নীল দিগন্তে পর্ব ৬

#নীল_দিগন্তে
পর্ব-০৬
লেখা- নীলাদ্রি নীরা

সোহেলী খাতুন বেজায় খুশি। পুষ্পর মতো সাহসী আর ত্যাগী মেয়েই তার দরকার। যদিও পুষ্প খুবই চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে, একটু আধটু চঞ্চল হলেও মন্দ হতো না। পুষ্পকে তিনি সংসারের বিভিন্ন ট্রিকস শিখিয়ে দিলেন। তার ছোটছেলে নিয়ে উনার কোনো মাথাব্যথাই নেই। রাজীব বিয়ের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই রুমে গিয়ে রাজ্যের ঘুম দিয়েছে। কাল তার অফিস আছে! ঘুম না হলে সে হিসাব,লেনদেন ঠিকঠাক কর‍তে পারবে না। পুষ্প রাজীবকে দেখে মনে মনে ভাবলো, পৃথিবীতে কোনো মেয়ে আছে যার বর বাসর রাতে ঢুকেই মরার মতো ঘুমায়? কি জানি! হয়তো আছে! অবশ্য তাতে পুষ্পর জন্য ভালোই হয়েছে। সে খানিকক্ষণ একা থাকতে পারবে।
.
সকালে পুষ্প ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় বাঁধ সাধলো ওদের বাসার বুয়া শারমিন। সে একবার ডাইনিং এ যাচ্ছে আরেকবার পুষ্পর রুমে। পুষ্প বিরক্ত হয়ে বলল,
-” শারমিন আপা, তুমি আমার পিছনে কেন পড়েছো বলবে? ”
শারমিন শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মুছে বলল,
-“ও আফা গো বিয়ার পরদিন নতুন বৌ এর বাসা থাইক্কা বাইরইতে নাই গো। বদ নজর লাগে গো আফা। জ্বীন পরীর নজর লাগে।”
পুষ্প ভ্রু কুচকে বলল,
-” এইসব কুসংস্কার কি তুমি নিজে বানিয়েছো?”
-” না গো আফা। এইডা হাছা কথা। ডাকের কথা। ডাকের কথা মিছা হয় না। আমি বানাই নাই আফা বিশ্বাস করেন।”
পুষ্প চুপ। শারমিন এবার জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” মাইনসের মন পাথর হইয়া যাইতেসে গো আফা। মানুষ আর মানুষ নাই, যন্ত্র হইয়া যাইতেসে। বিয়ার কইন্যা এখন আর কান্দে না। দাত বাইর কইরা হাসে আর ফডু তুলে। দুনিয়াডাই পাথর হইয়া গেছে গা গো। বিয়ার জামাই আর শরম পায় না। মাইনসের সামনেও বউরে চুমা দিয়া দেয়। কেমুইন্না বেশরম দেখছেন? আল্লাহ গো কি দিন আইলো।”
শারমিন আবারও আঁচলে চোখ মুছলো।
-” জানেন আফা। বড় ভাইজানরে কইলাম, ভাইজান আপনে আইজকা অফিসে যাইয়েন না, বিয়া করসেন কাইলকা। আইজকা বাসায় থাকেন। আফার লগে গল্প করেন। ভাইজানে কয়, আমার অফিসের কাজগুলো কি তুমি করে দিবা শারমিন আপা? আমি আর কি কমু। ভাইজান ও অফিসে গেল গা। আপনেও ভার্সিটিতে যাইবেন না গা। বিয়ার পরের দিন জামাই অফিসে যায়,বউ ভার্সিটিতে যায় এইডা পারা প্রতিবেশী শুনলে কত কি কইব গো আফা। কইব পোলা মাইয়া দুইজনেরই বিয়ার আগে রিলেশেন আছিল। হের লাইজ্ঞাই…”
পুষ্প রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে শারমিনের দিকে তাকালো। শারমিন ভয়ে দৌড়ে সোহেলী খাতুনের কাছে গিয়ে বলল,
-” খালা গো। দুইন্নাই থাইক্কা ঈমান উইট্টা যাইতেসে গো খালা।”
.
দুপুরের দিকে সোহেলী খাতুন রান্না করছিলেন। শারমিন কাটাকুটি করছিলো। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে শারমিন মেইন ডোর খুলেই “ও খালাগো” বলে একটা চিৎকার দিলো। সোহেলী খাতুন বিরক্ত হয়ে এগিয়ে আসলেন। কেউ কিছু বলার আগেই রাত্রি বলল,
-” শারমিন আপা এত আস্তে চিৎকার করলে হয় বলো? মাইক এনে দিই? তারপরে জোরে জোরে বলবে, ভাইসব নিরিবিলি হাউজে ডাকাত এসেছে। তাদের সাথে অস্ত্র স্বরূপ আছে তিনটি বড় বড় লাগেজ। তারা দুইজন মহিলা। আপনারা যে যেখানে পারেন আমাদের সাহায্য করেন।”
সোহেলী বললেন,
-” শারমিন চুলায় তরকারিটা দেখ তো গিয়ে।”
তারপর খুশবুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” দাড়িয়ে আছো কেন খুশবু? ভেতরে আসো।”
খুশবু বাসার ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,
-” বড় ভাবী ভয় হচ্ছে ভেতরে যেতে বুঝলে। ভাইয়ের ঘাড়ে চাপতে হবে স্বপ্নেও ভাবি নি। দুদক থেকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছে বাসা ছাড়ার। ভাড়াটিয়া গুলা ভাড়া না দিয়েই চলে গিয়েছে। যতগুলো বাসা ছিলো সবগুলোই সীলগালা করে দিয়েছে। লোভী লোকটা একদম পথে বসিয়ে ছাড়লো। নিজে তো কোথাও গুম মেরে বসে আছে কোনো খবর নেই, আর আমরা মা মেয়ে ঘরছাড়া। পুরো বাসার জিনিসপত্র পুলিশ, ডিবি এসে লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে।”
-” কপালে যা হওয়ার তাই হয়েছে। কপালের লিখা তো বদলানো যায় না।”
খুশবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রাত্রি বললো,
-” বড় মামী পুষ্প কি বাসায় নেই?”
সোহেলী খাতুন বললেন,
-” না। ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে।”
রাত্রি পুষ্পর রুমে চলে গেল। সোহেলী খাতুন বললেন,
-” রাহাত কোথায়? তোমাদের বাসায় না ছিলো?”
খুশবু বললেন,
-” ছেলের খোঁজ নিয়ে করবেটা কি? তাদের তো তোমরা এক্সেপ্ট করবে না। কতসব কথাই তো শুনালে তুমি আর বড় ভাই মিলে।”
-” কি বলছো তুমি? যে ছেলে বাবা মাকে জিজ্ঞেস না করে বিয়ে করে বসে তাকে কেন এক্সেপ্ট করবো বলো? সে কি এটা অন্যায় করে নি? আর এখন কোথায় আছে সেটা আমরা জানতে পারব না? আশ্চর্য! সে আমার নিজের ছেলে। ”
-” বাদ দাও ওসব। রাজীব পুষ্পকে নাকি বিয়ে দিয়েছো?”
-” করবো টা কি! কখন আবার ছোটটার মতো কাজ করে বসবে বলা যায়? বাবা মায়ের মানসম্মান দিয়ে তো ভাবলো না।”
-” ভালোই করেছো। পুষ্পর জন্যও ভালো হলো। ওর কোনো ননদ নেই। কথায় আছে না? ননদ কাঁটা ভীষণ জ্বালা! পুষ্পর এই ঝামেলাটা নেই।”

সোহেলী খাতুন অবাক হলেন না। কিছু মানুষের স্বভাব সারাজীবনেও বদলায় না। এরা সময়, অসময় বুঝে না। বুঝে শুধু সুযোগমত অন্যদের খোঁচা মারা।
.

পুষ্প বাসায় আসতে আজকে খুব লেট হয়ে গেল। অন্যদিন ফেরে রাত আটটা কিংবা নয়টায়। এটা নিয়ে অবশ্য বাসার কারোরই মাথাব্যথা নেই। রাজীব ফেরে দশটার মধ্যেই। পুষ্প বাসায় আসতেই দরজা খুলে দিলো রাত্রি। দরজা খুলেই বলল,
-” কিরে পুষ্প! তুই এতো রাতে আমাদের এখানে যে? এনি প্রবলেম?”
পুষ্প ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। ও কি ভুল করে ফুফুর বাসায় চলে এসেছে? আশ্চর্য! পুষ্প এদিক ওদিক তাকিয়ে শিওর হলো এটা ওদেরই বাসা।
-” উফফ আমি একটুর জন্য হলেও ভেবে নিয়েছি ভুল করে তোদের বাসায় এসে পড়েছি।”
রাত্রি হাসলো। পুষ্পও আলতো করে হাসলো। সেটা লক্ষ্য করে রাত্রি বলল,
-” বাব্বাহ হার্ড লায়নির মুখে হাসি! এটা আমি দেখছি? লাইক সিরিয়াসলি? ওহ মাই গড! আচ্ছা পুষ্প বিয়ে তো তোর উপর সেই ইফেক্ট ফেলেছে দেখছি।”
পুষ্প ভ্রু কুচকে বলল,
-” মানে?”
রাত্রি বলল,
-” এই যে হাসছিস। তুই তো হাসতেও জানতিস না। একদিনেই? রিয়্যালি ইউ ডিড আ গ্রেট জব মাই লাভলী সিস্টু! অ্যাম প্রাউড অফ ইউ বেইবি।”
-” আরে কি যে বলিস তুই। এসব কিছুই না। আজকে আমি অনেক খুশি কারণ আমরা অনেক বড় একটা ডিল পেয়েছি। একটা শোরুমে যাস্ট সিম্পল দেখাতে গিয়েছিলাম ওরা অনেক বড় একটা এমাউন্টের অর্ডার করেছে। আমরা তো কেউ ভাবিইনি যে এত তাড়াতাড়ি এত বড় একটা অর্ডার পাবো যেখানে আমাদের হাতে কালেকশন বলতেই নেই। ”
রাত্রি ভ্যাংচিয়ে বলল,
-” বাল”

পুষ্প আবারো হাসলো। ও সত্যিই আজ খুশি। পুষ্প অভ্যাসবশত নিজের রুমে চলে গেলো। নিজের রুমে গিয়েই ওর চক্ষু ছানাবড়া। ঘর পুরো চেঞ্জড। রাত্রি বুঝতে পেরে বলল,
-” তোর জিনিসপত্র রাজীব ভাইয়ার ঘরে শিফট করা হয়েছে। আর সেই সুযোগে তোর ঘরটা আপাতত আমি দখলে নিয়ে নিলাম। তোর কোনো আপত্তি নেই তো!”
পুষ্প বলল,
-” আরে ধুর! কিসের আপত্তি!”

পুষ্প রাজীবের ঘরে গেলো। পুষ্পকে দেখে রাজীব বলল,
-” তুই কি প্রতিদিনই রাত করে ফিরিস পুষ্প?”
পুষ্প ওয়ারড্রোব থেকে কাপড় বের করতে করতে বলল,
-” না তো। আজকেই একটু লেট হয়েছে।”
-“কেন লেট হয়েছে? ”
-” কাজ ছিলো।”
-” কি কাজ?”
পুষ্প বিরক্ত হয়ে রাজীবের দিকে তাকালো। কিন্তু রাজীব আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে খুব রাগ। পুষ্প দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
-” সংঘটনের একটা অর্ডারের কাজ ছিলো। ”
-” সেটা দিনে করা যায় না?”
পুষ্প এবার রেগে গিয়ে বলল,
-” আশ্চর্য তো। ভাইয়া তুমি এত জেরা শুরু করেছো কেন বলবে? ”
রাজীব চিৎকার করে বললো,
-” তুই রাত ১১টা বাজিয়ে বাসায় আসবি আর আমি জিজ্ঞেস করলেই সেটা দোষ? ”

পুষ্প কিছু না বলে চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমে চলে গেল। রাজীব রাগে এসির রিমোট ছুড়ে মারল ওয়াশরুমের দরজায়। শাসন না পেয়ে পেয়ে পুষ্প এতটা বেয়াদব হয়ে গিয়েছে সেটা ওর ধারণাই ছিলো না। রাত্রি বারান্দায় বসে ছিল। দুই রুম পাশাপাশি হওয়ায় ওদের পুরো কনভারসেশনটাই রাত্রি মোটামুটি শুনতে পেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রাত্রি মনে মনে বলল,
” পুরুষ জাতি খুবই স্ট্রং। খুব সহজেই তারা পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে পারে আবার তার ব্যবহারও করতে পারে। অথচ আমরা মেয়েরা সহজে সেটা পারিনা। বছরের পর বছর চলে যায় আমাদের এডজাস্ট করে নিতে। মেয়েরা এত উইক কেন? এইযে ছোট মামা মামীকে ছেড়ে ফিল্মের কোন হিরোইনকে বিয়ে করেছে এটা কি মামী মেনে নিতে পেরেছে? পারে নি। এখনও তিনি স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছেন না। অথচ সেই জায়গায় মামা হলে এতদিনে সব ভুলেটুলে গিয়ে আবার হয় সংসারী হয়ে যেতেন নয়তো ভালো ভাবেই জীবনটাকে নিজের মতো করে উপভোগ করতেন। ”

চলবে……
(একটা প্রশ্নঃ গল্পের কোন চরিত্রকে আপনার ভালো লেগেছে আর কাকে ভালো লাগে না জানাবেন। কেন ভালো লাগে/লাগে না সেটাও জানাবেন। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here