ডায়েরি পর্ব ৭

#ডায়েরি_পর্ব_৭

জান্নাতুল জান্নাত

চোখটা ঝাপসা হয়ে আসলো৷ ডায়েরিটা বন্ধ করে চোখ কচলে দৃষ্টি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম৷ জীবনে কত পাপ করেছিলাম যার জন্য ভাগ্যদেবতা আমার ভাগ্যটা এমন করেছেন? এ কেমন জীবন আমায় দিলেন? এতো পূজো অর্চনা, এতো ভক্তি সব কোথায় গেলো? বাবার ঘরে তো ভালোই ছিলাম৷ স্বামীর ঘরে এসে এ কি হাল হলো? কি এমন পাপ করেছি মনে তো কিছু পড়ছে না৷ আর কোনভাবে কি আমায় শাস্তি দেয়া যেতো না? জীবনের সবটা কেড়ে নিয়ে শাস্তি দিতে হলো? কিছুতেই চোখের পানিকে আজ আটকাতে পারছি না৷ খুব কান্না পাচ্ছে৷ ডায়েরি কুঠুরিতে রেখে হাওমাউ করে কেঁদে ফেললাম৷ মনে হচ্ছে দশবছরের কান্না আজ একসাথে বৃষ্টি হয়ে ঝড়ছে৷ বহুবার থামানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু পারছি না৷ ছুটে গোসলখানায় ঢুকে ঝর্না ছেড়ে দিলাম৷ ঝর্নার পানি আমার চোখের পানির সাথে মিশে আজ একাকার হয়ে যাক৷ কতক্ষণ ওভাবে ছিলাম বলতে পারি না৷ একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে ছিলাম তখন৷ চক্রাকারে দশবছরের সব ছবিগুলো চোখে ভাসছিলো৷ আমি যত চাইছি দেখবো না ততই ভেসে উঠছে৷ কাট ক্যামেরা এ্যাকশন শব্দগুলো মাথার মধ্যে কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে৷ ঘোর ভাঙলো কাজের লোকের ডাকে৷
-ম্যাডাম আপনার ফোন বাজতাছে৷ অনেকক্ষণ ধইরা বাজতাছে৷
-তুমি যাও আমি আসছি৷
কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে দেখি ১৫টা মিসড কল৷ সবগুলো অঞ্জনদার৷ যদিও বুঝতে পারছি এখন কি বলবে তারপরও ফোন দিতে হবে৷ কল ব্যাক করলাম৷ অনেকক্ষণ ঝাড়লেন আমায়, আমি শুধু বললাম আসছি৷

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরুলাম৷ যেতে যেতে ভাবছি আজ যে অনেক দেরি হয়েছে৷ কি হতে পারে এর পরিণাম৷ স্পটের কাছাকাছি যেতেই আবার অঞ্জনদার ফোন৷ অন্য ঠিকানায় যেতে বললেন৷ আমার ঠোটের কোণে ঈষৎ হাসি৷ এই ঠিকানা বদলের কাহিনী তো আমার দশ বছর ধরে জানা৷ তাহলে আজ অন্য কাজেই যাচ্ছি৷ তাই বুঝি এতো তাড়া দাদার৷ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ড্রাইভারকে অন্য ঠিকানাটা বললাম৷

বাসায় ফিরলাম রাত দশটায়৷ স্নান করতে যাওয়ার আগে বুয়াকে বললাম কড়া চা ফ্লাক্সে করে টেবিলে রাখতে৷ স্নান সেরে স্ট্যাডি রুমে যাওয়ার সময় তনিমা এলো কথা বলতে৷ কথা না বলে এড়িয়ে গেলাম৷ আজ তাড়াতাড়ি ফেরাতে অনিতা অর্ণবও ছুটে এলো আমাকে ধরতে কিন্তু আমি যে অপবিত্র৷ ওরা আমায় ছুঁলে ওরাও অপবিত্র হয়ে যাবে৷ তড়িঘড়ি করে ফ্লাক্সটা নিয়ে স্ট্যাডিরুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম৷ বাহির থেকে ওরা ডাকতেই বললাম “আমি ব্যস্ত আছি আমাকে বিরক্ত করো না৷”
কুঠুরি থেকে ডায়েরি বের করে টেবিলে বসলাম৷

৫ই আগস্ট ২০১৫ রাত ১০টা ৩০ মিনিট

পরিপাটি পোশাক পড়ে ভদ্র সভ্য রমনীর মতো বেরুলাম বাসা থেকে৷ ফিরলামও পরিপাটি হয়ে কিন্তু কেউ কি জানে এর মাঝের সময়টা কতোটা অগোছালো হয়েছিলাম আমি? প্রতিদিন যে আমি শ্যুটিংএ বের হই আসলে প্রতিদিনই কি আমার শ্যুটিং থাকে? এমন কোন অভিনয় শিল্পী আছে যে ছুটি পায়না? কিন্তু আমি পাই না কারণ আমি শুধুমাত্র অভিনয় শিল্পী নই আমি যে অঞ্জনদা আর তার বিশেষ কিছু অতিথির নিয়মিত মনোরঞ্জন করি৷ শ্যুটিং ছাড়া সিডিউলগুলো আমার এ কাজেই যায়৷ এজন্যই তো বলেছিলাম আমি পতিতা৷ আমি চাইলেও বাঁধা দিতে পারি না৷ চুক্তির শৃঙ্খলে আমার দু’হাত বেঁধে রেখেছে এরা৷ আমার কন্ঠনালী আটকে রেখেছে যাতে আমি চিৎকার করতে না পারি৷ পরতের পর পরত মেকআপে আমাকে চেহারার কাঠিন্যত্ব ঢেকে দেয়৷ মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে উম্মুক্ত করি নিজেকে প্রতিদিন অন্যে পুরুষের সামনে৷

আমার এ শরীরটা বিছানার চাদরের মতো হয়ে গেছে৷ যখন যে চায় তাকে বিছিয়ে দেই৷ নোংরা হই আবার ধুয়ে শুকিয়ে পরিপাটি করি নিজেকে অন্য কারো জন্য৷ এগুলো কিন্তু আমার স্বামীর অজানা নয়৷ আচ্ছা আমার শিবপূজোতে কি কোন ত্রুটি ছিলো কখনো? আমি কেন একজন পুরুষ পেলাম না? কেন পুরুষ হয়েও তার আচরণ তৃতীয় লিঙ্গের মতো? কোন স্বামী কি করে স্ত্রীর এ অপমান সহ্য করে?

শারিরীকভাবে দেখতে পুরুষ হলেই কি সে পুরুষ হতে পারে? পারে না৷ পুরুষ হয়ে জম্মানো সহজ কিন্তু স্বামী হয়ে স্ত্রীর সম্মান রক্ষার দায়, বাবা হয়ে ছেলে মেয়ের দায় ঘাড়ে নিয়ে বহন করতে শক্ত দু’টি কাধের প্রয়োজন৷ সে কাধ সবার নেই৷ বাবা আমাকে একজন কাধশূন্য মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন৷ ইনি আমার দায়িত্ব ঘাড়ে আসতেই আমাকে অন্যের সাথে ভাগ করে নিয়েছেন যাতে তার উপর ভারটা কম পড়ে৷ বাবা একজন গরীব লোকের হাতে আমাকে দিতে প্রাচুর্য থাকতো না কিন্তু সুখ তো থাকতো৷ সম্মান নিয়ে তো বাঁচতে পারতাম৷ সবার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারতাম৷ বাবা আমি যখন আয়নার সামনে দাঁড়াই নিজের দিকে তাকাতে লজ্জা করে৷ একটা কুৎসিত চেহারা আমার সামনে ভেসে উঠে৷ নরকের কীট মনে হয় নিজেকে৷ আমার শরীর থেকেও মনে হয় দূর্গন্ধ আসে৷ কেন এতো পঁচন আমার শরীরে?

আচ্ছা এদের ঘরে কি স্ত্রী নেই? কেন আসে এরা আমার কাছে? কি আছে এই সাড়ে তিন হাত শরীরে? একদিন তো বিলীন হয়ে যাবে সব৷ চিতার আগুণে দাউদাউ করবে জ্বলবে এ সুন্দর শরীর৷ পুরুষেরা নারী দেহে কি খুঁজে পায়? কিসের নেশায় তারা এতো মাতোয়ারা হয়? দু’টি মাংসপিন্ড ছাড়া আর কি আছে এ শরীরে? কি এতো খোঁজে এই পোড়া শরীরে? কি এমন আলাদা আছে আমার শরীরে যা তার স্ত্রীর কাছে নেই? সব নারীই তো এক৷ মা তুমি তো নারী আকৃতির৷ তুমি তো প্রকৃতি৷ তুমিও কি আমার অসহায়ত্ব বুঝতে পারো না? কেন আমরা শুধু ভোগের বস্তু হবো? যে হাত তোমার পায়ে ফুল দেয় সে হাত কি করে আমার গায়ের আবরণ খোলে? মা দোষ নিওনা একটা প্রশ্ন করি৷ যখন তোমার মূর্তি গড়া হয় এই মাংসপিন্ড দু’খানা তো তোমার শরীরেও দেয়া হয় তখনও কি এই পুরুষ নামের পশুদের মনে কামনা জাগে? যে হাতে মায়ের শরীর কাপড় দিয়ে ঢাকে সেই হাতই আমার শরীরের খাজে খাজে কি অন্বেষণ করে বেড়ায় প্রতি মূহুর্তে? মা একবার ওদের বলো না সব নারী এক৷ আমার শরীরে আলাদা কিছু নেই৷ আর কতো খুঁজবে বলো? সারা শরীরে কয়েকবার চিরুনী অভিযান তো এরা করে ফেলেছে৷ মা গো আমি যে বড্ড ক্লান্ত৷ ওদের বলো দশ বছরে তো অনেক দেখলো এবার আমায় যেনো মুক্তি দেয়৷ আর তো পারি না৷ নয়তো মা তুমি আমায় উঠিয়ে নাও৷ আর কতদিন বলো এমন করে বাঁচবো? এভাবে কি বাঁচা যায়? মাগো শত্রুরও যেনো এতো কঠিন জীবন না হয়৷

মা গো এরা তোমাকে বলে দূর্গতিনাশিনী অথচ আমাকে বলে অবলা৷ এরা তোমার পায়ে পূজো দেয় অথচ আমার বুকে মুখে চলে ওদের পায়ের আনাগোনা৷ এরা তোমাকে আবৃত করে তোমার পায়ের নিচে অসুরকে বসায় অথচ আমার উপর সিংহের মতো হামলে পড়ে৷ সিংহ তোমার বাহন অথচ এ রুপেই ওরা আমাকে করে নিরাভরণ৷ এরা এক হাতে পূজো করে আর অন্য হাতে করে নারী লীলা৷

কেন বলবো তোমাকে আমি এতো কথা? তুমি কি শুধু পাথর নাকি দেবতা? সব তো বোঝো৷ তবে আমার নিস্তার করো৷ এই পাপী দেহ আর বহন করতে পারছি না৷ আমাকে মুক্তি দাও৷ মা গো তুলে নাও তোমার কোলে৷ প্রতিদিন আমি একটু একটু করে মরছি৷ এভাবে শুধু শরীরটাকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছি আর আমার স্বামী যিনি কিনা আমার সবকিছুর রক্ষক তিনি সুখ অন্বেষণ করে অন্য কারো শরীরে৷

কি লিখবো? কাকে অভিযোগ করবো? কে আছে আমার কথা শোনার জন্য? এই দূর্গম পাথর ভেদ করে আমার কান্না হয়তো দূর্গা মায়ের কাছেও পৌঁছায় না৷ তার কি দোষ? তিনিই বা কেন একটা নষ্টা মেয়ের দীর্ঘশ্বাস শুনবেন৷ সবাই যদি আমাকে ঘৃণা করে সরিয়ে দেয় তিনি কেন আমাকে কাছে টানবেন? না মা তুমি ঠিকই আছো৷ আসলে আমিই মাঝে মাঝে ভুলে যাই আমার স্থানটা৷

চায়ের সাথে ঔষধ মিশিয়েছিলাম৷ এতোক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে৷ তবুও খেয়ে শুয়ে পড়লাম৷ নিদ্রাদেবীও তো আমাকে পর ভেবে আমার কাছে আসে না তাই ঔষধ হচ্ছে নিদ্রাদেবীকে কাছে আনার মন্ত্র৷ সে মন্ত্র চায়ের সাথে মিশিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ এখন নিশ্চয়ই তিনি আমার চোখের উপর বসবেন৷
চলবে……

#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here