প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব ২৫+২৬

#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

২৫.

প্রাপ্ত চলে গেছে বেশ অনেকক্ষন। ওর পাগলামোগুলো ভেবে এতোটা সময় শুধু নিশব্দে মিটিমিটিয়ে হেসেছে ইচ্ছে। অনেকটা সময় পর খেয়াল হলো, আবারো শরীর দুর্বল লাগছে ওর। পাশে তখনো সে নার্স থমকে দাড়িয়ে। চুপচাপ উঠে বসলো ইচ্ছে। গলা ঝেড়ে বললো,

-একচুয়ালি…

-উনি আপনাকে নিয়ে অনেক সেন্সিটিভ।

ইচ্ছে কিছু বলার আগেই নার্সটা বলে উঠলো। ইচ্ছে থামলো। সত্যি তো এটাই, জীবনে ওকে নিয়ে চিন্তা করার মানুষ আছে। ওর বাবা, রাকীন, রাকীনের বাবা-মা সবাই ভাবে ওকে নিয়ে। তবে চিন্তা করলেও ওকে সময় দেওয়ার সময় হয়ে ওঠে না কারোরই। তাই প্রাপ্তর মতো এমন করে কারো সেন্সিটিভিটি দেখা হয়ে ওঠেনি ইচ্ছের। ইচ্ছে নখ দেখতে দেখতে মৃদ্যু হেসে বললো,

-মেবি।

নার্স চুপ রইলো। দু দন্ড পরই ইচ্ছে ধ্যান ভাঙলো নিজের। বললো,

-সরি সিস্টার। ও এভাবে আমাকে এখানে নিয়ে আসলো, আ’ম রিয়েলি সরি।

-ইটস্ ওকে। কিছু মানুষের ভালোবাসা দেখতেও ভালো লাগে। অল দ্যা বেস্ট টু বোথ অফ ইউ।

ইচ্ছে নির্বাকচোখে তাকিয়ে রইলো। আর পাঁচটা সাধারন মেয়েকে বুঝি ওদের ভালোবাসার মানুষটা এভাবেই যত্ম নেয়? তাই বুঝি ওকে আর প্রাপ্তকে তুলনা করলো নার্স? তাহলে ওর জীবনটা কেনো এতো সুন্দর না? কি দোষ করেছে ও? সেলেব্রিটি হওয়া তো না। তবে কি নিজেকে খোলকে মুড়িয়ে রাখার জন্য? ও তো চেয়েছিলো কেউ নিজে থেকে এসে বুঝুক ওকে। ভালোবাসুক ওকে। সেই ছোট থেকে রাকীনের সাথে বড় হলো। কই? কখনো তো রাকীনকে নিয়ে এতোকিছু ভাবার সুযোগ হয়নি ওর। তবে কেউই কি নেই ওকে বোঝার জন্য? ওকে চুপ থাকতে দেখে নার্স আবারো বললো,

-জলদি জলদি স্যারের অভিমান ভাঙাবেন কিন্তু ম্যাম! স্যার বেশ অনেকটা অভিযোগ করে বেরিয়ে গেলো বলে মনে হলো।

ইচ্ছে আবারো মাস্কের আড়ালে মুচকি হাসলো। বাবু হয়ে বসে আগ্রহ নিয়ে বললো,

-তাই? তো কিভাবে স্যারের অভিমান ভাঙাতে হবে সিস্টার? এনি টিপস্?

নার্স একটু চিন্তার ভঙিমা করে বললো,

-উম্…শুনেছি ছেলেরা নাকি মেয়েদের শাড়িতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। আপনি শাড়ি পরে স্যারকে ভালোবাসি বলে দেবেন, দেখবেন সব অভিমান গায়েব!

ইচ্ছে শব্দ করে হেসে দিলো এবার। এইসব ফিল্মি বিষয়গুলো কেনো শুনতে চেয়েছিলো ও, কেনো শুনলো, নিজেও জানে না। তবে এগুলো কোনোদিনও‌ ঘটার নয়। নার্সকে আরো দুবার সরি বলে সৌজন্য হেসে হসপিটাল থেকে বেরোলো ও। ইতিমধ্যইে রাকার কল। রিসিভ করতেই রাকা বললো,

-কোথায় তুই ইচ্ছে?

-লিভ ইট। তুই‌ কোথায়?

-তুই যে হসপিটালে, তার রিসেপশনে দাড়িয়ে আছি। প্রাপ্ত ভাইয়া কল করে বললো তুই নাকি হসপিটালে? নিশ্চয়ই আজও বাসা থেকে‌ না খেয়ে বেরিয়েছিস? তাই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি। তাইনা? কতো নম্বর কেবিনে তুই এখন? প্রাপ্ত ভাইয়া বললো…

-প্রাপ্ত?

বিস্ময়ে বললো ইচ্ছে। রাকা বললো,

-হ্যাঁ! ভাইয়া তো…ন্ না মানে, আগে বল তুই কোথায়?

-বেরিয়েছি।

-ও! বেরিয়েও গেছিস? আচ্ছা ঠিকাছে। তুই পাশের রেস্ট্রুরেন্টে বস। আমি আসছি।

নিরবে কল কেটে তাই করলো ইচ্ছে। কেমন অদ্ভুত লাগছে ওর। প্রাপ্ত রাকাকেও জানিয়েছে ওর বিষয়ে। তারমানে শুধু ঋনপরিশোধ ছিলো না সবটা। চুপচাপ বসে রইলো ও রেস্ট্রুরেন্টের এক কোনে। মিনিটপাঁচেকের মধ্যে রাকা হাজির। ও এসেই আগে জরিয়ে ধরলো ইচ্ছেকে। স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললো,

-শুকরিয়া খোদার। ঠিক আছিস তুই!

-রাকা…

-কোনো কথা না! আগে তুই‌ কিছু খেয়ে নে!

-কিন্তু রাকা…

-ওয়েটার?

রাকা ওয়েটারকে‌ ডাক‌ লাগালো। বলার সুযোগ দেয়নি ইচ্ছেকে। ইচ্ছেও আর তেমন কিছু বললো না। রাকার সাথে বসে খেয়ে নিলো চুপচাপ। খাওয়া শেষে বললো,

-তোকে এখানে প্রাপ্ত আসতে বলেছে?

রাকা মোবাইলে ব্যস্ত ছিলো। ইচ্ছের কথা শুনে তৎক্ষনাৎ বন্ধ করলো মোবাইল। বললো,

-ম্ মানে, ও্ ওই…আসলে…

ওকে তোতলাতে দেখেই ইচ্ছে বুঝলো, প্রাপ্তই বলেছে ওকে আসতে। ইচ্ছে চুপ রইলো। রাকা ধীর গলায় বললো,

-তুই রাগ করেছিস প্রাপ্ত ভাইয়া আমাকে বলেছে বলে?

-তেমন কিছু না রাকা। তবে আমি ঠিক আছি। এভাবে তোকে বলে…

-ভাইয়া তোকে নিয়ে অনেক ভাবে ইচ্ছে।

-ইয়াহ্! সরি, থ্যাংকস্, ওয়েলকাম করার নিত্যনতুন উপয়াগুলো আমার ওপর এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে যে!

-হ্যাঁ! শুধু তোরই ক্ষেত্রে সরি বলেছে সে। থ্যাংকস্ বলেছে। আরো হয়তো অনেককিছু, যা না আমি জানি, নাইবা তুই!

ইচ্ছে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর খানিকটা গুরুগম্ভীরভাবে বললো,

-কি বলতে চাইছিস তুই বলতো রাকা? তুই জানিস, আমার কথা প্যাচানো পছন্দ না। যা বলার স্ট্রেইটলি বল।

রাকা একশ্বাসে বলে দিলো,

-আমার‌ তো মনে হয়, প্রাপ্ত ভাইয়া তোকে ভালোবাসে।

ইচ্ছে থমকে গেলো‌ রাকার কথায়। খানিকক্ষন তাকিয়ে থেকে জোরপুর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো,

-রিল্যাক্স)।‌ আই‌ নো, মিস্টার গ্যাংস্টার ওসব প্রেম ভালোবাসা টাইপের ছেলে‌ না।

-বাবা! ইনায়াত নিক্কন, দ্যা রকস্টার! একটা গ্যাংস্টার কেমন ছেলে, কেমন না, তার সম্পর্কে ভালোই জেনে গেছে দেখছি।

রাকার কথায় ইচ্ছে চুপ করে গেলো আবারো। তবে এটাও বুঝলো, ওকে‌ মৌনতায় মানায় না। মৌনতা মানেই দুর্বলতা। কিন্তু ইচ্ছে তো দুর্বল নয়! রাকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, একটা শ্বাস ছেড়ে ইচ্ছে শক্তভাবে বললো,

-হাজারো ফ্যানফলোয়ার ভালোবাসে ইচ্ছেকে। এদের সবাইকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত না রাকা। তবে হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস তুই। না চাইতেও, ঘটনাক্রমে প্রাপ্তকে অনেকটাই চিনে গেছি। তুই যা ভাবছিস, ওর দ্বারা এমন কিছু হতে পারে না।

-তুই চাস না এমন কিছু হোক?

-রাকা!

ইচ্ছের কড়া গলা। রাকা দমলো না। শান্তভাবে বললো,

-কি হতে পারে, কি হতে পারে না, সেটা আমি, তুই, আমরা কেউই ঠিক করে দিতে পারি না ইচ্ছে। কিন্তু আমরা কে কি চাই, সেটা নিতান্তই আমরা জানি। তুই কি চাস, সেটা শুধু তোর মনই জানে। আমার শুধু একটাই অনুরোধ, ওই মনকে বেধে রাখিস না তুই। বাধা দিস না! সে অনুভূতি যার জন্যই হোক, তাকে নিজের করে নিস। প্লিজ ইচ্ছে! প্লিজ!

রাকার অনুনয়। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো। সাথে রাকাও। ও বেশ বুঝলো ওর কথাগুলোই ইচ্ছের অস্থিরতার জন্য দায়ী। তবে তার জন্য ওদের বন্ধুত্ব নষ্ট হবে না, এ বিষয়েও নিশ্চিত রাকা। ইচ্ছে বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেলো কি মনে করে। আবারো রাকার দিকে ফিরে তাচ্ছিল্যে বললো,

-ভালোবাসা আমার জন্য ধূসর মরুভূমির জলের মতো রাকা। হয় দুর্লভ, নয় মরিচীকা। সত্যিকার প্রেমজোয়ার পেলামই বা কই, প্রেমনোঙরে আটকাবো বলে? দোষটা কি আমার?

রাকা নিরত্তর। ইচ্ছে বললো,

-তবে হ্যাঁ! যদি সত্যিই কোনোদিন অনুভব হয়, এই সেই ভালোবাসার অনুভব, এই সেই প্রেমজোয়ার, কথা দিচ্ছি, সে জোয়ারে আমি সর্বস্ব উজার করে দেবো। সবটা! আর তখন পুরো পৃথিবী দেখবে ইচ্ছের ভালোবাসা। হার ক্রেজিনেস। কজ ইচ্ছে ও’ন্ট ফল ইন লাভ । শি উইল রাইজ ইন লাভ রাকা! শি উইল রাইজ ইন লাভ!

বলা শেষ করে ইচ্ছে রেস্ট্রুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছনপেছন ছুটতে ছুটতে এতোক্ষনে মোবাইলে চলা কলটা কাটলো রাকা। সঙ্গেসঙ্গে বাইক ব্রেক করলো প্রাপ্ত। সবে যেনো ভেতর থেকে শ্বাস বেরোলো ওর। কানে গোজা ব্লুটুথটা কান থেকে খুলে, নিচের ঠোট কামড়ে ধরলো ও। ইচ্ছেকে ছেড়ে হসপিটাল থেকে চলে চলে আসলেও ওকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিলো প্রাপ্তর। তাই ওই রাকাকে হসপিটাল যেতে বলেছিলো। ইচ্ছেকে দেখতে যেতে। কিন্তু রেস্ট্রুরেন্টে ঢুকে রাকা কল করেছিলো ওকে। ব্লুটুথে রিসিভ করে, কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বলেও প্রতিত্তর পায়নি প্রাপ্ত। ভেবেছিলো রাকা হয়তো ভুলে ডায়াল করেছে। ও নিজেই কল কেটে দিতে যাচ্ছিলো। কিন্তু ইচ্ছের স্বর শুনে আর কলটা কাটতে ইচ্ছে করেনি ওর।

ওদের কথোপকথন শুনতে শুনতেই প্রাপ্ত বাইক চালিয়েছে পুরোটা পথ। কিন্তু ইচ্ছের শেষ কথায় কিছু তো ছিলো! গায়ের সমস্ত জোর যেনো সব হারিয়ে ফেললো ও হঠাৎই। মাঝরাস্তায় নিজের বিমুঢ় সত্ত্বাটা নিয়ে বাইক দাড় করিয়ে রেখেছে। “ইচ্ছে প্রেমে পরবে না, ইচ্ছে তো প্রেমে উত্তল হবে। প্রেমজোয়ারে উত্থানলাভ করবে সে। মাতবে, প্রেমপাগলামিতে।” কানে শুধু এই কথাগুলোই বাজতে লাগলো প্রাপ্তর। পেছনের হাজারো গাড়ির হর্নের শব্দ কানে আসলো না ওর। মনপ্রান জুড়ে বরং এক তীব্র লোভের সঞ্চারন, “ওই ইচ্ছেনদীতে ভরাডুবি হোক শুধু প্রাপ্তর। প্রেমজোয়ার হোক তো হোক,প্রাপ্তর নামে। শুধুই প্রাপ্তর নামে!”
#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা

২৬.

সন্ধ্যায় কফি বানাবে বলে কিচেনে ঢুকে খইকে দেখে দরজায়ই দাড়িয়ে গেলো প্রাপ্ত। খই খুব মনোযোগ দিয়ে কাবার্ডগুলো দেখছে। যেনো কিছু খুজছে ও। দিনগুলোর সাথে মিষ্টিঘরে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে খই। আর এ বাসায়ও ওর আসাযাওয়া হয় সাদিক সাহেবের কাছে পড়ার উদ্দেশ্যে। তবে ওর সাথে তেমন কথা বলা হয়ে ওঠেনি প্রাপ্তর। বলা বাহুল্য, খইই সুযোগ দেয়নি এমনটাই মনে হয়েছে ওর। তাই নিজে থেকেও দুরুত্ব বজায় রেখেছে প্রাপ্ত। আজও তাই দরজায় দাড়িয়েই বললো,

-তুমি কিচেনে কেনো?

আঁতকে উঠলো খই। সেদিন সাদিক সাহেবের কথায় ওর মনে প্রাপ্তকে নিয়ে কোনো এক আতঙ্ক ঢুকে গেছে যেনো। কি, কেনো, কোনো উত্তর নেই এসবের। তবে আছে কোনো এক ভয়। তাই প্রাপ্ত যখন বাসায় থাকে না, তখনই ও পড়তে আসে এ বাসায়। তবে আজকে এসময় আসতে বাধ্য হয়েছে ও। সাদিক সাহেব ওর হাতে বানানো খাবার খেতে চেয়েছিলেন। ও কিছু বলার আগেই প্রাপ্তর পাশ থেকে পিয়ালী বললো,

-জানিস ভাইয়া? আজ বাবা ওর হাতের রান্না খেতে চেয়েছে। তাই এভাবে…

প্রাপ্ত বিস্ময়ে বললো,

-ওর হাতের রান্না মানে? তুমি রান্না জানো খই?

-হ। মায়ে করতে না দিলেও সব শিখাইছিলো আমারে।

খই ধীরগলায় বললো। পিয়ালী প্রাপ্তর কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

-বাবার পছন্দের তারিফ করতে হয় রে ভাইয়া! দেখনা! জেনেশুনে রান্না জানা বউমা এনেছে একদম!

প্রাপ্ত একপলক ফাকা দৃষ্টিতে তাকালো পিয়ালীর‌ দিকে। পিয়ালী গলা ঝেরে‌ বললো,

-আহারে। বাবা আমার শখ করে খইয়ের হাতের রান্না খেতে চাইলো, খই তো‌ মনে হয় কিছু খুজেই‌ পাচ্ছে না। এক কাজ কর ভাইয়া! আমি তো কিছু পারি না, তো তুইই বরং হেল্প কর ওকে। নিজেই কিছু করতে যাস না আবার! বাবার কিন্তু তোর রান্নার টেস্ট মুখস্ত। সো, নো চিটিং! আমি‌ পড়তে গেলাম। বাইইই!

পিয়ালী চলে গেলো। প্রাপ্ত কোনো উপায় না দেখে কিচেনে ঢুকলো।‌‌ ওকে‌ ভেতরে ঢুকতে দেখেই ইতস্তত করতে করতে ওড়না আঙুলে‌ পেঁচাতে শুরুর করেছে খই। প্রাপ্ত লক্ষ্য করেছে ওর‌ অস্বস্তি। ‌চটজলদি যাবতীয় জিনিস বের করে‌ দিয়ে বললো,

-আমি দুরেই‌ থাকছি। তুমি নিজের মতো করেই‌ রান্না করো।

আস্তেধীরে নিজের কাজ শুরু করলো খই। প্রাপ্ত অনেকটা দুরে দাড়িয়ে ফোন স্ক্রল করছে। কাজ করতে করতে ‌আড়চোখে ওকে লক্ষ্য করছিলো খই। প্রাপ্তর নজর পুরোপুরিভাবে ফোনে। প্রাপ্তকে লক্ষ্য করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত গরম তেলের কিছুটা ছিটে এসে হাতে লাগে খইয়ের। আহ্ শব্দে মৃদ্যু আর্তনাত করে উঠলো ও। ফোন ছেড়ে ছুটে এসে ওর হাত ধরলো প্রাপ্ত।

বাসায় ফেরার সময় কিচেনের জানালায় চোখ পরতেই প্রাপ্তকে খইয়ের হাত ধরে থাকতে দেখলো মিষ্টি। তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিলো ও। সেকেন্ডদুই দাড়িয়ে থেকে জোর করে একটা কৃত্রিম হাসি ফুটালো ঠোটে। ওর এমন ঋনাত্মক অনুভূতি হওয়াটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিতে চায় ও। প্রাপ্ত ছেলেটাই এমন, যার প্রতি যে কারো মুগ্ধতা আসা আবশ্যক। ব্যতিক্রম হয়নি ওর ক্ষেত্রেও। তাই সে মুগ্ধতার মানুষটাকে অন্য একটা মেয়ের সাথে দেখে এমন অনুভব হচ্ছে ওর। যেটার কোনো মানে হয়না। প্রাপ্ত তার সাথেই ভালো থাকুক, যাকে ও ভালোবাসে। এটাই হওয়া উচিত।

মৃদ্যু হেসে সাইডব্যাগের ফিতাটা ধরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো মিষ্টি। দরজার লক খুলে ব্যাগ রেখে টেবিলের পানির গ্লাসের পানি শেষ করলো আগে। একটা বড়সর শ্বাস ফেলে সবে বিছানায় বসতে যাবে, বিছানায় থাকা কাগজগুলো দেখে থমকে দাড়িয়ে রইলো মিষ্টি। তিনটে কাগজ পাশাপাশি। মাঝেরটাতে অতি সুন্দরভাবে লেখা, “আই লাভ ইউ মিষ্টি। উইল ইউ ম্যারি মি?” এটা দেখে দু দন্ড থেমে রইলো মিষ্টি। কে লিখেছে এটা ভাবার আগেই ওর চোখ পরলো পাশের কাগজ দুটোতে। ডানপাশে একটা প্রোমোশন লেটার। বা পাশে ট্রান্সফার লেটার। মিষ্টি বিমুঢ়। দুটো কাগজই সাফোয়ানের। কাপাকাপা হাতে ট্রান্সফার লেটার নিতে যাবে, কেউ একজন বললো,

-আগেই‌ কাগজ তুলিস না মিষ্টি!

মিষ্টি থেমে পেছন ফিরলো। দরজার বাইরে থেকে ঘাড় চুলকে ভেতরে ঢুকলো সাফোয়ান। মিষ্টি অবাকচোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। সাফোয়ান ওর দিকে তাকিয়ে থেকে স্পষ্টস্বরে বলে উঠলো,

-আই লাভ ইউ।

আরো বড়বড় চোখে তাকালো মিষ্টি। মুচকি হেসে সাফোয়ান পিছিয়ে গেলো। দরজার কাছেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে বললো,

-এই লুক দিস না। সেই ছোটবেলা থেকে একসাথে আছি। তোর প্রেমে পরাটা কিন্তু এতো আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু না।

-সাফোয়ান? এসব…

সাফোয়ান সোজা হয়ে দাড়ালো। মিষ্টি থামলো। সাফোয়ান গলা স্বাভাবিক করে বললো,

-ভালোবাসা বুঝতে শেখার পর থেকেই ভালোবাসার মতো একটা মানুষ খুজেছি মিষ্টি। পেয়েও গেছিলাম বলে মনে হয়েছিলো একবার। অনাথ বলে শিক্ষাজীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে আরেকটা জিনিস শিক্ষা পেয়েছি। অনাথআশ্রমে বড় হওয়া অনাথকে ভালোবাসা যায় না। জানিস মিষ্টি? কলেজের যে মেয়েটা আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছিলো, পুলিশে জয়েন করার পর সে ফিরে আসতে চেয়েছিলো আমার জীবনে। কিন্তু ততোদিনে বুঝলাম, আমার মন অন্যকারো। সে কেনো, কাউকেই ভালোবাসতে পারবো না আর। সে মানুষটা তুই। তোকে ভালোবাসি মিষ্টি।

শ্বাস আটকে দাড়িয়ে রইলো মিষ্টি। প্রাপ্তর প্রতি ওর অনুভূতিগুলো একান্তই ওর অনুভব। সেটা আজোবদি কাউকে জানতে দেয়নি ও। একাএকা একতরফা মুগ্ধতায় কেটেছে ওর দিনগুলো। নিশ্চিত ছিলো, ওর অনুভব পুর্নতা পাবার নয়। তবে আজ সাফোয়ান যা বললো, তাও তেমনই অনাকাঙ্ক্ষিত ওর জন্য। এর বিপরীতে হ্যাঁ বলার পরিস্থিতি যেমন নেই, না বলার সাহসটাও ওর নেই। সাফোয়ান বললো,

-আমি জানি, প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে, সংসার এসব নিয়ে এখনো ভাবিস না তুই। এটাও জানি, আমার এই ভালোবাসা প্রকাশের জন্য আমাদের সম্পর্কটা আগের মতো থাকবে না। তাই উপায়ন্তর দেখতে বাধ্য হলাম। তোর উত্তর হ্যাঁ হলে এই প্রমোশন লেটার আমার হাতে দিস। আমি চাই তোর হাত থেকেই লেটারটা অফিসিয়ালি আমার নামে হোক। আফটার অল, তোকে‌ নিয়েই তো সংসার করতে হবে তাইনা?

সাফোয়ান থামলো। একটা শুকনো কাশি দিয়ে ঠোটের কোনে হাসি ফুটিয়ে আবারো বললো,

-আর যদি উত্তর না হয়, ট্রান্সফার লেটারটা‌ দিয়ে দিস। এই শহর, তোর জীবনে সাফোয়ানের ছায়াটাও থাকবে না। উত্তর এখনই দিতে হবে না। সময় নিয়ে জানাস। আসছি।

একমুহুর্ত দেরি না করে সাফোয়ান বেরিয়ে গেলো। শ্বাস ছেড়ে ধপ করে বিছানায় বসে পরলো মিষ্টি। ট্রান্সফার লেটারের দিকে তাকিয়ে রইলো একাধারে। চোখ থেকে টুপটাপ জল গরাতে লাগলো ওর। আর ভেতরে হয়তো এক নিরব আর্তনাত।

“মেঘের পালক, চাঁদের নোলক, কাগজের খেয়া ভাসছে
বুক ধুকপুক, চাঁদপানা মুখ, চিলেকোঠা থেকে হাসছে
মেঘের বাড়িতে মেঘ ভেজা পায়
তাথৈ তাথৈ বর্ষা
কাক ভেজা মন জল থৈ থৈ
রাত্তির হলো ফরসা
আমি তুমি আজ একাকার হয়ে মিশেছি আলোর বৃত্তে
মম চিত্ত্বে, নিতি নৃত্তে, কে যে নাচে…”

-ইচ্ছে?

রাকীনের গলা শুনে গান থামালো ইচ্ছে। চোখ মেলে তাকালো ও। অনেকক্ষন আগেই রাত নেমেছে ধরনীর বুকে। সুইমিংপুলের পানিতে বাগানের আলোগুলোর প্রতিফলন জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু আকাশে মেঘের আনাগোনা। কালো মেঘের আড়ালে থাকা চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। ইচ্ছে পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে অনেকক্ষন হলো। কাগজের নৌকা বানিয়ে সুইমিংপুলের পানিতে ভাসিয়েছে। টমি এতোক্ষন হাটছিলো ওর পাশ দিয়েই। যেইনা ইচ্ছে গিটার নিয়ে গান ধরেছে, ও গিয়ে সুন্দরমতো পাশে শুয়ে পরেছে ইচ্ছের। রাকীনের কন্ঠ শুনে টমিও উশে দাড়ালো। গা ঝাড়া মেরে ইচ্ছের গায়ে গা ঘষে বুঝালো হয়তো, কেউ এসেছে। ইচ্ছে কোল থেকে গিটার সরিয়ে পাশে রাখলো। পেছনে হাত দিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে বসে বললো,

-কেমন আছিস?

রাকীন ছোট একটা শ্বাস ফেলে বললো,

-বাবা এসেছে।

ইচ্ছের ঠোট টিপে হাসলো। রাজীব মাহমুদ এ বাসায় এসেছে মানেই আবারো ওদের বিয়ের কথা। আর তার মানেই রাকীন ভালো নেই। রাকীন এগোলো। ইচ্ছের পাশে হাটু গেরে প্যান্ট ভাজ দিতে দিতে বললো,

-তারপর? কার সাথে একাকার হয়ে আলোর বৃত্তে মেশার প্লান করছিস তুই?

-নিজেকে ইমাজিন করে নে না। হুম…আমি তুই আজ একাকার হয়ে মিশবো আলোর বৃত্তে!

ইচ্ছের কৌতুকের সুর। রাকীন একপলক ওর দিকে তাকালো। তারপর পানিতে পা ভিজিয়ে বসে সামনের একটা কাগজের নৌকো হাতে তুলে নিলো ও। একধ্যানে নৌকাটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজেও সুর তুললো,

-মম চিত্তে, নিতি নৃত্যে, সে যে আছে…

-আমার মতো তুইও খেয়াকে মিস করছিস?

খেয়ার নাম শুনে কেউ‌ কলিজা খামচে ধরলো যেনো রাকীনের। নিজেকে সামলে মুখে বললো,

-ও আমাকে মিস করে না ইচ্ছে। তাই আমিও ওকে মিস করি না। ভুলতে চাই।

ইচ্ছে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলো। ও জানে, এটা রাকীনের মনের কথা নয়। কথা ঘোরাতে বললো,

-আচ্ছা। আন্টি কেমন আছে?

-আমাদের বিয়ে না হওয়া অবদি বোধ হয় সে পুরোপুরি ভালো থাকবে না।

-আর আমাদের বিয়ে হলে এস এম‌ ভালো থাকবে না!

মনে মেঘ জমলেও ইচ্ছের কথায় রাকীন হেসে দিলো। খানিকক্ষন হেসে আবারো গম্ভীর হয়ে গেলো ও। হাতের কাগজের নৌকা আবারো পানিতে ভাসিয়ে দিলো। ইচ্ছে বললো,

-এভাবে আর কতোদিন রাকীন?

রাকীন পানির দিকে দৃষ্টিস্থির রেখে বললো,

-যতোদিন না নতুন করে দুর্বলতা তৈরী হচ্ছে, ততোদিন। তোর দিক থেকে কোনোদিনও হবে না আমি জানি। তুই তো অনেক শক্ত মনের মানুষ। আমার তো আমাকে নিয়েই যতো অভিযোগ।

-কিন্তু যদি কোনোদিন আমিই দুর্বল হয়ে পরি, তখন কি হবে রাকীন?

রাকীন বিস্ফোরিত চোখে তাকালো ইচ্ছের দিকে। ইচ্ছের শীতল চাওনি। তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়ালো রাকীন। উত্তর না দিয়েই চলে যাচ্ছিলো ও। তারপর কি ভেবে পেছন ফিরলো। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

-এতোগুলো বছর হলো একসাথে আছি দুজনে। বিশ্বাস কর! বাবাকে হ্যাঁ বলার জন্য যেমন এখনো আমি প্রস্তুত নই, ঠিক তেমনি তোকে বারনের উপায়ও এখনো আমি খুজে পাইনি ইচ্ছে। তাই হয়তো জানিনা তোর সেই দুর্বলতার পরিনতি কি। বলতে পারিস, এদিক দিয়ে আমি নিরুপায়, নিরুত্তর! কিন্তু আমি তো…

কথা শেষ না করেই রাকীন চলে গেলো। ইচ্ছে পা দিয়ে পানিতে নাড়া দিলো। টমি এগিয়ে আসলো ওর দিকে। ওকে কোলে নিয়ে ওর গায়ে হাত বুলাতে লাগলো ইচ্ছে। টমি শব্দ করে হয়তো বুঝালো, “যাই‌ হয়ে যাক, আমি আছি তোমার পাশে।” ইচ্ছে হেসে দিয়ে বললো,

-দ্যাটস্ দ্যা প্রবলেম বাডি। এই পাশে থাকা, দায়িত্ব, এগুলোর বেড়াজালেই আমার জীবন। দেখ? রাকীনও আজ ভাষাহীন। ভয় পেয়ে গেছে বেচারা! ভেবেছে সত্যিসত্যিই আমি ওর প্রেমে পরে যাবো।

দুবার আওয়াজ করে টমি ভাব নিয়ে নামলো ওর কোল থেকে। যেনো বুঝালো, রাকীনই ওর জন্য পার্ফেক্ট। তার প্রেমে পরা উচিত ইচ্ছের। ইচ্ছে ঠোট টিপে হাসি আটকালো। টমি কাকে কাকে পছন্দ করে, তার লিস্ট অনেক লম্বা। কিন্তু কাকে পছন্দ করে না, সে লিস্টে একমাত্র একজনই আছে। টমির উপদেষ্টা ভাবকে ক্ষিপ্ততায় বদলে দেওয়ার জন্য ওই একটা নামই যথেষ্ট। ইচ্ছে মুচকি হেসে ধীর গলায় বললো,

-টমি? হোয়াট আবাউট প্রাপ্ত?

টমি তৎক্ষনাৎ শব্দ করতে শুরু করে দিলো। গিটারের পাশে থাকা নৌকা বানানোর সবগুলো রঙিন কাগজ পা দিয়ে সুইমিংপুলে ফেলে‌ দিতে লাগলো ও। শব্দ করে হাসতে লাগলো ইচ্ছে। ওর হাসি প্রতিধ্বনি হয়ে, পুরো বাসায় বাজতে লাগলো বারবার। একসময় মেঘও ডেকে উঠলো ক্ষীনস্বরে। হয়তো ইচ্ছের কথার প্রতিত্তরে বললো, “টমির‌ এই হিংসুক কর্মকান্ডের‌ কারন যেমন প্রাপ্ত, ঠিক তেমনি ইচ্ছের ঠোটের হাসির কারনটাও প্রাপ্ত! সো, ইটস্ অল আবাউট প্রাপ্ত! অনলি প্রাপ্ত!”

#চলবে…
#চলবে…

[ গঠনমুলক মন্ত্বের অপেক্ষায় থাকবো পাঠকমহল❤ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here