#নীল_দিগন্তে
পর্ব-০৫
লেখাঃ নীলাদ্রি নীরা
পুষ্পর সংঘটনের থিওরিকাল পার্ট শেষ। প্র্যাকটিক্যাল পার্টও মোটামুটি শেষের দিকে। কিছুদিন পর থেকে অর্ডার নেয়ার কাজ শুরু হবে। অবশ্য নকশিকাথাগুলো ডেলিভারি দেয়া শুরু করে দিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ট্রেনিংটা শেষ হয়ে যাবে সে ভাবেই নি। ভালোই হয়েছে। অন্যগুলোরও অর্ডারের জন্য কাজ শুরু করে দিবে শীঘ্রই। প্রশিক্ষণার্থীরাও খুব চালু। পুষ্প ব্লকের জন্য রঙ মাখানো ডাইটা যাস্ট কাপড়ে বসিয়েছে তখনই সোহেলী খাতুনের নাম্বার থেকে কল আসলো। পুষ্প ভ্রু কুচকে তাকালো ফোনটার দিকে। দুপুর সাড়ে তিনটা বাজে। চাচী ফোন দিচ্ছেন হটাৎ! মেয়েদের কাছে ডাইটা দিয়ে একটু দূরে গিয়ে কলটা রিসিভ করলো পুষ্প!
-“হ্যালো পুষ্প! পুষ্পরে! মা তুই তাড়াতাড়ি বাসায় আয়। আমার সংসারটা শেষ রে পুষ্প! ”
-” কি হয়েছে চাচী?”
-” পুষ্পরে আমি দুইটা অমানুষ পেটে ধরেছিলাম। ছোট অমানুষটা ফিল্মের কোন নায়িকাকে বিয়ে করে তোর ফুফুর বাসায় গিয়ে উঠেছে। কত বড় হারামজাদা দেখছিস! যে মা বাপ জন্ম দিলো তাদের না জানিয়ে বিয়ে করে বসে আছে!”
-” একদিন তো বিয়ে করতোই চাচী। বাদ দাও যা হওয়ার হয়েছে! ”
সোহেলী খাতুন ধমকে বললেন,
-” যা হওয়ার হয়েছে মানে! আমার ছেলে আমাকে না বলে বিয়ে করে বসে আছে। আশ্চর্য তো!”
পুষ্প ফোন রেখে আবার গিয়ে ওর কাজে মন দিলো। আজকে সে খুব ভালো করে কাজটা কমপ্লিট করবে।
.
পুষ্প খুশবু ফুফুর বাসায় গেলো সন্ধ্যায়। ফুফুর প্রেশার বেড়ে গিয়েছে। তানিয়া, সানিয়া নামের কাজের মেয়ে দুটি অনবরত ফুফুর মাথায় পানি ঢালতেই আছে। রাত্রি মায়ের পাশে বসে বসে ঘুমুচ্ছে। পুষ্প ফিসফিস করে তানিয়াকে জিজ্ঞেস করলো রাহাত ভাইয়া কোথায়। তানিয়া ইশারায় পুষ্পকে দেখিয়ে দিলো। আরো বললো,
-” খালুজানের নামে মামলা হইবো আফা। নিউজে কইতাসে খালুজান নাকি দুর্নীতি করসে। সকাল থাইকা খালুজানের ফোন বন্ধ। কোনো খোঁজ নাই আফা।”
পুষ্প রাহাত ভাইয়া যে রুমে আছেন ওইদিকে গেলো। রাহাত ভাইয়া আর নায়িকা ভাবী ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। আচ্ছা পুষ্প রাহাত ভাইয়ার বউকে কি ডাকবে? ছোট ভাবী? নাকি নায়িকা ভাবী? দরজার সামনে গিয়ে পুষ্প ভাবলো নক করবে নাকি করবে না। ভাবতে ভাবতেই নক করে ফেললো। রাহাত প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে পুষ্পকে দেখেই আবার দরজা বন্ধ করে দিলো। ভিতর থেকে নিচু গলায় রাহায় বললো,
-” পুষ্প তোর সাথে মা এসেছে? ”
পুষ্প বললো,
-” না”
রাহাত দরজা খুলে লাজুক ভঙ্গিতে হেসে বললো,
-” ভিতরে আয়”
পুষ্প রুমের ভিতরে গিয়ে দেখলো খুব সুন্দরী একটি মেয়ে পায়ে নেইল পলিশ দিচ্ছে আর গুনগুন করে গান গাইছে,
“শোনো গো দখিনা হাওয়া
প্রেম করেছি আমি……”
পুষ্পকে দেখে মেয়েটি ইশারায় রাহাতকে জিজ্ঞেস করলো। রাহাত বললো,
-” ও ভাইয়ার আপন বোন আর আমার সৎ বোন পুষ্প। তোমার কাছের ননদ। আর রাত্রি সে তোমার দূরের ননদ। বেশি দূরের না তবে একটু দূরের।”
মেয়েটা হেসে ফেললো। পুষ্প তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো রাহাতের দিকে। আপন বোন, সৎ বোন মানেটা আবার কি! মেয়েটা এক হাত উচু করে হাই দেখিয়ে বললো,
-” হেই ননদিনী! ইটস নিহারিকা।”
পুষ্পও হাই দিলো। রাহাত বললো,
-” পুষ্প তুই ভালোবাসা আজকাল মুভিটা দেখেছিস? ও ওই সিনেমার মেইন হিরোইন ছিলো! একদম সুপারহিট একটা মুভি ”
-” আমি এগুলো দেখিনা ভাইয়া!”
-“ওহ আই ফরগট। তুই তো একটা রসকষহীন মানুষ। সারাক্ষণ মুখটা ভোতা করে রাখিস। যাইহোক নিহারিকার সাথে গল্পটল্প কর। বেচারি একা একা বোর হচ্ছে। তুই এইভাবে দাড়িয়ে থাকিস না তো বিরক্ত লাগে।”
-” একা কোথায়? তুমিও তো আছো ভাইয়া তুমি গল্প করছো না কেন?”
রাহাত কিছু না বলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। পুষ্প বিছানায় বসতে বসতে বললো,
-” এভাবে চুপিচুপি বিয়ে করলেন যে, আপনার ইমেজে কি এর কোনো প্রভাব পড়বে না? আই মীন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মানুষ! সেলিব্রিটি মানুষ! মিডিয়া খবর পেলে নিশ্চয়ই নিউজ হয়ে যাবে ব্যাপারটা! বিভিন্ন গল্প বানিয়ে দিবে।”
নিহারিকা একটু হাসলো। তারপর বললো,
-” আমরা প্রিপ্ল্যান ছাড়া কিছুই করিনা। মিডিয়া উৎ পেতে থাকে গোল দেয়ার, অথচ তাদের এই উৎ পাতার মাঝেই আমরা গোল দিয়ে বসি। মিডিয়া জানে আমি এখন আমেরিকায়।”
-“ওহ”
-” বাই দ্যা ওয়ে পুষ্প তোমার নাকের ডগার তিলটা কি অরিজিনাল নাকি আর্টিফিশিয়াল?”
পুষ্প ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
-“অরিজিনাল।”
-” আই সী। তিলটা দারুন। এই যে আমার ডান গালের নিচের দিকে থুতনির কাছাকাছি যে তিলটা আছে না? ওটা খুব নাইস না? কিন্তু এটা আর্টিফিশিয়াল। যাস্ট কিউটনেস এর জন্য অলওয়েজ দিই।”
-“ওহ”
পুষ্প কিছুটা অবাক হলো সুপারহিট হিরোইন কি অবলীলায় কথা বলছে। পুষ্পর ধারণা ছিলো সেলিব্রেটি মানেই পাবলিক দেখলে নাক সিটকাবে, বিরক্ত হবে। বলবে, হেই ইউ, গেট লস্ট, স্টে এওয়ে, অ্যাম বিজি। অথচ নিহারিকা হিরোইন ওর ধারণাই বদলে দিলো। এই সময় রাহাত রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-” বুঝলি পুষ্প এই সুযোগে তুইও বিয়ে
করে ফেল। এখনই মুখ্যম সুযোগ। পরে দেখবি পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছিস না। তখন নাকের ইয়ে আর চোখের ইয়ে বিক্রিয়া করে বিস্ফোরিত হবে।”
পুষ্প একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। নিহারিকা ভাবীর কন্ঠ শোনা গেলো,
-” সিগারেট খেয়ে সেন্টারফ্রুট চিবোতে পারো না! পুরো ঘরে সিগারেটের গন্ধে ভুই ভুই করছে। ছিহ”
.
পুষ্পকে দেখে সোহেলী খাতুন বললেন, -“তুই কত নিষ্ঠুররে পুষ্প! তোকে ফোন দিয়েছি সেই দুপুরে আর এখন হচ্ছে গিয়ে রাত! তুই আমার এই অসময়েও আমার পাশে থাকলি না! কি নিষ্ঠুর তুই!”
পুষ্প জুতো খুলে সেটা স্যু কেবিনেট এ রাখতে রাখতে বললো,
-” কাজ ছিলো চাচী!”
-” আমাদের থেকেও তোর কাজ বড়?”
পুষ্প প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললো,
-” ফুফুর বাসায় গিয়েছিলাম। ফুফুর প্রেশার বেড়ে গিয়ে বেহাল অবস্থা। ফুফার ও কোনো খবর নেই। ”
-” জানি জানি! দূর্নীতি করবে আর ফল পাবে না? আর ওই হারামজাদা আর হারামজাদী দুইটা কয়দিন তোর ফুফুর বাসায় থাকবে দেখবো! খেলা তো অটোমেটিক শুরু হয়েছে। আসুক না একবার লাথি মেরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে যদি বান্দর দুটোকে বিদেয় না করেছি তো আমার নাম সোহেলী না!”
-” চাচা কোথায় চাচী? রেগে আছে নিশ্চয়ই?”
-” দরজা বন্ধ করে রেখেছে। ছোট ছেলেকে ত্যাজ্য করবে বলছে। শয়তানটা তো বড়টার আগেই বিয়ে করে বসেছে। এবার বড়টাকে ছাই লাগিয়ে ধরতে হবে বুঝলি? বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোর চাচা কে ঠান্ডা করে রেখেছি। রাজীব আসুক তারপর ব্যবস্থা হবে। শোন তোর চাচা বলেছিলো তুই ফিরলে একবার তার ঘরে যেতে। তোর সাথে কথা বলবে।”
.
পুষ্পর চাচা ব্যারিস্টার মশিউর রহমান বললেন,
-” তোর বাবার অনুপস্থিতিতে তোর অভিভাবক কে সেটা নিশ্চয়ই জানিস পুষ্প?”
-” হ্যা চাচা।”
-” তুই এটা বিশ্বাস করিস তো তোর সেই অভিভাবকেরা তোকে কতটা স্নেহ করে। তোর কতটা ভালো চায়?”
পুষ্প মাথা নাড়ালো। মশিউর রহমান বললেন,
-” তুই পড়াশোনার পাশাপাশি কাজটাজ করছিস। নিজে নিজে স্টাবলিসড হওয়ার চেষ্টা করছিস সেটা আমার ভালো লাগছে। আশা করি, একদিন তুই তোর এই পথে অনেক এগিয়ে যাবি। সারাদেশের মানুষ তোর এই পদক্ষেপটাকে সম্মান জানাবে। কিন্তু রাজীব ও কিন্তু তোর জন্য কম নয়। ব্যাংকে জব করছে কিন্তু সে বিসিএসের জন্যও পড়ছে। আমার রাজীবের প্রতি বিশ্বাস আছে যে সে পারবে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে। রাহাতের মতো মূর্খতা সে করবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাহাত পালিয়ে বিয়ে করেছে সেটা আগে আমার কাছে খারাপ লাগলেও এখন মনে হচ্ছে রাজীবেরও এখনই বিয়েটা করে ফেলা উচিত। ইভেন আজকেই। আর বিয়েটা হবে তোর সাথে! তোর কিছু বলার নেই আশা করছি।”
পুষ্প অবাক হওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে। চোখ বড় বড় করে বললো,
-“মানে কি চাচা আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
-” তুই কোনো বাচ্চাও না আর না বুঝার মতো আমি কিছুই বলিনি পুষ্প। রাজীবের সাথেও আমার কথা হয়েছে। তোর মা ও রাজি আছে। আমি তোর কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাচ্ছি না। নাও গেট লস্ট”
পুষ্প মনে মনে বললো, ঘোড়ার ডিমের কথা হয়েছে। সে কেন রাজি হবে? নির্ঘাত রাজীব ভাইয়াকে চিপায় ফেলে দিয়েছো।
সেদিন রাত ১১টায় একদম ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়ে গেলো রাজীব পুষ্পর। একদম সাধারণ ভাবে। তবে মশিউর রহমান বলেছেন রিসিপশন পরে হবে। রাজীবের বিরক্তির শেষ নেই। শেষমেশ কিনা পুষ্প! একরোখা, বদমেজাজি, রাগী একটা মেয়ে! এরমাঝে ওদের চোখাচোখি হলো, তখন পুষ্প কপাল কুচকে ভ্যাংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এই মেয়ের সাথে সারাটা জীবন কিভাবে কাটাবে চিন্তায় পড়ে গেল রাজীব।
বিয়ের হয়ে যাওয়ার পরপরই জাহানারা নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে চুপ মেরে বসে আছেন। তার ধারণা পুষ্পর বাবার মতো রাজীবও অন্য মেয়ে নিয়ে পালাবে। পুষ্পকে সারাজীবন উনার মতো একাকীত্ব নিয়ে বাঁচতে হবে। রাহাত ও তো নায়িকা নিয়ে পালিয়েছে। এই পরিবারের ছেলেগুলো সবকটাই বদমাশ! উনার মাঝেমধ্যে মনে হয় মিনহাজুর রহমানকে উনার খোঁজা উচিত, দেখা করে জনসমাগম কোনো জায়গায় জুতোটা খুলে দুই চারটা বারি দিয়ে আসবেন। বউ,সন্তান রেখে অন্য মেয়ের হাত ধরে পালানোর শাস্তি স্বরূপ।
চলবে…..
💓