হৃদমাঝারে পর্ব -২০

#হৃদমাঝারে
#নাঈমা_জান্নাত
(২০)

কেউ আমাদেরকে ভালোবাসে শুনলে অটোমেটিকলি আমাদের মনের ভেতর একটা আনন্দ কাজ করে। হোক আমরা বিপরীত মানুষটাকে ভালোবাসি অথবা না বাসি। শুভ্রতার মনে আজ খুশির জোয়ার চলছে। মেঘ তাকে এতোদিন ধরে,এতোটা ভালোবাসে সেটা কোনোদিনও বুঝতে পারে নি। শুভ্রতার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করে। ওপাশ থেকে রুহি হ্যালো হ্যালো করছে তার কোনো খবর নেই। খট করে ফোনটা কেটে দিলো। মেঘ তাকে ভালোবাসে সে এটাতেই আটকে আছে। আজ সে তার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গিয়েছে। কেনো মেঘ তার আগের বিয়ের কথায় ভ্রুক্ষেপ করে নি, কেনো সব জেনেও তাকে বিয়ে করলো। কিভাবে শুভ্রতার সব কিছু নিজের নখদর্পণে নিয়ে নিয়েছে। কিভাবে শুভ্রতার পছন্দ-অপছন্দ জানে। আর এই সব কিছুর উত্তর মেঘ তাকে ভালোবাসে। শুভ্রতা ছাদে দু’হাত মেলে আকাশের দিকে তাকালো। এইরকম আকাশের দিকে তাকিয়েই একদিন সে আল্লাহ কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলো। আজ আবার এই আকাশের নিচে দাঁড়িয়েই সে সবচেয়ে খুশি, আল্লাহ যা কেড়ে নিয়েছে তার থেকেও হাজারগুন উত্তর তাকে দান করেছে। শুভ্রতা দু’হাত মেলে নিজে নিজে ঘুরতে ঘুরতে বলে,,’উনি আমাকে ভালোবাসে। শুনেছো তোমরা মেঘ ফল ইন লাভ উইথ শুভ্রতা,উঁহু শুভ্র!’
হাতে থাকা ফোনটা আবারও ভাইব্রেট করতে শুভ্রতার উচ্ছাস থামে। ফোনের স্ক্রিনে ‘ঘোমড়ামুখো এইচবি’ নামটা ভেসে উঠতে শুভ্রতা ফিক করে হেসে দেয়। বেচারা হাটতে পারে না বলে বউকে ফোন দিয়ে ডাক দেয়। শুভ্রতা ফোন কানে ধরলে মেঘ ওপাশ থেকে বলে,,’হ্যালো শুভ্র। কই তুমি? কখন রুম থেকে বের হয়েছ। বের হয়ে কি হাওয়া হয়ে গেছো নাকি?’
‘বউরে এতো মিস করলে নিজেই ছাদে চলে আসেন। আপনার বউ ছাদে।’
‘হ্যাঁ আমি হাটতে পারলে ফোন করে ডাকা লাগতো না, নিজেই চলে আসতাম।’
‘আহা গো,জামাই আমার। কোলে করে ছাদে নিয়ে আসবো?’
শুভ্রতার টিটকারি কথায় মেঘ খানিকটা কর্কশ কন্ঠে বলে,,’নিতে পারলে নিয়া যাও। ওই তো কাঠির মতো শরীর। দেখা যাবে, কয়েকটা হাড় জয়েন্ট থেকে ছুটে মাংস ফেটে বেরিয়ে এসেছে।’
‘এ্যাহ আমার কাজ নাই তো, আপনার মতো বুইড়া দামড়ারে কোলে নিবো। ফোন রাখেন আমি আসছি।’ কথাটা বলে শুভ্রতা ফোন কেটে নিচে চলে যায়।
___________________
শিং মাছের সামনে পা গুটিয়ে বসে আছে শুভ্রতা। সামনেই মেঘ মুখ চেপে হাসছে। চেয়ারে বেশ আয়েশ করে বসে মোড়ার উপর দু’পা দিয়ে শুভ্রতার কান্ড দেখছে। পাশেই মেঘ আর শুভ্রতার মা দাঁড়িয়ে আছে। মেঘের শরীর খারাপের জন্য শুভ্রতার মা বলেছে শিং মাছ খাওয়াতে,তাই একটু আগে দারোয়ানকে দিয়ে শিং মাছ আনিয়েছে শুভ্রতা। শুভ্রতা শিং মাছ কাটতে জানে না বলে,শুভ্রতা আর মেঘের মা বলেছে কেটে দিবে। কিন্ত শুভ্রতা বেশ ভাব নিয়ে বলেছে,,’চেষ্টা করলে মানুষ কি না পারে, আর এটা তো শুধু শিং মাছ। আমি পারবো।’
এরপর শিং মাছগুলো পাতিলে ডালতেই শুভ্রতা লাফিয়ে উঠে। মাছ গুলো লাফিয়ে একবার এদিক আরেকবার ওদিক যায়। শুভ্রতা ধরতে গিয়ে বার বার হাত সরিয়ে নেয়। আর শুভ্রতার কান্ডে উপস্থিত সবাই মুখ টিপে হাসছে। শুভ্রতার সবার দিকে অসহায় ভাবে তাকায়।
‘আচ্ছা বউ’মা, তুমি বরং উঠো। বসে দেখো কিভাবে কাটতে হয়। তুমি পারবা না।’

‘কেনো মা? মানুষ চাইলে কিনা পারে? এটা তো শুধু শিং মাছ। শুভ্র উইল বি ম্যানেজ। তাই না?’
শুভ্রতার দিকে কোণা চোখে তাকিয়ে বলে মেঘ। মেঘের কথায় শুভ্রতার মা এবার জোরেই হেসে দেয়। শুভ্রতা মেঘের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালে,মেঘ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বসে থাকে।
‘আচ্ছা হইছে,এবার উঠ তো। আমরা কেটে দেই।’ মায়ের কথায় শুভ্রতা উঠে দাঁড়িয়ে যায়। মেঘের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধুপ ধাপ পা ফেলে রুমে চলে যায়। শুভ্রতা যেতেই আরেক দপা হাসির রোল পড়ে।
_________________
‘শুভ্রা।’ সন্ধ্যে বেলায় চায়ের পানি বসিয়েছে শুভ্রতা। তখনই তার মা এসে পাশে দাঁড়ায়।
‘কিছু বলবে?’
‘আমাদের উপর রেগে আছিস তাই না?’
‘আমার রাগ,অভিমান কিছু থাকতে নেই। খারাপ সন্তানদের এসব থাকা পাপ।’
‘শুভ..’
‘প্লিজ মা। পুরণো কাসুন্দি ঘেটে লাভ নেই। আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাকে ক্ষমা করো। ব্যাস আর কিছুর প্রয়োজন নেই।’ কথাটা বলে শুভ্রতা অন্যদিকে চলে যায়। শুভ্রতার যাওয়ার দিকে তার মা শুধু তাকিয়ে রয়। সে সময় যদি মেয়েটাকে ধাক্কা সামলানোর একটু সময় দিতো, একটু পাশে দাঁড়াত, তাহলে হয়তো মেয়েটা এতো কষ্ট পেতো না। মেয়েটা যা বরাবরই চাপা স্বভাবের। শুভ্রতার মা মনে মনে এটাই প্রার্থণা করে তার সন্তান যাতে ভালো থাকে।
_________________
বন্ধুদের সাথে আড্ডায় সব সময় ভালো সময় কাটে। মন খারাপ থাকলেও সেটা নিমিষেই দূর হয়ে যায়। ক্যাম্পাসের একপাশেই বসে আড্ডা দিচ্ছে শুভ্রতারা। আড্ডার বিষয় বস্ত মাহির ছ্যাঁকা খাওয়া। মাহি বেশ বড় আকারে ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে গিয়েছে। সে ফেইসবুকে একটা ছেলের সাথে কথা বলেছে। প্রোফাইলে বেশ ইয়াং দেখা গিয়েছে, কিন্ত দেখা করার পর জানা গেলো,উনার মাথায় ইয়া বড একটা টাক। মাহি সেই দুঃখে নাজেহাল।
‘আরে ভালোই তো,যখন তোর ভালোবাসা উতলাইয়া পড়ব,তুই ওই ব্যাডার টাকে ইয়া বড় একটা চুম্মা দিবি।’ নিশানের কথায় সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। মাহি উঠে ধুম ধুম করে কিল বসিয়ে দেয়।
‘আবে রাখ তোর চুম্মা, আমাদের এখানে বিয়াইত্তা শুভ, তুই টিপস দে বেডি। বইসা বইসা মজা মারা লাগবো না।’
মাহির কথায় শুভ্রতা মুখ বাঁকিয়ে বলে,,’আমি কি টিপস দিমু? আমার জামাইর মাথায় হেব্বি চুল,তোর ওই ব্যাডা তো টাক। আমার কাছে টাকের কোনো টিপস নেই। তুই বরং নিশানের দেওয়া টিপস এপ্লাই কর!’
‘এই তো একটা ভালা কথা কইছস। এর লাইগা মাম্মা তোরে আমি বিশেষ ট্রিট দিমু।’
নিশানের কথায় শুভ্রতা নাক সিটকে বলে,,’ছিহ তোর ওই স্পেশান ট্রিট মানেই,করলা ভাজি। ইয়াক!’
নিশান কিছু বলবে তার আগেই শুভ্রতার ফোন বেজে উঠে। মেঘের ফোন দেখেই সবাই হইহই করে উঠে। শুভ্রতাকে ফোন কানে নিতেই নিশান বেশ ঢং করে বলে,,’আহ বেবি,এই সময় ডিস্টার্ব করে কে? দেখা করার সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে ভাল লাগে না। ফোনটা বরং বাসায় রেখে আসবা।’
নিশানের কথায় শুভ্রতা চোখ বড় বড় করে তাকায়। পাশে সবাই মুখ টিপে হাসে। শুভ্রতা ধুম করে একটা কিল বসিয়ে বলে,,’হারামি পোলা,আমার ঘর ভাঙ্গার লাইগা উইঠা পড়ছস কেন? ওই মাহি এডার মুখ চাইপা ধর।’ শুভ্রতার কথায় মাহি নিশানের মুখ চেপে ধরে। শুভ্রতা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,,’জ্বি বলুন।’
‘তোমার সাথে কে?’
‘ওই নিশান মজা করেছে। আই সোয়ার আমি ক্যাম্পাসে।’
‘পেছন ফিরো।’ মেঘের কথা মতো শুভ্রতা পেছন ফিরে দেখে কয়েক হাত দূরে মেঘ দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতাকে অবাক হতে দেখে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। শুভ্রতা উল্টো দিকে তাকিয়ে ছিলো বলে মেঘকে এতোক্ষণ দেখে নি, কিন্ত বাকি সবাই মেঘকে দেখেছে। মেঘকে দেখেই নিশান কথাগুলো বলেছে। মেঘ এগিয়ে এসে আড্ডার স্থলে দাঁড়াল।

‘আমাদের দুলাভাইয়ের বউয়ের জন্য কি টান,টানে টানে ভার্সিটিতে চলে এসেছে।’ মাহির কথায় সবাই হেসে উঠলেও শুভ্রতা খানিক লজ্জা ফেলো।
‘থাম তোরা। আসছি আমি।’
‘এখন চুল ওয়ালা জামাই পাইয়া,আমারে ভুইলা গেলা বেইব। এটা সহ্য হয় না।’ নিশান বুকের ডান পাশে হাত দিয়ে বলে।
‘ওইটা বা’পাশে হবে ভাই।’ মেঘের কথায় সবাই সমস্বরে হেসে উঠে। নিশান অসহায় চোখে সবার দিকে তাকায়।
‘এই জন্যই তোর জিএফ টিকে না। যা ফট।’ কথাটা বলে শুভ্রতা আড্ডা থেকে বিদায় নিয়ে মেঘের কাছে যায়।
‘আমার শরীর এখনও পুরো ভালো হয় নি। আপনি এখানে চলে এসেছেন? এই জন্যই আমি ভার্সিটিতে আসতে চাই নি। মা রাও দু’দিন আগে চলে গেছে। বাসায় আপনাকে একা ছাড়তে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় নি। আপনি জোর করে পাঠিয়েছেন।’
‘আমি একদম ঠিক আছি। কাল থেকেই অফিস জয়েন করবো। ভাবলাম তার আগে বউকে একটু সময় দিয়ে যাই।’
‘এ্যাহ আসছেন আমার বউকে সময়দাটা বীরপুরুষ। ‘ শুভ্রতা ভেংচি কেটে কথাটা বলে।
শুভ্রতার কথায় মেঘ শুভ্রতার হাতে চিমটি কেটে বলে,,’ক্ষেপি মহিলা।’
‘ঘোমড়ামুখো ব্যাডা।’
দু’জনে মজা করতে করতে ভার্সিটি পেরিয়ে নিজেদের গন্তব্যের দিকে হাটা দিলো।

চলবে..?

(ভূল-ত্রুটি ক্ষমা করবেন। ধন্যবাদ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here