#হৃদপূর্ণিমা
লাবিবা_ওয়াহিদ
| পর্ব ২২ |
-‘গতকাল রাতে কোথাও গিয়েছিলে নাশিদ?’
মনিকার দিকে না তাকিয়েই খেতে খেতে নাশিদ বললো,
-‘থানায় গেছিলাম। কেন মা, আজ নতুন নাকি?’
মনিকা থতমত খেয়ে গেলো নাশিদের এরূপ ব্যবহারে। ইদানীং আগের মতো ঠিকভাবে কথা বলে না। ব্যবহারটাও কেমন পাল্টে গেছে। ইদানীং ‘আপনি’ বলেও সম্বোধন করছে তাকে। অর্পি নাশিদকে টাচ করতে গেলে নাশিদ প্লেট নিয়েই উঠে দাঁড়ায় এবং লিভিংরুমে যেতে যেতে বলে,
-‘ঢোলাঢোলির জন্য ক্লাবে যাও, এটা খাবারের টেবিল। আর আমিও তোমার সো কল্ড প্লে বয় নই যে তোমার ইশারায় সাড়া দিবো!’
নেওয়াজ নাশিদকে পিছুডাক দেয় কিন্তু নাশিদ শুনলো না। নেওয়াজ অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা চোখ রাঙিয়ে মনিকার দিকে তাকালো। মনিকার চাল যে সে ধরতে পারেনি এমনটি নয়! বাবা মনিকাকে দাঁতে দাঁত চেপে আস্তে করে বললো,
-‘ছেলেটাকে কী খেতেও দিবে না শান্তিমতো?’
মনিকা কিছু বললো না, চুপ করে রইলো। নেওয়াজ আর বাবা কোনরকম খেয়েই চলে গেলো। নেওয়াজও যাওয়ার আগে মায়ের সাথে কথা বলেনি। ভাবী খাওয়া শেষ করে নাফিসাকে নিয়ে উঠে গেলো। কিছুক্ষণের মাঝে নাশিদ প্লেট নিয়ে কিচেনে চলে গেলো। সেখানে হাত ধুঁয়ে টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে সিঁড়ির সামনে গেলো এবং নাফিসার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বললো,
-‘ভার্সিটি কী আমি তোকে ড্রপ করে দিয়ে আসবো?’
-‘না ভাইয়া। আমার যেতে লেট হবে!’
নাশিদ আর কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো। মনিকা বা অর্পিতার দিকে ফিরেও তাকালো না। রথি অনেক আগেই কোচিং সেন্টারে চলে গেছে। অর্পিতা নাশিদের যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরিয়ে মনিকার দিকে তাকালো।
-‘এরকম কেন হচ্ছে ফুপ্পি? তোমার ছেলে আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না!’
-‘সব ঠিক হয়ে যাবে। ধৈর্য ধর!’
অর্পিতা কিছু বললো না।
রেগে বোম হয়ে চলে গেলো।
রথি রিকশার জন্য কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে খানিক চিন্তিত। আজ ফাহাদ স্যারের ঘেঁষাঘেঁষিটা বিরক্তিকর ছিলো। তার ঘোরলাগা দৃষ্টিও রথির বুঝতে সময় লাগেনি। তার উপর গতকাল রাতের এমন আকস্মিক বিয়ে। রথির তো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, সে বিবাহিত, মিসেস নাশিদ। রথির ভাবনার মাঝেই কোথা থেকে নাশিদের গাড়ি এসে থামলো। রথি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। নাশিদ সানগ্লাস খুলে রথির দিকে তাকিয়ে বলে,
-‘গুড আফটারনুন বউ!’
নাশিদের মুখে ‘বউ’ শুনে রথির ভেতরটা শীতল হাওয়ায় ছেয়ে গেলো। এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভব হচ্ছে তার। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে রথি বলে উঠলো,
-‘আপনি এখানে?’
-‘হু। আমি!’
-‘আমার কোচিং সেন্টারের এড্রেস কই পেলেন?’
নাশিদ গাড়ি থেকে নেমে রথির বরাবর দাঁড়িয়ে বললো,
-‘মাথা কী গেছে তোমার? এর আগেও তো এখানে তোমার সাথে মিট করেছি, মনে নেই?’
বলেই নাশিদ মাথা নিচু করে রথির দিকে ঝুকতেই রথি পূর্বের ন্যায় দুই পা পিছিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। রথির এরূপ রিয়েকশনে নাশিদ হেসে উঠলো।
-‘কী মনে পরেছে?’
রথি জোরে জোরে মাথা নাড়ায়। ঠিক এভাবেই! গত দেড় মাস আগে ঠিক এভাবেই নাশিদ তার উপর অদ্ভুত কারণে রাগাম্বিত হয়ে এভাবে ঝুকেছিলো। তবে আজ নাশিদ রেগে নেই, তার আজ পাগল করা হাসি।
-‘তাহলে যাওয়া যাক?’
-‘আপনার সঙ্গে যাবো না আমি!’
-‘ওরে বাচ্চাটাহ! এতো অভিযোগ, অভিমান কেন? তোমায় কী গুতা দিয়েছি?’ নাশিদ বাচ্চা বাচ্চা ফেস করে বললো! নাশিদের এমন বাচ্চামো দেখে রথির চোখ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এ কোন রূপ দেখাচ্ছে নাশিদ?
-‘কী হলো চুপ কেন? কই ভাবলাম তোমার সাথে লাঞ্চ করবো! কিন্তু তুমি তো আমার সাথে যেতেই চাও না। ঠিক আছে আমি লাঞ্চ না করেই থানায় চলে যাচ্ছি!’
-‘উফফ, এমন করেন কেন? উঠছি তো গাড়িতে!’
নাশিদ বাঁকা হাসলো। রথি গিয়ে দরজা খুলে উঠে বসলো। নাশিদ এর মাঝে কোথায় যেন গেলো। রথি এদিক সেদিক খুঁজতে গিয়েই তার পাশের ডোর খুললো নাশিদ। হাতে তার দুটো সান চিপসের প্যাকেট। নাশিদ মুখে হাসি নিয়ে বলে,
-‘বাসরে নাকি বউদের উপহার দিতে হয়। কিন্তু আমার তো বাসর হয়নি, তাই বাসরে না দিয়ে এখানে দিলাম। নেও তোমার উইদাউট বাসর গিফট!’
বলেই রথির কোলে চিপসের প্যাকেট ছুঁড়ে মেরে দরজা লাগিয়ে দিলো। আর রথি সেখানেই বেক্কলের মতো বসে রইলো৷ নাশিদ ড্রাইভিং সিটে উঠে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। রথি চিপসের প্যাকেট উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বলে,
-‘আচ্ছা ছেলেরা কী এভাবেই বিয়ের পর গিরগিটির মতো রূপ বদলায়?’
নাশিদ স্টেয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বাঁকা হেসে বলে,
-‘সব ছেলের কথা তো জানি না তবে আমার হৃদপূর্ণিমার খুশির জন্য এই নাশিদ তার সর্বোচ্চ করতে রাজি, তবে লিমিট বজায় রেখে। তোমার ছেলেমানুষি আবদার করলে ঠিকই বকা খাবা!’
-‘ছেলেমানুষি আবদার মানে?’
-‘যেগুলা করা ঠিক না, আমার লিমিটের বাইরে!’
রথি ভেংচি কেটে বাইরের দিকে তাকালো। নাশিদ নিঃশব্দে হেসে ড্রাইভিং-এ মনোযোগ দিলো। একটা রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে ওরা বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। রাস্তাতেই নাশিদ এমন একটা প্রশ্ন করলো যা রথিকে বিষম খাইয়ে দিলো।
-‘মা তোমায় কিছু বলেছে রথি?’
রথি বিষম খায় এবং নাশিদের দিকে তাকায়। কিন্তু নাশিদের কোনোরকম পতিক্রিয়া নেই! রথি আমতা আমতা করে বললো,
-‘মা..মানে?’
-‘মানে টা তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালো জানো! যা জিজ্ঞেস করেছি বলো, এমন চুপ করে লুকিয়ে লাভ নেই!’
রথি প্রথমে অস্বীকার করলো। পরমুহূর্তে নাশিদের কঠোর দৃষ্টিতে ঘাবড়ে বলতে বাধ্য হলো। রথি মাথা নিচু করে চিপসের প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠলো,
-‘সেদিন আমি একা ঘরে ছিলাম, আন্টি আমার ঘরে এসে আমায় উল্টো পাল্টা কথা বলেছে। আমার কোনোরকম অধিকার নেই এই বাড়িতে থাকার। আমি থাকলে আপনি আমার প্রতি দুর্বল হবেন, অতঃপর আমার মতোন সমাজছাড়া মেয়ের সাথে সে আপনাকে কিছুতেই সহ্য করবে না। আমায় বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে! তাই….’
-‘তাই তুমি আমায় বিয়ে করে আমার বউয়ের পরিচয়ে থাকতে চেয়েছিলে। আমার বিয়ের জন্য চাপ দিয়েছো তাইতো?’
রথি মাথা নাড়ায়। সে আবারও বলেছে,
-‘আমি আলাদা বাসা খোঁজাও শুরু করেছিলাম। মা তো আর আমার মুখও দেখবেন না বলেছিলেন তাই আলাদা বাসা দেখা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। আর আপনি তো… মাঝেমধ্যে মনে হতো আপনি দায়িত্ব মনে করে আপনার কাছে রেখেছেন, দায়িত্ব শেষ হলে হয়তো আপনার সাথে আমারও কোনো সম্পর্ক থাকবে ন…’
রথি আর কিছু বলার আগেই নাশিদ বেশ জোরে ব্রেক কষে। রথি ভয় পেয়ে নাশিদের দিকে তাকালো। নাসজিদের চোখ-মুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। রথি অনেকটা ভয় পেয়ে যায়। নাশিদ কয়েক সেকেন্ড রাগে ফোঁসফোঁস করে রথির দিকে তাকিয়ে রথির মুখ চেপে বাজখাঁই গলায় বলে উঠলো,
-‘তোর কী আমার ভালোবাসা ঠুনকো মনে হয়? কাল থেকে আমার ভালোবাসার দিকে আঙ্গুল তুলছিস! কেউ ভালোবাসি না বললেই সে ভালোবাসে না? আর এদিকে যে তোর জন্য আমি নিঃস্বার্থে সব করে গেলাম? তোকে সময় দিয়েছি, ইঙ্গিতেও বুঝিয়েছি। তুই এতোটাও বাচ্চা না যে আমার কথা, টাইম স্পেন্ড করার মানে বুঝবি না! তুই যদি এতোই বুঝ হতি বারবার এভাবে আমায় আঘাত করতি না, আমায় চলে যাওয়ার কথাও বলতি না। তুই এখন বিবাহিত! এই নাশিদের বউ তুই! তোরে যেমন ভালোবাসতে পারবো তেমনই কষ্ট দিতে পারবো। তুই ওই মহিলার কথা শুনতে যাবি কেন? আমি বলসি, ওই মহিলার কথা শুনতে? ওই মহিলা কতোটুকু জানে আমার ভালোবাসা সম্পর্কে? লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি রথি, আমার ভালোবাসাকে খারাপ দিকে ইঙ্গিত করলে আমি যে তোকে কী করবো তা আল্লাহ’র চেয়ে ভালো কেউ জানে না। তিন কবুলে তোকে বিয়ে করেছি মনে রাখিস!’
বলেই নাশিদ রথিকে ছেড়ে নিজের সিটে গিয়ে বসলো। নাশিদ যথাসম্ভব চেষ্টা করতে লাগলো নিজের রাগকে সংগত করার। নাশিদ সরে যেতেই রথির চোখ বেয়ে টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। তার বৃষ্টি স্তব্ধ, বিমূঢ়! নাশিদ চোখ বুজে কয়েকবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
সারা রাস্তায় আর দুজনের মধ্যে কথা হলো না। রথিকে বাসায় পৌঁছে দিয়েই রথিকে কিছু না বলেই গাড়ি টান দিয়ে নাশিদ আবার থানাতে চলে যায়। রথি মন খারাপ করে ভেতরে চলে গেলো। এভাবে দুইদিন কেটে গেলো নাশিদ রথির সঙ্গে কথা বলে না। ভুল করেও রথি নাশিদের সামনে পরলে নাশিদ নিখুঁতভাবে তাকে এড়িয়ে চলে। এখন রথিকে নাশিদ একা ছাড়ে না। ড্রাউভার দিয়ে কোচিং পৌঁছে দেয় আবার ড্রাইভারের মাধ্যমে নিয়ে আসে। কিন্তু নাশিদ ভুল করেও রথিকে পিক করে না। রথির ইচ্ছে করছে সবকিছু তছনছ করে দিতে। নাশিদের এমন ইগনোরেন্স সে নিতে পারছে না।
সে মানছে সে ভুল করেছে, তাই সে রেগে আছে। এর জন্য তাকে মারুক, বকুক। তাই বলে কথা কেন বন্ধ করবে? নাশিদের এই ইগনোরেন্স তার বুকে ছুঁড়ি দ্বারা বারংবার ক্ষত-বিক্ষত করছে তা কী নাশিদ বুঝে না?
গত দুই রাতের মতোই আজও রথি বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করছে নাশিদের জন্য। নাশিদ আজ এখনও ফিরেনি। এখন নাশিদকে না দেখলে তার ঘুম আসে না, আসে না অবস্থা। দেরী করে ফিরছে, এজন্য তার চিন্তার শেষ নেই। আচ্ছা বিয়ে হলে কী সকল মেয়েরাই এমন হয়ে যায়? আগেও তো নাশিদ দেরীতে ফিরেছে, রথির ঘুমিয়ে পরার পরে এসেছে। কিন্তু এখন? নাশিদের জন্য কতোটা উদ্বীগ্ন হয়ে আছে। বিয়ের নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাদের ভালোবাসা আরও গাঢ়তে রূপ নিয়েছে! অপেক্ষা করার মাঝেও আলাদা সুপ্ত অনুভূতি রয়েছে। রথির ভাবনার মাঝেই সে গাড়ির শব্দ পেলো। মুহূর্তেই তার মুখমন্ডলে খুশির আলোড়ন তৈরি হলো। রথি চোখ মুছে মাথায় সুন্দর করে ঘোমটা দিয়ে ভেতরে আসলো। নাফিসা ঘুমোচ্ছে। রথি মুখে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সিঁড়ির কাছে নাশিদকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে রথি সেখানেই থমকে গেলো।
~চলবে।