#দখিনা_হাওয়া
#মারিয়া_আক্তার
[০৫]
– তুমি হয়তো জানো না আমার বাবার একটা কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে।
আরাধ কথাটা বলে একটা চাপা শ্বাস ছাড়ে। বিন্দু অবাক হয়ে আরাধের দিকে তাকায়।
– কি বলছেন? কবে থেকে?
– গত কয়েকমাস ধরে। একটা কিডনি পুরোপুরি ড্যামেজ হয়ে গেছে। অন্য একটার অবস্থাও বেশি ভালো না। চিকিৎসা চলছে, ডাক্তার বলেছে পৃথিবীতে আর বেশিদিন হয়তো নেই বাবা। আর সেখানে বাবা আমার কাছে একটা আবদার করেছে আমি কি করে খালি হাতে ফেরাই বাবাকে? সন্তান হিসেবে আমার এখন কি করা উচিৎ? তুমি আমায় প্লিজ বলো।
বিন্দু চুপ করে বসে রয়েছে। চোখ থেকে এক ফোঁটা টসটসে জল গড়িয়ে পড়লো ওর। আলী আকবর মির্জা খুব ভালো একজন মানুষ। উনি বিন্দুকে খুব ভালোবাসেন, যেন বিন্দু ওনার নিজের মেয়ে। ওনার নিজের মেয়ে নেই বলেই হয়তো বিন্দুকে এতটা ভালোবাসেন তিনি। উনি বিন্দুকে মা বলে সম্বোধন করেন। যে লোকটা বিন্দুকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছে তার শেষ সময়ের একটা আবদার কি করে অগ্রাহ্য করবে বিন্দু?
– আপনি এখন কি করবেন ভাবছেন?
আরাধ বিন্দুর দিকে ফিরে তাকায়। মলিন হেসে বলে,
– আমি কিছু জানি না বিন্দু। কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার।
বিন্দু অবাক হয় আরাধের ব্যবহারে। এই প্রথম আরাধ বিন্দুর সাথে এভাবে কথা বলতেছে। আগে সেভাবে কখনো কথা হয় নি তাদের দু’জনের মধ্যে।
– ডাক্তার বলেছে, আনুমানিক কতদিন সময় আছে আঙ্কেলের?
– বলেছে, পাঁচ-ছয় মাস মত হবে। তবে তারও নিশ্চয়তা নেই।
কথাটা বলার সময় আরাধের গলা যেন ধরে আসছিলো।
– ভালো হওয়ার কোনো আশা নেই? মানে উন্নত চিকিৎসা..।
বিন্দুকে থাকিয়ে দিয়ে আরাধ বলে,
– না, সেসবে কোনো কাজই হবে না। অনেক চেয়েছি আমরা। কোনো ত্রুটি রাখিনি বাবার চিকিৎসায়। ডাক্তার বলেছে কোনো কাজ হবে না।
বিন্দু কিছুসময় মৌন থাকে। কিছু একটা ভেবে বলে,
– আপনি ভালোভাবে তানিয়ার খোঁজ করেন, পেয়ে যাবেন অবশ্যই। দেশ থেকেতো আর চলে যাবে না সে। ওর দেশের বাড়ি কোথায়, সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখেন।
– খোঁজ নিয়েছি আমি সেখানে তানিয়া নেই। আর তাছাড়া বাবা চায় তোমায় পুত্রবধূ করতে, এখন তানিয়ার কথা বললে হয়তো কষ্ট পাবে। হয়তো আমার কথা ভেবে তানিয়াকে খুঁজতে সাহায্যও করবে। খুঁজে পেলে আমাদের বিয়েও দেওয়াবে। কিন্তু দিনশেষে বাবার মনে একটা চাপা কষ্ট থেকে যাবে। ওনার একটা আফসোস থেকে যাবে, তোমায় পুত্রবধূ করতে পারলেন না। আর বাবা চলে যাওয়ার পর সেই ভার আমি বইতে পারবো না। যেই বাবা আমায় কোলে পিঠে করে মানুষ করলেন তার একটা আবদার রাখবো না আমি? এতটা অকৃতজ্ঞ সন্তান আমি হতে পারবো না বিন্দু।
– তাই বলে নিজের ভালোবাসা ভুলে যাবেন?
– ক্ষণিকের ভালোবাসার জন্য আমার বাবার আঠাশ বছরের ভালোবাসাকে দূরে ঠেলে দিই কি করে? সেসব ছাড়ো। এতকিছু জেনে তুমিতো আর রাজি হবে না বিয়েতে, তাই না?
বিন্দু পাথরের একটা টুকরো দিয়ে মাটিতে কি যেন আঁকিবুঁকি করে। মাথার হিজাবটা আরো একটু টেনে নেয়।
– আমি রাজি হলে আপনি খুশি, নাকি না হলে?
– আমার খুশির কথা আসছে না বিন্দু। তুমি রাজি নাতো, সেটা বলো?
– যদি রাজি হই তাহলে কেমন হবে মিস্টার আরাধ মির্জা?
আরাধ কিছু না বলে বিন্দুর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। চুপ করে থাকে। তাই বিন্দু আবার বলে ওঠে,
– কখনো কারো সাথে হারাম সম্পর্কে জড়াই নি আমি। নিজের স্বামীকে ভালোবাসবো বলে ভেবে এসেছি সবসময়। তো এইবার আপনি বলুনতো, যার সাথে আমার বিয়ের কথা হচ্ছে সে অন্য একজনকে ভালোবাসে এটা কি করে মেনে নিই?
– আমি কি করে তানিয়াকে ভুলবো বিন্দু? প্রথম ভালোবাসা যে ভুলা যায় না। আমি এখনো আশায় আছি আমি একদিন ওর খোঁজ পাবোই।
বিন্দু খানিকটা সময় চুপ করে কিছু যেন ভাবে। তারপর কিছু না বলে মাথাটাকে নাড়ায়।
– তাহলে আর কি? আমার তরফ থেকে সরাসরি না-ই। আর বাকিটা আপনি আপনার বাবাকে বলে দিবেন।
আরাধ কিছু বলে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। বিন্দুও চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কোনো এক গোলকধাঁধাঁয় যেন সে ফেঁসে গেছে। এখান থেকে কি করে সে নিজেকে বের করে আনবে? কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর নিজেকে সিরিয়াস করে। আরাধ বিন্দুর দিকে ফিরে কিছু বলতে নেয়। আবার আমতাআমতা করে। বিন্দু কিছুক্ষণ ধরে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। আরাধ কিছুটা সাহস সঞ্চার করে বিন্দুকে কিছু বলতে নিলে বিন্দু তাকে থামিয়ে নিজে বলে ওঠে,
– আমি জানি আপনি আমার কাছে কি এক্সপেক্ট করছেন? কিন্তু মিস্টার আরাধ আমায় একটা কথা বলুন তো, আমি এতসব কিছু মানবো কেন?
আরাধ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর মৃদু হেসে বলে,
– তুমি খুব বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। না বলতেই বুঝে গেছো। যাই হোক, এর বিনিময়ে তুমি যা চাইবে তা-ই।
– কিন্তু আপনাকে বিয়ে করলেতো আমার গায়ে বিবাহিত ট্যাগটা লেগে যাবে।
– দেখো এটা নকল বিয়ে? আমরা বিয়ে না করেও বিবাহিত সেজে থাকি বাবার সামনে। পরে তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায়।
– আরাধ মির্জা। বিয়েটা ছেলেখেলা নয়। আমি আপনার বাড়িতে আপনার নকল বউ সেজে থাকবো, আমার কি আত্মসম্মানবোধ নেই নাকি?
– আমার বাবাকে শেষ সময়ে একটুখানি সুখ দিতে চাই বিন্দু। আমায় দয়া করে একটু সাহায্য করো।
বিন্দু বিদ্রুপাত্মক হেসে বলে,
– মিথ্যে দিয়ে বাবার শেষ সময়ে তাকে সুখ দিতে চান ?
– তাহলে বিয়েতে না করে দাও। কারণ আমি বাবাকে না করতে পারবো না।
বিন্দু এবার উঠে দাঁড়ায়। চারদিকে তাকিয়ে দেখে এখন নদীর পাড়টায় মানুষের আনাগোনা বাড়ছে।
– আচ্ছা আপনার বাবা আমায় আপনার বউ বানানোর জন্যে এমন করছে কেন? দুনিয়াতে তো মেয়ের অভাব নেই।
আরাধ মুচকি হেসে বলে,
– আমার দাদির নাম ছিল নুরজাহান বেগম। আমার বাবারা দুই ভাই একবোন। বড় জেঠা অনেক আগে থেকেই ফ্যামিলিসহ অ্যাব্রোডে থাকে। তাই দাদি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার বাবার কাছেই ছিল। বাবা দাদিকে খুব ভালোবাসতেন। মা পাগল ছেলে ছিল আমার বাবা। কিন্তু হঠাৎ করে দাদির ক্যান্সার ধরা পড়ে। তার কিছুদিন পরই মারা যান তিনি। তারপর বাবা খুব ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু বাবা যেদিন তোমায় প্রথম দেখলো, সেদিন আমাদের কাছে বলেছিল তার মা নাকি ফিরে এসেছে। তোমায় দেখতে নাকি অনেকটা আমার দাদির মত। এজন্য বাবা তার মায়ের মত আরেক মাকে পুত্রবধূ করে ঘরে তুলতে চান।
বিন্দু একটা চাপা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ে। এতদিনে মূল ঘটনাটা জানতে পারলো।
– সে যতকিছুই হোক। আমি আপনার সাথে নকল বিয়ে করে বিয়ে বিয়ে খেলা খেলতে পারবো না। নিজের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার হাতে তুলে দিতে পারবো না আমি। যেখানে আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন, সেখানে এই বিয়ের ব্যাপারটার কথা নিয়ে না এগোনোই ভালো।
আরাধ খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি এখন কি করবো বলোতো বিন্দু? আমার এখন করণীয় কি?
বিন্দু মৃদু হাসে। আরাধের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুই পা সামনে এগোয়।
– আমার মনে হয় আঙ্কেলকে আপনার আর তানিয়ার বিষয়টা বলে দেওয়াই ভালো।
আরাধ চুপ করে থাকে। চোখেমুখে তার দুঃচিন্তা স্পষ্ট। বিন্দু নিজের হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আচ্ছা চলেন যাওয়া যাক।
আরাধ দু’পা এগিয়ে এসে বলে,
– যদি তানিয়াকেও খুঁজে না পাই তখন কি হবে?
– আপনার পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা না হলে আমি বিয়েটা করার চেষ্টা করতাম। ঋণ পরিশোধ করার জন্য হলেও। আসলে তখন ব্যাপারটা হত গিভ এন্ড টেক। আপনার বাবা আমাদের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল। আমিও না হয় তার বিনিময়ে কিছু দিতাম। ওনাকে মানসিক প্রশান্তি দিতাম। আচ্ছা সে যাই হোক আমি এখন যাচ্ছি।
– আমি তোমাকে ড্রপ করে দিই, এসো।
– না, লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।
বিন্দু আরাধকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নিজের গন্তব্যে হাঁটা দিলো। মাথায় চিন্তা পোঁকারা একসাথে কুট কুট করে কামড়াচ্ছে। আলী আকবর মির্জার জন্য কিছু করতে পারলে বিন্দু খুব আনন্দিত হত। একটু সেক্রিফাইস না হয় করতো সে কিন্তু আরাধতো নকল বিয়ে করতে চাইছে। সে বিন্দুর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু আলী আকবর মির্জা, ওই মানুষটা না থাকলে এতদিনে বিন্দুর পরিবারটার কি হাল হত। বছরখানিক আগের ঘটনা, বিন্দুদের গ্রামের বাড়িতে বিন্দুর বাবার অনেক জায়গাজমি আছে। সেখানে তাদের অনেক সুপারি বাগান, নারকেল বাগান আছে। সেখান থেকে বছর বছর অনেক টাকা আসে তাদের। যত জায়গাজমি ছিল সব বিন্দুর বাবার ভাই নেই তাই সেই সুযোগে তার বাবার চাচাতো ভাইয়েরা জবরদখল করে নেয়। বিন্দুদের সম্ভল বলতে গ্রামের জায়গাজমিগুলো ছিল। শহরে ভাড়াবাড়িতে থাকে তারা। নিজের জমি ফিরে পেতে কবির শেখ যত কিছু করেন কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারছিলেন না। তাদের ঝামেলা একটা সময় অনেক ভয়াবহ পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। কবির শেখ তাদের সাথে পেরে উঠেন নি। একদিনতো মিথ্যা কেইসে কবির শেখকে তারা ফাঁসিয়ে দেয়। বিন্দুরা তখন দিশেহারা হয়ে পড়ে। যার কাছে যায় কারো কাছেই আশানুরূপ সাহায্য তারা পায় নি। শেষে আলী আকবর মির্জার দারস্থ হলে, উনি সর্বপ্রকার সাহায্য করেন তাদেরকে। ওনার ক্ষমতাবলে বিন্দুদের জায়গাজমিও ফিরিয়ে দেন। বিন্দু পুরোনো কথা ভেবে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ে।
চলবে…
[ভুলত্রুটি হলে মার্জিত ভাষায় ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইলো।]