ভীন দেশের গল্প পর্ব ৫

#ভীন_দেশের_গল্প
#পর্ব_৫
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

-‘তুমি ওকে কিছু বলেছো?’
তনয়কে আড়ালে ডেকে নিয়ে অকস্মাৎ এহেন প্রশ্ন করায় হকচকিয়ে উঠল তনয়। সে রুবার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। নিরুত্তর তনয়কে দেখে রুবা দাঁত কিড়মিড় করে পুনরায় বলে উঠল,
-‘কথা বলো না কেন? কী বলছো ওকে তুমি?’
তনয়ের বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে উঠে রুবা। তনয় থতমত খায়। তোতলানো কণ্ঠে বলে উঠে,
-‘কী শুরু করছো? কাকে কী বলছি আমি?’
-‘ওহ, না জানার নাটক করা হচ্ছে এখন? কেন, তুমি দেখোনি লাবণী তোমার দিকে চেয়ে কীভাবে বলল, ‘সব রকমের বিপদের জন্যেই তৈরি আছি’। এই কথাটা কেন বলল ও, তাও তোমার দিকেই তাকিয়ে। নিশ্চয়ই তুমি ওকে কিছু বলেছো।’
তময় আমতা-আমতা করে,
-‘দেখো রুবা, সবসময় আমার উপর প্রেশার ক্রিয়েট করতে পারো না তুমি। আমি ওকে কেন কিছু বলতে যাব? আমাকে কী পাগল কুকুরে কামড়েছে?’
তনয়ের বাহু ছেড়ে অস্থির দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায় রুবা। সন্দিহান কণ্ঠে বলে উঠল,
-‘তাহলে এরকম কথা বলল কেন ও! কী কারণ!’
-‘সেটা আমি কী জানি? হতেও তো পারে ও মাজহাবকেই কথার জবাব দিয়েছে। তুমিই বেশি বেশি ভেবে নিয়েছো।’
চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে নিজেকে যথাসম্ভব স্থির রাখার চেষ্টা করে তনয়।
তনয়ের কথাগুলো রুবাকে ভাবিয়ে তুললো। সে-ই কী বেশি বেশি ভাবছে তবে? হতে পারে। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো রুবা। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বলল,
-‘যাইহোক, ও যেন কিছু জানতে না পারে। সেদিকে খেয়াল রেখো।’
তনয় ঘাড় দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়ে। তার ভেতর থেকে স্বস্তি মিশ্রিত নিঃশ্বাস ছিঁটকে বেরোলো। যাক, তার উপর থেকে হওয়া সন্দেহটা ঘুরে গেছে। একবার যদি রুবা বুঝতে পারতো, তাহলে নির্ঘাত তার ঘাড় মটকে দিতো।

দুপুরের পর পরই হঠাৎ বৃষ্টি বায়ুর তাপমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে। এখন বিকেল। আকাশে রোদের বদলে এক ছটাক মেঘের ভেলা উড়ে বেড়াচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে আবারও বৃষ্টি নামবে বোধহয়। লাবণী ছাদে এসেছে কাপড় তুলতে। উড়ন্ত মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে সে ভাববাচ্যে বলে উঠল,
-‘তোদের কত শান্তিরে! কোনো কষ্ট নেই, ঝামেলা নেই, বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই। নিজেদের মতো উড়ে বেড়াস শুধু। আমিও যদি তোদের মতো হতে পারতাম, কতই না ভালো হতো।’

-‘একা একা কী বকবক করিস?’
লাবণী চমকে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। রুবা এসে দাঁড়িয়েছে। রুবা বলল,
-‘তোকে ডাকছে। হুজুর এসে গেছে।’
লাবণী ছোট্ট করে জবাব দিলো,
-‘আচ্ছা।’

বাকি কাপড় গুলোও দ্রুত তুলে রুবার সঙ্গে সেও নিচে চলে গেল। মাজহাব একজন হুজুর ডেকে নিয়ে এসেছেন। তার সামনেই ধর্মীয় ভাবে লাবণীর সঙ্গে নিজের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটানো হবে। লাবণী মাথায় কাপড় দিয়ে হুজুরের সামনে এলে হুজুর বললেন,
-‘আপনাকে আপনার স্বামী তালাক দিতে চায়। এতে আপনার মতামত কী? সে কী আপনার উপর অবিচার করছে? তাহলে বলতে পারেন আমাকে।’
লাবণীর ইচ্ছে হয়, চিল্লিয়ে বলার জন্য, ‘অবিচার? আমার জীবনটাই নষ্ট করে দেওয়া যদি অবিচার হয়, তবে ঘোর অবিচারই করছেন উনি।’
কিন্তু ঠোঁট ভেঙে একটি শব্দও উচ্চারণ হয় না লাবণীর। সে শুধু দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে নিচু কণ্ঠে তোতলে বলল,
-‘আ..আমি রাজী।’
এইটুকু শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়েও তার বুকটা ভেঙে আসে। স্বামী খারাপ হোক, পাগল হোক, আর যা-ই হোক, তবুও কে চায় বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে? একটি নারী তো কখনোই চায় না। লাবণীও চায়নি। কিন্তু কতদিনই বা মাজহাবের রক্ষিতা হয়ে থাকবে সে?

হুজুর লাবণীর থেকে জবানবন্দি নিয়ে তাকে ভেতরে যেতে বললেন। পাঁচ বছর আগে ‘তিন কবুল’ এর মাধ্যমে লাবণীর জীবনের সঙ্গে মাজহাব যেভাবে যুক্ত হয়েছিল, ঠিক তেমন করেই আজ পাঁচ বছর পর, ‘তিন তালাক’ এর মাধ্যমে মধ্যকার সুতোটা ছিঁড়ে পড়ে গেল। মাজহাবের একেকবার উচ্চারিত ‘তালাক’ যেন গরম শিষার ন্যায় লাবণীর কর্ণকুহরে গিয়ে ঢোকে। দু’হাতে কান চেপে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিরব কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। অপরদিকে মাজহাবের ভেতর কোনো ভাবান্তর নেই। সে এক যোগে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করল। অবশেষে দু’জনের জীবন এবং জীবনের পথ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। ক্রুর হাসি ফুঁটে উঠল মহুয়ার ঠোঁটে। সেই সঙ্গে তনয় এবং রুবাও… নিজেদের ঘরে দাঁড়িয়ে উল্লাসে মেতে উঠে তিনজনে। রুবা ফিসফিস করে বলল,
-‘অভিনন্দন মহুয়া, অভিনন্দন। আমরা আমাদের কাজে সফল হয়েছি।’
মহুয়া ঠোঁট বাকায়,
-‘এতোটা খুশির কী আছে? আমাদের আসল কাজ এখনো হয়নি।’
রুবা নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলে,
-‘হুম, জানি। তবে তুমি চিন্তা করো না। সেই কাজও দ্রুত হয়ে যাবে। মনে করো, আজই..’

হুজুরকে বিদায় দিয়ে লাবণী যে ঘরে ঢুকেছে, সে ঘরের পাল্লা সরায় মাজহাব। লাবণীকে ফ্লোরে বসে কাঁদতে দেখে মায়ার বদলে এক গুচ্ছ রাগ জেগে উঠে তার ভেতরে। দিকদিশা হারিয়ে সে ছো মেরে খামচে ধরে লাবণীর চুলের গুছি। দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
-‘নাটক! নাটক হচ্ছে এখন? যা.. এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। কোন ভা’তার ধরছোস, তার কাছে যা। এইজন্যেই তো পাগল হয়ে ছিলি।’
অস্পষ্ট ব্যথায় গোঙানি এলেও ঠোঁট টিপে মাজহাবের কথাগুলো শুনতে লাগল লাবণী। সেই সঙ্গে এক রাশ বিস্ময়তা ঘিরে ধরে তাকে। চিড়বিড়ানি রাগটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ল। নিজে চুরি করে অপরকে চোর উপাধি দেওয়া হচ্ছে!
মাজহাবকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে সরিয়ে দেয় লাবণী। আচানক প্রতিবাদে তাল সামলাতে না পেরে পেছনের দরজায় মুখ থুবড়ে পড়ে মাজহাব। সেই সাথে হিংস্র হয়ে উঠল সে। লাবণীর দিকে মুখ ঘুরাতেই এক দলা থুতু তার মুখের উপর ছুঁড়ে দিলো লাবণী। আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সে,
-‘তুই নিজে আরেকটা বিয়ে করছোস আমি থাকা সত্ত্বেও। আমি চাইলে তোকে জেলের ভাত খাওয়াতে পারতাম। তা না করে ভদ্র মানুষের মতো সব সহ্য করছি। আর এখন এসে আমাকেই কথা শোনাস! তোর মতো চরিত্রহীন আমি না। তোদের পুরুষ জাতের কপালে জুতা মারি আমি।’ বলে আরেক দলা থুতু ছিটিয়ে দেয় লাবণী।

ততক্ষণে মাজহাবের পুরোপুরি ভার উঠে গেছে। রুবা, মহুয়া, তনয় তিনজনেই চিল্লাচিল্লি শুনে ছুটে আসে। তবে কেউ কাউকে থামালো না। মাজহাব ছুটে গিয়ে ঠাস ঠাস করে বেশ কয়েকটি চ’ড় বসিয়ে দিলো লাবণীর গালে। লাবণী গুমরে উঠে। প্রতিবাদ করতে চায়। মাজহাবকে ঠেলে সরানোর চেষ্টা করতে লাগল। পাশাপাশি পা দিয়ে মাজহাবের পায়ের পাতায় একের পর এক চাপা দিতে লাগল। মাজহাব বিশ্রি ভাষায় গালাগাল করতে করতে বলল,
-‘মা** আজকে তোর রস মিটামু। সবসময় ভেজা বিলাই সাইজা থাকস। আজকে তোর আসল রূপ আমি বের করে ছাড়মু।’
-‘মা** আমি না, যেটারে নিয়ে আসছোস সেটা। এক বউ থাকতে আরেক মাইয়া আসলে সেটারে বলে রক্ষিতা। রক্ষিতা তো ভদ্র শব্দ। এটার আসল অর্থ কী জানোস? পতিতা।’

মহুয়া হুংকার করে উঠল,
-‘মাজহাব!! তুমি থাকতে ও আমাকে পতিতা বলল? তুমি ওর মুখ ভেঙে দিচ্ছো না কেন? দেখছো, এতদিন দুধ দিয়ে কোন কাল সাপ পুষছিলা?’
আগুনে ঘি পড়ল যেন। মাজহাব সত্যি সত্যি ঘুষি মেরে বসে লাবণীর মুখের উপরে। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট কেটে ছড়ে গেল। র’ক্তের ফোয়ারা নামলো। লাবণী হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো। এর আগে এতোটা হিংস্র, বন্য পশুর ন্যায় মাজহাবকে কখনো দেখেনি সে। দু’দিনের একটা মেয়ের জন্য..! কষ্টে, দুঃখে, রাগে, ক্ষোভে- শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে মাজহাবের মাথার ভেতর বারি মেরে বসে লাবণী।বারি খেয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে শুরু করল সে। তৎক্ষনাৎ জায়গাতেই বসে পড়ল চিৎকার দিয়ে। লাবণী ঘাবড়ে যায়। মাথা ফেটে দু’ভাগ হয়ে গেল নাকি?
না,মাথা ফাটেনি। তবে তীব্র ব্যথা পেয়েছে মাজহাব। লাবণী শ্বাস নিলো। সবাইকে পাশ কাটিয়ে ঘর থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যায়। রান্নাঘরের দরজা আঁটকে গুমরে কেঁদে উঠল। বিচ্ছেদের ইতি এত জঘন্য ভাবে না হলেও তো পারতো!

মহুয়া হৈহৈ করে উঠে। তনয়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘জলদি ডাক্তার ডাকো তনয়। তোমার ভাইকে ধরো।’
মাজহাব হাত ইশারায় তনয়কে দাঁড়াতে বলে মহুয়াকে বলল,
-‘আমি ঠিক আছি। চিন্তা করো না। তুমি এক্ষুনি ওই মেয়েকে ঘর থেকে বের করো মহুয়া। ও যেন আমার বাসায় আর এক মুহূর্তও না থাকে।’
মহুয়া রুবার দিকে এক পলক চেয়ে বলল,
-‘আমি দেখছি। তুমি আসো তো। রেস্ট নাও একটু। তারপর ওর ব্যবস্থা আমিই করবো। তুমি চিন্তা করো না।’
মাজহাবকে ধরে ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয় মহুয়া। নিজে পাশে বসে মাথায় আলতো হাত বুলাতে লাগল। চোখ ইশারায় রুবাকে কিছু একটা বলতেই সে মাথা নত করে বেরিয়ে গেল।

রান্নাঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার গায়ে চাপড় দিয়ে রুবা ডাকতে লাগল লাবণীকে। কিছু সময় পর দরজা খুলে ফোলা চোখ মুখ নিয়ে লাবণী সামনে দাঁড়াল। তার ঠোঁট অনেকটা কেটে গেছে। র’ক্ত পড়া থামলেও কালশিটে পড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। রুবা ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাবণীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
-‘মানুষ মানুষের প্রতিদান এত দ্রুত ভুলে যায়, তা আজ মাজহাবকে না দেখলে বুঝতাম নারে। তুই কী কম করছিস এই সংসারের জন্য? তারপরও তোর উপর এতবড় অন্যায় করল। তোকে তালাক দিলো। আবার আজকে মা’রলোও!’
লাবণী ডুকরে উঠে। রুবা লাবণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কাঁদিস না। শত হোক, একত্রে থেকেছি এতগুলো বছর আমরা। একটু হলেও তো মায়া লাগে নাকি?’
লাবণী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
-‘আর তার সাথে এক বিছানায় থেকেছি আমি। অথচ তার বিন্দুমাত্র করুণাও হয় না আমার উপর। আমাকে চলে যেতে বলল ভাবী! কোথায় যাবো আমি? আর কে আছে?’
-‘তুই কাঁদিস না। শান্ত হ। আমি আছি তো। কিন্তু এখানে থাকলে তোরই দুঃখ বাড়বেরে। চোখের সামনে মাজহাবকে অন্য নারীর সাথে দেখবি, এটা কী ভালো লাগবে? আর মাজহাবও যে নিত্যদিন ঝামেলা করবে না তারই বা কী গ্যারান্টি। আমি বলি কী, তুই চলেই যা। এতেই তোর ভালো হবে রে লাবণী।’

লাবণী অবাক চোখ মেলে তাকায়। বলল,
-‘কোথায় যাবো আমি? আমাকে আশ্রয় দেওয়ার মতো কেউ তো নেই ভাবী।’
-‘জানি। আমি এর জন্য ব্যবস্থা করেছি। আমার এক চাচা আছেন। বিদেশে লোক পাঠান। তুই চাইলে তার সাথে কথা বলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি। তবে ওখানেও তোকে যেতে হবে কাজের লোক হিসেবেই। ওখানেই থাকবি, খাবি, মাস শেষে মোটা বেতনের টাকা-ও পাবি। যাবি?’
লাবণী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইলো।
রুবা পুনরায় বলল,
-‘তুই ভাবিস না তোকে যেতে হলে টাকাপয়সা দিতে হবে। একদম ফ্রি ভিসায় যেতে পারবি। যারা নিবে তারা-ই তোর টিকিটের টাকা দিয়ে নিবে। তুই শুধু পাসপোর্ট টা বানাবি। আপাতত পাসপোর্ট বানাতে যেটুকু খরচ হবে তা না হয় আমার চাচাকেই দিতে বলব। তুই যখন কামাই করবি, তখন আবার ফিরিয়ে দিস। কী যাবি, বল? কথা বলব চাচার সাথে?’

বাহির থেকে মাজহাবের চিৎকার ভেসে আসে। সে চিল্লিয়ে বলছে, ‘খা** মা** কই? ওরে বাইর করছ আমার ঘর থেকে? ওরে যেন আর চোখের সামনে না দেখি মহুয়া। ওরে পাইলে একদম এক কো’পেই শেষ করে ফেলব।’

চোখ বন্ধ করে লাবণী। মনের ভেতর প্রশ্নের উত্তর হাতড়ে বেড়ায়। পেয়েও যায়। সে চোখ খুলে ঠান্ডা গলায় জবাব দিলো,
-‘যাবো ভাবী। তুমি সব ব্যবস্থা করে দাও।’

(চলবে)
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here