নীল দিগন্তে পর্ব ৪

#নীল_দিগন্তে
পর্ব-০৪
লেখা- নীলাদ্রি নীরা
সৌরভ মিডিয়ায় ভিডিওটা আপলোড করার আগে যাস্ট একবার সেটা চেক করার কথা ছিল। অথচ সে অন্তত হাজারবার ভিডিওটা দেখেছে। ভূমি অফিসার নাসির হোসেন অবৈধ টাকায় ঢাকা শহরে তিনি নির্মাণ করেছেন গুটি কয়েক বহুতল ভবন। এই ভিডিওতে স্পষ্ট ওই মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছে। গতকালই বাঘিনী মেয়েটাকে সকালে দেখেছে একটা লোককে মারতে। বিকালে আবার ভিডিওতে মেয়েটা নাসির সাহেবের বিল্ডিং থেকে বের হচ্ছে। এই বিল্ডিং এ তো রাত্রিরাও থাকে!
ইয়েস! মনে পড়েছে সৌরভ মেয়েটাকে রাত্রির সাথে একটা ছবিতে দেখেছে। রাত্রি একবার ওই ছবিটা পাঠিয়েছিলো হোয়াটসএপে। রাত্রির কোনো এক জন্মদিনে তোলা ছবি। ছবিটা সৌরভের ফোনে এখনও আছে। সৌরভ পুরো গ্যালারি ঘেটে ফেলেছে। ছবিটা নেই তো! কোথাও নেই! ছবিটা তাহলে গেলো কই? বাই এনি চান্স, রাত্রির আত্মীয় হয় মেয়েটা ঠিক আছে বুঝা যাচ্ছে, কিন্তু নাসির হোসেনের মতো লোক রাত্রির আত্মীয় নয়তো? শীট!

সৌরভ কল করলো রাত্রিকে। রাত্রি ফোন ধরেই ব্যস্ত সুরে বললো,
-” হ্যালো ওগো রিপোর্টার শুনছো, আমি পড়ছি গো এখন কথা বলতে পারবো না পরশু আমার পরীক্ষা।”
-” হ্যালো, হ্যালো রাত্রি শোনো যাস্ট দুই মিনিট ”
-” ওকে যাস্ট টু মিনিটস, দুই মিনিট পর আমি রেখে দিবো। ইওর টাইম স্টার্ট নাও!”
-” রাত্রি তোমার বার্থডেতে একটা ছবি পাঠিয়েছিলে আমাকে মনে আছে! একটা মেয়ের সাথে।”
-” কোন মেয়ের সাথে? কত ছবিই তো দিয়েছি”
-“আরে ফর্সা, হালকা পাতলা করে একটা মেয়ে। লম্বাটে গড়ন। নাকের ডগায় গাঢ় একটা তিল।”
রাত্রি খানিকক্ষণ ভেবে বললো,
-” ব্যাপার কি বলো তো রিপোর্টার। কাহিনীটা কি হুম! তুমি ওর নাকের তিলটাও পর্যবেক্ষণ করেছো?”
-” শিট রাত্রি। আগে বলো মেয়েটা কে?”
-” পুষ্প। আমার মামাতো বোন।”
-” আচ্ছা তোমার বাবার নাম কি রাত্রি?”
-” মানে কি? আমাদের এত বছরের রিলেশনশিপে তুমি আমার বাবার নামটাও জানো না! আশ্চর্য!”
-” বলো না !”
-” নাসির হোসেন।”
-” রাত্রি তোমার দুই মিনিট শেষ। রাখছি”
সৌরভ কল কেটে দিলো। ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে দুই হাত দিয়ে নিজের মুখটা চেপে ধরলো সে! এটাও হওয়ার ছিলো! রাত্রির বাবা একজন দুই নাম্বার লোক। এখন কি করবে সে! রিপোর্টটা কি পাবলিশ করবে? রিপোর্ট পাবলিশ করলে রাত্রিকে যে সারাজীবনের জন্য হারাবে তা নিশ্চিত। আর যদি পাবলিশ না করে তাহলে তো সেও রাত্রির বাবার কাতারের লোক হবে। নিজের কাজের সাথে, দেশের সাথে অন্যায় হবে। কি করবে সে?
রাত্রি পুরো অবাক! কি হচ্ছে এসবের! সৌরভ আবার তাদের নিয়ে রিপোর্ট লিখা শুরু করেছে নাকি! রাত্রির ভাবনার মধ্যেই আবার সৌরভ ফোন করলো,
-” রাত্রি তুমি আর্জেন্ট আমার সাথে দেখা করো। আমি কোনো এক্সকিউজ শুনতে চাচ্ছি না। প্লিজ”
-” এসবের মানে কি?”
-” প্লিজ রাত্রি যাস্ট ১৫ মিনিটের জন্য!”
-” পারবো না। ফোনে বলো।”
-” সব কথা ফোনে বলা যায় না রাত্রি। সামনাসামনি বলতে হয়। ফোনে বলার মতো ব্যাপারও না ওগুলো।”
-” দার্শনিকগিরি ছাড়ো তো। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কি ঢং শুরু করেছো তুমি বলবে?”
-” সবই বুঝতে পারবে যাস্ট একবার আসো। ফর গড সেক রাত্রি, প্লিজ তুমি আধঘন্টার মধ্যে আমার সাথে মীট করো। প্লিজ! ইটস রিয়্যালি আর্জেন্ট রাত্রি। নাহলে তোমার পরীক্ষার মাঝে আমি দেখা করার জন্য এত প্রেশার করতাম না। ট্রাস্ট মি!”
রাত্রি মনে মনে সৌরভকে একটা গালি দিলো। কিন্তু মুখে বললো,
-” আসছি। ”
.
একদিন সন্ধ্যায় নাসির হোসেন ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। রাত্রিকে দেখে তিনি বললেন,
-“খবর কি তোমার মামুনি! পরীক্ষা দিয়ে সারাদিন নাকি বাসায় ফেরো নি তুমি?”
রাত্রি বাবার বিছানায় বসতে বসতে বললো,
-” জরুরী কাজ ছিলো বাবা।”
-” এক্সাম তো শেষ তোমার। ছুটিতে কোথাও যেতে চাও তুমি?”
-” কোথাও যাবো না। বাবা আমি তোমার কাছে ইম্পর্টেন্ট কিছু বলতে এসেছি।”
-” ইয়েস মাই চাইল্ড বলো কি বলতে চাও!”
রাত্রি বিছানায় বসে পা দুলাতে দুলাতে আহ্লাদি সুরে বললো,
-” বাবা আমি কি আমার পছন্দে বিয়ে করতে পারবো?”
নাসির হোসেন বললেন,
-” কেনো নয় মামুনি? আফটার অল তুমি আমার ওয়ান এন্ড অনলি চাইল্ড। অবশ্যই তুমি সবকিছু তোমার পছন্দমতো পাবে!”
রাত্রি এই সুযোগটাই কাজে লাগালো,
-” বাবা আমি যদি কুড়ি হাজার টাকা স্যালারি পাওয়া কোনো নিউজ রিপোর্টার আই মীন জার্নালিস্টকে বিয়ে করি তুমি কি রাগ করবে?”
নাসির হোসেন পুরো হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মতো কোটিপতির মেয়ে কিনা বিয়ে করবে এক ভিখিরীকে? মেয়েটার কি কোনো কমন সেন্স নেই? নাসির হোসেন যথাসম্ভব স্বাভাবিক ভাবে বললেন,
-” মামুনি আর ইউ কিডিং! তোমার মান্থলি খরচ জানো তুমি? আর তোমার ইউনিভার্সিটির ফি?”
-” ওটাই তো সমস্যা বাবা! খরচ কমাতে হবে। সেজন্যই আমি ভেবেছি খুব সাধারণ একটা ফেমিলিতে বিয়ে করবো। সাধারণ জীবন লীড করবো।”
-” তাই বলে একটা থার্ড ক্লাস ছেলেকে?”
-“বাবা জানো তো তুমি যাকে থার্ড ক্লাস বলছো, তার কাছে এমন এক রিপোর্ট আছে যেটা পাবলিশ হলেই তুমি সারাজীবন চেষ্টা করেও জেল থেকে ছাড়া পাবে কিনা সন্দেহ আছে। তাহলেই বুঝ সে কোন ক্লাসের!”
নাসির হোসেনের রাগে মেয়ের গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার এই ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে হলো। একমাত্র মেয়ের গায়ে তিনি কখনো হাত তুলেন নি। নাসির হোসেন দ্রুত রাগ সামলে নিয়ে বললেন,
-“মানে কি বুঝাতে চাইছো তুমি?”
-” এই যে তুমি হাফ লাখ টাকা স্যালারির জব করে এতগুলো বিল্ডিং করেছো,গাড়ি কিনেছো তাও যেমন তেমন বাড়ি নাহ! পুরো হাই স্ট্যান্ডার্ড, কোটি কোটি টাকার বাড়ি! এতটাকা তো আর স্যালারি থেকে আসে নি তাই না বাবা?”
রাত্রি দ্রুত বাবার রুম ত্যাগ করলো। নাসির হোসেন অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দরজার দিকে। তার মেয়ে তাকে হুমকি দিচ্ছে? এত বড় স্পর্ধা! তিনি কল করলেন তার ম্যানেজার মোখলেসকে। এর মধ্যেই রাত্রি ফিরে এলো। দরজায় দাড়িয়েই বললো,
-” বাবা! গেইম ইজ ওভার! নিউজ পাবলিশ হয়ে গিয়েছে। টিভিতে দেখাচ্ছে। আই প্রমিজ, তুমি যদি রিপোর্টার এর কোনো ক্ষতি করো তাহলে আমি সুইসাইড করে নোট লিখে যাবো। তুমি কি তোমার মেয়েকে হারাতে চাও? তখন অবশ্য আরও বড় ঝামেলা হবে। একুলও যাবে ওকুলও যাবে। তারচেয়ে এক কুল যখন গিয়েছে, যেতে দাও না!”
নাসির হোসেন অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। এই মেয়েই কি তিনি জন্ম দিয়েছেন! একটা কোথাকার কোন ভিখিরী ছেলে নিশ্চয়ই টাকার লোভে মেয়েটাকে পটিয়েছে, উনার পিছনে লেগেছে। কত টাকা চায় ****বাচ্চাটা! কত টাকা! টাকা একদম জায়গামতো ঢুকিয়ে দিবেন তিনি। তার সাথে ফাজলামো! এত বড় সাহস দুইদিনের ছোকরার!
মোখলেস হ্যালো হ্যালো করছে। নাসির হোসেন কানে ফোন ধরলেন। তার দ্রুত জানা দরকার কি রিপোর্ট পাবলিশ করেছে তার নামে।
.
জাহানারার রাতে ঘুম আসতে চায় না। বয়স হলে হয়তো এরকমই হয়। গভীর রাতে তিনি প্রতিদিন পুষ্পর রুমে যান। পুষ্পর গায়ে কাথাটা টেনে দেন। লাইট অফ করে ড্রিম লাইটটা জ্বালিয়ে দেন। পুষ্প একদম গোছালো একটা মেয়ে। কত সুন্দর পরিপাটি হয়ে থাকে। জাহানারা প্রতিদিনই পরীর মতো মেয়ের কপালে গভীর চুমু দেন। বাবাহীন মেয়ের মুখটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই জাহানারার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসে। তিনি পুষ্পর গালে এসে পড়া বেহায়া চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে কানের পিছনে গুজে দেন। মেয়েটা কি তার মায়ের এই মমতার কথা জানে? কখনো কি বুঝে যে জাহানারা পুষ্পকে কতটা ভালোবাসেন? জাহানারা প্রতিদিনই মনে মনে শপথ করেন, এই মানব পরীটার সাথে তিনি আর কখনো দুর্ব্যবহার করবেন না। কিন্তু প্রতিদিনই তিনি শপথ ভঙ্গ করেন। অকথ্য কথা শুনিয়ে দেন মেয়েটাকে, প্রায় প্রতিদিনই ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এত বড় একটা মেয়ের গায়ে হাত তুলেন। এই পৃথিবীতে কেউই কথা রাখে না, রাখেনি উনার স্বামী মিনহাজুর রহমান ও। স্ত্রী, কন্যা ছেড়ে এক ফিল্মের নায়িকার সাথে পালিয়েছে লোকটা। কত্ত বড় জানোয়ার! ছিঃ
জাহানারা পুষ্পর কাছ থেকে উঠতেই পুষ্প চোখ বন্ধ রেখেই বললো,
-” রাত বিরেতে আমার রুমে আসবে না মা। আমার ভালো লাগে না।”
জাহানারা অবাক হয়ে গেলেন। পুষ্প তাহলে টের পায় উনার রুমে আসার ব্যাপারটা। জাহানারা বললেন,
-” রুম অগোছালো করে রাখিস তাই আসি।”
-” আমি মোটেও অগোছালো করে রাখি না।”
-” একদম বেশি কথা বলবি না।”
জাহানারা পুষ্পর রুম থেকে বের হতে গিয়েও ফিরে এসে বললেন,
-” তোর চাচী তোকে তার ছেলের বউ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। খবরদার তুই রাজি হবি না। জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলবো তোকে যদি রাজি হোস।”

কথাটা বলেই জাহানারা চলে গেলেন। পুষ্প কাঁদছে। সে প্রতিদিনই কাঁদে তার মা যাওয়ার পর। সেই কান্না কেউ দেখতে পায় না। সবাই শুধু জানে পুষ্প হাসতেও জানে না, কাঁদতেও জানে না। পুষ্প কঠিন স্বভাবের একটা মেয়ে। সে ভীষণ খারাপ পরিস্থিতিতেও খুবই সহজে তা সামাল দিতে পারে। অথচ প্রতিরাতেই পুষ্পর বালিশ সাক্ষী হয় ওর নিঃশব্দে কান্নার। আচ্ছা কখনো কি কেউ পুরোপুরি বুঝতে পারবে পুষ্পকে? কেউ কি উপলব্ধি করতে পারবে ওর চাঁপা আর্তনাদ, হাহাকার গুলোকে?

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here