ডায়েরি পর্ব ৫

#ডায়েরি_পর্ব_৫

জান্নাতুল জান্নাত

রুম থেকে বেরিয়ে স্নানে গেলাম৷ স্নান সেরে খেতে বসে দেখলাম সচারাচর রুটিনে যা থাকে তার একটাও নেই৷ স্বাভাবিক রান্না যেমনটা বাড়িতে খেতাম৷ তারচেয়েও বড় কথা খাবারগুলো আমার খুব পছন্দের৷ প্লেটে খাবার নিতে গিয়ে থেমে গেলাম৷
-মামনি আমি খাবার দিয়ে দিচ্ছি৷
-তনিমা কলেজে যাসনি?
-না৷ তোমার রুমের সামনে সকালে লেখাটা দেখেই বুঝেছিলাম দুপুরে বাসায় খাবে৷ তাই কলেজে যাইনি৷ দেখোতো খাবারগুলো পছন্দ হয়েছে?
-এগুলো সব বাঙালীরই পছন্দের খাবার৷ কতবছর যে খাইনা ভুলে গেছি৷ কিন্তু এগুলো এ বাসায় কে রাধলো?
-কে আর রান্না করবে? তোমার স্পেশাল কাজের লোক৷ এটা যে অন্যের বাসা সে খেয়াল আছে এই মেয়ের? মনে হয় যেনো নিজের বাসা৷ যা খুশি তাই করে চলেছে সবসময়৷ অন্যের বাসায় থাকতে হলে কিছু নিয়ম মানতে হয় সে শিক্ষাটাও পাওনি?
-মা আপনাকে বহুবার বলেছি তনিমাকে কাজের লোক বলবেন না৷ ও আমার আরেক মেয়ে৷ নাতনি হিসেবে মানতে না পারলে সামনে আসবেন না কিন্তু আমি যেনো আর কখনো এসব কথা না শুনি৷ এটা ওর নিজের বাসা আর ওর যখন যা খুশি তাই করবে৷ যা খুশি রান্না করবে৷ আপনার ভালো লাগলে খাবেন ভালো না লাগলে বুয়াকে রান্না করে দিতে বলবেন৷
-বাইরের মানুষকে এতো লাই দিতে নেই৷ তাহলে মাথায় চড়ে বসে৷ সে যাই হোক আমার বিষয় না হয় ম্যানেজ করে নিবো কিন্তু তোমার মেয়ে?
-আমার মেয়ের আবার কি হলো?
-আরে অনিতাকে সাঝ সকালে উঠিয়ে পূজোতে বসায় এই মেয়ে৷ বাসার খবর কিছু রাখো তুমি? নিজেও একটা গাইয়্যা আর আমার নাতনিটাকেও দিনদিন গাইয়্যা বানাচ্ছে৷
-পূজো করতে বসায় সে তো ভালো কাজ৷ ধর্মের কাজ করায়৷ আপনা… আচ্ছা বাদ দিন৷ আমি এখন খেয়ে শ্যুটিংএ যাবো৷ আপনি আপনার রুমে যান৷ আর তনিমাকে আমিই বলেছি অনিতাকে এসব শিখাতে৷ আমার মেয়ে কিভাবে বড় হবে সেটা আমি বুঝবো৷ আমার জীবনটা ধ্বংস করেছেন আমার মেয়ের দিকে খবরদার হাত বাড়াবেন না৷ আমার তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না৷ ভগবানের নামে দিব্যি করে বলছি সব তছনছ করে দিবো কিন্তু৷
-শোনো অঞ্জনা আজকাল বেশি কথা বলছো কিন্তু?
-মামনি এসব বাদ দাও তো? আমি আজ নিজের হাতে সব রেধেছি৷ খেতে বসো৷
বলেই তনিমা খাবার দিতে শুরু করলো৷
-ঠাম্মা তুমি রুমে যাও তো মাসি তোমার খাবার রুমে দিয়ে আসবে৷ তোমার জন্য আলাদা খাবার আছে৷ এ খাবার তোমাকে খেতে হবে না৷
-এগুলো তুই রেধেছিস? এতো অল্প বয়সে তুই রান্নাও করতে পারিস?
-হ্যাঁ পারি৷ মা আমাকে সব শিখিয়েছিলো৷
-তোর মা অনেক সুন্দর ছিলো তাই না রে?
-মায়েরা তো সবসময়ই সুন্দর হয়৷ এই দেখো কালী মা৷ তিনি তো কালো তারপরও কি আমাদের দৃষ্টিতে তিনি অসুন্দর? নন তো? তাহলে? আসলে সন্তানের কাছে মায়েরা সবসময়ই সুন্দর৷
-বাহ্ কি সুন্দর করে কথা বলিস৷ যেমনি মিষ্টি তোর চেহারা তেমনি মিষ্টি তোর কথা৷ ছোটবেলায় তুই আমার কোলে থাকলে তোর নাম রাখতাম প্রতিমা৷ অবশ্য তোর কথাগুলো তোর বাবার মতোই৷ তোর বাবাও এমন সুন্দর করে কথা বলে৷
-মামনি রাখো তো এতো কথা৷ খাওয়া শুরু করো৷ আজ রাতে একটু তাড়াতাড়ি ফিরো৷ আজ আমরা একসাথে ডিনার করবো৷
-আমরা মানে?
-তুমি, আমি, অনিতা আর অর্ণব৷
-তোদের মাথা খারাপ? তোরা ঘুমিয়ে পড়িস৷ আমার ফিরতে রাত হবে৷ এমনিতেই দেরি করে যাচ্ছি৷ মাংস কষা আর মাছ দু’টোতেই ফাটিয়ে দিয়েছিস৷ তুই তো বেশ ভালো রাধুনি৷
-চুপচাপ খাও৷ চাটনি আনছি৷
খাচ্ছি আর ভাবছি এমন খাবার মেয়ে খাওয়ালে আমার ফিগারের বারোটা বাজবে৷ থাক মেয়েটা কষ্ট করে রেধেছে৷ একবেলা খেলে কিচ্ছু হবে না৷ খেয়ে উঠতেই চাটনি নিয়ে হাজির তনিমা৷ চাটনিটাও মেয়েটা বেশ বানিয়েছে৷ খেয়েই হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়লাম৷ লিফট দিয়ে নামতেই মনে পড়লো মেয়েটাকে অপেক্ষা করতে নিষেধ করি৷ ফোন করলাম
“মা রে আমার জন্য অপেক্ষা করিস না৷ আমার রাত হবে৷”

গাড়িতে যাচ্ছি আর ভাবছি
” আজ হঠাৎ মেয়েটা এতোসব রান্না কেন করলো? আজ কি কোন বিশেষ দিন? আমার তো তেমন কিছু মনে পড়ছে না৷”
তপুকে ফোন করে যা জানলাম আবারও নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে৷ আমি আসলেই ইউসলেস৷ তনিমার মা আর হয়ে উঠতে পারিনি, মাসিই রয়ে গেলাম৷ আজ যে মেয়েটার জম্মদিন সেটা আমি এই তিনবছরেও জানতে পারলাম না৷ মেয়েটা আমার জন্য কতো রান্না করলো অথচ এটা আজ আমার করা উচিত ছিলো৷ মা মরা মেয়ে নিজের জম্মদিনে স্পেশাল কিছু চাইতেও পারেনি৷ অথচ ও দেখছে তিনবছর আমি অনিতা আর অর্ণবকে কত গিফট দিয়েছি৷ এজন্যই হয়তো রাতে একসাথে খেতে চেয়েছে৷ দেখি আজ একটু আগে যেতে পারি কিনা৷ অঞ্জনদাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করবো৷ আজ ওর জম্মদিন জানলে কি আর গত রাতে ঔষুধ খেয়ে ঘুমাতাম?
-সামনের জুয়েলার্সটাতে একটু পার্ক করবেন দাদা৷
এরমধ্যে অঞ্জনদার ফোন আসলো৷
-হ্যাঁ দাদা আমি আসছি তো৷ গাড়িতে আছি জ্যামে আটকা পড়েছি৷
-জ্যামের দোহাই দিয়ে আর কতদিন চলবে?
-দাদা এভাবে বলছেন কেন? আমি তো খুব কমই লেইট করি৷
-তুমি যে কি করো সেটা কি আর আমি জানিনা?
আমি কিছু না বলে রেখে দিলাম৷ এভাবে আমার সাথে কথা বলছে৷ একটা দিন শুধু বিকেলে শ্যুটিং করতে বলার জন্য এতো কথা?
-ম্যাডাম জুয়েলার্স এসে পড়েছে৷
নেমে পড়লাম৷ খুব তাড়াতাড়ি করে একটা চেইন আর লকেট কিনলাম৷ তনিমাকে উপহার দিবো বলে৷ কিনে বেরুনোর সময় অঞ্জনদার সাথে দেখা৷
-এখন বুঝেছো তো কেন একটু আগে ঐ কথা বলেছিলাম?
-দাদা আমি মাত্র পনেরো মিনিটই নিয়েছি এখানে…
-কথা না বলে চলো৷ শাস্তিস্বরুপ আজ তোমাকে বেশি কাজ করতে হবে৷

দাদার সাথে গাড়িতে উঠলাম৷ আজ ছেলেমেয়েগুলো না খেয়ে অপেক্ষা করবে৷ আমি তো তাড়াতাড়ি যাবার কথা বলতেই পারলাম না৷ অজান্তেই আমার চোখের কোণে জল জমে উঠলো মা মরা মেয়েটার জন্য৷

কাজের ফাঁকে ড্রাইভারকে দিয়ে কেক আর বুকে আনিয়ে রেখেছিলাম৷ স্পট থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে দেখি ১২:৪৫ বাজে৷ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অপেক্ষায় রইলাম পৌঁছাবার৷ ১:৩৫ এ বাসায় এসে দেখি তনিমা টেবিলে মাথা নিচু করে আছে৷ চুলে হাত দিতেই ধরফড় করে উঠে বললো
-মামনি এসেছো? অনেক রাত হয়েছে তাই অনিতা আর অর্ণবকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি৷ হাত মুখ ধুয়ে খাবে এসো৷
-তুই খেয়েছিস?
-না৷
-দশমিনিট পর স্ট্যাডিরুমে আয়৷ এখন একট ঠান্ডা জল খাওয়া৷ এই ফাঁকে কেক আর বুকেটা রুমে দিয়ে আসলো ড্রাইভার৷ জল খেয়ে রুমে গেলাম৷ তেমন কিছু নয়৷ কেকের সামনে একটা মোমবাতি আর আমার ছোট্ট উপহারটি ও বুকে পাশে রেখে নিজে ফ্রেশ হলাম৷ দশ মিনিট পর তনিমা নক করলো৷ ভিতরে এসে দরজা আটকে দিতে বললাম৷ চেইনটা পড়িয়ে দিতে দিতে বললাম
“Happy Birthday. Many Many Happy Return’s Of The Day” যদিও দেরি হয়ে গেছে৷ দিনটা এখন আর নেই৷
তনিমা আমায় জড়িয়ে ধরে বললো
-তাতে কি হয়েছে মামনি? তুমি কি করে জানলে আজ আমার জম্মদিন?
-এতোদিন সত্যি তোর মামনি হয়ে উঠতে পারিনি তাই জানিনি৷ আজ পেরেছি৷ তুই কেন আমাকে আগে বললি না? আমি কি তোর মা না?
-এমনি বলিনি৷ তাছাড়া এদিনে তো বাবা আমাকে নিয়ে যেতো৷ এবার তো নিতে এলো না৷
-তাইতো শুধু মুখেই মামনি বলিস৷ মা যদি ভাবতি প্রতি জম্মদিনে চলে যেতে পারতি? আজ জেনেছি আর ভুল হবে না৷
-আর কখনো যাবোনা মামনি৷
-মনে থাকে যেনো৷ তুই আমার সাথে খুব অভিমান করেছিস না? ক্ষমা করে দে মা৷ আমি হাজার চেষ্টা করেও তাড়াতাড়ি আসতে পারিনি৷ আজ তুই আর আমি একসাথে খাবো৷ আয় আগে আমরা কেক কাটি৷
কেক কেটে ওকে নিজ হাতে খাওয়ালাম৷
-অনিতা আর অর্ণবকে সকালে কেক দিস৷ চেইন আর লকেটটা পছন্দ হয়েছে?
-হ্যাঁ খুব৷ রাতেও অনেককিছু রেধেছি৷ সব খাবে তো?
-হ্যাঁ৷ তুই খাবার রেডি কর আমি আসছি৷
দু’জনে মিলে খেলাম৷ খাবার শেষে মেয়েটা আমাকে পান বানিয়ে খাওয়ালো৷ আমি তো হেসেই কূল পাই না৷ আমিও পান খেতে পারি?

যা হোক কফি নিয়ে স্ট্যাডিরুমে গিয়েছি দেখি পিছনে তনিমাও এসেছে৷
-কিরে মা কিছু বলবি?
-হ্যাঁ৷ আজ আমি তোমার সাথে এখানে ঘুমাই?
ও আমার সাথে ঘুমালে আজ তো আর ডায়েরি লিখতে পারবো না৷ জম্মদিনের আব্দার তো ফেলতেও পারি না৷ বললাম
-আচ্ছা৷
মেয়েটা এসে আমার পায়ের উপর গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো৷ অনিতা কখনো এভাবে কাছে আসার সাহস পায়নি৷
-কি রে বাবার কথা মনে পড়ছে?
-না৷
-আচ্ছা বল তো তুই কি তোর মায়ের মতো হয়েছিস তাই না? তপুর সাথে তো তোর কোন মিল নেই৷
-না৷ আমি পুরোটাই আমার বাবার মতো হয়েছি৷
মেয়েটার কথা শুনে চমকে উঠে ওর মুখের দিকে তাকালাম কিন্তু কোথাও তপুর ছাট পেলাম না৷ কিন্তু এটা কি করে সম্ভব?
চলবে…..

#
#

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here