আফিম বড্ড নেশালো ০২-পর্ব ১৪

#আফিম_বড্ড_নেশালো_০২
#লেখিকা_মাহযাবীন
#পর্বঃ১৪

গুনগুনিয়ে গান গাইছে নাফিয়া।গোসলখানা হতে আসা পানির রিমঝিম শব্দ কানে লাগছে তার।সকাল সকাল ছেলেটা গোসল করবেই।প্রতিদিনকার তার একই রুটিন।আর প্রতিদিনের মতোই আজও আফিমের কাপড় আয়রন করছে সে।আনমনে গান গাওয়ার মাঝেই হটাৎ তার মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি এসে উঁকি দেয়।সাথে সাথেই দুষ্টু হাসি ফুটে ওঠে মেয়েটার ঠোঁটে।
গোসল শেষে অফিসের পোশাকে নিজেকে আবৃত করে নিতে ব্যস্ত আফিম।ওয়াশরুমে বসেই নিজের প্যান্টটা পড়ে নিয়ে চুল মুছতে মুছতে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে সে।উদ্দেশ্য শার্ট খানা গায়ে জড়িয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে ডাইনিংরুমে যাবে।
নিজের কক্ষে পা রাখতেই কেমন যেনো একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এসে লাগছে আফিমের।দৃষ্টি ঘুরিয়ে নাফিয়ার দিকে তাকাতেই সে দেখতে পায় মেয়েটা ঠোঁট উল্টে পোড়া শার্ট খানা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটার এ কান্ডের আগাগোড়া বুঝতে না পেড়ে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আফিম।নাফিয়া আফিমের চাহনির অর্থ বুঝতে পেড়ে ঠোঁটে উল্টে বলে ওঠে,
-অল্প একটু ফোঁটা অন্যমনষ্ক হয়েছিলাম।এরই মাঝে এ অঘটন ঘটে বসলো।আপনার প্রিয় সাদা শার্ট টা পুড়ে গিয়েছে!
মন খারাপের স্বরে কথাগুলো বলে ওঠে নাফিয়া।আফিম চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।নিজের সন্দিহান দৃষ্টি নাফিয়ার দিকে স্থির রেখেই এক পা এক পা করে তার দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে সে।আফিমের চাহনি দেখে নাফিয়ার হৃদয়ের ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়ছে।ছেলেটা কি বুঝে গেলো তার মিথ্যে নাটক?বুঝে গেলো যে ছেলেটাকে জ্বালানোর জন্যেই ইচ্ছে করে শার্টটা পুড়িয়েছে সে?
প্রশ্নগুলো মনে উদয় হতেই মনে দুশ্চিন্তার আবির্ভাব ঘটে নাফিয়ার।শাস্তিস্বরূপ ছেলেটা আবার অন্ধকার বাথরুমে আঁটকে রাখবে না তো?
এগিয়ে আসতে আসতে নাফিয়ার অনেকটা কাছে চলে আসে আফিম।আফিমকে নিজের এতোটা কাছে আসতে দেখে এক পা এক পা করে পিছিয়ে যেতে আরম্ভ করে নাফিয়া।পেছাতে পেছাতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার।আফিমও এগোতে এগোতে একদম কাছে চলে আসে নাফিয়ার।দু’জনার দৃষ্টি একে-অপরের আঁখিতে আবদ্ধ।আফিম তার এক হাত নাফিয়ার ডানদিকের দেওয়ালে রাখে।মুখ এগিয়ে নাফিয়ার মুখের কাছে এনে বলে ওঠে,
-‘অল্প একটু ফোঁটা’ অন্যমনষ্ক হলে কাপড় এতো বেশি পোড়ে না, মিস.শেখ।
আফিমের কথাগুলো কানে আসতেই ঠোঁটে চোরা হাসি টেনে নেয় নাফিয়া।জোরপূর্বক হাসি হাসি মুখ করে বলে ওঠে,
-ঐতো,অল্প একটু ফোঁটা মানে হচ্ছে কাপড় পুড়তে যতটা সময় লেগেছে ততটুকুকেই বুঝিয়েছি।
-বাহ,একদম টাইম ক্যালকুলেশন করে অন্যমনষ্ক হয়েছিলে?
-ওহহো আফিম,আপনি আমাকে অবিশ্বাস করছেন!
বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে উক্ত কথাটি বলে ওঠে নাফিয়া।সাথে সাথেই চোখমুখে একদম নির্দোষী ভাব ফুটিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-উহু,আমি তো তোমায় বিশ্বাস করার চেষ্টা করছি।

আফিমের এ কথাখানা শুনেও না শোনার ভান ধরে গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে নাফিয়া। ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবাদ বাক্যটিকে সত্য প্রমাণিত করে সে চুরি করবার পরও নত না হয়ে উল্টো রেগে গাল ফুলিয়ে রেখেছে।কারণ আফিমের যুক্তিযুক্ত প্রশ্নের মিথ্যে উত্তর দেওয়ার মতো যোগ্যতা এখনো অর্জন করতে পারেনি এই সপ্তদশী কন্যা।
মেয়েটার গাল ফুলানো দেখে হাসি আঁটকে রাখা দায় হয়ে পড়েছে আফিমের জন্যে।মেয়েটা গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে চেয়ে আছে।একদম যেনো কোনো ৫-৬ বছরের শিশু কন্যা খেলনা বায়না করেছে আর তাকে সে খেলনা কিনে দেওয়া হয়নি দেখে ক্ষেপে আছে সে।
আফিম নাফিয়ার বেলুনের ন্যায় ফুলোনো গালে আলতো করে ঠোঁট লাগিয়ে বলে ওঠে,
-You have done a big mistake Miss. Sheikh. Pay now![তুমি মস্ত বড় ভুল করেছো মিস.শেখ।ক্ষতিপূরণ দিবে এখন!]
আফিমের কথাগুলো কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাতেই ভয়ে মৃদু ঢোক গেলে নাফিয়া।লুকোনোর শত চেষ্টার পরেও ছেলেটা ঠিকই ধরে ফেলেছে তার দুষ্টুমি।এখন কি শাস্তি দেবে আফিম তাকে!চেহারায় চিন্তের ছাপ ফেলে আফিমের দিকে তাকায় সে।এতোক্ষণ অন্য দিকে তাকিয়ে নিজের আকাম লুকোনোর চিন্তায় মগ্ন থাকাতে এতোটা অনুভব না করলেও এবার দৃষ্টি ফেরাতেই দেখতে পায় তার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে আফিম।মাত্র কয়েক ইঞ্চির দূরত্ব বিরাজ করছে তাদের মাঝে।তার উপর ছেলেটার বক্ষ উন্মুক্ত হওয়ায় বারংবার সেথায় দৃষ্টি আবদ্ধ হতে চাইছে তার।ইচ্ছে হচ্ছে ছেলেটার বুকে একটুখানি মাথা রাখতে, একটুখানি ঠোঁট ছুঁইয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
“এই স্থানটা আমার,একান্তই আমার”
নাফিয়া দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের উন্মুক্ত বক্ষ পানে তাকায় আফিম।ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে নাফিয়ার আরো কাছে এগিয়ে আসে সে।দূরত্ব হয়তো ২ ইঞ্চিরও নেই এবার।নাফিয়ার খুব কাছে এসে তার চেহারা পানে দৃষ্টি আবদ্ধ করে মৃদু কন্ঠে আফিম বলে ওঠে,
-খেয়ে ফেলবা নাকি?
নিজের ভাবনার মাঝেই আফিমের কন্ঠস্বর কানে আসায় ধ্যান ভাঙ্গে নাফিয়ার।প্রশ্নের অর্থ বোধগম্য না হওয়ায় সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আফিমের চোখ পানে চেয়ে বলে ওঠে,
-হু?
-যেভাবে তাকিয়ে আছো আমার বেচারা বুকটার দিকে তাতে তো মনে হলো কিভাবে খাবা তার পরিকল্পনাও করে ফেলছো।
কথাগুলো বলে দুষ্টু হাসে আফিম।ছেলেটার এমন সব কথায় নাফিয়ার গালগুলো রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।লাজে চোখজোড়াও বুঁজে নিয়েছে সে।এই সাংঘাতিক লজ্জার হাত থেকে কি করে রেহাই মিলবে তা ভাবতে ২ সেকেন্ড সময় নিলো সে।অতঃপর নিজেকে বাঁচাতে লজ্জাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সে বলে ওঠে,
-হ্যাঁ খাবো,একদম আস্তো কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নিবো।সকাল দিয়ে একটা বাচ্চা মেয়েকে খেতে না দিয়ে কাজ করিয়ে যাচ্ছেন।শুকরিয়া আদায় করেন যে এখনো আপনাকে খাওয়া শুরু করিনি।
নাফিয়ার কান্ডে মৃদু হাসি আফিম।বলে ওঠে,
-আই উইশ,আমাকে খাওয়ার জন্যে পরিণত বয়সটা তোমার হতো!
কথাটি বলে একটু থামে আফিম।আবার সাথে সাথেই কন্ঠে একরাশ আফসোস নিয়ে আফিম বলে ওঠে,
-তুমি এতো ছোট কেনো মিস.শেখ?আরেকটু বড় হলে কি হতো!
কথাটি বলেই নাফিয়ার থেকে দূরে সরে যায় আফিম।নিজের আলমারির কাছে এগিয়ে গিয়ে এক সেকেন্ডের জন্যে চোখজোড়া বুজে নেয় সে।শুনেছে, অপেক্ষা শুদ্ধতম ভালোবাসার প্রতিক।তাই নিজের প্রেয়সীর জন্যে সেও নাহয় কিছু অপেক্ষার প্রহর গুণে নিজের অনুভূতিগুলোকে শুদ্ধ থেকেও শুদ্ধতম হওয়ার খেতাব দেবে।
বুঁজে রাখা আঁখি মেলে আলমারিতে থাকা সবগুলো শার্ট একে একে বের করে বিছানায় ছুঁড়ে মারতে আরম্ভ করে আফিম।হুট করে ছেলেটার এ উদ্ভট কাজটি করার পেছনের কারণটা অজানা।নাফিয়া চেয়ে আছে আফিমের দিকে কিন্তু তার মাথায় চলছে আফিমের বলা কথাগুলো।বুঝার চেষ্টা করছে সে কথাগুলোর অর্থ।
একে একে নিজের সবগুলো শার্ট বের করে বিছানায় ছুঁড়ে মারা শেষ হতেই নাফিয়ার দিকে ফিরে দাঁড়ায় আফিম।বেপরোয়া ভাব নিয়ে বলে ওঠে,
-এই সবগুলো শার্ট আগামী ১৫ মিনিটে আয়রন করে নিচে আসবা।যদি লেট করো তাহলে সকালের নাস্তা পাবা না।আর যদি একটা শার্ট ও পুড়ে যায় তাহলে আজকে টয়লেটেও আমার সাথে যাবে তুমি।রিমেম্বার ইট।
কথাগুলো বলতে বলতে গায়ে একটি গেঞ্জি জড়িয়ে নেয় আফিম।অতঃপর নাফিয়ার দিকে আর না তাকিয়েই নিজের কক্ষ ত্যাগ করে সে।
এদিকে আফিমের শেষ কথাটি শুনেই চোখ রসগোল্লার ন্যায় বড় হয়ে যায় নাফিয়ার।মনে মনেই বলে ওঠে,
“আস্তো একটা নির্লজ্জ”

!!
কোমরে কাপড় বেঁধে কোনো মতে ১৫ মিনিটের যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলো নাফিয়া।ঝড়ের বেগে কোনোমতে আফিমের শার্ট গুলো আয়রন করে ১৫ মিনিটে ডাইনিংরুমে উপস্থিত হয়েছিলো সে।অতঃপর একসাথে সকালের খাবার শেষে দুজনে বেড়িয়ে পড়েছে অফিসের উদ্দেশ্যে।ড্রাইভার ড্রাইভ করছে।আর পেছনের দু’সিটে বসে আছে তারা দু’জন। আফিম ব্যস্ত ফোন কলে আর নাফিয়া ব্যস্ত জানালা হতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আশেপাশের দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করা নিয়ে।হটাৎ এক মহিলা ও একটি বাচ্চার দিকে চোখ যায় নাফিয়ার।বাচ্চাটা তার এক হাত দ্বারা তার পাশে দাঁড়ানো মহিলাটির হাত আঁকড়ে ধরে আছে এবং অন্য হাতে তিনটে বেলুন ধরে ঠোঁটে এক বৃহৎ হাসি ঝুলিয়ে ফুটপাথে হেঁটে যাচ্ছে।
এ দৃশ্য ঠোঁটে হাসি এনে দেয় নাফিয়ার।সাথে সাথেই মনে পরে যায় তার নিজের ছোটবেলা।একদিন সেও তো তার মাম্মির কাছে বেলুন আবদার করেছিলো।হরেক রঙের বেলুন মন কেঁড়েছিলো তার।মাম্মির কাছে বায়না করায় তার মাম্মিও ঠোঁটে হাসি টেনে কিনে দিয়েছিলেন মৌলিক তিনটি রঙের তিনটি বেলুন।কিনে দিয়ে বলেছিলেন,
“আমার মেয়েটার জীবন রঙীন হোক”
কথাখানা বলে ঠোঁটে হাসি টেনে নিয়েছিলেন নুরানি বেগম।আবদার পূরণ হওয়ায় নাফিয়ার ঠোঁটেও ফুটে উঠেছিলো আনন্দের হাসি।কিন্তু মুহূর্তেই মা-মেয়ের ঠোঁটের হাসিতে নজর লাগলো কারো।এক দানব এসে ছিনিয়ে নিলো নাফিয়ার হাত থেকে সে রঙিন বেলুনগুলো।বেলুনগুলো হাতের বাঁধন হতে মুক্ত হয়ে উড়তে আরম্ভ করলো ঐ দূর আকাশে।নুরানি বেগম ভীত চাহনিতে তাকালেন দানবটির দিকে।দানবটি বলে উঠলো,
-দ্বিতীয়বার এসব আজাইরা টাকা নষ্ট করতে দেখলে খুব খারাপ হবে,নুরি।এই মেয়ের এসব ফালতু আবদার সহ্য হয় না আমার।খবরদার,তুমি ওকে প্রশ্রয় দিবা না।
চোখে পানি চলে আসে নুরানি বেগমের।তবে মুখ ফুটে কিছু বলেন না তিনি।এ জীবনে ব্যক্তিস্বাধীণতা বলে কিছুই পায়নি তিনি।তবে তার মেয়ে স্বাধীনতা পাবে।তার মেয়েকে তিনি দমে থাকতে দেবেন না।মনে মনে এ কথা আওড়িয়ে মেয়ের মাথায় স্নেহের স্পর্শ আঁকেন নুরানি বেগম।আর তার মেয়ে?
বেলুন উড়ে যাওয়ায় না তার মনে ক্ষোব জমেছে আর না দুঃখ।সে অপলক চোখে উড়ন্ত বেলুনগুলোর দিকে চেয়ে আছে।একদিন সেও উড়বে ঐ খোলা আকাশে।

চলবে।

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here