সুখের পাখি পর্ব -১১+১২

#সুখের_পাখি

১১
ইহান দাঁড়িয়েই আছে। তনু ওকে দেখছে না। ফুলি যখন তাকে বলেছিল তনুর জ্বর। আরও কয়দিন পড়তে আসবে না তনু। তখন ইহান ভেবেছিল সিরিয়াস অবস্থা হবে হয়তো। তাই তো তাকে বাড়িতে দেখা যাচ্ছে না। ইহানের কী পরিমাণ টেনশন হচ্ছিল তা শুধু সে-ই জানে। শেষ পর্যন্ত ঘরে থাকতে না পেরে নিজেই তনুকে দেখার জন্য চলে এসেছে। কিন্তু এখানে এসে তো অন্য কিছুই দেখছে। এই মেয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ। কিচ্ছু হয়নি ওর। ফুলিকে দিয়ে মিথ্যে বলিয়ে শুধু শুধু ইহানকে টেনশন দিয়েছে। ইহানের রাগ হওয়া উচিত। কিন্তু তনুর উপর রাগ করতে পারছে না সে। সেদিন একটু বেশিই কঠিন হয়ে গিয়েছিল। একদিনে তো তনুকে বুঝানো যাবে না। আস্তে ধীরে বোঝাতে হবে।
ইহান দু’চোখ ভরে তনুকে দেখছে। দু’দিন তার কাছে দুই যুগ মনে হয়েছে।
তনু পড়তে পড়তে হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে ভূত দেখার মতো চমকে গেল। ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ইহান ভাই তার ঘরে এসেছে! নিশ্চয় তাকে দেখতে এসেছে। শুনেছে তার জ্বর। কিন্তু এখন তো ইহান ভাই বুঝে যাবে তার জ্বর না। মিথ্যা বলেছে সে। তনুর চোখ বড় বড় হয়ে ইহানের উপর আটকে গেল। মুখে কোন কথা বলতে পারছে না সে। ইহান ভাই আজও তাকে বকবে। আবার রাগারাগি করবে। তোতলাতে তোতলাতে তনু বলল,

–‘আ-আপনি! আপনি এ-এখানে?’

ইহান মনে মনে হাসল। মুখে কঠিন ভাব বজায় রেখে দরজা থেকে সামনে এগিয়ে এলো। ইহান যতই তনুর দিকে এগোচ্ছে তনুর মনে হচ্ছে এক্ষুনি হার্টফেল করবে সে। এইতো মাথা ঘুরছে। চোখে ঝাপসা দেখছে। পা কাঁপছে তার। ইহান তনুর সামনে এসে দাঁড়াল। তনুর চোখে চোখ রেখে বলল,

–‘তোমার জ্বর? অসুস্থ তুমি!’

এভাবে মুখের উপর কখনও কারো সাথে মিথ্যে কথা বলেনি তনু। ইহানের সামনে তো মিথ্যা কথা মুখ দিয়ে বেরুবেই না। মিথ্যা কথা তো দূর কথাই বের হচ্ছে না তার গলা দিয়ে। ইহান আবার জিজ্ঞেস করল,

–‘জ্বর তোমার?’

–‘হ্যাঁ? হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার জ্বর। জ্বর আছে তো। আমার এখন খারাপ লাগছে ইহান ভাই। আমি শুবো।’

কথাগুলো বলেই তনু ইহানের সামনে থেকে পালানোর জন্য ঘুরে বিছানার দিকে যেতে নিচ্ছিল। ইহানের সাথে চালাকি! সে এখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়বে আর ইহান কিছুই জানবে না। এমনটাই ভেবেছে তো তনু! কিন্তু ইহান তো অলরেডি সব জেনে গেছে। চট করে তনুর হাত ধরে ফেলল ইহান। এক টানে তনুকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। ইহানের এমন কাজে তনু ভয় পেয়ে মরে যাবার দশা। পাথর হয়ে গেছে সে। ইহানের কী হলো সে নিজেও বুঝতে পারল না। তনুকে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। ওদের দু’জনের মাঝে এখন এক চুল দূরত্ব। তনু তার কাঁধের সমান। মেয়েটা এতো খাটো! নাকি সে বেশি লম্বা? যাই হোক। এদিকে তনুর বুকের ভেতর কেউ হাতুড়ি পেটানো শুরু করে দিয়েছে। নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে যেন। ঘনঘন দম নিতে লাগল তনু। তার গরম নিঃশ্বাস ইহানের বুকের উপর পড়ছে। কিছু সময়ের জন্য ঘোরের ভেতর চলে গিয়েছিল ইহান। কী হচ্ছে এসব? তনুর থেকে সে সব সময় যে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে, আজ সেই দূরত্ব ভেঙে যাচ্ছে। তনুর অনেকটা কাছে চলে এসেছে সে। এর থেকে বড় কোন ভুল হয়ে যাবার আগে ইহান নিজেকে সামলে নিল। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

–‘দেখি কেমন জ্বর। কপাল গরম কি-না দেখি তো।’

তনুর কপালে হাত রেখে গায়ের তাপমাত্রা দেখল। তারপর সাথে সাথে তনুকে ঠেলে নিজের থেকে একহাত দূরে সরিয়ে দিল। তনু ছলছল চোখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। তার আশেপাশে কী ঘটে যাচ্ছে কোন খেয়াল নেই তার।

–‘একদম জ্বর নেই। কপাল একটুও গরম না। গা-ও ঠান্ডা। জ্বরের বাহানা দিয়ে দুদিন ধরে পড়া মিস দিচ্ছ। কাল থেকে পড়তে যাবে। নইলে তোমার বাবাকে বলবো। এখন নাটক না করে পড়তে বসো। এগারোটার আগে শুতে যাবে না। বুঝেছ?’

ইহান আর দাঁড়াল না। সে বুঝতে পারছে কী ভুল করতে যাচ্ছিল আজ সে। তনুর এতো বড় ক্ষতি কীভাবে করতে যাচ্ছিল সে। আজকের পর থেকে চাইলেও সে তনুর মন থেকে নিজের জন্য অনুভূতি মুছে দিতে পারতো না। শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়েছে সে। কিন্তু এতদূর পর্যন্ত কেন এগিয়েছিল? তনুর হাত ধরার জন্য এসেছিল সে? নাকি কপাল ধরে জ্বর দেখার জন্য? তনুর মুখটা শুধু দেখতে এসেছিল। আর দূর থেকেও সেটা সম্ভব হতো। কাছে যাওয়ার দরকার পড়তো না। নিজের উপর রাগ হচ্ছে ইহানের।

–‘গাধা! তুই একটা গাধা ইহান। এমনিতেই ওই মেয়ে তোকে নিয়ে অনেককিছু ভাবে। তুই এটা জানিস। জেনেও তুই মেয়েটার এত কাছে কেন গিয়েছিস? অল্প বয়সী মেয়ে। হতে পারে জীবনের প্রথম প্রেম। কেন তুই মেয়েটার ক্ষতি করছিস? এসব জিনিস ওর মাথা থেকে বের করতে না পারলে ওর পড়াশোনা হবে না। ফিউচার নষ্ট হবে। সেই দায় কি তুই নিতে পারবি? নাকি মেয়েটার ভালোবাসা গ্রহণ করে ওকে কাছে টেনে নিতে পারবি? কোনোটাই পারবি না। না পারবি ওকে সুখী করতে। না পারবি ওর দুঃখ কমাতে। তাই ওর থেকে দূরে থাক তুই। এটাই ওর জন্য ভালো হবে।’

ইহান চলে গেলে তনু ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ে। মেঝের দিকে তাকিয়ে কতক্ষণ পাথর হয়ে বসে থাকে। তারপর হু-হু করে কেঁদে ফেলে। কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। ইহান ভাই কী চায়? কেন এমন করে? কেন এতো কষ্ট দেয় তাকে? কেন তাকে বুঝে না? এই রাতটাও তনু মেঝেতে শুয়ে কেঁদে কেঁদেই কাটিয়ে দেয়। ইদানিং এমন কোন রাত নেই যে রাতে তনু না কেঁদে ঘুমিয়েছে। কান্না, চোখের পানি তার রাতের সঙ্গী হয়ে উঠেছে। কয়েক রাতে সে ঘুমাতেও পারে না। কান্না করলে মাথা ব্যথা করে। তারপর আর চোখে ঘুম আসে না। জেগে থেকেই রাত পার করে দেয়।
পরের দিন সকালে তনু স্কুলে যায়। রাতে মাথা ব্যথায় ঘুমাতে পারেনি। ফলে আজ ক্লাসে বসে ঘুমে টলছে। মিতা কয়েকবার তনুকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছে। বিরক্তি নিয়ে বলেছে,

–‘তনু তুই ক্লাসে ঘুমোচ্ছিস! রাতে ডাকাতি করতে বেরিয়েছিলি নাকি? নাকি কারো বাড়িতে ছাগল মুরগী চুরি করতে গিয়েছিলি। রাতটা ঘুমিয়ে কাটানোর জন্য। জেগে থাকার জন্য না। রাতে ঢঙ করে এখন দিনের বেলা ক্লাসে বসে বসে ঘুমোচ্ছিস! রাবিশ কাজকাম।’

তনু প্রতিবাদ করে না। তার দু’চোখে ভীষণ ঘুম। স্যারটা হাঁসের মতো প্যাকপ্যাক করে আরও ঘুমের চব্বিশটা বাজাচ্ছে। এখন আবার মিতা লেকচার দিচ্ছে।

–‘মিতা পেঁচাল পারিস না তো। আমার মনের উপর দিয়ে কী ঝড় তুফান যাচ্ছে তা তুই কী বুঝবি? খালি খালি পটরপটর করছিস। চুপ করে বসে থাক না একটু। একদিন কথা না বললে মরে যাবি না তুই।’

–‘এই কে কথা বলে? আমার ক্লাসে কে কথা বলে? তোমরা দু’জন! দাঁড়াও। তনু, মিতা দাঁড়াও দু’জন। হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে থাকো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও যদি আবার কথা বলেছ, তাহলে কানে ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রাখব মনে রেখো। ক্লাসে মনোযোগ নেই অন্যদের ডিস্টার্ব করা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকো।’

কলিজা কাঁপানো ধমক দিয়ে স্যার আবার পড়াতে লাগলেন। তনু আগুন গরম চোখে মিতাকে দেখল। কাঁচা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে ডাইনীটাকে। ওর জন্য বসে বসে শান্তির ঘুমটা নষ্ট হলো। দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে এখন। মিতা ভুলেও তনুর দিকে তাকাচ্ছে না। এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখছে সে। তনু মনের রাগ মিটাতে মিতার হাতে জোরে চিমটি কাটল।

ক্লাস থেকে বেরিয়েই তনু মিতার পিঠে এক ঘা বসিয়ে দিল। মিতা বেঁকে গিয়ে বলল,

–‘পিঠ বাকিয়ে ফেললি। এখন থেকে এরকম বেঁকে থাকলে বাঁকা বউ কেউ ঘরে তুলবে? কার ছেলের গলায় ঝুলব আমি? তোরও তো ভাই নেই। নাকি তোর ফুপুর ওই পোলার বউ করে আমাকে ভাবি বানিয়ে নিবি?’

ফুপুর ছেলে। মানে ইহান ভাই। যাও এই চড়টা আস্তে দিয়েছিল। এই কথা শুনে তার থেকেও জোরে দুম করে আরেকটা বসিয়ে দিল। কত বড় সাহস হ্যাঁ! ইহান ভাইয়ের দিকে চোখ দেয়। তনু কিড়মিড় করে বলল,

–‘ওদিকে চোখ দিলে তোর চোখ তুলে মারবেল খেলব আমি।’

–‘মেরে ফেললি রে তনু! একটা ছেলের জন্য আমার মার্ডার করলি তুই। নির্ঘাত এবার তোর ফাঁসি হবে।’

ওরা স্কুলের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। পেছন থেকে কারো গলা পেয়ে দাঁড়াতে হলো। ক্লাসের সেকেন্ড বয় ডাকছে তাদের! বাবাহ! দুই ফেল্টুসের সাথে ক্লাসের দ্বিতীয় ছাত্রের কী কথা থাকতে পারে ভেবে পেল না ওরা। মিতা ফিসফিস করে বলল,

–‘কী লেটা রে? হালায় ডাকে ক্যান?’

–‘আমি কী জানি? আমারে আগে কইছে নাকি?’

–‘তাও কথা।’

ছেলেটা এসে ওদের সামনে দাঁড়াল। দৌড়ে এসেছে, এখন জোরে জোরে দম নিচ্ছে। তনু মহা বিরক্ত হলেও মিতার হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল,

–‘কী হয়েছে তুহিন? আমাদের ডাকছিলে তুমি?’

তুহিন তনুর দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে বলল,

–‘হ্যাঁ।’

মিতা আগের থেকেও মিষ্টি গলায় বলল,

–‘কী কথা, বলো? আমাকে বলবে? নাকি তনুকে? নাকি আমাদের দু’জনকেই?’

তুহিন তনুকে ভয় পায়। ভয় ভয় চোখে তুহিন তনুর দিকে তাকাল। মিনমিনে গলায় বলল,

–‘তনুর সাথে।’

তনু বিরক্ত হয়ে মিতাকে দেখল। এই ছেলের সাথে চিনির রসে ডুবিয়ে কথা বলছে কেন? অন্য সবার সাথে তো নিম পাতার রসে ডুবিয়ে কথা বলে। নিরাসক্ত গলায় তনু বলল,

–‘কী বলবে বলো।’

–‘আজ না। দুইদিন পর বলব।’

–‘তোমার ছাতার মাথা কথা শোনার জন্য আমাকে দুই দিন অপেক্ষা করে থাকতে হবে? শুনলাম না তোমার কথা।’

মিতা চোখ পাকিয়ে তনুকে থামানোর চেষ্টা করে নিজে বলল,

–‘দুইদিন পর কী তুহিন?’

তুহিন লজ্জা পেয়ে মাথা নুইয়ে বলল,

–‘আমার বার্থডে। টিফিন টাইমে ক্লাসে কেক কাটব। তোমরা থাকবে তো?’

মিতা উৎসাহী হয়ে বলল,

–‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। অবশ্যই থাকব। তুমি আমাদের বন্ধু। তোমার বার্থডেতে না থাকতে পারি নাকি? আমরা না থাকলে তুমি কষ্ট পাবে না! থাকব আমরা।’

–‘আচ্ছা। এখন যাই তাহলে আমি?’

–‘যাও যাও।’

–‘বাই। বাই তনু।’

তুহিন চলে যাবার পর মিতা তনুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,

–‘বুঝেছিস কিছু?’

–‘না বোঝার কী আছে? আমি বাচ্চা নাকি? ওর মতো ছেলেদের কত দেখে এসেছি। সব শালারা এক রকম।’

–‘ছেলেটা হেব্বি বড়লোক বাপের পোলা। নিজের গাড়ি করে স্কুলে আসে। পড়াশোনায়ও ভালো। দেখতেও মোটামুটি ঠিকঠাক। চলে আরকি।’

–‘ওর গাড়ি, পড়াশোনা আর চেহারা ধুয়ে তুই পানি খা। আমার এসবে কোন ইন্টারেস্ট নেই।’

–‘কেন রে? তোর অলরেডি কেউ আছে নাকি? ছাইয়্যা, নাগর টাইপ কেউ। আমাকে তো বললি না!’

–‘সময় হলে সব জানতে পারবি। আগে থেকে ব্যাঙের মতো লাফাস না তো।’
#সুখের_পাখি

১২
তুহিন ছেলেটা তাকে পছন্দ করে। এটা তনু প্রথম দিনই বুঝতে পেরেছিল। তার দিকে কীভাবে কীভাবে যেন তাকাতো। ক্লাসের দুই নাম্বার ভালো ছাত্র নাকি তাকে ভয় পায়! বিষয়টা আগেই খটকা লেগেছিল। পড়াশোনার ব্যাপারে যেচে পড়ে তাকে সাহায্য করতে আসতো। তনু কি এসব বুঝে না? খুব ভালো করেই বুঝে। মাতব্বরের ছেলের উদেশ্যও সে প্রথম দিনই বুঝে গিয়েছিল। তনু বুঝে না শুধু একজন মানুষকে। আর সে হলো ইহান ভাই। তনু ইহান ভাইকে যত বুঝতে চায়। ইহান ভাই তার তাকে ততই রহস্যময় হয়ে ধরা দেয়।
এসব ভাবতে ভাবতেই তনু দরজা দিয়ে ঢুকছিল। বসার ঘরে যে ইহান সোফায় বসে টিভি দেখছে তা তনু লক্ষই করল না। তুহিন ছেলেটাকে নিয়ে ভাবনায় আছে সে। এই ছেলেও তাকে জ্বালাবে নাকি? দু’দিন পর জন্মদিনে কী এমন কথা বলতে চায়? এ মা! প্রেম ভালোবাসার কথা বলবে না তো।

–‘না বাবা। আমি ওইদিন স্কুলেই যাব না। ওসবে আমার কাজ নেই। আমার যেই মানুষটাকে চাই সে আমার চোখের সামনেই আছে। আর কাউকে লাগবে না আমার।’

নিজে নিজে কথা বলতে বলতে তনু নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। ইহান কান উঁচিয়ে তার কথাই শুনছিল। চোখ মুখ কুঁচকে উঠে বসল সে। আজব তো! তনু তাকে দেখল না। উল্টাপাল্টা কীসব বলতে বলতে চলে গেল!

–‘কেন স্কুলে যাবে না তনু? তার মানুষটা চোখের সামনেই আছে বুঝলাম। কিন্তু আর কাউকে লাগবে না মানে? তার মানে অন্য কেউ তনুকে স্কুলে বিরক্ত করছে!’

ইহানের এতো রাগ হলো! কার অত সাহস? কে তনুকে বিরক্ত করছে? মেয়েটা মাত্র টেন-এ পড়ে। এখনই পাঁজি ছেলেগুলো ওর পিছু লেগে গেছে? কলেজ, ভার্সিটি কীভাবে পার করবে ও। আর সবথেকে বড় কথা তনুর মন সব সময় একরকম না-ও থাকতে পারে। ইহান ওকে ফিরিয়ে দিলে তনু যে অন্য কাউকে সুযোগ দিবে না তার কী গ্যারান্টি আছে!

–‘না না। কীসব ভাবছি আমি! তনু কেন অন্য কোনো ছেলেকে সুযোগ দিবে? ও তো একজনকেই পছন্দ করে। আর কাউকে কেন সে পছন্দ করবে? কালই তনুর স্কুলে যাব আমি। ওই ছেলেকে খুঁজে বের করে ওর ভালোবাসা ছুটিয়ে দেব। পাছায় লাথি দিয়ে আবেগ বের করব। আজকালের কী ছেলেপুলে রে বাবা!’

ইহান স্বস্তি পাচ্ছে না। তার মাথায় এই কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে। গিটার হাতে নিয়েও রেখে দিল। ঘরময় পায়চারি করে যাচ্ছে সে। ফ্যান ঘুরছে তবুও গরম লাগছে তার। টিশার্ট খুলে ফেলল। মেঝেতে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল ইহান। এরকম তার আজকের আগে কখনও লাগেনি।
সাবিনা কপাল চেপে ধরে ঘরে বসে আছে। তনু ফুপুর কাছে এলো। ঘরে এসে ডাকল,

–‘ফুপু আম্মা! মাথা ব্যথা করছে তোমার?’

সাবিনা কপাল থেকে হাত সরিয়ে তনুর দিকে তাকাল।

–‘তনু, আয়।’

–‘তোমার কি খারাপ লাগছে? মাথা টিপে দেব একটু?’

–‘না। বোস তুই। স্কুল কেমন যাচ্ছে? পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে তো? ইহান বকাঝকা করে?’

”ইহান” এই নামটাই তনুর জন্য যথেষ্ট। মানুষটা সামনে থাকতে হয় না। নামটা শুনলেই বুকের ভেতর কিছু হতে শুরু করে। ফুপুর আড়ালে দীর্ঘ নিঃশ্বাস চাপল তনু৷

–‘পড়াশোনা ভালোই চলছে। ফুপা কবে আসবেন?’

সাবিনার মুখ মলিন হয়ে গেল। এইজন্যই আজ তার মন খারাপ। কথা ছিল কাল আসবে। কিন্তু আজ ফোন করে বললো আরও এক মাস লাগবে। হঠাৎ আরেকটা কাজ পড়ে গেছে। সাবিনা কি কখনও এতো টাকাপয়সা চেয়েছিল? নাকি বড় বাড়ি, দুই তিনটা গাড়ির স্বপ্ন দেখেছিল? সে স্বামী সন্তানকে কাছে নিয়ে সুন্দর একটা সুখী সংসার আশা করেছিল। স্বামী যেই কাজই করুক। রাতে বাড়ি ফিরে ওর সাথে বসে খাবে। একসাথে শুতে যাবে।

–‘জানি না। তোর ফুপার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করবি না। আমি তার কে? তার খবর আমি রাখব কেন?’

সাবিনার গলা ধরে এসেছে। তনু বুঝতে পারল ফুপু আম্মার ফুপার সাথে ঝগড়া হয়েছে। তাই উনার মন খারাপ। তনু আর এখানে বসলো না। তার সামনে ফুপু আম্মা কেঁদে ফেললে লজ্জা পাবে। তিনমাস হয়েছে তনুরা এই বাড়িতে এসেছে। অথচ তার মাঝে একবারও ফুপা বাড়ি আসেনি। কী অত কাজ ফুপার? বাড়িতে বউ, ছেলে আছে। তা কি ভুলে গেছে? অত টাকাপয়সা কার জন্য করছে? ছেলে বউয়ের জন্যই তো? ওদের একটু সময় দিলে কী হয়!

–‘আপনি আমাকে ছেড়ে এরকম দূরে থাকলে আমি কখনও আপনার মুখই দেখব না। বাড়ি গাড়ি টাকাপয়সার দরকার নেই আমার। আমার শুধু আপনাকে চাই। আপনি বছরে ৩৬৫ দিনই আমার পাশে থাকবেন। এতেই আমি খুশি। আমার শুধু আপনাকেই চাই ইহান ভাই। অন্য কিছু চাই না।’

তনু পড়তে যায় না। ইহান তনুর জন্য অপেক্ষা করে থাকে। তনুকে আসতে না দেখে ফুলিকে ডাকে।
ফুলি ইহানের সামনে গিয়ে বলে,

–‘অহন চা খাইবেন ভাইজান!’

–‘চায়ের জন্য ডেকেছি তোকে?’

–‘না? তাইলে কেন?’

–‘তনু স্কুল থেকে ফিরেছে?’

–‘সেই কহন ফিরছে।’

–‘ওকে গিয়ে বল পড়তে আসতে। আজও পড়া মিস দিলে পিঠের চামড়া তুলে ফেলব। গতবার অংকে পেয়েছে বত্রিশ। এবার পাবে ষোলো।’

ফুলি এসে তনুকে বলার সাথে সাথে তনু ভয় পেয়ে বই বগলে করে ইহানের ঘরের দিকে ছুট দিল। আর লুকোচুরি করে লাভ নেই। ফুপুর ছেলে চালাক শয়তান। তাড়াহুড়ো দরজায় টুকা না দিয়ে সরাসরি ঘরে চলে আসে তনু। ইহান রাগী চেহারা বানিয়ে তার দিকে তাকায়। ধমকের সুরে বলে,

–‘বাইরে যাও। আবার গিয়ে দরজায় নক করে আমার অনুমতি নিয়ে তারপর ভেতরে আসো।’

তনু কটমট করে তাকায়। উপায় নেই। তার রাগ দেখার ইহান ভাইয়ের সময় নেই। রাগে পায়ে জোরে শব্দ তুলে আবার ফিরে যায়। দরজায় টুকা দেয়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

–‘আসবো ইহান ভাই?’

ইহান মনে মনে মজা পায়৷ তনু তাকে এতটা ভয় পায়! আগে জানা ছিল না। মেয়েটা পাগলি একটা। ইহান ভাব নেয়। ভরাট গলায় বলে,

–‘কে?’

তনুর গা জ্বলে যায়। মজা করা হচ্ছে তার সাথে? তাকে চেনে না? নিজেই তো বের করে দিয়ে আবার যেতে বলল। এখন না চেনার ভাব নিচ্ছে। মিচকা শয়তান।

–‘আমি।’

–‘আমিটা কে?’

তনুর সহ্যের সীমা ভেঙে গেছে। চেঁচিয়ে বলে সে,

–‘আমি তনু। আপনার মায়ের মুখে বলা ভাইয়ের মেয়ে। আপনার ছাত্রী। চিনতে পেরেছেন আমাকে? নাকি জন্মসনদ এনে দেখাতে হবে। আইডি কার্ড হয়নি আমার। ওটা চাইলে এখন দেখাতে পারব না।’

ইহান বুঝল তনু রেগে গেছে। একটু বেশিই করে ফেলেছে সে।

–‘অহ তনু! এসো এসো।’

তনু মনে মনে উচ্চারণ করে,

–‘শালা মিচকা শয়তান। বদমাশ হারামি।’

ইহান পড়ানো শুরু করায়। তনুর লেখাপড়ায় মন নেই। জোর করে ধরে বেঁধে কখনও পড়াশোনা হয় নাকি? পড়াশোনা মন থেকে আসতে হয়। জোর করে যেমন তনু ইহানকে ওকে ভালোবাসাতে পারবে না। তেমনই ইহানও জোর করে তনুকে পড়াতে পারবে না। পড়াশোনা আর ভালোবাসা দু’টোই মন থেকে আসতে হয়। তনু কলম কামড়ায়। পা নাচায়। অস্থির চোখে এদিকওদিক তাকায়। ইহান ভালোই বুঝতে পারছে তনুর পড়াশোনা গোল্লায় যাচ্ছে। এর পেছনে অনেকটা দায় তার নিজের। তনুটা যে কেন এমন কাজ করলো! দুনিয়ায় কি আর ছেলে ছিল না?
ছেলের কথা মনে পড়ায় ইহান সোজা ভাবে জিজ্ঞেস না করে ইনিয়েবিনিয়ে অন্য ভাবে তনুর থেকে কথা আদায় করতে চাইল।

–‘স্কুলে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?’

উদাস গলায় তনু উত্তর দেয়।

–‘কী সমস্যা হবে?’

তনু কি ইহানের থেকে ওই ছেলেটার কথা লুকাতে চাইছে? ছেলেটার কথা ইহানকে বলছে না কেন? কেউ বিরক্ত করে কি-না এটা ইহানকে তনু জানাবে না?

–‘ক্লাসে পড়া বোঝো কি-না। স্যার ম্যামরা কেমন পড়ায়। এইসবই আরকি।’

–‘এইসবই জানতে চাইবেন আপনি। আমাকে নিয়ে আপনি ভাবেন নাকি? ভাবলে না অন্য কিছু জানতে চাইতেন। আমাকে স্কুলে কেউ বিরক্ত করলে আপনার কি কোনকিছু যাবে আসবে ইহান ভাই?’

–‘কিছু বললে?’

–‘না। কী বলব? পড়ান আপনি।’

ইহান তনুর উপর বিরক্ত হয়। কচুর মাথা পড়াবে সে। দরকার নেই পড়াশোনার। ঘরে বসে থাকো তুমি। একদম বাইরে বের হবে না। আর কোন ছেলেদেরকেও আশেপাশে ঘেঁষতে দিবে না। আমার কথা না শুনলে ঠ্যাং ভেঙে ফেলব তোমার। এভাবে কি তনুকে বলতে পারবে সে? কক্ষনো পারবে না।
তনু বসে বসে নিরাসক্ত চোখে ইহানের হাতের তালু, হাতের আঙুল দেখে। কত বড় হাত! কী লম্বা লম্বা আঙুল! হাতের তালু এতো সুন্দর উপরের সাদা চামড়া ভেদ করে ভেতরের লাল অংশ দেখা যাচ্ছে। নখগুলো কত সুন্দর করে কেটেছে। একদম সোজা। হাত থেকে আস্তে আস্তে মুখের দিকে উঠল তনু। আজকে চুল ঠিক করেনি। থাক, এলোমেলো চুলেই সুন্দর লাগছে। কপালে ভাঁজ পড়ে আছে কেন? এতেও সুন্দর লাগছে। মনে মনে তনু বলল,

–‘ছেলেরা এতো সুন্দর হওয়ার মানে কী? আপনি কেন এতো সুন্দর হলেন ইহান ভাই? একটু কালো হতে পারলেন না! ছেলেরা কালো নয়তো শ্যামলা হবে। ফকফকা ফর্সা কেন হবে? আপনার সবকিছুই এতো সুন্দর কেন? এইযে আপনি কথা বলছেন। কী সুন্দর করে ঠোঁট নড়ছে। আপনার কথাগুলোও আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। জানি আপনি গায়ক মানুষ। তাই বলে এতো সুন্দর করে কথা বলতে হবে? আপনাকে ঘিরে সবকিছু আমার কাছেই এতো ভালো লাগে! নাকি অন্যদের কাছেও আপনাকে আমার মতোই ভালো লাগে? আপনি ঘর থেকে বেরুবেন না। সারাদিন ঘরেই বসে থাকবেন। আপনাকে হারানোর আমার অনেক ভয়। আমার শুধুই মনে হয়, বাইরে গেলেই মেয়েরা আপনাকে আমার থেকে চুরি করে নিবে। আপনি আমার এই ভয়টা দূর করে দিতে পারেন না ইহান ভাই?

ইহান বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। তনু ইহানকে বেরিয়ে যেতে দেখে দৌড়ে ছাদে চলে এলো। ইহানের ঘরের দরজা কখনও আটকানো থাকে না। ঘরে ঢুকে গেল তনু। সবার আগে গিটার হাতে নিল। ইহান এই গিটার কত যত্ন করে হাতে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে বাজায়! তনুও সেভাবেই গিটার হাতে নিল। চোখ বুজে নিল সে। মনে হচ্ছে ইহান ভাই তাকে জড়িয়ে রেখেছে। অনেকক্ষণ একই ভাবে বসে থেকে তনু গিটার রেখে হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এই বিছানায় ইহান ভাই ঘুমায়। এই বালিশে মাথা রাখে। তনু বালিশে নাক গুঁজে ইহানের চুলের গন্ধ পায়। অজানা এক শিহরণে সর্বাঙ্গ শিহরিত হচ্ছে তনুর। পৃথিবীর সব ভালোলাগা তার মনে ঝেঁকে বসেছে। পরক্ষণে আবার কান্না পাচ্ছে। কখনও কী এই ঘরে, এই বিছায়, এই বালিশে, এসবে তার জায়গা হবে? ইহানের বুকে মাথা রেখে ঘুমাবার অধিকার কোনোদিন পাবে সে? এই ঘরের সবকিছুর উপর ইহান তাকে অধিকার পেতে দিবে?
তনু উঠে আলনার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ইহানের সবগুলো শার্ট, গেঞ্জি, টিশার্ট দেখতে লাগল। পরম আবেশে সাদা শার্টটা হাতে নিল। নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নিল। ইহানের গন্ধ পাচ্ছে সে। তনু শার্টটা বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বুজে রইল। তারপর শার্টটা গায়ে দিল সে। তনুর সর্ব শরীর কাঁপছে। ইহান তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ছলছল চোখে তনু কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকল জানে না সে। দরজায় শব্দ পেয়ে হুঁশ ফিরতে ঝট করে ঘুরে দরজার দিকে ফিরে দাঁড়াল তনু।

চলবে🍃

Jerin Akter Nipa-জেরিন আক্তার নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here