ডায়েরি পর্ব ৬

#ডায়েরি_পর্ব_৬

জান্নাতুল জান্নাত

সারারাত মেয়েটা আমার কোলে ঘুমালো৷ আমিও উপায় না পেয়ে পিছনে বালিশ দিয়ে হেলান দিয়ে বসে বসে ভাবছি
” কোথাও কি কোন সমস্যা আছে? ও বলছে ও ওর বাবার মতো কিন্তু আদৌ তপুর সাথে কোন মিল দেখছি না৷ তপুর ইচ্ছে ছিলো ওর মেয়ের নাম তনিমা হবে, হয়েছেও তাই৷ তাছাড়া এ মেয়ে অবশ্যই আমাদের সম্পর্কের আগে জম্ম নেয়া৷ তা না হলে তো মেয়েটা এতো বড় হতো না৷ তপু আমার থেকে বিষয়টা লুকিয়েছে৷ মেয়েটা আবার মিথ্যে বলছে নাতো? হয়তো আমাকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে কিন্তু আমাকে বিভ্রান্ত করে ওর লাভ কি? ও তো নিশ্চয়ই আমার আর ওর বাবার সম্পর্কের বিষয়ে কিছু জানে না৷ তপুকে জিজ্ঞেস করবো দশ বছর আগে কি ঘটেছিলো? কিন্তু কি লাভ হবে জেনে? ফিরে কি আসবে দশ বছর আগের দিনগুলো? দশটা বছর আমার জীবনকে সম্পূর্ণ উলট পালট করে দিলো৷ হাজার চাইলেও আর আগের দিনগুলো ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়৷ আমি চেয়েছিলাম তনিমার বায়োলজিক্যাল মা হতে৷ ভগবান আমায় সে সুযোগ দেননি কিন্তু তনিমার মামনি তো হয়েছি৷ বেশি লোভের দরকার নেই৷ যদি এই মামনি ডাকটুকু হারিয়ে ফেলি? কি দরকার অতীত ঘাটার? অতীত ঘাটা মানেই তো জঞ্জাল ঘাটা, মনে অশান্তি আনা৷”
একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঘুমানোর চেষ্টা করছি৷

“মামনি জানি আমার এ কথা তোমার মনে আজ হাজারো প্রশ্নের উদয় করেছে৷ যে প্রশ্নের উত্তর তুমি পাচ্ছো না আবার কাউকে জিজ্ঞেস করতেও পারছো না৷ জানো তো মামনি মানুষের সামনে এমন কিছু পরিস্থিতি আসে মানুষ চাইলেও এড়াতে পারে না৷ আমি জানি এরকম প্রশ্ন যখন মনে জাগে যার কোন উত্তর নেই তখন কেমন অনুভব হয়৷ কিন্তু এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়ার সময় তোমার এখনও হয়নি৷ জানোতো মামনি সময় সবচেয়ে বড় প্রশিক্ষক৷ সময় তোমাকে এমন সব কঠিন বিষয় শিখিয়ে দিবে যা তুমি কখনো কল্পনাও করোনি৷ সময় হোক তোমার সকল প্রশ্নের উত্তর মিলবে৷ কে আমি? কে তপু আর কে তৃপ্তি? সব জানতে পারবে তুমি৷ কিছুদিন ধৈর্য ধরো৷ দশটা বছর তো না জেনেই আছো৷ আরো না হয় কিছুদিন থাকো৷”

সকালে আমার ঘুম ভাঙলো আটটায়৷ তনিমা কখন উঠে গিয়ে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে টের পাইনি৷ টেবিলের উপর ফুল প্রসাদ রাখা৷ অনিতা আর অর্ণব এতোক্ষণে স্কুলে চলে গেছে৷ তনিমাও হয়তো তৈরি হচ্ছে৷ ফ্রেশ হতে যাবো এর মধ্যে অঞ্জনদার ফোন৷ শ্যুটিং ন’টার বদলে এগারোটায় হবে৷ বেশ ভালো হলো গতরাতে ডায়েরি লিখতে পারিনি এখন লিখা যাবে৷ অনিতাকে কিছু একটা লিখছিলাম৷ স্নান আর খাওয়া সেরে লিখতে বসবো৷ স্নান সেরে খেতে বসে দেখি তনিমা আমার খাবার প্লেটে বেড়ে ঢেকে রেখেছে৷ সামনে ফ্লাক্সে কফি৷ নাস্তা সেরে কফি নিয়ে স্ট্যাডি রুমে গেলাম৷

৫ই আগস্ট ২০১৫, সকাল ৮.৫০
জানিস তোর জন্য একটা লকেট এনেছি৷ সোনার নৌকা আকৃতির৷ অবাক হচ্ছিস তাই না? এটা আবার কেমন লকেট? বুঝবি যখন সময় হবে তখন বুঝবি তোকে কেন এটা দিয়েছি৷ এর ভিতরটা ফাঁপা৷ তোর ইচ্ছে হলে এতে গোপন কিছু রাখতে পারবি৷ এটাও কুঠুরিতে রেখে দিবো৷ এক্ষুণি কিন্তু এটা তোকে দিচ্ছি না৷ তোর দশম জম্মদিনে দিবো৷ বলতে পারিস এতো আগে কেন আনলাম? ইচ্ছে হলো তাই৷ মানুষ তো বলতে পারে না কখন কি পরিস্থিতিতে পড়ে৷ পরে যদি আর বানাতে না পারি তাই আগেই বানিয়ে রেখেছি৷ এটা মনে হয় তোকে দেয়া আমার সবচেয়ে ছোট্ট উপহার৷ তবুও আমি এটা দিবো৷ এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেককিছু৷ তুই এখন বুঝবি না৷ জানিনা দুই বছর পরেও বুঝতে পারবি কিনা৷

তুই অনেক ছোট তবুও তোকে আজ এসব বলছি কারণ তুই যখন এটা পড়বি তখন হয়তো বড় হবি আর সব কিছু বুঝতে শিখে যাবি৷ এছাড়া আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক অল্পবয়সেই সবকিছু বুঝতে শিখে যায়৷ তোর বাবার সাথে বিয়েটা আমার ইচ্ছেতে হয়নি আবার অনিচ্ছাতেও বলা যায় না৷ ফিফটি ফিফটি যাকে বলে৷ বিয়ের পরে আমার অভিনয় জগতে আসা৷ আমার এ জগতে আসাটা মোটেও স্বাভাবিক নয়৷ বরং বেশি অস্বাভাবিক৷ আমি কখনোই সাংস্কৃতিকমনা ছিলাম না৷ নাচ গান আবৃত্তি কিচ্ছু আমি করতাম না৷ তবে বই পড়তাম৷ পড়তে খুব ভালোবাসতাম আর গান শুনতে খুব ভালো লাগতো৷ স্কুল আর কলেজ লাইব্রেরির প্রায় সব বইই আমার পড়া ছিলো৷ তবে বাবা কোনদিন বই কিনে দিতেন না৷

যাই হোক অঞ্জনদা তোর বাবার বন্ধু৷ চিনিস তো তাকে৷ মাঝে মাঝে বাসায় আসে৷ আসলে আমাকে বিয়ে করে আনাটাই ছিলো তোর বাবার একটা চাল৷ আমাকে বিয়ে করে এনে তুলে দেয় অঞ্জনদার হাতে৷ বারো বছরের চুক্তি হয় ওদের মধ্যে যেখানে অঞ্জনদা যখন যা বলবে তা করতে আমি প্রস্তুত থাকবো৷ সেটা যদি পতিতাবৃত্তিও হয় তাতেও তোর বাবার আপত্তি নেই৷ আমার সম্পূর্ণ আয়ের ৮০ শতাংশ টাকা তোর বাবা পাবে বাকি ২০ শতাংশ টাকা তুলে দেয়া হবে আমার হাতে৷

তুই বলতে পারিস তুমি কেন রাজি হলে? আমি তো জেনে রাজি হইনি৷ এটাই ছিলো আমার ভুল৷ চুক্তিপত্র না পড়েই আমি স্বাক্ষর করেছিলাম৷ বিশ্বাস ছিলো তোর বাবার উপরে৷ শোন মা তুই কিন্তু এরকম অন্ধভাবে কাউকে বিশ্বাস করবি না৷ আমিও যদি তোকে কখনো এরকম কিছু বলি তুই কিন্তু করবি না৷ কখনোই কোন চুক্তিপত্র না পড়ে স্বাক্ষর করবি না৷ কোন স্বামী যে তার স্ত্রীকে এভাবে বিক্রি করতে পারে তা আমার জানা ছিলো না৷ চুক্তিপত্রের বিষয়টা জেনেছি কিছুদিন পর৷ ব্যাংকক শ্যুটিংএ গিয়ে আমি যখন অন্তরঙ্গ অংশগুলোতে অভিনয় করতে ইতস্তত করছিলাম তখন চুক্তিপত্রের একটি কপি তুলে দেয়া হয় আমার হাতে৷ এরপরেও প্রশ্ন থাকে আমি কেন এরপরেও বেরিয়ে আসলাম না? আমাকে তো কেউ বেঁধে রাখেনি৷ হ্যাঁ, দৃশ্যমান বাঁধন আমার ঠিকই নেই কিন্তু অদৃশ্যমান বাঁধন ছিলো৷ আমি এখান থেকে পালিয়ে গেলে বা তার বিরুদ্ধে কিছু করলে তোর দুই মাসিকে তারা তুলে নেয়ার কথা বলেছিলো৷

দ্যাখ আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে, গায়ে একটা স্ট্যাম্প পড়েছে৷ এ সমাজে বিয়েটা একটা স্ট্যাম্প স্বরুপ৷ এখন আমার ভালো মন্দ সবকিছুর দায় আমার স্বামীর৷ আমরা মেয়েরা যতোই আত্মনির্ভরশীল হই না কেন বিয়ে নামক স্ট্যাম্প লাগেই৷ নয়তো এই সমাজে মেয়েদের বেঁচে থাকা দূর্বিষহ হয়ে দাঁড়ায়৷ বিয়ে নামক স্ট্যাম্পের আড়ালে দেহব্যবসা করলেও দোষ নেই কিন্তু অবিবাহিতা থেকে ধর্মকর্ম করলেও দোষ৷ তাই আমার দোষটা এ সমাজের দৃষ্টিগোচর হয় না আর হবেও না কিন্তু তোদের মাসিরা এদের হাতে পড়লে ওদের জীবনটা শেষ হয়ে যেতো৷ তাই ভাবলাম নিজেকে বিলানোই ভালো৷ অন্তত দু’জনকে তো বাঁচাতে পারবো৷ পরে তোদের দুই মাসিকেই আমি দেখেশুনে ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দিয়েছি৷ তোরাও জানিস ওরা ভালো আছে৷ ওদের পার করতে পেরেছি এখন আছিস তুই আর অর্ণব৷ তনিমাকেও আমি তোদের থেকে আলাদা দেখি না৷ আমি মনে করি আমার তিনটি সন্তান৷ তনিমা এবার কলেজে ভর্তি হলো৷ কলেজ পাস করলেই ওকে আমি বাহিরে পাঠিয়ে দিবো৷ আমার চুক্তির বারো বছর শেষ হওয়ার আগেই ওর কলেজ পাস হবে৷ ওখানেই ও লেখাপড়া করবে৷

ঐ লোকটা শুধু লোভী নয় চরিত্রহীনও বটে৷ বাবা মানুষ চিনতে ভুল করেছিলো নাকি এ দূর্ভোগ আমার কপালে লেখা ছিলো আমি জানি না৷

বুঝলি মা এ বাসার বাতাসেও স্লো পয়জনিং আছে৷ তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে সবাইকে৷ আমি তোদের সেই পয়জনিং থেকে দূরে রাখতে চাই৷ তোর বাবার জন্য কাকে দোষ দিবো তোর ঠাম্মিও যে তেমন৷ মা এমন হলে ছেলের দোষ কি? তাই তো তোদের নিয়েও আমার বড্ড ভয় হয়৷ এ কারণেই আমি তোদের কাছে কম যাই৷ যদি আমার পাপ আবার তোদের গায়ে লাগে? তুই আর অর্ণব ভালো থাকলেই আমি খুশি৷ তোরা তোর বাবার মতো হোস না৷ আমি চাই না তোরা ঐ লোকটার নাম ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই যাতে গ্রহণ না করিস৷

প্রথম প্রথম লোকটাকে বদলাতে চেয়েছিলাম কিন্তু পরে বুঝলাম ইনি আর বদলানোর নয়৷ তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছি৷ তোদের আমি হোস্টেলে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু এতোটা নির্দয় হতে পারিনি৷ তোদের মুখ না দেখলে আমার ঘুম আসে না৷ আমি তো জানি লোকটার তোদের প্রতি তেমন কোন আগ্রহ নেই৷ তবুও লোকটা বাসার বাইরে থাকলে আমার দুশ্চিন্তা কম হয়৷ লোকটার প্রতি আমার ভালোবাসাটা কেমন জানিস? অভ্যস্ত ভালোবাসা৷ কোন পশুপাখি পাললে যেমন ভালোবাসা হয় তেমন৷ আছে ভালো, নেই সমস্যা নেই৷ তবে আমার ভাগ্য অন্যদিকে সুপ্রসন্ন, তনিমাকে পেয়েছি৷ মেয়েটা অনেক ভালো৷ তোদের ভালোভাবে বড় হওয়ার জন্য যে সুস্থ পরিবেশ দরকার সেটা আমি দিতে পারিনি৷ তনিমা তোদের মায়ের কাজটা করছে৷ ওকে কখনো কষ্ট দিস না মা৷ মা মরা মেয়ে, তোদের খুব ভালোবাসে৷ ও যে শিক্ষাটা দিচ্ছে সেটাই সঠিক শিক্ষা৷ দেখ তুই রোজ ভোরে আমার জন্য ফুল প্রসাদ রেখে যাস৷ দেখলেই আমার মনটা ভরে যায়৷ গতদিনের মনের জ্বালাগুলো ভুলে যাই৷ আমার এইটুকু মেয়ে এ ঘরে পূজো অর্চনা করছে৷ আমি তো ঠাকুর ঘরে যেতেই ভয় পাই৷ হয়তো আমার স্পর্শে মা রাগ করবে, অপবিত্র হয়ে যাবে৷ আচ্ছা মা কি তোকে দেখা দিয়েছেন কখনো? মাকে আমার হয়ে জিজ্ঞেস করবি আমি যদি মায়ের পূজো করি তাহলে মা রাগ করবে কিনা? আরো জিজ্ঞেস করিস আমি যে তার প্রসাদ খাই তাতে কি মা রাগ করে? তুই তো নিষ্পাপ৷ তোকে নিশ্চয়ই মা ফিরিয়ে দিবে না৷ আমার হয়ে মা’কে একটু বলিস৷ মা যেনো আমাকে ক্ষমা করে দেয়৷ শুনেছি অনিচ্ছায় অন্যায় করলে ক্ষমা করে৷ আমি তো অনিচ্ছাতেই করেছি৷ নইলে কতগুলো জীবন নষ্ট হতো৷ সব ঝড় না হয় আমার উপর দিয়েই গেলো৷ আবার অন্য কোনদিন তোকে লিখবো৷ আজ যাই৷ জানিস না তো শ্যুটিংএ দেরি করলে অঞ্জনদা খুব রেগে যায় আর রেগে গেলে….
যাই রে৷ তৈরি হতে হবে৷
চলবে…….

#
=

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here