী হয়? এই কয়দিন তো ভালোই ছিল। কত ভালো করে তার সাথে কথা বলতো। হাসতো, গান শুনাতো। আজ কেন এরকম খারাপ ব্যবহার করলো? উনি এমন করলে তনুর কষ্ট হয়৷ তা কি ইহান ভাই বুঝে না! নাকি বুঝেও আরও বেশি কষ্ট দেয় তাকে?
তনু দরজা লাগিয়ে সেই যে শুলো আর উঠল না। গভীর রাত পর্যন্ত কেঁদেই গেল সে। এতো কষ্ট কেন তার? এই বাড়িতে আসার পরই তার এত কষ্ট। গ্রামে থাকতে মাতব্বরের ছেলে তাকে বিরক্ত করার সময়ও তার এত কষ্ট হয়নি। ইহান ভাই ওই ছেলের মতো তাকে বিরক্ত করে না। বরং তাকে দেখতেই পারে না। তবুও তনুর ইহান ভাইয়ের জন্যই কেন এত মন কাঁদে?
কেঁদে কেঁদে তনুর মাথা ব্যথা করছে। মাথাটা ছিড়ে যাচ্ছে যেন। ঘুমও আসছে না। তনু ভাবল ফুপু আম্মার কাছে ঘুমের ঔষধ আছে। কয়েকটা এনে খেয়ে ফেললেই তার কষ্ট কমতো।

–‘আমি আর কখনও আপনার কাছে যাব না ইহান ভাই। কখনও না। আপনি অনেক খারাপ। আমাকে অনেক কষ্ট দেন। কেন এমন করেন আপনি? আমি কী করেছি? আমি তো আপনার কাছে বেশি কিছু চাই না। আপনি আমার সাথে একটু ভালো করে কথাও বলতে পারেন না! আমাকে কষ্ট দিয়ে আপনি সুখ পান তাই না! আমার সাথে ওরকম বাজে ব্যবহার করতে আপনার ভালো লাগে। আপনি আমার মন একটুও বুঝেন না। আমিই পাগলের মতো একা একা আপনাকে ভালোবেসে যাচ্ছি। আপনি আমাকে ভালোবাসবেন তো দূর আমার ভালোলাগা খারাপ লাগার কথাও ভাবেন না। ফুলি আপা অন্যায় করলেও আপনি তাকে পুরষ্কার দেন। আর আমি কিছু না করেও আপনার কাছে বকা খাই। আপনি আমার জন্যই এত কঠিন কেন বলুন তো?’

তনু কাঁদছে। সত্যিই তার কষ্ট হচ্ছে। তার অবুঝ মন কেন ইহান ভাইয়ের মতো একজন মানুষকে পছন্দ করতে গেল! কেন ভালোবাসলো? জীবনের প্রথম ভালোলাগার মানুষ। সে-ই কিনা তনুর সাথে ওরকম বাজে ব্যবহার করে! ভালোবাসা তার জীবনে এসেছিল কিন্তু এই ভুল মানুষটার জন্য কেন এলো?
মাতব্বরের ছেলে সাত মাস পিছে ঘুরেও তার মন পায়নি। কিন্তু ইহান ভাই কিছুই করল না। তনুই প্রথম দেখাতে ওকে পছন্দ করে ফেলল।
কান্নার বেগে তনুর পিঠ ফোলে ফোলে উঠছে।

–‘আপনি অনেক পাষাণ। আপনার বুকে মন জিনিসটা নেই। এতো কঠিন কেন আপনি? আমি আপনাকে বুঝতে পারি না ইহান ভাই।’

….তার চোখে যেন দেখলাম, আজ দিনটা বড় মেঘলা, বুঝি বৃষ্টি নামবে বললো সে আমায়।
কেনো মেঘ সরেনা রত্তি?
কেনো গল্প হয়না সত্যি?
আমি মত্ত তারই তৈরি দোটানায়। দোটানায়…
বোঝেনা সে বোঝেনা,বোঝেনা…

ইহানের গলা। গান গাইছে সে! মনে সুখ লেগেছে! তনু দুই হাতে কান চেপে ধরল।

–‘আপনার গান আর কখনও শুনবো না আমি। জীবনেও না। একটা গান শুনাতে বলেছিলাম বলে এতো কথা শুনালেন তখন! আর এখন কাকে শুনাতে গাইছেন? বন্ধ করুন। চুপ করুন আপনি। আপনার গলা শুনে আমার রাগ হচ্ছে ইহান ভাই। আপনি আমাকে বোঝেন না। এখন আবার নিজে বোঝেনা সে বোঝেনা গান গাইছেন। আপনাকে আমি বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। দোহাই লাগে গান বন্ধ করুন আপনি।’

তনু কান চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল। ইহানের উপর তার দুনিয়ার সব রাগ এসে ভর করেছে। কিন্তু ইহান! ইহান কি তনুর মনের কথা শুনতে পাচ্ছে? নাকি তনুর কথা ভাবছে?

….যদি একটিবারও পারতো, সব চিন্তা ভুলে আসতে, আমি সব হারাতাম তাকে পেতে হায়…

তনু আর সহ্য করতে না পেরে দরজার দিকে বালিশ ছুড়ে মারল। অন্য একটা বালিশ নিয়ে কান চেপে ধরল। চেঁচিয়ে বলল,

–‘থামবেন আপনি! চুপ করবেন এবার? কাকে পেতে সব হারাতে রাজি আপনি? কে সেই শাঁকচুন্নি যার জন্য আমাকেও পাত্তা দিচ্ছেন না।
থাম তুই শালা। আমাকে কষ্ট দিয়ে তোর মনে রঙ লেগেছে! রঙের পুকুরে ডুব দিচ্ছিস শালা হারামি। তোর কখনও ভালো হবে না। ওই মেয়েটারও না। বিয়ের পরের দিনই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তোদের। একদিনও সংসার করতে পারবি না। আমার অভিশাপে তোর বউ তোকে বাসরঘরে রেখে অন্য ছেলের সাথে পালিয়ে যাবে৷ তখন আমার কষ্ট বুঝবি তুই।’

পরের দুইদিন তনু ইহানের কাছে পড়তে গেল না। ফুলি আপাকে দিয়ে বলিয়ে পাঠিয়েছে,

–‘আমার জ্বর ফুলি আপা। তুমি গিয়ে তোমার ভাইজানকে বলে দাও তনু কয়দিন পড়বে না।’

মুখে জ্বর বললেও তনুকে দিব্যি সুস্থ দেখা যাচ্ছে। ফুলি চিন্তিত গলায় বলল,

–‘তোমার জ্বর! আমারে তো বললা না তনু। কই দেখি। দেখি কত জ্বর!’

বলতে বলতে ফুলি তনুর কপালে হাত রাখল।

–‘কই জ্বর! কপাল তো ঠান্ডা। জ্বর আইলে কপাল গরম থাকতো। তোমার জ্বর আসে নাই।’

তনু উদাস গলায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

–‘গায়ের জ্বর না গো ফুলি আপা। মনের জ্বর।’

তনুর আগামাথা ছাড়া কথা ফুলির বোধগম্য হচ্ছে না। ভুরু কুঁচকে তনুকে দেখছে ফুলি। এত সুন্দর মেয়েটার মাথায় ছিট আছে। এর ছেলেমেয়ে হলে ওদেরও মাথায় ছিট থাকবে। ওর জামাইটা পড়বে জ্বালায়। মাথায় ছিট ওয়ালা বউ। পোলাপানও মা’র ধারা পাইব।

–‘মনের জ্বর! মনেরও আবার জ্বর হয় নাকি গো!’

–‘হয় গো হয়। শরীরের জ্বরের ঔষধ আছে। কিন্তু মনের জ্বরের ঔষধ নাই। তুমি এতসব বুঝবে না। তুমি শুধু তোমার ভাইজানকে গিয়ে বলো তনুর জ্বর। এর বেশি আর কিছু বলতে হবে না।’

–‘আচ্ছা।’

ফুলি চলে যাচ্ছে। তনু পেছন থেকে ডেকে বলল,

–‘এই শোনো, মনের জ্বরের কথাটা আবার বলতে যেও না। তুমি যা মুখ পাতলা!’

সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ইহান ভেবেছিল তনু এসেছে। হাতের সিগারেট মেঝেতে ফেলে পাপোশ দিয়ে ঢেকে ফেলল। তনু তাকে সিগারেট খেতে দেখলে রাগ করবে। সেদিন ওভাবে তনুকে বকার পর আজ দুই দিন পর তনুর দেখা পাচ্ছে ইহান। মাঝের আটচল্লিশ ঘন্টায় তনুর ছায়াটা পর্যন্ত দেখেনি ইহান। খাবার টেবিলে না। বসার ঘরে টিভির সামনেও না। ইহান একরাত নিজের বেডরুমে ছিল। এই ভেবে যে তনুর দেখা হয়তো পেতে পারে। হুটহাট রাতের বেলাতেও বসার ঘরে চলে গেছে। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল ও গিয়ে দেখবে তনু সোফায় উপুড় হয়ে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে রিমোট হাতে গান শুনছে। তাকে দেখে চট করে খবরের চ্যানেলে দিয়ে দিবে। না। তেমন কিছুই হলো না। তনু যেন এই বাড়িতেই নেই। পুরো বাড়ি ঘুরেও সে তনুর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারল না। দুইটা দিন ধরে বুকের ভেতর কেমন ব্যথা হচ্ছে তা ইহানও জানে না। দুইদিন পর তাহলে তনুর রাগ ভেঙেছে! ইহানকে দেখা দিতে এসেছে ও। ইহান তার তৃষ্ণার্ত চোখে দরজার দিকে তাকালো। তনু আসছে। দরজার সামনে পায়ের শব্দ পেয়ে তনু দরজায় টুকা দেওয়ার আগেই খুশি খুশি গলায় ইহান বলল,

–‘এসো তনু।’

ইহানের সব ভাবনায় এক চুলা ছাই ফেলে তনুর বদলে ফুলি ঘরে ঢুকল। ফুলিকে দেখে ইহানের মেজাজ সাত আসমানে উঠে গেল। এখন তনুর আসার কথা ছিল। ও না এসে ফুলি এসেছে। ফুলিটার চাকরি এবার সত্যি সত্যিই নট করে দিবে সে।

–‘তনু না ভাইজান। আমি ফুলি। তনু পড়তে আইব না।’

–‘আজও আসবে না! গত দু’দিন আসেনি। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে নাকি ও?’

–‘আরও এক সপ্তাহ মনে হয় আইতে পারব না।’

ইহান বিরক্ত হলো। আবার পাশাপাশি চিন্তিতও হলো।

–‘কেন? কী হয়েছে তনুর?’

–‘তনুর জ্বর। আমারে এই কথা আপনারে জানাইতে পাঠাইল।’

ইহানের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি গিয়ে তনুর গালে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিতে। দুইদিন ধরে জ্বর! ইহান কিছুই জানে না! কেউ তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করল না। আজব পরিবার তার। এমনিতে তো মা দুনিয়ার সব আজাইরা কথা তার কানে তুলতে ভুলে না। আর এই কাজের কথাটা বলতে পারল না। আর তনুর আক্কেল জ্ঞান কেমন? আজ দুইদিন পর নিজে না এসে ফুলিকে পাঠিয়েছে তার অসুস্থতার কথা বলতে! নিজে এলে কি পা ব্যথা হতো? ফাজিল মেয়ে।

–‘আমি যাই ভাইজান।’

ফুলি চলে যাচ্ছিল। ইহান বাঁ হাতে কপাল ডলতে ডলতে বলল,

–‘জ্বর কি খুব বেশি? বিছানা থেকে উঠতে পারছে না?’

–‘মনের জ্বর বেশি না কম কেমনে কমু ভাইজান। মনের জ্বর কি মাপুন যায়?’

ইহানের কপাল কুঁচকে গেল।

–‘মনের জ্বর আবার কি?’

ফুলি জিভ কামড় দিল। তনু তাকে এই কথা ভাইজানকে বলতে না করেছিল। ফুলি সাথে সাথে কথা ঘুরিয়ে নিল।

–‘মন কইছি নাকি আমি? তনু কইছি। আপনে শুনতে ভুল করছেন। তনুর জ্বর।’

ইহান ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার বের করে ফুলির হাতে দিল।

–‘এই নে জ্বর মাপার যন্ত্র। এটা দিয়ে জ্বর মেপে এক্ষুনি এসে আমাকে জানাবি। বুঝেছিস?’

–‘হ। আইচ্ছা ঠিক আছে।’

ফুলি যখন থার্মোমিটারটা এনে তনুর হাতে দিল, তনু জিনিসটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। ঠোঁট বাকিয়ে বলল,

–‘এটা দিয়ে আমি কী করব ফুলি আপা? তুমি এটা আমাকে দিচ্ছ কেন? আর তোমাকেই বা এটা কে দিল? কোথায় পেলে তুমি এটা?’

ফুলি মহা বিরক্ত। তনুর পড়ার টেবিলে বসে পড়ে বলল,

–‘ভাইজান দিছে। এইটা দিয়া জ্বর মাপে। জ্বর মাপার যন্ত্র। তোমার মনের জ্বর মাইপা আমারে কও। আমি ভাইজানরে গিয়া বলে আসি।’

তনু রাগ সামলাতে পারল না। ওটাকে ছুড়ে ফেলল। ফুলি হায় হায় করে উঠে বলল,

–‘এইডা কী করলা তুমি!’

–‘তোমার ভাইজানের কোন জিনিস আমার লাগবে না। তোমার ভাইজান একটা মিচকা শয়তান। বুইড়া শয়তান। ধলা শয়তান। চেহারায় মানুষ ভেতরে শয়তান। রগে রগে শয়তানি উনার। হাড়ে হাড়ে বজ্জাতি। পেটে পেটে খবিশি বুদ্ধি। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভেজাল মাল।’

এই ফুলির চাকরি সত্যিই খাবে ইহান। ফুলিটা আজকাল কোন কাজে লাগছে না। কখন বলেছে তনুর জ্বর মেপে তাকে এসে জানিয়ে যেতে। তা তো জানালোই না। তার চা-টাও এখন পর্যন্ত দিয়ে এলো না। কী করে ফুলি?

–‘ফুলি! এই ফুলি! কই মরলি?’

তনুর ঘর থেকে তনুর পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। গলা শুনে তো মনে হচ্ছে না তনু অসুস্থ। ইহান এই প্রথম তনুর ঘরের দিকে পা বাড়াল। তনু চেয়ারের উপর এক পা তুলে আরেক পা ঝুলিয়ে বসে গলা ছেড়ে পড়ছে। ইহান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে দেখল। সে যে এসেছে এদিকে তনুর খেয়াল নেই। তনু মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে তসবিহ জপার মতো পড়ে যাচ্ছে। ইহান ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে দরজায় হেলান দিয়ে তনুর দিকে চেয়ে রইল। অসুস্থতার কথা তাহলে সম্পূর্ণ ভুয়া! কোনো জ্বর-টর আসেনি তনুর। ইহান মুচকি হাসল। বিড়বিড় করে বলল,

–‘তাহলে মনের জ্বর হয়েছে তোমার!’

চলবে🍂
চলবে🍂

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here