নীল দিগন্তে পর্ব ৭

#নীল_দিগন্তে
পর্ব-০৭
লেখা- নীলাদ্রি নীরা

রাজীব মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে ফোনে কাজ করছিলো। সোহেলী খাতুন ছেলের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,
-” তোর বাবা বলছিল কাল নাকি পুষ্প ১১টা বাজিয়ে ফিরেছে। আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মেয়েটা কিন্তু আগে এরকম করত না। আট নয়টার মধ্যে ফিরত। এখন ও ঝামেলায় আছে ঠিক আছে তাই বলে এত রাত করবে? বিপদ আপদের হাত পা আছে? দেশের যা পরিস্থিতি। মেয়েদের জন্য বাবা মা চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে যায়। কখন কি হয়ে যায় বলা যায়? মেয়েটা কি অবুঝ? বাবা তুই কি পুষ্পকে বলবি যে একটু তাড়াতাড়ি যেন বাসায় ফেরে।”
রাজীব বলল,
-” তুমিও তো বলতে পারো মা। সে তো তোমার বান্ধবী। দিল কা টুকরা।”
-” চুল কেটে দিবো সব। শয়তান ছেলে। আমার গিলটি ফীল হয়। যতই হোক আমি তো ওর শাশুড়ি। মেয়েটা আবার যদি ভেবে বসে যে আমি তাকে সংসারে বাঁধতে চাইছি। যদিও পুষ্প অন্যরকম মেয়ে, তাও বলা তো যায় না। তুই ওর হাজবেন্ড তুই ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলবি।”
রাজীব মনে মনে বলল, লাভ নেই মা, সে আজকেও লেট করেই ফিরবে। ডানা গজিয়েছে তার। ফাজলামি….
-” আচ্ছা বলব।”
-” রাহাতের সাথে তোর কথা হয়?”
-” না তো।”
-” কালকে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি জানিস। সারাটা দিন কেটেছে অস্থিরতায়। ছেলেটা যে কোথায় আছে। ফোনটাও অফ করে রেখেছে। মায়ের কথা কি তার একবারও মনে পড়ে না? কেমন ছেলে এ আমার? ”
-” হয়তো পড়ে মা। তোমরা তো ওকে এক্সেপ্ট করবে না তাই হয়তো ও চায় না কন্টাক্ট করতে।”
-” আরে বাবা সে যে কাজ করছে তাতে এক্সেপ্ট করার কথা না। রাগ হয়েছিল তাই কত কিছু বলে ফেলেছি। কিন্তু ও তো আমার ছেলে! আমি কতদিন রাগ পুষে রাখব বল? না জানি ছেলেটা কেমন আছে! ওর চাকরিটাও রাগের মাথায় তোর বাবা নট করিয়ে দিয়েছে।”
সোহেলী খাতুনের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো রাজীবের কপালে। রাজীব মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-” রাহাত খুব ভালো আছে মা।”
সোহেলী খাতুনের হাসি পেলো। দুইটা ছেলে দুইরকম হয়েছে। বড়টা ওনার মতো, আর ছোটটা বাবার মতো। উনি যেমন মিথ্যে কথা বলতে পারেন না, রাজীব ও তেমন। বললেও ঠিকই সময়মতো ধরা পড়ে যাবে।
.
পুষ্প আজও দেরি করে ফিরেছে। পুষ্পকে দেখে রাজীব ঘড়ির দিকে তাকালো। এগারোটা সাইত্রিশ বাজে। রাজীব ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পুষ্প চলে গেল চেঞ্জ করতে। একটা লং শাওয়ার ও দিবে সে। তারপর এক ঘুমেই রাত পার।

রাত্রি ছাদে হাটছিল আর গান গাইছিলো,

ছিলে আমার স্বপ্নে তুমি, আজ কেন বহুদূর?
অনুভবে ভেসে আসে সেই চেনা প্রিয় সুর
কাছে যেতে সংশয়, দূরে থাকতেও লাগে ভয়
এলোমেলো লাগে সবই
অপূর্ণ রয়ে যায় ভালোবাসা
থেকে যায় কিছু কথোপকথন
অপূর্ণ রয়ে যায় ভালোবাসা
থেকে যায় কিছু কথোপকথন…

রাজীব চলে যাচ্ছিল। রাত্রি পিছনে না তাকিয়েই ডাকলো,
-” ভাইয়া!”
রাজীব বেশ খানিকটা অবাক হলো। রাত্রির কি মাথার পিছনেও চোখ আছে নাকি? রাজীব এগিয়ে গিয়ে বলল,
-” এত রাতে ছাদে কি করিস?”
-” ঘুম আসে না ভাইয়া!”
-” চেষ্টা না করলে আসবে কিভাবে? ”
-” কেমন আছো ভাইয়া?”
-” যেমন দেখছিস।”
রাত্রি হাসলো। তারপর বলল,
-” ভালো নেই ”
-” আমি ভালো আছি রাত্রি”
রাত্রি হেসে ফেললো।
-” তোমাকে আসামীর মতো লাগছে ভাইয়া। যেন কিছু একটা স্বীকার করতে চাচ্ছো না এরেস্ট হওয়ার ভয়ে। কিন্তু এরেস্ট হওয়া থেকে যদি দারুণ কিছু হয় তাহলে এরেস্ট হওয়াই ভালো। তাই না?
-” থাপ্পড় খেতে চাস?”
-” আমি মানুষের মন পড়তে পারি জানো তো। এই যে তুমি ছাদে এসে আবার ফিরে যাচ্ছিলে সেটাও আমি না দেখেই বুঝে ফেলেছি। আবার এখন তোমার বউ এর প্রতি তোমার খুব রাগ জমেছে। কারণ রাত করে বাসায় ফিরছে। তুমি তা প্রকাশ করছ না। কিন্তু সেটাও আমি বুঝতে পারছি। আমি সব বুঝতে পারি।”
রাজীব চুপ। রাত্রি কি সত্যিই মন পড়তে জানে? রাত্রি আবার বলল,
-” তুমি ছাদে এসেছো বউ ভেবে ফুটবলকে লাথি মারতে তাইনা? কিন্তু ফুটবল আমি ফুটো করে দিয়েছি। শয়তানটাকে কিক মারতে গিয়ে আমার পায়ে ভীষণ ব্যথা পেয়েছি।”
রাজীব হেসে ফেললো। রাত্রি বলল,
-” ভাইয়া ভিতরে ভিতরে কষ্ট পেয়ে লাভ নেই বুঝলে। কি দরকার নিজেকে কষ্ট দেয়ার? পাশের মানুষ থেকে অবহেলা পেলে তুমি যদি সেটা মেনে নিয়ে দূরে সরে আসো তাহলে মানুষটাকেই তুমি হারিয়ে ফেলছো। সম্পর্ক টিকে থাকে নিজ চেষ্টার কারনে। উদাসীন হয়ে চললে কোনো সম্পর্কই ঠিক থাকবে না।”
-” এক পক্ষের চেষ্টায় কি সম্পর্ক টিকে থাকে? সম্পর্ক টেকাতে হলে অবশ্যই উভয়পক্ষকে সম্পর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে।”
-” তুমি নিজে কি চেষ্টা করেছো? করছো না। আগে নিজে চেষ্টা করো, অপরপক্ষ থেকে সায় আসে কি না দেখো। এমন ও তো হতে পারে, অপরপক্ষের মানুষটাও একই কথা ভাবছে যে তার অপরপক্ষের মানুষটা হয়তো সম্পর্কটা টেকাতে চাচ্ছে না। পারে না বলো? একটা সুন্দর জীবনের জন্যে যদি আত্মসমর্পণ করতে হয় অবশ্যই করা উচিত।”
রাজীব অন্যদিকে তাকালো। রাত্রির সাথে কথায় সে কখনোই পারবে না। অবশ্য রাত্রি ভুল কিছু বলে নি। নিজের ইগোর কারনে ও পারছে না নাকি পুষ্পকে ও ভয় পাচ্ছে কোনটা? পুষ্পকে কেন সে ভয় পাবে। ইজ সি আ ফেরোসিয়াস অ্যানিমেল! রাজীব নিজের মনে প্রশ্ন আওড়ালো। পুষ্প কোনো হিংস্র প্রানী না পুষ্প একটা ভয়ংকর মহিলা। রাজীব নিজের মনেই হাসলো। হেসে বললো,
-” রাত্রি ইউ আর মোস্ট ইন্টিলিজেন্ট গার্ল ইন দ্যা ইউনিভার্স! ”
-” এন্ড ইউ আর মোস্ট অনেস্ট হাজবেন্ড এন্ড ইউর ওয়াইফ ইজ পিওর লায়নি।”
রাজীব হাসলো। হেসে নিচে চলে গেল। রাত্রি আবারও গান ধরলো,

ফাগুনের দিন শেষ হবে একদিন
ঝর্ণার সাথে গান হবে একদিন
এ পৃথিবী ছেড়ে চলো যাই
স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সীমাহীন
ফাগুনের দিন শেষ হবে একদিন
ঝর্ণার সাথে গান হবে একদিন
হৃদয়ে জ্বলছে যে বন্নি
সে একদিন তাঁরা হয়ে জ্বলবে
জোছনায় মিল হব ওমনি
সে আলোর পথ ধরে চলবে
সে যাত্রায়. কেন হায়
ভয় হয়. নিশিদিন
ফাগুনের দিন শেষ হবে একদিন
ঝর্ণার সাথে গান হবে একদিন
এ পৃথিবী ছেড়ে চলো যাই
স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সীমাহীন……

পুষ্প ড্রেসিং টেবিলটার সামনে দাড়িয়ে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছছিলো। রাজীব রুমে ঢুকে দরজাটা লক করে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে পুষ্পর দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আজকে কি জন্য লেট?”
পুষ্প আয়নায় রাজীবের দিকে তাকালো। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-” কাজ ছিলো? ”
-” এই এক্সকিউজ দেখানোটা কবে শেষ হবে? ”
পুষ্প বিরক্ত হলো। কিছু না বলে চুল মুছতে লাগলো। রাজীব এগিয়ে এসে পুষ্পকে নিজের দিকে ঘুরালো। দুই হাত দিয়ে পুষ্পর বাহু আঁকড়ে ধরে বলল,
-” কথা বলছিস না কেন?”
পুষ্পর হাত ফসকে টাওয়ালটা নিচে পড়ে গেলো। নিজের বাহু থেকে রাজিবের দুইহাত চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারলো না। রাজিব আরও চেপে ধরে রেখেছে। পুষ্প রাজীবের দিকে তাকালো। একজোড়া নিরব চোখ ওর চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। এই চাহনির অর্থটা কি হতে পারে? ভ্রু দুটি কুচকে আছে। কপালের ডানদিকের রগ ফুলে আছে কিছুটা। পুষ্প দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
-” এক্সকিউজ দেখাচ্ছি না। আমাদের অর্ডার নিতে হয়, ডেলিভারির কাজটাও করতে হয়। অনেক প্রেশার চলে যায়। বিভিন্ন যায়গায় ডেলিভারি দিতে হয়তো তাই। আর….”
পুষ্পকে আর কিছু বলতে না দিয়েই রাজীব পুষ্পর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট বসিয়ে দিলো। ঘটনার আকস্মিকতায় পুষ্প পুরো হতভম্ব হয়ে গেল। খুব করে চেষ্টা করেও রাজীবকে বিন্দুমাত্রও সরাতে পারলো না সে। না পারলো নিজেকে ছাড়াতে। তার পুরো শরীর কাঁপছে। রাজীব খেয়াল করলো, পুষ্পর চোখ ভেজা। মুহুর্তেই পুষ্পকে ছেড়ে বারান্দায় চলে গেল সে। মেজাজ পুরো বিগড়ে গিয়েছে ওর। তার ইচ্ছে করছে “জীবিকার তাগিদে” নামক সংঘটনটাকে জ্বালিয়ে দিতে। একটা মেয়ে এত আনরোমান্টিক হয় কিভাবে? যত্তসব…

চলবে…..

1 COMMENT

  1. লেখাটি পড়ে অনেক ভাল লাগল। এমন সুন্দর সুন্দর গল্প পড়ে সাহিত্য চর্চা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here