#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ১৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন। আমার কোনো ক্ষতি করবেন না প্লিজ…”
আরশি কান্নারত অবস্থায় চেচিয়ে কথা গুলো বলছে। এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে আরশির। নিজেকে বাঁচানোর জন্য আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে কেউ যেন এসে তাকে রক্ষা করে। তার নামের পাশে ধর্ষিতার পদক পাওয়ার থেকে রক্ষা করে। তার ইজ্জত যেন সে রক্ষা করতে পারে। আরশির চেচামেচিতে লোকটা ক্ষিপ্ত হয়ে আরশির গালে সজোড়ে থাপ্পড় মেরে মুখ চেপে ধরলো। টেনে হেঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
—————————
প্রিয় রৌদ্র,
অচেনা মানুষের সাথে অনুভূতি শেয়ার করা, কিশোরী মেয়ের মতো উৎসুক, আবেগপ্রবণ হয়ে চিঠি লিখতে বসা, এক বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্য বারান্দায় চিঠি ছুড়ে ফেলা এইসব কিছুতেই আমি অন্য রকম অনুভূতি খুঁজে পাচ্ছি। এই সকল অনুভূতির সাথে আমি আগে কখনো পরিচিত হইনি। এইসব অভিজ্ঞতা অনুভব করতেই হয়তোবা প্রয়োজন ছিল চিঠির অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটার।
যাইহোক আপনার পাখিগুলোর খেয়াল রাখবেন। আমি দু তিনদিন বাসার বাহিরে থাকবো। তাই আপনার পাখিগুলোর খেয়াল রাখতে পারবো না দুঃখিত। ভালো থাকবেন।
[বিঃদ্রঃ আপনার চিঠির অপেক্ষায় ছিলাম কি-না তা না হয় অজানাই থাকুক। আপনিই তো বলেছিলেন সব কিছু জেনে গেলে মানুষের আগ্রহ কমে যায়। তাই আমিও চাচ্ছি এটা আপনার কাছে অজানা থাকুক।]
ইতি,
রুদ্রাণী
রৌদ্র চিঠিটা পরতেই তার মন খারাপ হয়ে গেল। বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে। তার রুদ্রাণী চলে গেছে ভেবেই তার রৌদ্রজ্বল আকাশ যেন কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশে পরিনত হয়ে গেল। কি হচ্ছে এসব!! দু দিন সে নিজেই বাসায় ছিল না আর এখন আরশি বাসায় থাকবে না ভাবতেই রাগ উঠছে তার। চিঠির জন্য অপেক্ষা করা তার জন্য কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। ময়না পাখির আকর্ষণীয় ‘আরু’ ডাকে রৌদ্র তার ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসলো। মুচকি হাসি দিয়ে পাখিটার দিকে তাকালো। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে এই আরু ডাকটা শিখিয়েছে পাখিটাকে। ময়না পাখির খাচার সামনে গিয়ে রৌদ্র শান্ত গলায় বলল-
“যতই কষ্ট হোক আমি আমার আরুর চিঠির জন্য অপেক্ষা করবোই। রৌদ্রর শহরে রুদ্রাণীকে আসতেই হবে।”
কথা গুলো বলেই রৌদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অল্প কয়দিনেই মেয়েটার প্রতি এতটা দুর্বল হয়ে পারবে সে কল্পনাও করেনি। আদোও কি আরশি তার হবে কি না সেটাও জানেনা রৌদ্র। তবুও সে আরশিকেই তার রৌদ্রজ্বল শহরের রুদ্রাণী বানিয়ে রেখেছে।
—————————
আরশির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে কাসফিয়া পেছন ফিরে আরশিকে খুঁজতে লাগলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে আশেপাশে আরশিকে দেখতে না পেয়ে ভয়ে আঁতকে উঠলো কাসফিয়া। উত্তেজিত হয়ে উচ্চস্বরে চেচিয়ে বলল-
“এইই নীল.. আশু কোথায়?? আমাদের সাথেই তো ছিল হঠাৎ করেই কোথায় উধাও হয়ে গেল।”
সবাই কাসফিয়ার কথায় চমকে উঠলো। আশেপাশে তাকিয়ে সত্যি সত্যিই আরশি না দেখে তাদের সবার মনেই খানিকটা ভয় ডুকে গেল। নীলা বার বার আরশিকে ফোন দিয়েও ফোন বন্ধ পাচ্ছে।আদ্রাফ দ্রুত এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে বললো-
“চিন্তা করিস না এখানেই আছে হয়তো খুঁজে দেখ।”
নীল হন্তদন্ত হয়ে খুঁজতে লাগলো। সবাই আলাদা আলাদা হয়ে খুঁজে যাচ্ছে। কাসফিয়ার মাথা যেন পুরো ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভয়ে চোখ মুখ ফেকাসে হয়ে গেছে। ডান পাশের মোড়ে দিকে আসতেই কাসফিয়া কারও গোঙানির শব্দ পেল। দ্রুত পায়ে সামনের দিকে যেতেই আরশিকে এই অবস্থায় দেখে কাসফিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো। আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এক বখাটে টাইপের লোক আরশির মুখ চেপে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর আরশি নিজেকে ছাড়ানো আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আরশিকে এই অবস্থা দেখে কায়াফিয়া স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার প্রানপ্রিয় বেস্ট ফ্রেন্ড আরশি ছোট থেকেই হাস্যজ্জল,দুষ্টু, চঞ্চল স্বভাবের ছিল। তবে দু বছর আগের তিক্ত সত্যিটা এমনিতেই আরশির হাসিখুশি জীবনটা কালো মেঘে ঢেকে দিয়েছে। ব্যস্ততা আর হাসি ঠাট্টার মাঝেও যেন হুটহাট করেই উদাসিনতা ছেয়ে যেত আরশির মুখে। আরশি খুবই সেনসিটিভ একটা মেয়ে। অল্পতেই যেই মেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পরে সেই মেয়েটার জন্য এইরকম পরিস্থিতি হয়তো মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর কিছু। কাসফিয়া কিছু না ভেবেই আশেপাশে তাকিয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো। ঝোপের ভেতর থেকে একটা লাঠি নিয়ে তাদের সামনে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লোকটাকে মারতে লাগলো কাসফিয়া। আচমকা আক্রমণে লোকটা তার সামলাতে না পেরে আরশিকে ছেড়ে দিল। কাসফিয়া লাঠি ফেলেই আরশিকে গিয়ে ঝাপটে ধরলো। আরশিকে দাঁড় করিয়ে দিতেই পেছন থেকে কাসফিয়ার হাত মুচড়ে ধরলো লোকটা। ড্রাগস নেওয়ার ফলে লোকটার চোখ রক্ত বর্ন হয়ে আছে। রাগে শক্তি যেন দ্বিগুণ হয়ে গেছে তার। লোকটা তার সজ্ঞানেই নেই। কাসফিয়া ব্যথা কুকিয়ে উঠতেই আরশির ভয়ের পরিমান আরও মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেল। আরশি লোকটার দিকে আসতে নিলেই কাসফিয়া বলে উঠলো-
“আরশি তুই যা এখান থেকে। ওইদিকে সবাই আছে।”
আরশি এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। অঝোরে চোখের পানি ফেলে যাচ্ছে। কাসফিয়া এবার নিজের হাত ছাড়ানো চেষ্টা করতে করতে চেচিয়ে বলল-
“আরশি তোকে আমাদের বন্ধুত্বের দোহাই তুই যা এখন থেকে। আমি এদিকটা দেখছি তুই বাকি সবাইকে নিয়ে আয়।”
আরশি কোনো কথা বলছে না। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে কাসফিয়ার দিকে৷ আচমকা কাসফিয়া বেশ জোরেই চিৎকার দিয়ে উঠলো। হাত পেছনের দিকে মুচড়ে ধরায় প্রচন্ড ব্যথায় গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠলো কাসফিয়া। আরশি এগিয়ে আসতে নিলে কাসফিয়া আবারও বাধা দিয়ে কান্নারত অবস্থায় জোড়ানো কন্ঠে বললো-
“আ আশু প্লিজজ তুই যা…”
আরশি কিছু করার আগেই পেছন থেকে নীল আর আদ্রাফ এসে তাদের এই অবস্থা দেখে বাঘের মতো হুংকার দিয়ে দৌড়ে আসতে লাগলো। লোকটা এবার বেশি মানুষ দেখে ভয়ে কাসফিয়াকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেই পালিয়ে গেল। আরশি দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে মাঝ রাস্তায় বসে পরলো। আদ্রাফ এসেই কাসফিয়াকে ধরে ফেললো। কাসফিয়া দাঁতে দাঁত চেপে হাতের ব্যথা সহ্য করে যাচ্ছে। নীল লোকটার পেছনেই ছুটে গেল। আর নীলা দৌড়ে এসে আরশিকে ধরে ওঠানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। আরশি আগের মতো করেই মাথা চেপে ধরে অনবরত চোখেরজল ফেলে যাচ্ছে নিঃশব্দে। ভয়ে আরশির পুরো শরীর কেঁপে উঠছে। দু হাত মাথার চুল গুলো খামচে ধরে আছে। কাসফিয়া বাম হাত দিয়ে ডান হাত আলতো করে আঁকড়ে ধরে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রাফ দু হাতে কাসফিয়া আগলে ধরে রেখেছে। কাসফিয়া আরশির কাছে এগিয়ে আসতে চাইলেই আদ্রাফ কাসফিয়াকে ধরে নিয়ে আসে। নীল লোকটা ধরতে ব্যর্থ হয়ে ছুটে ফিরে এসেছে আরশির কাছে। কাসফিয়া আরশির দিকে ঝুকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আরশি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলো। সবাই প্রচন্ড বিচলিত হয়ে পরলো আরশির অবস্থা দেখে। নীল তাড়াতাড়ি করে আরশির পাশে বসে আরশিকে তুলে ঝাপটে ধরে ডাকতে লাগলো। আরশির কোনো সাড়াশব্দ না পাঁজাকোলে তুলে নিয়েই দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। নীলা কাসফিয়াকে ধরে আছে। কাসফিয়া নিজের হাতের ব্যথা ভুলে গিয়েই আরশির জন্য উত্তেজিত হয়ে পরেছে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠেছে কাসফিয়া। আর আদ্রাফ দ্রুত আরশি আর কাসফিয়া বাসায় ফোন করে জানিয়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যেই দু পরিবারের সবাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো রাস্তায়। তাদের মেয়ে দুটোর এই অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সবাই। আদ্রাফ আরশির বাসা থেকে গাড়ি এনেই সবাইকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে চলে গেল।
————————
হসপিটালের কেবিনে শুয়ে আছে আরশি। হাতে স্যালাইন লাগানো। অজ্ঞান অবস্থাতেই বার বার ভয়ে আঁতকে উঠছে। নিম্নস্বরে অস্পষ্ট ভাবে কাসফিকে ডেকে যাচ্ছে। নীল আরশির বেডের পাশেই দু’হাত ভাজ করে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কাসফিয়া প্লাস্টার বাঁধা হাত নিয়ে বসে আছে আরশির ডান পাশের একটা চেয়ারে। আদ্রাফ আর নীলা কেবিনের বাহিরে আরশি আর কাসফিয়া বাবা-মাকে সামলাচ্ছে। মেয়ের এক অবস্থা দেখে তারা প্রচন্ডভাবে ভেঙে পরেছে। কাসফিয়া অপলকভাবে তাকিয়ে আছে আরশির কম্পিত ঠোঁটের দিকে। নীলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো-
“নীল ডক্টরকে ডেকে নিয়ে আয়। আরশির অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না আমার কাছে।”
নীল মাথা নাড়িয়েই কেবিন থেকে বেড়িয়ে গেল।
চলবে…