রাজমহল পর্ব -০৪

#রাজমহল
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-৪

আমি ঘুম ঘুম চোখে হাসিবের কলটা ধরে হ্যালো বলতেই হাসিবের কন্ঠস্বর শোনে ভয় পেয়ে গেলাম। হাসিব বিমর্ষ কন্ঠে হ্যালো বলেই থেমে গেল। ওপাশ থেকে হাসিবের দীর্ঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ভেসে আসছে। কি যেন বলতে চাচ্ছে কিন্তু পারছে না। মনে হচ্ছে তার কন্ঠস্বরটা আটকে আছে। হাসিবের এমন দশা দেখে কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে বললাম

– কি হয়েছে হাসিব? এত চুপচাপ কেন? কিছু তো বলো।

হাসিব আমার কথাগুলো শোনেও মিনেট তিনেক নীরব ছিল। ওপাশ থেকে হাসিবের দীর্ঘ নিঃশ্বাস গুলোর শব্দই পাচ্ছিলাম। মিনেট তিনেক পর হাসিব একটু শান্ত হয়ে বলল

– সন্ধি কোথায়?

– কেন?

– আরে বলো না কোথায়?

আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম সন্ধি ঘুমাচ্ছে। তাই হাসিবকে বললাম

– আমার পাশেই তো শুয়ে আছে।

– মানে?

– আরে হ্যাঁ আমার পাশেই শুয়ে আছে। কেন বলতো।

– কিছুক্ষণ আগে সন্ধিকে দেখলাম।

– হাসিব তুমি কি পাগল হয়ে গেছ? সন্ধিকে দেখবে কি করে? সন্ধি আমার পাশে শুয়ে আছে আর ও এত রাতে তোমার কাছে যাবে কি করে?

হাসিব ঢুক গিলতে লাগল। মনে হচ্ছে পানি গদগদ করে ও গিলছে। খানিকটা চুপ থেকে আমাকে বলল

– তাহলে শোনো কি হয়েছে।

-হ্যাঁ বলো।

– আমি ল্যাপটপে কাজ করতেছিলাম একটু আগে। জানোই তো আমার রুমের দরজাটা খুলাই থাকে। রুমের সাথে বলেকনি থাকায় জানালাটাও খোলা রাখি সেই সাথে ব্যালকনির দরজা।

– হ্যাঁ সেটা তো জানি। কি হয়েছে সেটা বলো।

– হ্যাঁ বলছি। আমি কাজ করতেছিলাম। এমন সময় হুট করে আমার রুমের বাতি নিভে গেল। মেঘহীন আকাশটা কালো হয়ে গেল। আকাশের চাঁদটাকে কালো মেঘ ততক্ষণে গ্রাস করে পরিবেশটা নিকষ অন্ধকার হয়ে গেল। চারদিকে থমথমা পরিবেশ। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না এমন কেন হচ্ছে।বাসায় সবাই তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।আমি কিছুটা ভয় পেলেও মনে সাহস রাখলাম। এমন সময় আমার ঘরের দরজাটা থেকে বিকট আওয়াজ পেলাম। অন্ধকারে বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছিল। তবে টের পাচ্ছিলাম দরজাটা বাতাসে বন্ধ হয়ে গেছে৷ সেই সাথে আরেকটা বিকট আওয়াজ আসলো জানালা থেকে। বুঝতে পারলাম বাতাসে জানালাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। পরক্ষণেই টের পেলাম বেলকনির দরজাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ ঘরের ভেতরে বাতাস হচ্ছিল প্রবল বেগে। এত বাতাস কীভাবে হচ্ছে বুঝতেছিলাম না। মনে হচ্ছিল বাতাসে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আমার দম নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এমন সময় একটা আলো দেখতে পেলাম। আলোটা আমার ঘরের জানালার কাঁচটা ভেদ করে ঘরে ঢুকেছে। আলোটা ঢুকার সাথে সাথে আমার ঘরের জানালা দরজা আপনা আপনি খুলে গেল। প্রবল বাতাসও নিমিষেই কমে গেল।কালো মেঘটাও চাঁদের উপর থেকে সরে গেল। চাঁদটা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হতে লাগল। দৃশ্যমান চাঁদটা দেখতে তখন গোলাকার আবার বৃত্তাকার মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এটা ত্রিমাত্রিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় আছে আবার মনে হচ্ছে দ্বিমাত্রিক স্থানাঙ্ক ব্যবস্থায় আছে। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতেই যেন বেশ অদ্ভূত মায়া মায়া সৃষ্টি হচ্ছিল ভেতরে। এমন সময় বরফ শীতল বাতাস আমার গায়ে এসে শীতলতার অনুভূতি দিল। হালকা শীত শীত লাগছে। চোখটা কেন জানিনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। পরক্ষণেই চোখটা বন্ধ করে সাথে সাথে খুললাম। ঘরের দেয়ালে একটা ছায়া লক্ষ্য করলাম। বুঝতে পারলাম ছায়াটা কোনো মানব শরীরের। আমি ছায়াটার উৎস খুঁজে বের করার জন্য পেছনে তাকাতেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

কারণ পেছনে সন্ধি দাঁড়ানো। তার এক কোলে একটা বিভৎস বাচ্চা পুতুল আরেক কোলে একটা সুন্দর তুলতুলে বাচ্চা পুতুল। সন্ধির চোখ দিয়ে তখন অজোরে রক্ত পড়ছিল। আমি ভয়ে সন্ধিকে উদ্দেশ্য করে বললাম

– এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমার এ হাল কে করল?

সন্ধি তখন হুংকার দিয়েও নীরব হয়ে গেল। তারপর আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।চোখটা দিয়ে তখন প্রবল বেগে রক্ত পড়ছিল। অসহায় ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল

– আমার বাচ্চা নষ্ট করার জন্য সাহায্য করতে তোকে কে সাহস দিয়েছে বল।

আমি আমতা আমতা করে বললাম

– এটা তো তোমার ভালোর জন্য করা হচ্ছে। তুমি তো তোমার বাচ্চার পরিচয় ঠিক করে দিতে পারছো না। কে এ বাচ্চার বাবা কিছুই বলতে পারছো না। আর তুমিও তো চাও এ বাচ্চার জন্ম না হোক।তবে তোমাকে এত বিভৎস লাগছে কেন?

সন্ধি কোনো কথা না বলে আমার দিকে তার বিভৎস পুতুলটা ঢিল মেরে বলল

– আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি করতে চাইলে প্রাণে মেরে ফেলব। সাতদিন পর তুই ডাক্তারের কাছে যাবি না। বাচ্চার কোনো ক্ষতি আমি চাই না। এমনিতেও বাচ্চাকে মারতে পারবি না। তবে আমি চাই না আমার বাচ্চাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক। ওকে আসতে দে। ওর আসার পথে বারবার বাঁধা দিবি না। তাহলে সেটা কারোর জন্য হিতকর হবে না। আমার কথা না শোনলে সবাইকে মরতে হবে।

সন্ধির ঢিল মারা বিবৎস পুতুলটা ততক্ষণে আমার পাশে পড়ে ছিল। আমি সন্ধির কথা শোনে হালকা গলায় বললাম

– সন্ধি তুমি এরকম হলে কি করে এত রাতেই বা আসলে কি করে?

সন্ধি কোনো উত্তর দিল না। দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। আর আমার পাশে পরে থাকা সন্ধির বিভৎস পুতুলটা হুট করে বিভৎস জ্যান্ত বাচ্চা হয়ে গেল। আমার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে লাগল। আমি পিছুতে লাগলাম। বাচ্চাটাও আমার পেছনে পেছনে আসতে লাগল। আমি ভয়ে মাটিতে পড়ে গেলাম। বাচ্চাটা এবার আমার কাছে এসে আমার নাক মুখ খাঁমচে ধরলো। আমি তখন দম নিতে পারছিলাম না। শরীরটা বেশ কাঁপুনি দিয়ে উঠল। মনে হচ্ছিল আমি মারা যাব।

এমন সময় ঘরের বাতিটা জ্বলে উঠল। চারদিক আরও আলোকিত হলো। পুতুলটাও অদৃশ্য হয়ে গেল। সবকিছু একদম স্বাভাবিক হয়ে গেল।আমি নীচ থেকে ভয়ে ভয়ে খাটের উপর উঠলাম। এখনো আমার গা টা শিউরে উঠছে তন্দ্রা।

আমি হাসিবের কথা শোনে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইলাম। ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সবার সাথেই এমন হচ্ছে।কেন হচ্ছে এটা যেন আমার বুঝার অন্তরায়।বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চাইলেও আমি এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। কারণ সন্ধিও বলছে তার সাথে এমন হচ্ছে আমার সাথে এমন রহস্যময় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে আর আজকে হাসিবের সাথে। আমার কাছে কেন জানি না মনে হচ্ছে বিষয়গুলোতে কোনো যোগসূত্র আছে।তবুও আমি হাসিবকে নীরবতার অবসান ঘটিয়ে বললাম

– দেখো হাসিব তুমি হয়তো সন্ধির বিষয় নিয়ে একটু বেশি ভাবছো তাই এমন দেখতেছ। সন্ধি আমার পাশেই আছে। আর একটু আগেও ছিল৷ তুমি নিশ্চিত কোনো স্বপ্ন দেখেছো নাহয় কল্পনায় এসব ভেবেছ। এসব ঘটনার কোনো বিজ্ঞান সম্মত অস্তিত্বও নেই।

– তন্দ্রা আমি যথেষ্ট ম্যাচুউর। স্বপ্ন আর বাস্তবের ফারাক আমি বুঝি। স্বপ্ন হলে আমার মুখে আঁচড়ের দাগ থাকত না। পুতুলটা আমার মুখে খাঁমচে ধরেছিল সে দাগটা এখনো আমার মুখে স্পষ্ট ভেসে আছে৷ নিশ্চয় সন্ধির এ বিষয়টার পেছনে কোনো রহস্যময় অধ্যায় আছে।

হাসিবের কথাটা ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। ভালোই বুঝতে পারছিলাম আমার সাথে যা ঘটছে হাসিবের সাথেও তেমনটা ঘটছে। তবে এ বিজ্ঞানের যুগে এসবের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে৷ তাই হাসিবের কথায় তাল না মিলিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললাম

– আচ্ছা ঠিক আছে এবার ঘুমাও। পরেরটা পরে ভাবা যাবে। যা হয়েছে ভুলে যাও। সাতদিন পরে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এটাই মাথায় রাখো। আমি রাখলাম।

কথা শেষে ফোনটা কাটতে গিয়ে খেয়াল করলাম সাড়ে তিনটে বাজে। ফোনটা রাখতে গিয়ে সন্ধির দিকে তাকাতেই দেখলাম সন্ধি বিছানায় নেই। সন্ধির জায়গাটা শূন্য দেখে পাশ ফিরে তাকাতেই ভয় পেয়ে গেলাম৷ কারণ একটু আগে হাসিব যেভাবে বলেছিল সন্ধি ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধির এক কোলে একটা বিভৎস পুতুল আরেক কোলে একটা সুন্দর পুতুল। হাসিবের ঘটনার সাথে সব মিলে যাচ্ছে।ঘরের ড্রিম লাইটটা বন্ধ হয়ে গেল। মেঘহীন আকাশে বজ্রপাতের প্রবল শব্দ হয়ে বৃষ্টি নামতে লাগল। ঘরের দরজাটা শব্দ হয়ে লাগতে শুরু করল। হাসিব যা বলেছে পুনরায় সে ঘটনা মাত্র হলো আমার সাথে। হাসিবের মতো আমিও খেয়াল করলাম আমি মেঝেতে পড়ে আছি। তাড়াহুড়ো করে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বিছানার কাছে যেতে খেয়াল করলাম সন্ধি বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাহলে একটু আগে কাকে দেখলাম? আমি কোনো শব্দ না করেই চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। মুখে অসম্ভব জ্বলুনি হচ্ছিল আমার। জ্বলাটা প্রবল ভাবে উপলব্ধি করছিলাম। তাই মোবাইলে ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালিয়ে আয়নার সামনে যাওয়ার জন্য খাট থেকে নীচে নামতেই মনে হলো কেউ একজন আমার পায়ে আঁকড়ে ধরেছে। আমি আলোটা পায়ের কাছে ধরতেই খেয়াল করলাম লম্বা লম্বা নখ বিশিষ্ট একটা হাত আমার পা কে আঁকড়ে ধরেছে। আমি পা টা সাহস করে কোনো মতে ছাড়িয়ে খাটে পা টা উঠিয়ে সন্ধির দিকে তাকাতেই সন্ধি উঠে বসে বলল

– কি রে কি হয়েছে তোর?

আমি ভয়ে তখন কম্পিত হয়ে যেতে লাগলাম। ভয়ে ভয়ে সন্ধির দিকে আলোটা ধরতেই আরও ভয় পেয়ে গেলাম। সন্ধির চেহারাটা পুড়ে গেছে মনে হচ্ছে।সন্ধির শরীর থেকে বিচ্ছিরি একটা গন্ধ আসছে।আমি ভয়ে চিৎকার দিতে চেয়েও চিৎকার করতে পারছিলাম না। এমন সময় সন্ধি আমার হাতটা চেপে ধরল। আমার প্রাণটা যায় যায় অবস্থা।গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না। চারদিকে তখন অন্ধকার এখনো ভোরের আলো ফুটেনি।মনে হচ্ছে এ রাত আর শেষ হবে না। ভয়ে ভয়ে চোখটা বন্ধ করে খিঁচ মেরে রইলাম। খানিক্ষন পর সায়রা আপুর কন্ঠ স্বর শোনে মাথাটা উঠালাম। সায়রা আপু আমাকে ধরে বলল

– কী রে তন্দ্রা তুই এভাবে নীচের দিকে তাকিয়ে বসে ছিলি কেন? আর এরকম অদ্ভূত শব্দ করছিলি কেন?

আমি আপুর দিকে তাকাতেই খেয়াল করলাম সন্ধি আপুর পাশে বসে আছে। আমার গলাটা তখন শুকিয়ে খরা পরে গেছিল। কিছু বলতে পারছিলাম না। আপু আমার অবস্থা দেখে সন্ধিকে বলল পানি আনতে। সন্ধি আমাকে পানি এনে দিল। আমি চটপট পানিটা খেলাম। এখন মনে হচ্ছে একটু শান্তি লাগছে। আমি আপুকে বললাম

– জানি না কি হয়েছিল। হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখেছি।

আপু আমার কথা শোনে সন্ধির দিকে তাকিয়ে বলল

– তোকে কত করে বললাম তন্দ্রার সাথে গিয়ে ঘুমা ও একা একা ভয় পাবে। নাহ তুই আমার সাথেই ঘুমাবি৷ এখন দেখেছিস ও কতটা ভয় পেয়েছে স্বপ্ন দেখে।

আপুর কথা শোনে কিছুটা অবাক হলাম। তার মানে সন্ধি আপুর রুমে আপুর সাথে ঘুমিয়েছে। অবাক চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে বললাম

– সন্ধি তোমার সাথে ছিল?

– হ্যাঁ তুই ঘুমানোর কিছুক্ষণ পর গিয়ে বলল ওর ভালো লাগছে না আমার সাথে ঘুমাবে।আমি তো সন্ধিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোরবেলা তোর রুম থকে তোর অদ্ভূত শব্দে রুমে এসে দেখলাম তুই নীচের দিকে তাকিয়ে বসে আছিস।

আপুর কথাটা শোনে দ্বিতীয় বারের মতো অবাক হয়ে গেলাম। একটু আগে আমার পাশে কে ছিল সেটা ভেবেই ভয়ে আঁৎকে উঠছিলাম। তবুও আপুকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হালকা সুরে বললাম

– দুঃস্বপ্ন দেখেছি। আচ্ছা যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসতেছি।

বলেই আমি চারপাশ তাকালাম। ততক্ষণে চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল।আপু আর সন্ধি কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। রাতের ঘটনাটা বারবার আমার মনে নাড়া দিতে লাগল। আমি নিজেকে ফ্রেশ করে হাসিবকে কল দিয়ে সবটা বললাম। হাসিব আমার সবটা কথা শোনে একটা চাঞ্চল্যকর কথা বলল। যা শোনে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম।

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here