সুখের পাখি পর্ব -১৩+১৪

#সুখের_পাখি

১৩
–‘ম্যাও! ম্যাও!’

বিড়াল! আল্লাহ! ইহান ভাই চলে এসেছে ভেবে তনুর কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিল। ইহান ভাইয়ের জায়গায় পাশের ফ্ল্যাটের বিড়ালটাকে দেখতে পেয়ে তনুর কলিজায় পানি আসে। যা ভয় পেয়েছিল সে! ইহান ভাই চলে এলে সর্বনাশ হয়ে যেত। সর্বনাশের আর কিছুই বাকি থাকতো না। মুখ দেখাতে পারত না তনু। এই বাড়ি ছেড়েও চলে যেতে হতো। তনু বিড়ালটার উপর রেগে গিয়ে ওকে ধমক দিয়ে বলল,

–‘তুই! শয়তানের বাচ্চা বিড়াল। হার্ট অ্যাটাক করিয়ে দিতি আমার। আমি মরে গেলে সেই দায় তুই নিতি?’

বিড়ালটা তনুর কথা বুঝতে পারল কি-না কে জানে। লেজ নাড়িয়ে আবার বলল,

–‘মিঁয়াও!’

–‘আবার মিয়াও বলে! মিয়াও এর বাচ্চা যা এখান থেকে। যা বলছি। ওই তুই আমাদের বাড়িতে এসেছিল কোন সাহসে? যা ভাগ। নইলে বেঁধে রেখে দেব। আর ফিরে যেতে দিব না।’

তনুর ধমক কাজে দিয়েছে। বিড়ালটা হয়তো বুঝতে পেরেছে তনু এখন সত্যি সত্যিই রেগে আছে। এখান থেকে না গেলে সত্যি সত্যিই বেঁধে রাখবে। তনুর দিকে অবহেলার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে লেজ নাড়াতে নাড়াতে বিড়ালটা আবার দরজা দিয়ে চলে গেল। তনুর আক্কেল খুললো। এভাবে যে এই ঘরে এক ঘন্টার উপর ধরে আছে সে, ইহান ভাই যদি হঠাৎ চলে আসে।

–‘ইহান ভাইয়ের শার্ট পরে ছিলাম। ও চলে এলে কোথায় যেতাম আমি? মাটিও তো ফাঁক করতে পারতাম না যে মাটির ভেতর ঢুকে যাব। না বাবা না। ইহান ভাই চলে আসার আগে আমি এই ঘর থেকে চলে যাই।’

শার্টটা খুলে হাতে নিল তনু। রেখে আসতে ইচ্ছে করছিল না। তাই ওড়নার নিচে লুকিয়ে ওটা নিজের ঘরে নিয়ে এলো। এতো এতো জামা-কাপড়ের মাঝে একটা শার্ট খুঁজে না পেলে কিছু হবে না। আর না পেলেও সমস্যা নাই। বুঝবে চোর নিয়ে গেছে। চোরটা যে কে তা তো কেউ জানবে না।

–‘তনু চোর। উঁহু, তনু চুন্নি। ইহান ভাইয়ের চুন্নি তনু।’

শার্টের এক হাতায় নিজের হাত ঢুকিয়ে। অন্য হাত তার হাতে নিয়ে ঘরজুড়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে তনু। গুনগুন করে গান গাইছে,

—তোমাকে চাই শুধু তোমাকে চাই, আর কিছু জীবনে পাই বা না পাই…

আজ এতো সুখ লাগছে কেন? পৃথিবীর সব সুখ তনুর হাতে ধরা দিয়েছে আজ। তনু তার খুশি লুকিয়ে রাখতে পারছে না। বারবার ইহানের শার্ট নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ শুঁকছে তনু। আহ! কী পাগল করা ঘ্রাণ। কী পারফিউম মাখে গায়ে? এতো সুন্দর গন্ধ!

ইহান চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। ফুলি কাচুমাচু হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সাবিনা ছেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে কপাল চেপে ধরে সোফায় বসে আছে। ইহান রাগে গমগম করছে।

–‘আমার নতুন শার্টটা। সেদিন কিনলাম। আর আজ পাচ্ছি না! হাওয়া হয়ে গেল? নাকি ভূত এসে নিয়ে গেল? আমার ঘরে কে যায়? না, শুনি আজ। আমি বাড়ির বাইরে গেলে আমার ঘরে যায়টা কে হ্যাঁ? একটা জিনিস ঠিকঠাক মতো এসে পাই না। আমার কত পছন্দের সাদা শার্টটা। বাড়িতে থেকে কী করিস তুই ফুলি? তোরা থাকতে আমার ঘরে চোর ঢুকে? শুধু আমার ঘরেই! আজব কারবার!’

সাবিনা বিরক্তিমাখা গলায় বলে,

–‘আহ! থাম না এবার। একটা শার্টই তো হারিয়েছে। তোর বাপের তালুক তো হারানো যায়নি। ওই শার্ট পাচ্ছিস না, নতুন একটা কিনে আন। তা না করে এক শার্টের জন্য দুই ঘন্টা ধরে চিল্লাচ্ছিস। মাথা খেয়ে ফেললি আমার। আমি পাগল হই তারপর তোরা শান্তি পাবি। তোর বাপ আর তুই তো এটাই চাইতেছিস। আমি সুস্থ আছি এটা সহ্য হচ্ছে না তোদের। সবাই মিলে আমাকে পাগল বানিয়ে পাবনা পাঠা।’

–‘কথা শার্টের না মা। কথা আমার অনুপস্থিতিতে আমার ঘরে কে যায়?’

–‘এই বাড়িতে কয়জন মানুষ আছে? তারা কেউ তোর ঘরে যায় না। আর গেলেও কেউ তোর স্বর্নের শার্ট চুরি করতে আসবে না। কে নিবে তাহলে তোর শার্ট?’

ফুলি মাঝ থেকে কথা বলে উঠল,

–‘ভাইজান বাড়িত না থাকলে আমি কিন্তু ভাইজানের ঘরে যাই না।’

সাবিনা, ইহান দু’জনই চোখ পাকিয়ে ফুলির দিকে তাকাল। ফুলিকে বলেছে কেউ যে, তুই ইহানের ঘরে যাস। নিজের উপর কথা টেনে নিচ্ছে কেন সে?
ইহান মনে মনে ভাবল, কেউ না গেলেও একজন অবশ্যই যায়। তনু! হ্যাঁ তনুই তার ঘরে যাবে। সে থাকলে যায় না। তাকে ভয় পায়। সে না থাকলে তো কোন কথাই নেই। ইহান কপাল কুঁচকে বিড়বিড় করে বলল,

–‘তনু আমার শার্ট নিয়েছে? কিন্তু ও আমার শার্ট দিয়ে কী করবে? শার্ট পরে নাকি ও? হায়, হায়! তনু আমার নতুন শার্ট নিয়ে কোন ছেলেকে গিফট করে দেয়নি তো! এমনটা হলে এই মেয়ের হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখব আমি।’

ঠিক এমন সময়ই তনু নাচতে নাচতে ভেতরে এসে ঢুকল। সবাইকে একসাথে বসার ঘরে দেখে তনু দাঁড়িয়ে গেল। সবার মুখ থমথমে। বাড়িতে কিছু হয়েছে নাকি? ইহান ভাই এত রেখে আছে কেন? তনু ইহানের মুখের দিকে দেখেও সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিল। বাড়ির আবহাওয়া বেশ সিরিয়াস।
ভয়ে ভয়ে ধীর গলায় তনু জানতে চাইল,

–‘ফুপু আম্মা, কী হয়েছে?’

–‘আর বলিস না রে তনু। আমার ছেলেমেয়ে গুলা আস্ত পাগল। পাগলের বংশ এরা। এর বাপ দাদা পাগল ছিল না। কিন্তু আমার ঘর থেকে পাগল হয়েছে। বাড়িতে চোর ঢুকে নাকি ওর ঘর থেকে শার্ট চুরি করে নিয়ে গেছে। এই নিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে রেখেছে। আরে বাবা একটা শার্টই তো নাকি? একটা শার্টের দাম কত? হাজার বারো’শো! তোর বাপের অত কিছু খাবে কে? একটা শার্টের জন্য এমন কাইস্টামি! ছি ছি ছি।’

ইহান ভাইয়ের শার্ট চুরি গেছে, খবরটা শুনে যেন তনু অনেক ব্যথিত হয়েছে। গলায় সমবেদনা ঝরিয়ে কিছুটা অবাক হবার ভান করে ইহানের দিকে তাকিয়ে তনু বলল,

–‘বাড়িতে চোর ঢুকেছিল! চোর ঘরে গিয়ে শার্ট চুরি করে নিয়েছে! এ কেমন চোর। চোরের তো সাহস কম না।’

ফুলি অনেকক্ষণ কথা বলতে না পেরে যেন দম আটকে মারা যাচ্ছিল। তনুর কথার খেই ধরল সে।

–‘সাঙ্ঘাতিক চোর গো তনু। একদিন সুযোগ পাইয়া খালি শার্ট নিছে। অন্য দিন সুযোগ পাইলে বাড়ি সাফ কইরা দিয়া যাইব। একদিন আইসা তো বাড়ি চিনেই গেছে। পরের বার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়া আইব। দা, বডি,ছুরি, কাঁচি নিয়াও আইবার পারে।’

–‘অঅহ্! কী বলো ফুলি আপা! সত্যি চোর এসব নিয়ে আবার আসবে?’

–‘সত্যি না তে মিছা কইতাছি নাকি আমি?’

–‘আহ্ ফুলি! থামবি তুই? নাকি এক্ষুনি চাকরি খাবো তোর?’

সাবিনা ধমক দিয়ে ফুলিকে থামিয়ে দিল। তনু সব জেনেও সবার সাথে এমন ভাব করছে যে কিছুই জানে না সে। চোর টোর কোত্থেকে আসবে হ্যাঁ? চোরের কী খেয়েদেয়ে কাজ নেই? একটা শার্ট চুরি করতে আসবে! আসল চোর তো এই বাড়িতেই আছে। সবার চোখের সামনে। ইহান বিরক্তির মহা পর্যায়ে চলে গেছে। কটমট করে রাগী চোখে তনুকেই শাসাচ্ছে সে৷ তার বিশ্বাস এই কাজ বাইরের কোন চোরের না। বাড়ির ভেতরই বড় চোর আছে।
তনু মুচকি হেসে মনে মনে বলল,

–‘এই শার্ট কক্ষনও পাবেন না আপনি। এটাকে আমি নিজের কাছে রাখব। সারাজীবন। আপনার সাথে আমার বিয়ে না হলেও, আপনি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে নিলেও এই শার্ট আমার কাছেই থাকবে। আমার স্বামীকেও আমি এই শার্ট ধরতে দিব না।’

ইহান অন্য কাউকে বিয়ে করবে। তনুর অন্য কারো সাথে বিয়ে হবে ভাবতেই তনুর মন খারাপ হয়ে গেল। এরকম হলে কোনোদিনও বিয়েই করবে না তনু। সারাজীবন একা থেকে যাবে। কিন্তু ইহান ভাইকে তার বউয়ের সাথে দেখলে তনুর ভীষণ কষ্ট হবে। সেসব দিনের কথা ভাবতেই এখনই তো বুকের ভেতর মুচড় দিচ্ছে। তনুর বড্ড ক্লান্ত লাগছে। ঘরে চলে আসে সে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে এই কাপড়েই উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
হঠাৎ করে পুরো দুনিয়া তনুর কাছে সহ্য মনে হচ্ছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

তনু রাতেই ঠিক করে নিয়েছিল আজ স্কুলে যাবে না সে। আজ ওই পাঠা তুহিনের জন্মদিন। উজবুকটা টিফিন টাইমে ক্লাসে কেক কাটবে। মিতা গোপন সূত্রে জানতে পেরেছে তুহিন আজ তাকে প্রপোজ করবে। শুনেই তনুর মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। তার তো ইহান ভাই আছে। আর কাউকে লাগবে না তার। রামগরুটা তাকে প্রপোজ করার আর দিন পেল না। নিজের জন্মদিনের দিনই অপমানিত হওয়ার ইচ্ছে জাগল। তনু যে সে মেয়ে না। মাতব্বরের ছেলেকে উচিত শিক্ষা দিয়ে এসেছে সে। এই ছেলেও বেশি বাড়াবাড়ি করলে একেও জন্মের শিক্ষা দিয়ে ছাড়তে পারবে। কিন্তু তনু চায় না হাঁদাটার জন্মদিন খারাপ করতে। গাধার বাচ্চা কেক কাটুক, মন চায় কেক দিয়ে গোসল করুক। ওসব ঝামেলা থেকে ভালো তনু আজ স্কুলেই যাবে না।
ফুলি এসে তনুকে ডাকে।

–‘ও তনু তোমার বান্ধবী আসছে। বসার ঘরে বইসা রইছে। ডাকে তোমারে।’

বান্ধবী! কোন বান্ধবী? মিতা ছাড়া তার তেমন কোন বান্ধবী নেই। কিন্তু মিতা তো তার বাড়ি চিনে না। তাহলে কে এসেছে। চিন্তিত মুখে তনু জিজ্ঞেস করে,

–‘কোন বান্ধবী গো ফুলি আপা? নাম বলেছে? ‘

–‘মিতা না মিনা, কী জানি মনে নাই। তুমি গিয়া দেখলেই তো চিনতে পারো।’

মিতাই এসেছে। তনু ভেবে পাচ্ছে না এই মিতাটা বাড়ির ঠিকানা জানলো কীভাবে?
বসার ঘরে এসে তনু মিতাকে দেখে সবার আগে যে কথাটা বলল তা হলো,

–‘আমার বাড়ি চিনলি কীভাবে তুই?’

মিতা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে হাই তুলতে তুলতে বলল,

–‘তুই যে ফেমাস লোক রে তনু! গুগলে তোর নাম পুরোটাও লিখতে হয়নি। খালি তনুর ‘ত’ টা লিখেছি তার আগেই তোর সব খবরাখবর চোখের সামনে এসে হাজির।’

–‘কেন এসেছিস?’

–‘কী ক্ষ্যাত রে তুই! কই বাড়িতে আসা মেহমানকে আপ্যায়ন, খাতিরযত্ন করবি। তা না করে জিজ্ঞেস করছিস কেন এসেছি। তোর বাড়িতে খেতে এসেছি। এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে রান্না হয় না। ভাইবোন দশটা থেকে পাঁচটা না খেতে পেয়ে মরে গেছে। বাকি পাঁচটাও এক দুইদিনের ভিতরে যাবে। তুই তো দয়ার দেবী। কয়টা ভাত খেতে দিবি? তিন দিনের পঁচা বাসি হলেও চলবে। আমার কোন সমস্যা হবে না।’
#সুখের_পাখি

১৪
তনু বিরক্ত হলো। কপালে বিরক্তির রেখা স্পষ্ট ভাসিয়ে মিতাকে কতক্ষণ দেখল। মিতাটা মরে যাবে তবুও শুধরাবে না। জিলাপির প্যাঁচ ছুটে যাবে তবুও মিতার কথার প্যাঁচ ছুটবে না। এটা অসম্ভব।

–‘আজ স্কুলে যাবি না তুই?’

–‘না।’

–‘জানতাম। আমি আগেই জানতাম। তোরে রগে রগে চিনি আমি। ওরকম একটা বিনোদন থেকে আমাকে বঞ্চিত করার প্ল্যান করছিস। গাধাটা আজ তোকে প্রপোজ করবে। ভুলে গেছিস?’

–‘সেইজন্যই তো যাব না। তোর কাছে ওসব বিনোদন হলেও আমার কাছে বিরক্তির কারণ। কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না আমি।’

–‘তুই ভয় পাচ্ছিস নাকি? আমি আছি না তোর সাথে।’

–‘সেটাই তো আরও বড় ভয়।’

মিতা যেন তনুর কথায় আহত হলো। কাতর মুখ করে বলল,

–‘চল না রে। রেডি হ না প্লিজ।’

–‘আমি যাব না মিতা। একবার তো বলেছি। তোরও আজ যেতে হবে না। এসেছিস যখন, তখন আজ আমাদের বাড়িতে বেড়াবি। তোর দাওয়াত।’

–‘আল্লাহ! তুই ওই গাধাটাকে ভয় পেয়ে স্কুল মিস দিবি!’

–‘প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে কোন বিদ্যা সাগরটা যে হবে তুমি তা আমার জানা আছে।’

মিতা নাছোড়বান্দা। এবার তনুর সামনে আকুতি মিনতি করতে লাগল।

–‘চল না। প্লিজ চল না তনু। মজা হবে আজ। গাধাটা তোর থেকে রিজেক্ট হয়ে ক্লাসের সবার সামনে যা অপমান পাবে না! ওর ফুটানি ছুটে যাবে। সেকেন্ড বয়! ছাতার মাতা আমার। চল তনু প্লিজ। আমার কথা রাখবি না তুই? আমি কি তোকে আগুনে ঠেলে দিব? তোর বান্ধবী থাকতে তোর কোন চিন্তা নেই।’

না চাইতেও তনুকে স্কুলে যাওয়ার জন্য রাজি হতে হলো। তনু জানে সে যতক্ষণ রাজি না হবে ততক্ষণ মিতা তার মাথা চিবিয়ে খাবে। মিতা যেহেতু এতদূর বাড়ি বয়ে এসেছে তার মানে তনুকে নিয়ে তবেই স্কুলে যাবে।

–‘ঘরে আয়। রেডি হচ্ছি আমি।’

–‘এখন আর ঘরে যেতে পারব না। তুই গিয়ে দু’মিনিটে ফটাফট রেডি হয়ে আয়। আমি এখানেই বসছি। এই তোরা এতো কিপ্টুস ক্যান? এখনও এক গ্লাস পানি, শরবত কিচ্ছু দিলি না! ওই মেয়েটা কই?’

তনু ঘরের দিকে যেতে যেতে ফুলিকে ডেকে বলল,

–‘ফুলি আপা এই পেটুককে চা বিস্কুট কিছু দাও তো। এক সপ্তাহ ধরে না খেয়ে আছে। এখন খিদের চোটে না মানুষ খেতে শুরু করে। সাবধানে ওর কাছে যেও। বেশি কাছে যেও না। ধরে কামড় দিতে পারে।’

ফুলির কলিজা কাঁপছে। ভয়ে ভয়ে মিতাকে দেখছে সে। সত্যিই এই মেয়ে তাকে কামড় দিতে নাকি? দিতেও পারে, বলা যায় না। সাত দিন ধরে না খাওয়া। ফুলি দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজে যত খাবার ছিল সব নিয়ে এলো। দূর থেকে মিতার সামনের টেবিলে রেখে লাফিয়ে কয়েক পা পিছনে চলে গেল। মিতা ফুলির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

–‘বাবাহ! এই বাড়িতে আমার বান্ধবীর কথার এতো দাম! এতো খাবার! গুড, গুড। ভেরি গুড।’

ফুলি আর আশেপাশে থাকল না। পাগল মেয়ে কামড় দিয়ে বসলে তখন! কুকুর কামড় দিলে ১৪টা ইনজেকশন লাগে। মানুষ কামড় দিলে কয়টা লাগাতে হবে? ২৮টা! ও বাবা!

–‘হাঁচি…হা-আ-চ্চি! ফুলি হা-হা-হাচ্চি! ফুলিরে, এই ফুলি কই গেলি? লবণ আদা দিয়ে একটু পানি গরম করে দে না রে। ফু-ও-হা-হা…

কাল রাত থেকে ইহানের ঠান্ডা লেগেছে। নাক টানতে টানতে আর হাঁচি দিতে দিতে জীবন শেষ। টিস্যু বক্স হাতে নিয়েই ঘুরছে। তার সুন্দর নাক লাল হয়ে গেছে। হাঁচি দেওয়ার সময় চোখে পানি চলে আসছে।
ইহান রাগে আবার চেঁচিয়ে উঠল। এই ফুলিটাকে কাজের সময় পাওয়া যায় না। কোথায় গিয়ে বসে আছে এখন? এর চাকরি সত্যিই এইবার নট করতে হবে। ইহান লক্ষ করেনি বসার ঘরে একটা মেয়ে বসে আছে। মিতা ইহানের গলা শুনেই উঠে দাঁড়িয়েছে। হাতে অর্ধেক খাওয়া বিস্কুট নিয়ে হাঁ করে ইহানকে দেখছে সে।

–‘ এই ছেলেটা কে? তনুর ফুপুর ছেলে! ও আল্লাহ! এটা তনুর ফুপাতো ভাই! শালি আগে কেন বলেনি ওর এতো সুন্দর একটা ভাই আছে। না, ভাই আছে জানতাম। কিন্তু এ তো শুধু ভাই না। রাজপুত্র! এই রাজপুত্রকে এতদিন তনু আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছে? শালি একটা হারামি। বান্ধবীর সংসার দেখতে চায় না।’

ইহান দেখল অচেনা একটা মেয়ে এলিয়েন দেখার মতো তার দিকে তাকিয়ে আছে। কে মেয়েটা? তাকে এভাবে দেখছে কেন? অদ্ভুত লাগছে তাকে? ইহান একবার নিজেকেই দেখল। না সব তো ঠিকঠাকই আছে। আজব কোনোকিছু পরেনি সে আজ।
মিতার পরনে স্কুল ড্রেস দেখে ইহান আন্দাজ করে নিলো এই মেয়ে তনুর বন্ধু হতে পারে।

–‘কই রে চল।’

তনু এসে মিতাকে তাড়া দিল। মিতার দৃষ্টি অনুসরণ করে ইহানকে দেখল। মিতার চোখ ইহানের উপর আটকে আছে। তনুর গা জ্বলে গেল। এই লুচ্চি মিতা তার ইহান ভাইয়ের উপর নজর দিয়েছে! চোখ গলিয়ে ফেলবে না ওর সে! একদম কানা করে দিবে।
ইহান তনুর গলা শুনে তনুর দিকে দেখল। তনু ইহানকে পাত্তা দিল না। মিতার পিঠে তাল ফেলল।
ওর হাত ধরে টানতে টানতে বলল,

–‘চল। চল আমি রেডি।’

–‘দাঁড়া। হাতের বিস্কুটটা শেষ করে নিই।’

তনু দেখল এখনও মিতার চোখ ইহানের উপরই। সে মিতার হাত থেকে অর্ধেক খাওয়া বিস্কুট নিয়ে প্লেটে রেখে দিল।

–‘অনেক খেয়ে ফেলেছিস। আর খেতে হবে না। বেশি খেয়ে ফেললে বদ হজম হয়ে যাবে।’

মিতা ফিসফিস করে বলল,

–‘তোর ভাইটা শুধু পোলা নারে তনু। আগুনের গোলা। আস্ত রাজপুত্র। এরে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলি তুই!’

তনু পারছে না মিতাকে খুন করে ফেলতে। কিড়মিড় করে সে উচ্চারণ করল,

–‘চল মিতা।’

ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ইহান কিছুই বুঝতে পারল না। মেয়েটা তাকে এমন ভাবে দেখেছে যেন ইহান এইমাত্র আকাশ থেকে পড়েছে। তনুও কিছু বলল না। মানে কোন দাম নেই তার! বন্ধুর সাথে পরিচয় করাল না!

–‘আমিই নাকি আবার তার সব! সে নাকি আমাকে ভালোবাসে। কচু বাসে কচু। ব্যাঙের ছাতার ভালোবাসা। বান্ধবীর সাথে কেন পরিচয় করাল না?’

ফুলি বোলে করে গরম পানি কাপড়ে ধরে এনেছে।

–‘নেন ভাইজান।’

–‘সাবধানে। গরম পানি গায়ে পড়বে। মেয়েটা কে রে ফুলি?’

–‘তনুর বান্ধবী। পাগল মেয়ে। মানুষরে কাছে পাইলেই কামড় দেয়। এক সপ্তাহে তিনজনরে কামড় দিছে। আমারেও দিতে চাইছিল। আমি দৌড়ে পালাইয়া জান বাঁচাইছি।’

–‘বাজে বকবি না তো। মানুষ আবার মানুষ খায় নাকি? তাহলে তনু যে ওর সাথে গেল। তনুকে কামড়াবে না?’

ফুলি ভাবনায় পড়ে গেল। সত্যিই তো। তনু যে কইল মানুষ কামড়ায়। তাহলে ওরে কামড় দেয় না কেন? নাকি বান্ধবী বাদে সবাইরে কামড়ায়।

–‘কেন এসেছিল ওই মেয়ে?’

ফুলি ওদের সব কথাই শুনেছে। কিন্তু ভাইজানকে বলা ঠিক হবে? আর সে বলবে কীভাবে? লজ্জা লাগবে না তার!

–‘মুখে তালা দিয়েছিস নাকি?’

–‘ ইস্কুলে তনুরে আজ জানি কোন পোলা পরপোজ করব। তনু যাইতে চাইতেছিল না। ওর বান্ধবী আইসা জোর কইরা লইয়া গেল।’

–‘প্রপোজ! তনুকে প্রপোজ করবে! কোন ছেলে? তনু গেল কেন? বান্ধবী জোর করলেই যেতে হবে নাকি? সে না গেলে বান্ধবীর বাপের সাধ্য আছে তাকে জোর করে নিয়ে যাবে।’

রাগে ইহানের হাত-পা রি-রি করছে। তনু মুখে এক কথা বলে অথচ মনে মনে তো তার অন্য কিছুই চলে। ইহানের এতো রাগ হচ্ছে কেন সে বুঝতে পারছে না। তনুকে সে গ্রহণ করতে পারবে না। তনু অন্য কাউরে তার জীবনে আসার অনুমতি দিলে ইহানের কেন এতো রাগ হবে?
ইহান ছাদ-বসার ঘর। বসার ঘর-ছাদে কয়েকশো বারের উপর পাক দিয়ে ফেলেছে। তনু কখন ফিরবে? আজ এত দেরি হচ্ছে কেন? তনু কি ছেলেটার প্রপোজাল একসেপ্ট করে নিয়েছে।

–‘না। তনু রিজেক্ট করে দিবে৷ আমি জানি তনু তার লাইফে অন্য কোন ছেলেকেই জায়গা দিবে না। তনু তো শুধু আমাকে… হা-হাচিই! এই হাঁচি আমার জান নিয়ে ছাড়বে। শালার হাঁচি!’

তনু খুশি মনে ব্যাগ কোলে নিয়ে হেলেদুলে দরজা দিয়ে ঢুকল। ঢুকেই ইহানের সামনে পড়ল। একটুর জন্য ধাক্কা খেতে যাচ্ছিল তনু। ইহান তনুর খুশির কারণ বুঝতে পারছে না। প্রপোজ পেয়ে এতো খুশি নাকি? রোবট গলায় ইহান জিজ্ঞেস করে,

–‘আজ এত দেরি হয়েছে কেন?’

তনুর বসার ঘরে দেয়ালের দিকে তাকায়। ঘড়ি দেখে বলে,

–‘চারটায় ছুটি হয়। এখন বাজে চারটা বিশ। হেঁটে আসতে বিশ মিনিট লেগেছে। দেরি কোথায়? প্রতিদিন তো এই সময়েই ফিরি।’

ইহানের আর কী বলার আছে? এই মেয়ের মুখ দিয়ে আজ কথার খই ফুটছে। নিজের ভেতরের অস্থিরতা তনুকে বুঝতে না দিয়ে কঠিন মুখে ইহান বলল,

–‘হেঁটে আসতে হয় কেন? রিকশা করে আসতে পারো না! মা টাকা দেয় না?’

–‘দেয়। কিন্তু মিতার সাথে এসেছি বলে হেঁটে এসেছি।’

তনু আজ স্কুলে যেতে চাচ্ছিল না। এই মিতা মেয়েটাই বাড়ি এসে তনুকে জোর করে নিয়ে গেছে। মিতার উপর রাগ হলো ইহানের।

–‘ওসব মিতা টিতার সাথে হেঁটে রঙঢঙ করে এসে শরীর খারাপ করলে পড়াশোনার ক্ষতি হবে না?’

তনুর ইচ্ছে করছে ইহানের মাথা ফাটিয়ে দেয়। খালি পড়াশোনা, পড়াশোনা। মনে মনে তনু বলল,

–‘আমার পড়াশোনা নিয়ে অত চিন্তা না করে একটু আমাকে নিয়েও তো চিন্তা করলে পারেন ইহান ভাই। আপনি যে কেন এত অবুঝ!’

মনের কথা মনেই রইল। তনু ইহানের কাছে আরও কয়েকটা ধমক খেয়ে ঘরে চলে এলো। শান্তি নেই তার। শান্তির মা মরে গেছে। অত পড়াশোনা করে কী হবে? তনু শুধু শুধুই আজকে স্কুলে যেতে ভয় পেয়েছে। ওই তুহিন রাম গরু তো বাইক চালানো শিখতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করে পা ভেঙে হাসপাতালে শুয়ে আছে। বেচারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে না, তাকে কী প্রপোজ করবে!

–‘গাধা ছেলে, বাইক চালাতে গিয়ে জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে গেছে। বেঁচে থাক গাধা। তুই মরলে অবশ্য পৃথিবী থেকে একটা গাধার সংখ্যা কমে যাবে।’

ইহানের কাছে পড়তে যাওয়ার সময় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে তনু ভাবে,

–‘এটাকে জীবন বলে? এটা জীবন! ছ্যাহ, পুরাই তেজপাতা। স্কুলে যাও, বাড়ি আসো। ইহান ভাইয়ের কাছে পড়তে যাও। বকা শোনো। আবার ঘরে এসে রাতে বই খুলে বসো। এক নিরামিষ বইয়ের চেহারা বারবার দেখতে কত ভালো লাগে? যেই বেডা এই পড়ালেখার আবিষ্কার করেছে ওইটারে হাতের কাছে পাইলে পড়াশোনা তার কোথায় দিয়ে যে দিতাম! আল্লাহ! আর ভাল্লাগে না। আমার থেকে তো আমার বইপত্রের ওজনই বেশি। বেঁচে আছিস কেন তনু? মরে গেলেই তো পারিস। এত কষ্ট আর সহ্য হয় না।’

নাকি কান্না করতে করতে তনু ধপ ধপ শব্দ তুলে সিঁড়ি ভাঙছে।

চলবে🍂
চলবে☘️

©জেরিন আক্তার নিপা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here