হৃদপূর্ণিমা পর্ব -০৭

#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ০৭ |

[
নাশিদ বিস্মিত দৃষ্টিপাত আমার দিকেই নিক্ষেপ করে আছে, যা আমি ঢের বুঝতে পেরেছি। আমি নাফিসার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আলিঙ্গন করলাম। অতঃপর নাফিসাকে বললাম,

-‘কেমন আছিস নাফু? এতদিন পর আমার বাসায় কী মনে করে?’

নাফিসাও হেসে উত্তর দেয়,
-‘ভালো আছি। এলাম, অনেকদিন দেখা হয় না তাই! ভেতরে চল, এই কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকবো নাকি?’

আমি গোমড়া মুখ করে ওর ভাইয়ের দিকে ইশারা করলাম। সাহেব তখন ফোনে ধ্যান দিয়েছে। নাফিসা আমার ইশারা বুঝতে পেরে বলে,

-‘কিছু হবে না। ভাইয়া আয়।’

নাশিদ সানগ্লাস ভেদ করে আমার দিকে আবারও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত দেয়। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে পথ থেকে সরে দাঁড়ালাম৷ কিছুটা বিব্রতবোধ লাগলেও কিছু করার নেই। মেহমান তো আরেক রহমত। তাকে কী করে দরজার সামনে থেকেই তাড়িয়ে দেই। আমার আগেই নাফিসা ওনাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় আর আমি পেছনে। নাশিদ চারপাশে গোল গোল চোখে তাকাচ্ছে, এমন ভাবে সব দেখছে যেন এখানেও চোরের সংকেত আছে। আমি মুখ বাঁকা করলাম, এই পুলিশগুলোও না। সব জায়গাতেই সন্দেহ। দরজায় নক করতেই মিনিটখানেকের মধ্যে মা দরজা খুলে দিলেন। নাফিসাকে দেখে মা তো সেই খুশি।

-‘আরে নাফিসা মা, এতদিন পর আমার কথা মনে হলো? আয় ভেতরে আয়!’

বলে আমাদের দিকে তাকালো। আমার পাশে ওনাকে দেখে মা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিপাত নাফুর দিকে নিক্ষেপ করলো এবং বললো, ‘ও কে?’

-‘আমার ছোটা ভাইয়া “নাশিদ!” আরে যে সিলেটে শিফট ছিলো!’

-‘ও হ্যাঁ চিনেছি।’

উনি সালাম দিলো। মা স্মিত হেসে সালামের উত্তর নিয়ে ওদের ভেতরে নিয়ে যায়। আমি এখনো মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে। কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না উনি আমার বাড়িতে হাসিখুশি ভাবে আসবে। আচ্ছা ওনার মনে কী একবারও আমায় নিয়ে প্রশ্ন আসেনি? সেদিন তো ওনাকে ভুল বাড়িও দেখিয়েছিলাম তাও তার মাঝে কোনরকম ভ্রুক্ষেপ দেখলাম না প্রশ্ন করা তো দূরে থাক। এই পুলিশগুলো এমন একরোখা কেন? যাক প্রশ্ন করেনি ভালোই হলো, আমারও কোনরকম অস্বস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। ভেবেই এক দীর্ঘশ্বাস ফেললাম এবং ভেতরে চলে গেলাম।

ভেতরে গিয়ে দেখি উনি তার মতোই বসে আছেন। নাফিসা মায়ের সঙ্গে ভাব-বিনিময় করছে। মা আমায় দেখতে পেয়ে বলে,

-‘রথি এসেছিস? নাফিসার সাথে গল্প কর আমি গিয়ে চা করি!’

-‘আরে না না আন্টি, ব্যস্ত হবেন না! আমরা ঠিক আছি।’ নাশিদ বললেন।

-‘না বাবা৷ প্রথমবার এসেছো চা না করলে হয়। আসছি!’ বলেই মা হাসিমুখে চলে গেলো। আমি নিশ্চুপ হয়ে নাফিসার পাশে বসলাম। নাফিসা একবার ওনার দিকে তাকালো। নাশিদ ফোন দেখছে। এটা দেখে নাফিসা আমার কানে ফিসফিস করে বললো,

-‘প্রেম কতদূর?’

আমি সজোরে নাফিসার কান টানলাম। নাফিসা হালকা চিৎকার দেয়। নাশিদ আমাদের দিকে তাকাতেই আমি নাফিসার কান ছেড়ে ভদ্র মেয়ের মতো অন্যদিকে দেখতে লাগলাম। নাশিদ রথির কান্ড দেখে মুচকি হাসি দিয়ে আবারও ফোনে মনোযোগ দিলো। আমি যখন বুঝলাম উনি আবারও ফোনে মনোযোগ দিয়েছে আমি তখন মিনমিন করে বলি,

-‘এমন চটকনা দিবো প্রেম তো দূর প্রেমের ‘প’ টাও ভুলে যাবি। তুই ভালো করেই জানিস আমি ঠাট্টা করে বলেছি আর তুই এক কথা বলে বলে কান ঝালাপালা করিস। তোর এই গম্ভীরমুখো ভাইয়ের সাথে প্রেম করার ইচ্ছে আমার একদমই নেই। সারাদিন চোরের পিছে দৌড়াবে আমায় সময় কখন দিবে?’

-‘এক্সকিউজ মি! তোমরা কী আমায় কথা বলছো?’

আমি চোখ বড় বড় করে নাশিদের দিকে তাকালাম। কিছু শুনে ফেলেনি তো? এ তো দেখছি খালভরা কুমিরের ফাঁদে পা দিয়েছি। ভুলেই গেছিলাম পুলিশদের কান একটু বেশিই খাড়া। আমি আমতা আমতা করে বললাম,

-‘দুপুরে কী খাবেন, কী খেতে পপছন্দ করেন সেটাই জিজ্ঞেস করছিলাম!’

-‘ওয়েল। কিছুই খাবো না। বাট এইটুকু বলার জন্য এমন কাঁপা-কাঁপি শুরু করলে কেন?’

আমি গালে, কপালে হাত দিতে দিতে বলি, ‘কোথায়?’
উনি তার সন্দেহের দৃষ্টি আবারও আমার দিকে দিলেন। নাফিসা এদিক দিয়ে ঠিকই মজা নিচ্ছে। ইচ্ছে করছে দুই ভাই-বোনকে উঠিয়ে এক আছাড় মারি। একজন সন্দেহ করে কনফিউশন বাড়াচ্ছে আরেকজন মজা নিচ্ছে। আমি কোনরকমে কথা কাটিয়ে সেখান থেকে চলে আসি মায়ের কাছে। মায়ের কাছে গেলে মা আবার চায়ের ট্রে ধরিয়ে কদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ধুর, কী যে হচ্ছে আমার সঙ্গে বুঝে উঠতে পারছি না। হে মাবুদ আপনার এই অসহায় বান্দাকে সাহায্য করুন, আমিন! এমন দোয়া-দরুদ পড়তে পড়তে ওদের সামনে ট্রে নিয়ে গেলাম। আবারও ওনার সেই কিলার লুক! আমি বিষম খেলাম৷ ওনার চোখের দিকে তাকাতে পারি না কেন? কী সমস্যা আমার? নাফিসাকে চা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে ঘেমে একাকার হয়ে ওনার হাতে চায়ের কাপ পেয়ালাসহ তুলে দিলাম। উনি একপলক আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

-‘তোমার মনে হচ্ছে রেস্টের প্রয়োজন। একবার কাঁপছো তো একবার ঘামছো? আর ইউ ওকে?’

আমি চট করে দাঁড়ালাম। আসলেই তো এমন কেন করছি আমি? নাহ স্বাভাবিক হতে হবে। কান্ট্রোল ইওরসেল্ফ রথি, তুই একজন টিচার। এতো এতো বাচ্চাকে হ্যান্ডেল করিস আর সামান্য এই ব্যাপারকে কান্ট্রোল করতে পারিস না? রিলেক্স!

বলতে বলতেই আবারও নাফিসার পাশে বসলো। নাফিসা চা খেতে খেতে পোগ্রামের কথা জানালো। আমার প্রথমে আনন্দ হলেও পরে ড্রেসআপের কথা শুনে কিছুটা বিব্রত হলাম। আমি মৃদু সুরে বলে উঠলাম,

-‘ড্রেস কোড কী ব্লু?’

-‘হ্যাঁ। তুই চাইলে আমিই করিয়ে দিবো তোর জন্য!’

নাশিদ চুপচাপ রথির ভাব-ভঙ্গি লক্ষ করছে। এই মুখশ্রী তার কাছে রহস্যের ভান্ডার মনে হয়। মুখশ্রীর অঙ্গ-ভঙ্গি, ভ্রু কুচকানো, ঠোঁট প্রসারিত করা, হুট করে হেসে ওঠা সবটা।

-‘না নাফু। সামনের মাসের বেতন পেলেই কিনবো। আমি ওতটাও অভাবী নই। আমি একজন টিচার। এটাই আমার জন্য অধিক সম্মানের। যাইহোক বাদ দে তারপর বল…’

এরকম নানান আলোচনা করতে লাগলাম। রথির টিচার নিয়ে বক্তব্য শুনে নাশিদ তার ঠোঁটজোড়া কিঞ্চিৎ প্রসারিত করলো। চা খেয়েই ওরা বেরিয়ে গেলো। মা এতো করে বললো দুপুরের খাবার খেয়ে যেতে কিন্তু পুলিশম্যানের নাকি জরুরি কাজ আছে, থানায় যেতে হবে। নাফিসাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েই উনি থানায় আসবেন, এমনই বললো। আমি দূর থেকে চুপচাপ ওনাকে দেখলাম। উনি চলে কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলতে বলতেই যাচ্ছেন। আমিও ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণের মাঝে ঘুমিয়েও পরলাম।

এভাবেই চলমান মাসের সমাপ্তি ঘটে নতুন মাসের সূর্যদয় ঘটলো। নতুন মাস মানেই মাইনে পাওয়া। এই অনুভূতিটা আমার প্রকাশ করার মতো নয়। তারিক স্যার হাতে টাকাগুলো বিনয়ের সাথে দিতেই আমি মিনিটখানেক এই টাকাগুলোর দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। এই টাকাগুলোর জন্য আমার ৩০টা দিন সংগ্রাম করতে হয়েছে, ৩০টা দিন!! সবশেষে পরিশ্রমের ফল পেতে কতই বা প্রশান্তি অনুভূত হয়! টাকাগুলো নিয়ে সর্বপ্রথম মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। গতমাসে ধার-দেনা শোধ করার কারণে আলাদা করে কেনা-কাটা করা হয়নি। মার্কেটে যাওয়ার আগে ট্রেইলারে ঢুকলাম।
আমাদের আশেপাশে ভালো দর্জি নেই তাই ট্রেইলারই ভরসা। আমি আমার জামার মাপ তাকে বলতেই জিজ্ঞেস করলাম আমার কতো গজ লাগবে? যেহেতু একটু লং করেই বানাবো। উনি কাপড়ের গজ বলতেই দাম জিজ্ঞেস করলাম। উনি দাম বেশি বলাতে আমাদের মাঝে মিনিটখানেক কথা কাটাকাটি হলো।
একসময় লোকটি বিরক্তি নিয়ে বলে,

-‘এতোই যখন কাপটামি করবেন তাহলে এখানে আসছেন কেন? যত্তোসব ফকিন্নির দল। কই থেকে আসে, শিক্ষা-দিক্ষা নাই!’

-‘মুখ সামলে কথা বলুন। আমি রাস্তার কোনো ভিখারী নই একজন শিক্ষক। আপনার ব্যবহারেই বোঝা সে প্রকৃত শিক্ষা। আর যাই হোক আপনার মতো এই ধরণের ভিখারীর কাছে আমি কখনো আমার জামার কাজ দিবো না!’

-‘কী বললেন আমি ভিখারী?’

দরজা দিয়ে বের হতে হতে বললাম,

-‘ব্যবহার অনুযায়ী আপনি একজন ভিখারী, ধনদৌলতের দিক দিয়ে নয়!’

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here